“।
অধ্যায় ১: হারিয়ে যাওয়া দরজা
ঢাকার পুরান অংশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুরাতন নবাবি প্রাসাদ—যেটি আজ কেবল ধ্বংসাবশেষ। স্থানীয়দের কাছে এটি "ভূতের বাড়ি" নামে পরিচিত, আর বহু বছর ধরে কেউ সাহস করে ওখানে ঢোকেনি। কিন্তু রিফাত, একজন বিজ্ঞানপ্রীত কিশোর, ঠিক করেছিল ইতিহাসের এই বন্ধ দরজাটি সে খুলবেই।
রিফাতের দাদা ছিলেন একজন প্রখ্যাত পদার্থবিদ, যিনি সময় ভ্রমণ নিয়ে গবেষণা করতেন। মৃত্যুর আগে তিনি রেখে যান কয়েকটি রহস্যময় ডায়েরি আর একটি ধাতব মানচিত্র। সেই মানচিত্রেই ছিল “সময় কোষ”-এর অবস্থান।
বন্ধু আরমানকে সঙ্গে নিয়ে রিফাত হাজির হয় সেই পরিত্যক্ত প্রাসাদে। দোতলার একটি ঘরে তারা খুঁজে পায় গোলাকৃতি একটি ধাতব ফলক, যার গায়ে লেখা ছিল—
"সময় এখানে বাঁকে মোড়ে, ঢুকো যদি সাহস থাকে।"
রিফাত ফলকের কেন্দ্র চাপে। মুহূর্তেই দেয়াল কেঁপে উঠে এক গোল দরজা খুলে যায়—তাতে ঘূর্ণায়মান আলোর রেখা, অজানা চিহ্ন, আর ভিন্ন মাত্রার স্পন্দন।
দুজনে একে একে ঢুকে পড়ে সেই দরজার ভিতর। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের আলো গাঢ় হয়ে যায়, শরীর হালকা, সময় স্তব্ধ—তারা পড়ে যায় এক ঘূর্ণায়মান সুড়ঙ্গে।
মুহূর্তেই তাদের পায়ের নিচে ধুলো, বাতাসে পলাশ ফুলের গন্ধ, আর চোখে পড়ে পালকি, ঘোড়া, আর ইংরেজ সেনা। তারা এসে পড়ে ১৮৫৭ সালের ঢাকা শহরে, ঠিক বিদ্রোহের আগমুহূর্তে।
চারপাশে ইতিহাসের স্পন্দন। কিন্তু এখন তাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—কীভাবে ফিরবে তারা, আর কি কেবল তারাই এসেছিল?
---
অধ্যায় ২: অতীতের শিকার
ঢাকা শহর তখন এক চরম উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে রাস্তায় রাস্তায়। রিফাত ও আরমান নিজেদের ছদ্মবেশে ঢাকা রেখে চলে আশ্রয় নেয় এক দেশপ্রেমিক কারিগর মোহাম্মদ বশির-এর কাছে।
বশির ছিলেন এক গোপন বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীর সদস্য—যারা ইংরেজদের কাছ থেকে সময় শক্তির রহস্য লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তিনি প্রথমেই বুঝতে পারেন, এই দুই কিশোর এই সময়ের নয়।
“তোমরা ভবিষ্যতের সন্তান। কিন্তু অতীত এমন এক জায়গা, যেখানে ভুল করলে শুধরে নেওয়ার সুযোগ নেই,”—বলেন বশির।
তিনি জানিয়ে দেন, সময় সুরঙ্গ প্রতিবার কেবল ২৪ ঘণ্টার জন্য খোলে। এরপর সেটি আবার দশকে দশকে সরে যায়।
রিফাত ও আরমান তখন দিশেহারা। কিন্তু সমস্যা বাড়ে যখন এক বিশ্বাসঘাতক, বশিরের পরিচিত একজন, ইংরেজ সেনাদের জানিয়ে দেয় তাদের অবস্থান। কারণ ভবিষ্যতের জ্ঞান তাদের কাছে হতে পারে এক মহাশক্তির অস্ত্র।
ইংরেজ বিজ্ঞানী মিস্টার হ্যামিলটন, যিনি আগে কলকাতায় গবেষণা করছিলেন, ঢাকায় এসেছেন একটি “সময় ধরার যন্ত্র” নিয়ে। তার বিশ্বাস, সময় সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ভবিষ্যতের কিছু মানুষ এখানে এসেছে—যাদের দিয়ে ইতিহাস পাল্টানো সম্ভব।
রিফাত, আরমান ও বশির তখন মিলে বানাতে শুরু করে এক বিকল্প যন্ত্র—যেটি প্রাচীন কালের মেটাল ও কাচ ব্যবহার করে একটি অস্থায়ী সময় দরজা খুলতে পারে। কিন্তু এ যন্ত্র চালাতে দরকার হয় মূল সংকেত—যেটি ছিল দাদার ডায়েরির এক পৃষ্ঠা।
আরমান মনে করে, সে সংকেত সে আগেই কপি করেছিল মোবাইলে। কিন্তু এ কালে মোবাইল? কোথাও চার্জ নেই, সংযোগ নেই। তখন তারা এক ছেলেকে খুঁজে পায়, যে তাম্র পাতায় সেই সংকেত খোদাই করে দিতে রাজি হয়।
শেষ মুহূর্তে, যখন ইংরেজ বাহিনী ঘিরে ফেলে পুরো এলাকা, তারা সময় দরজার সামনে পৌঁছায়। গোলাগুলির মাঝে রিফাত যন্ত্রটি চালু করে। আলো ছড়িয়ে পড়ে, আবার সেই সুড়ঙ্গ খুলে যায়।
তারা দুজনে ফিরে আসে বর্তমানের সেই পুরোনো প্রাসাদে। সব শান্ত। সব স্বাভাবিক।
কিন্তু দরজার পাশে পড়ে থাকে একটা ভাঙা ঘড়ি—যেটি ছিল না আগেও, না তাদের কারো।
তাদের মনে পড়ে যায় বশিরের কথা—"সময় দরজা দুদিকেই খোলে। কে বলতে পারে, কেউ তোমাদের সাথেই আসেনি?"
---
অধ্যায় ৩: ভবিষ্যতের ছায়া
ফিরে আসার পর রিফাত ও আরমানের জীবনে যেন কিছুই আগের মতো নেই। দিনের আলো যেন বেশি উজ্জ্বল, ছায়াগুলো যেন বেশি গাঢ়।
তারা দেখে, রিফাতের দাদার পুরনো গবেষণাগারে কিছু যন্ত্র অদ্ভুতভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু অজানা সংকেত ভেসে আসছে—যেগুলো কেউ জানে না কীভাবে এসেছে।
তাদের সন্দেহ হয়, কেউ হয়তো তাদের সঙ্গেই সময় সুড়ঙ্গ পার হয়ে এসেছে।
এক রাতে, রিফাত দেখতে পায় সেই পুরনো প্রাসাদের কাছাকাছি এক ছায়ামূর্তি। লোকটি তার হাতে ধরে আছে এক প্রাচীন টাইম কম্পাস—যা কেবল বশিরের ল্যাবে ছিল।
রিফাত এগিয়ে গেলে ছায়াটি পালিয়ে যায়, আর দেয়ালে একটি বাক্য খোদাই করে যায়:
"তোমাদের সময়ই আমার অস্ত্র। দেখা হবে কাল।"
রিফাত বুঝে যায়, সময় এখন আর কেবল এক বিজ্ঞান নয়—এটি এখন এক যুদ্ধ। অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝে শুরু হয়েছে লড়াই, যেখানে ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষণই এখন এক সম্ভাব্য বিস্ফোরণ।
তারা সিদ্ধান্ত নেয়, আবার সেই দরজা খোলা হবে। কিন্তু এবার আর নয় শুধু জানার জন্য, এবার দরজা খুলবে রক্ষা করার জন্য।
তারা প্রস্তুতি নেয়—এই সময়, সেই সময় আর ভবিষ্যত—তিনটি সময়কে এক সুতোয় বাঁধতে হবে। আর সেই সুতোটাই হবে সময় সুরঙ্গ।