রাত ৩ টার সময়ে ঢং ঢং শব্দে সৎবিত ফিরে শিপন এর। যদিও আজকাল কারো বাসায় ঢং ঢং শব্দ করা ঘড়ি নেই। ঘড়িটা নেপালের এক অ্যান্টিক শপ থেকে শিপন এর বাবা নিয়ে আসেন। সেটা আবার শিপন
তার ঢাকার দুই কামরার ফ্ল্যাট বাসায় নিয়ে এসেছে। শিপন হঠাৎ শুনতে পায় পিপলু ফিসফিস করে কি জানি বলছে। শিপন এর যেনো কেমন লাগতে থাকে, ভাবতে থাকে, কি থেকে কি হলো, একজনের জীবন এর কাঁটা এভাবে উল্টে কিভাবে যায়। এরই মধ্যে ঘুম ভেঙ্গে যায় পিপলুর। ধড়মড় করে উঠে বসে শোয়া থেকে। ঈশিতার কাছে যাওয়া লাগবে আমার, শিপন । শিপন ওকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে, সকাল হোক তারপর যাবো। এত রাত্রে বাইরে থাকা ঠিক না। দিনকাল ভালো না। পিপলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, বললো জানিস আমাকে ঈশিতা প্রায় ই কবরস্থান এ নিয়ে যেত, আর বলতো, আমার যদি কিছু হয়ে যায়, আমার কবরের পাশে তুমি প্রতিদিন আসবে প্লিজ। এসে আমার প্রিয় গানটার দুই লাইন গাইবে প্রতিদিন।
আচ্ছা এখন একটু গেয়ে শুনাও না। গান গাইতো ইশিতা, কিন্তু আমার ভাঙ্গা গলায় গান শুনত প্রায় জোর করে। এটুকু বলে থামে কিছুক্ষণ পিপলু। তারপর আবার বলে, আমার মনে হয় ও আসলে ঠিক ঠাক ই আছে, হয়তো দেখবো কবরের সামনে দাড়িয়ে আছে,,,
আচ্ছা আচ্ছা তুই এখন রেস্ট নে একটু। আমি আসছি
বলে রান্নাঘরে গেলো শিপন, চুলায় চা বসিয়ে দিল। মাথা জ্যাম হয়ে আছে। হঠাৎ কানে কিছু আসতেই গা হিম হয়ে গেলো শিপন এর। পিপলু যেনো কর সাথে কথা বলছে, একটা মেয়েলি কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, এক ছুটে রুম এ যেতেই দেখে পিপলু বিছানায় বসে পা দুলিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। কিছু বলবি? নাহ কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো শিপন। বাকি রাত টা মনে খচখচানি নিয়েই ঘুমাতে গেল শিপন।
সকাল ১০ টা। পিপলু যে ঘরটায় বসে আছে তার দেয়ালটা হালকা নীল রং করা, দেয়ালে কিছু অয়েল পেইন্টিং, একটা বুকশেলফ । তার উপরে একটা ফুলদানি, তাতে কিছু প্লাস্টিক এর ফুল রাখা। ফুলগুলোর রং ও নীল। সামনে বসা মানুষটার নাম সফিউল কাদের। বেশ বড় মাপের সাইকিয়াট্রিস্ট। যদিও দেখে মনে হচ্ছে না, একটা সাদা টিশার্ট আর ব্লু জিন্স পরে আছে, আর সিগারেট ফুঁকছে আয়েশ করে। পিপলু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, সফিউল কাদের সিগারেট টা নিভিয়ে বলতে লাগলেন, সবই শুনলাম, বুঝলাম। আপনার বন্ধু কি চলে গেছে? নাহ, ও বাইরে অপেক্ষা করছে। কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে সফিউল কাদের বললেন, আমার মনে হয় না আছে, তাও আমি চাচ্ছি আপনি যেয়ে দেখে আসুন নিজে। হয়তো কোথাও কাজে গেছে, তাতে কি? সমস্যা আমার, শিপন আসছে কোথা থেকে, কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি পিপলুর। আপনি হয়তো বিরক্তবোধ করছেন, তাও আমি অনুরোধ করবো আপনি দেখে আসুন । অগত্যা পিপলু ওয়েটিং রুম এর দিকে পা বাড়ায়। যেয়ে চারিদিকে নজর বুলাতে থাকে, নাহ কোথাও শিপন এর নামগন্ধ নেই। ফিরে আসতেই সফিউল আলম একটা ফুটেজ দেখায় পিপলু কে, সিসি টিভির ফুটেজ এ দেখা যাচ্ছে পিপলু একাই ঢুকছে ক্লিনিক এ। ওয়েটিং রুম এর ফুটেজ এ দেখা যাচ্ছে ও একাই কথা বলছে চেয়ার এ বসে সামনের দিকে তাকিয়ে। ফুটেজ দেখানোর পর সফিউল আলম অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন । তারপর ঠান্ডা গলায় বলতে শুরু করলেন , পিপলু আপনার যে সমস্যা , বা আপনার যে বন্ধু , আপনার প্রেমিকা এসবই যে আপনার কল্পনা এটা আপনি বিশ্বাস হয়তো করবেন না, কিন্তু এটাই সত্যি। আপনি আমার কাছে আরো দুইবার এসেছিলেন, আপনার হয়তো মনেই নেই। আপনার ছোট বেলা থেকে নিঃসঙ্গতা , ভয়াবহ একাকিত্ব এগুলো থেকে আপনাকে আপনার মস্তিষ্ক কাইন্ড অফ প্রোটেক্ট করে আসছে, আমি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে ও খোঁজ লাগিয়েছিলাম। শিপন নামে আপনার কোনো বন্ধুর কথা জানা যায় নি। আপনি বলুনতো আপনি কালকে রাত্রে কোথায় ছিলেন? কেনো শিপন এর বাসায়। নাহ, আপনি ছিলেন আপনার নিজের বাসায়। ঠিকানা ৩৩/২, আজিমপুর তাই তো? হ্যাঁ হ্যাঁ এটা তো... এটা আপনার বাসার ই ঠিকানা। আপনি মা বাবাকে হারিয়েছেন ছোট বেলায়, চাচার বাসায় মানুষ, আপনি মূলত নিঃসঙ্গ এবং ভয়ানক নিঃসঙ্গতা ভোগ করেছেন আপনার পুরো জীবন। সেখান থেকে আপনার মস্তিষ্ক আপনার একজন প্রিয় মানুষ সৃষ্টি করলো, একটা প্রিয় বন্ধু সৃষ্টি করলো, যখন যার প্রয়োজন, তাকে আপনার সামনে হাজির করলো, আই অ্যাম ভেরি সরি, কিন্তু এটাই সত্যি। পিপলু বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছে, তার দৃষ্টি পাশের বুকশেলফ এর দিকে, ঠোঁট এ স্মিত হাসি নিয়ে ঈশিতা আর শিপন যেনো দাড়িয়ে আছে.....
108
View