Posts

উপন্যাস

শার্লক হোমস, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার ও মঙ্গলগ্রহ

April 30, 2025

MAHAFUJ

Original Author ম্যানলি ওয়েড ওয়েলম্যান এবং ওয়েড ওয়েলম্যান

Translated by মাহফুজ সরকার (অনলাইন)

116
View

লেখকের কথা

‘শার্লক হোমস, প্রফেসর চ্যালেঞ্জার ও মঙ্গলগ্রহ’ উপন্যাসটি আমার প্রয়াত বন্ধু খবির এর অনুপ্রেরণায় লেখা। ওঁর কথা ফেলতে পারতাম না বলেই আমার এই কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস লেখা কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানের পাতায় প্রায় বিশ বছর আগে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রচুর কল্পবিজ্ঞানের গল্প, উপন্যাস লিখেছি বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু সেদিনের এই লেখার মজাই ছিল আলাদা। কারণ এটা ছিল আমার প্রথম জীবনের কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস। বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের ভালো লাগবে এই আশা রাখি।

মুখবন্ধ

স্যার আর্থার কন্যান ডয়াল এবং হারবার্ট জর্জ ওয়েলস ইংরেজি গোয়েন্দা এবং সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের দুই দিকপাল। স্যার ডয়াল সৃষ্টি করে গেছেন অমর গোয়েন্দা শার্লক হোমস এবং অমর বৈজ্ঞানিক প্রফেসর চ্যালেঞ্জারকে। ওয়েলস তাঁর সুবিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন পিয়ারসনস ম্যাগাজিনে ১৮৯৭ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাসে— বইটি প্রকাশ পায় ১৮৯৮ সালের জানুয়ারিতে।

১৯০২ সালের জুন মাসে পৃথিবীর খুব কাছে এসেছিল মঙ্গলগ্রহ এবং ওয়েলস কল্পনা করেন সেই সময়েই লালগ্রহের ভয়ংকররা দানবিক আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছিল অভাগা গ্রহ এই পৃথিবীর ওপরে। শৌর্যেবীর্যে জ্ঞানে বিজ্ঞানে অহংকৃত এবং সমুন্নত মানুষ হেরে গিয়েছিল তাদের কাছে— হারেনি কিন্তু তারাই, যাদের চোখে দেখা যায় না— যারা ছড়িয়ে রয়েছে এই পৃথিবীর সর্বত্র— জীবাণুরা।

হোমস এবং চ্যালেঞ্জার কিন্তু আগেই জেনেছিলেন পৃথিবীতে হানা দিতে আসছে মঙ্গলগ্রহীরা। তারপর কী কী ঘটেছিল, তা-ই নিয়েই বিস্ময়কর এই রোমাঞ্চ কাহিনি। বিশ্বের বিখ্যাত দুই চরিত্র হোমস এবং চ্যালেঞ্জার বিশ্বের বিখ্যাত কাহিনি ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন কীভাবে— তা-ই নিয়েই এই চাঞ্চল্যকর এবং লোমহর্ষক উপাখ্যান। ওয়েলস যা কল্পনাও করেননি কিন্তু পরবর্তীকালে ওদেশের বহু সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক যা নিয়ে ভেবেছিলেন এবং ভাবনার বীজ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও চিঠিপত্রে রোপণ করে গিয়েছিলেন, তা-ই নিয়েই রচিত অতিবিচিত্র এবং অতি-অবিশ্বাস্য এই অতি-কাহিনি ছোটবড় সব্বাইকে রুদ্ধশ্বাসে রাখবে প্রথম পংক্তি থেকে শেষ পংক্তি পর্যন্ত।

অলীক চরিত্র হোমসকে নিয়ে বাস্তব রহস্যভেদের চেষ্টা এর আগে হয়েছে ‘এ স্টাডি ইন টেরর’ ছায়াছবিতে। ছবিটি লন্ডন শহরে মুক্তি পায় ১৮৯০ সাল নাগাদ এবং তাতে দেখানো হয় চিররহস্যাবৃত ভয়াল ভয়ংকর জ্যাক দ্য রিপারকে কীভাবে এক হাত নিয়েছেন শার্লক হোমস। কিন্তু হোমসকে মঙ্গলগ্রহীদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে অভিনবত্ব আছে বইকী। এই অভিনবত্বের প্রথম সন্ধান দেন সুবিখ্যাত সাংবাদিক স্যার এডওয়ার্ড ডান ম্যালোন তাঁর বিভিন্ন অপ্রকাশিত চিঠিপত্র এবং ছদ্মনামে প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে। এই বইটি ম্যানলি ওয়েড ওয়েলম্যান এবং তাঁর পুত্র ওয়েড ওয়েলম্যানের লেখা ‘শার্লক হোমস’স ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ উপন্যাসের ভাবানুবাদ।

Sherlock Holmes (2009) #movies #films #sherlock

ক্রিস্টাল ডিম প্রহেলিকা

লন্ডন শহরের গ্রেট পোর্টল্যান্ড স্ট্রিটের যে দোকানটি কারওরই নজর কাড়তে পারে না, দীনহীন সেই দোকানেই শুরু হচ্ছে বিচিত্র এই কাহিনি।

সামনের দরজাটা বেশ মজবুত। লোহার পাত মারা। সাইনবোর্ডে লেখা শিল্পদ্রব্য এবং সুপ্রাচীন দ্রব্য। দুটো ছোট জানালায় পুরু কাচ। একটার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা কার্ড। তাতে লেখা:

দুষ্প্রাপ্য বস্তুসমুদয়ের কেনাবেচা হয় দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লেখাটির ওপর চোখ বুলিয়ে নিল দীর্ঘকায় পুরুষটি। পরনে তার চেককাটা আলস্টার। পরক্ষণেই লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢুকল ভেতরে।

তখন বিকেল। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় হাড়সুদ্ধ যেন জমে যাচ্ছে।ভেতরে আলোর চাইতে অন্ধকার বেশি। এককোণে ঢাকা দেওয়া একটা লম্ফ। তাকগুলোতে ঠাসা হাবিজাবি অনেক জিনিস। ফুলদানি, কাপ, পুরোনো বই। একটা টেবিলের ওপর ছড়ানো এমনি আরও টুকিটাকি জিনিস। ওপরে রাখা সাদা কার্ডে লেখা: ম্যাকফারসনের সংগ্রহশালা লম্বা লোকটা যেই ঝুঁকেছে টেবিলের ওপর, অমনি ভেতরের দরজা খুলে দোকানঘরে ঢুকল মালিক। মাথায় টাক। ‘ইয়েস স্যার?’ ‘মি. বল্ডুইন, এক ভদ্রলোক এখুনি আসবেন এখানে। দেখা করব বলে এলাম। ভালো কথা,’ টেবিলের ওপর ফের ঝুঁকে বাজপাখির চঞ্চুর মতো নাকখানা বাড়িয়ে বললে আগন্তুক, ‘কী এগুলি?’ ‘পুরোনো জিনিস কেনাবেচা করতেন ম্যাকফারসন। মারা গেছেন সেই সেদিন। দোকান বিক্রি হয়ে যেতে কিছু জিনিস আমি কিনেছি।’মুঠোর মতো বড়, ডিমের মতো দেখতে, সুন্দরভাবে পালিশ করা চকচকে একটা ক্রিস্টাল তুলে নিল আগন্তুক। লম্ফের আলোয় যেন নীল শিখা জ্বলে উঠল ভেতরে। ‘দাম কত?’‘পাঁচ পাউন্ড।’ শীর্ণ সাদা হাতে ধূসর সুটের ভেতর পকেট থেকে পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বার করে এগিয়ে দিল আগন্তুক, ‘থাক, প্যাক করার দরকার নেই।’ক্রিস্টাল ডিম অন্তর্হিত হল আলস্টারের পকেটে। ঠিক সেই সময়ে দরজা দিয়ে দোকানঘরে ঢুকল আর এক খদ্দের। মাথায় খাটো। নোংরা। অবিন্যস্ত ধূসর চুল। ঢুকেই দাঁড়িয়ে গেল পায়ে পেরেক-আঁটা পুতুলের মতো। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল লম্বা লোকটার পানে।পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠল ষাঁড়ের মতো গলায়, ‘বল্ডুইন, শার্লক হোমসকে ডেকে এনেছিস কী মতলবে?…’লম্বা লোকটা বললে অশান্ত কণ্ঠে, ‘কেউ ডাকেনি, নিজেই এসেছি। তোমার সঙ্গে দেখা করব বলেই এসেছি।’ আমতা আমতা করে বল্ডুইন বললে, ‘ইনি শার্লক হোমস?’ ‘আজ্ঞে, হ্যাঁ। আমিই শার্লক হোমস।’ যেন বিনয়ের অবতার হয়ে গেল তালঢ্যাঙা শীর্ণ লোকটা, ‘এসেছি হাডসনের সঙ্গে মোলাকাত করতে।’ ‘আমার সঙ্গে!’ সিঁটিয়ে ওঠে নবাগত। ‘মিস্টার স্যামুয়েল ফ্রিজের বিকিনি আংটিটা বেচতে আসবে এখানে, আঁচ করেই এসেছি। বার করো।’ হাত বাড়িয়ে বললে হোমস।

বুক চিতিয়ে জবাব দিল হাডসন, ‘ফ্রিজের আংটি আমি নিয়েছি, প্রমাণ করতে পারবেন?’ ‘প্রথমত, আংটিটা এই মুহূর্তে তোমার কড়ে আঙুলে শোভা পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমার চ্যালাচামুন্ডারা প্রমাণ করে দেবে আংটি কীভাবে এসেছে ফ্রিজের কাছ থেকে তোমার আঙুলে। খোলো আংটি। নইলে চোরাই আংটি কেনার দায়ে বল্ডুইনকে ঝামেলায় ফেলব।’ মুখ লাল হয়ে গেল হাডসনের। আঙুল থেকে আংটি খুলে এগিয়ে দিয়ে বললে দাঁত কিড়মিড় করে, ‘শয়তান কোথাকার!’

ওয়েস্টকোটের পকেটে আংটি চালান করে হোমস বললে নির্লিপ্ত স্বরে, ‘তোমার কাছে কনসাল্টিং ডিটেকটিভ মাত্রই অবশ্য শয়তান।’ হাডসন জবাব দিল না। আরক্ত মুখে বল্ডুইনের পানে ফিরে বললে, ‘ক্রিস্টাল ডিমটা গেল কোথায়? চার্লির কাছে শুনলাম তুমি কিনেছ?’ নির্লিপ্ত স্বরেই বললে হোমস, ‘আমি আবার কিনেছি বল্ডুইনের কাছ থেকে। কিন্তু সৌন্দর্যের তুমি কী বোঝো হাডসন? ক্রিস্টাল ডিমের দিকে নজর পড়ল কেন?’

রেগে গেল হাডসন, ‘বলব আপনার কেচ্ছাকাহিনি?’ ‘বলতে পারো। তোমারও কিছু কেচ্ছাকাহিনি পুলিশকে বলে আসা যাবে-খন। তবে তোমার মুখ বন্ধ থাকলে আমিও মুখ বন্ধ করে রাখব কথা দিচ্ছি।’ বলেই, দোকানের বাইরে এল শার্লক হোমস।

পেছন পেছন ছুটে এল হাডসন। বরফ পড়ার মতো কনকনে ঠান্ডা রাস্তায়।

‘মিস্টার হোমস, ক্রিস্টালটা আমাকে বিক্রি করুন।’ ‘হাডসন, তোমাকে শেষ ওয়ার্নিং দিয়ে যাচ্ছি— ফের যদি এ-পাড়ায় তোমাকে দেখি— তোমার এই দোকানে পুলিশ ঢুকিয়ে ছাড়ব— তোমাকেও শ্রীঘরে ঢোকাব। গুড় বাই।’ চলন্ত ছ্যাকড়াগাড়ি দাঁড় করিয়ে টকাস করে উঠে পড়ল হোমস। গনগনে চোখে দাঁড়িয়ে রইল হাডসন। গাড়ি এসে দাঁড়াল ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কাছে স্যামুয়েল ফ্রিজের বাড়ির সামনে। নধরকান্তি ফ্রিজ তো আহ্লাদে আটখানা আংটি দেখে। আংটিটা অত্যন্ত পয়মন্ত। বাপঠাকুরদা এই আংটি পরিয়ে বউ এনেছে সংসারে— ফ্রিজেরও সেই পরিকল্পনা বানচাল হতে বসেছিল আংটি চুরি যাওয়ায়। তাই একগাল হেসে হোমসের দক্ষিণা গুনে দিতে দিতে ফ্রিজ বললে, ‘মাত্র বারো ঘণ্টার মধ্যে চোরাই মাল ফেরত এনে আবার আপনার সুনাম বজায় রাখলেন মিস্টার হোমস।’

শুষ্ক হেসে বিদায় নিল হোমস। এল বেকার স্ট্রিটের বাসায়। ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকল ছোকরা চাকর বিলিকে। এক মুঠো খুচরো তার হাতে গছিয়ে দিয়ে বললে মিষ্ট কণ্ঠে, ‘বেকার স্ট্রিটের চ্যাংড়াবাহিনীকে বিলিয়ে দিয়ে আয় আংটি চোরের নাম বলে দেওয়ার জন্যে।’

আঁজলা পেতে খুচরো নিয়ে বিলি বললে, ‘আরও খবর আছে। হাডসন বল্ডুইনের দোকানে আর যাবে না— অন্য দোকান খুঁজছে আপনার ভয়ে। বল্ডুইনকে বলছিল হাডসন নিজে।’

হাসল হোমস, ‘প্রস্তাবটা আমারই, বিলি। শত্রুরাও তাহলে হোমসের কথা শুনছে আজকাল।’ বিদায় হল বিলি। হোমস আলস্টার খুলে ঝুলিয়ে রাখল আলনায়। পকেট থেকে ক্রিস্টাল ডিমটা বার করে এনে বসল চেয়ারে। ডিমটা ও কিনেছে ল্যান্ডলেডিকে বড়দিনে উপহার দেবে বলে। কিন্তু হোমসের খটকা লাগছে, এমন জিনিসে হাডসনের মতো চারশো বিশ লোকটার বেজায় আগ্রহ দেখে। কেন সে কিনতে চায় ক্রিস্টাল ডিম?

একাগ্র দৃষ্টি মেলে চকচকে ডিমটার দিকে চেয়ে রইল হোমস। আবার দেখল কুয়াশার মতো নীলচে অগ্নিশিখা— গোলাপি লাল আর উজ্জ্বল সোনা রং সরু সরু সুতোর আকারে যেন মিশে রয়েছে নীল অগ্নিশিখার সঙ্গে। ঝিলমিলিয়ে উঠছে বিচিত্র সেই রঙের খেলা— ক্রিস্টাল নাড়লে রঙের বাহার কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে। উঠে দাঁড়াল হোমস। জানালার পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে দিয়ে ফের এসে বসল টেবিলের সামনে ক্রিস্টালটাকে আরও খুঁটিয়ে দেখবে বলে।

আচম্বিতে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল শার্লক হোমসের পৃষ্ঠদেশের মধ্যে দিয়ে। উদগ্র উৎসাহে ঝুঁকে পড়ল ডিমের ওপর— নিরতিসীম উত্তেজনায় ঝকঝক করে উঠল হীরক-উজ্জ্বল দুই চক্ষু।

এ কী দেখছে শার্লক হোমস! নীল আলোটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। শুধু ঝকঝকেই হয়নি, যেন নড়ছে, ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত হচ্ছে। জলের ঢেউ যেমন ছলছলিয়ে তরঙ্গাকারে বয়ে যায়— নীল আলোটাও যেন সেইভাবে তরঙ্গাকারে দুলছে, প্রবাহিত হচ্ছে। জল যেন বিক্ষুব্ধ। তরঙ্গও তাই উত্তাল… এ তরঙ্গ রঙের তরঙ্গ, ক্যালিডোস্কোপে যেমন অজস্র রঙের প্যাটার্ন আর ছুটোছুটি দেখা যায়… আশ্চর্য এই ক্রিস্টালেও তেমনি নীল রঙের সঙ্গে বিনুনি কেটে নক্ষত্রবেগে উধাও হয়ে যাচ্ছে সোনালি ডোরা লাল রশ্মি, এমনকী সবুজ দ্যুতিও। কখনও দেখা দিচ্ছে স্ফুলিঙ্গের মতো কখনও রশ্মিরেখার মতো। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে আরও একটা আশ্চর্য পরিবর্তন। কুয়াশা পরিষ্কার হয়ে আসছে। ফিকে হয়ে যাওয়া কুয়াশার মধ্যে দিয়ে মুহূর্তের জন্যে হোমসের শাণিত চোখে ধরা পড়ল যেন বহুদূরের এক নিসর্গ দৃশ্য। যেন অনেক উঁচু থেকে নীচের পানে চেয়ে রয়েছে হোমস। বহুদূর বিস্তৃত সমতলভূমির অনেক দূরে দৃষ্টিপথ ব্যাহত করে বিরাট বিরাট চাঁইয়ের মতো কী যেন মাথা ঠেলে উঠেছে আকাশপানে। টেরাকোটার মতো লাল তাদের বর্ণ। কাছের দিকে এবং প্রায় সরাসরি চোখের তলায় দেখা যাচ্ছে বিরাট একটা আয়তক্ষেত্র— গাঢ় রঙের মঞ্চ যেন। ডাইনে বাঁয়ে হালকা সবুজ মাঠের মতো কী যেন নজরে আসছে, তার পরেই লাল মাটি… বহুদূর বিস্তৃত। এক লহমায় এই পর্যন্ত দেখার পরেই চকিতে ফের আবির্ভূত হল কুয়াশার মতো নীল-কালো… মুছে দিল বিচিত্র নিসর্গদৃশ্যকে। ঠিক এই সময়ে টুক টুক করে আলতো টোকা পড়ল দরজায়। ঝটিতে ক্রিস্টাল ডিমকে চেয়ারের তলায় আঁধার অঞ্চলে চালান করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল হোমস। দরজা খুলে ধরতেই দেখল মার্থা হাডসনকে— এ বাড়ির ল্যান্ডলেডি।

‘খাবেন? ডক্টর ওয়াটসন থিয়েটারে গেছেন। আহারে বিলম্ব করতে নেই।’ হাসল হোমস। নেমে গেল মিসেস হাডসন। হোমস গিয়ে টেলিফোন পাকড়াও করে একটা নাম্বার চাইল।অন্য তরফ থেকে সাড়া এল এই ভাবে: ‘হ্যাল্লো!’ মেঘগর্জন তুচ্ছ সেই কণ্ঠস্বরের কাছে। ‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ হোমস বললে বিনীত কণ্ঠে। ‘প্রফেসর চ্যালেঞ্জার হাজির।’ এবার যেন বজ্রপাত ঘটল কণ্ঠস্বরের মধ্যে। ‘কিন্তু আপনি কোথাকার বে-আক্কেলে? কী মতলবে বিরক্ত করা হচ্ছে আমাকে?’

‘আমি শার্লক হোমস।’ ‘আ!’ কণ্ঠস্বর এবার যেন ফেটে পড়ল লক্ষ বজ্রের মিলিত বিস্ফোরণে। ‘ভায়া হোমস, এত চড়া চড়া কথা বলার মোটেই ইচ্ছে ছিল না… কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ছিলাম তো… ফোনটা আসতেই মেজাজটা ঠিক রাখতে পারিনি। তা ছাড়া খবরের কাগজের ওই সবজান্তা হাড়হাভাতে রিপোর্টারগুলো বড্ড জ্বালিয়ে মারছে আমাকে। বলো ভায়া বলো, কী সেবায় তোমার লাগতে পারি বলো।’

‘অদ্ভুত একটা প্রহেলিকা নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু বসতে চাই।’ ‘প্রহেলিকা! অদ্ভুত প্রহেলিকা! নিশ্চয়… নিশ্চয়… যখন খুশি… যেভাবে খুশি আসতে পারো। লন্ডনের মুষ্টিমেয় যে ক-জনের সঙ্গে কথা বলে উপকৃত হওয়া যায় এবং মানসিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পেশার চরম শিখরে যারা উঠতে পেরেছে… তুমি তাদের অন্যতম। কাল সকালে আসবে?’

‘সকাল দশটায় এলে চলবে?’ ‘আলবত চলবে। তাহলে ওই কথাই রইল।’

টেলিফোন ঝুলিয়ে রাখল হোমস। ট্রে-ভরতি খাবারদাবার নিয়ে ঢুকল মার্থা হাডসন।

Comments

    Please login to post comment. Login