প্রেম, বিয়ে, যৌনতা -এই তিন আবেগ, প্রথা বা অঙ্গভঙ্গি আর প্রজননের একচ্ছত্র অধিপতি থাকবে না। নতুন যুগের দরজায় কড়া নাড়ছে এমন এক বিজ্ঞান, যেখানে ‘মা’ বা ‘বাবা’ হওয়ার জন্য শরীরের প্রয়োজন নেই, দরকার নেই যৌন সম্পর্কেরও। সন্তান জন্ম নিতে পারবে গবেষণাগারের একটি গ্লাস কন্টেইনারে -একটি পেট্রি ডিশে।
এই বৈপ্লবিক প্রযুক্তির নাম In Vitro Gametogenesis (IVG)। সহজ বাংলায়, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষের দেহকোষ থেকে ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি করা যায়। জৈবিক উপাদান তৈরি হবে শরীর ছাড়াই, অর্থাৎ পুরুষ বা নারীর প্রজননাঙ্গের প্রয়োজন হবে না। গবেষকেরা বলছেন, এই প্রযুক্তি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হতে পারে আগামী এক দশকের মধ্যেই।
কিভাবে কাজ করে IVG?
প্রথমে একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ত্বক বা রক্তের কোষ সংগ্রহ করা হয়। এরপর এই কোষকে induced pluripotent stem cell (iPSC)-এ রূপান্তর করা হয়, যা এমন এক ধরনের স্টেম সেল, যেটি দেহের যেকোনো ধরনের কোষে রূপ নিতে পারে। এরপর জেনেটিক ও হরমোনাল নির্দেশনার মাধ্যমে এই কোষকে শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে রূপান্তর করা যায়। বর্তমানে ইঁদুরের উপর এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সফলভাবে বাচ্চা জন্ম দেওয়া হয়েছে।
কারা উপকৃত হবেন?
১. সমলিঙ্গের জুটি: একই লিঙ্গের দুই ব্যক্তি ভবিষ্যতে তাদের নিজের দেহকোষ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু তৈরি করে জৈবিক সন্তান নিতে পারবেন।
২. বন্ধ্যাত্বে ভোগা দম্পতি: যাদের শুক্রাণু বা ডিম্বাণু নেই, তারাও নিজের শরীরের অন্য কোষ থেকে গ্যামেট তৈরি করে সন্তান নিতে পারবেন।
৩. একক পিতা-মাতা হতে ইচ্ছুক মানুষ: এককভাবে মা বা বাবা হতে চাইলে, কেবল নিজের কোষ থেকেই সন্তান তৈরি সম্ভব হবে।
কিন্তু বিতর্ক কোথায়?
প্রথমত, এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ‘ডিজাইনার বেবি’ তৈরির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অভিভাবকরা যদি সন্তানদের উচ্চতা, চোখের রঙ, বুদ্ধিমত্তা বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বেছে নিতে চান, তবে মানবজাতির বিবর্তন একটি বাজারে রূপ নিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এতে করে ‘প্রাকৃতিক পরিবার’ ধারণা হুমকির মুখে পড়তে পারে। যৌনতা, প্রেম, মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের সাথে আমাদের যে আবেগগত ও সামাজিক বন্ধন রয়েছে, তা কি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মুছে যাবে?
তৃতীয়ত, শিশুদের নৈতিক অধিকার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তারা যদি সম্পূর্ণ পরীক্ষাগারে তৈরি হয়, তবে তাদের অস্তিত্ব কি হয়ে উঠবে একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প মাত্র?
ভবিষ্যতের ভয় ও সম্ভাবনা কী?
যেমনটি ইন্টারনেট, ক্লোনিং বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তেমনি IVG-ও আমাদের জীবনের গঠনমূলক পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু এ প্রযুক্তি ব্যবহারে চাই নৈতিক সংলাপ, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং সর্বোপরি মানবিক বিবেচনা।
মানবজাতির ভবিষ্যৎ কি এবার প্রকৃতির নিয়মে নয়, বরং বৈজ্ঞানিক কল্পনায় গঠিত হবে? প্রকৃতি এটা মানবে?
References:
• Regalado, A. (2023). A lab is growing human eggs and sperm. No sex required. MIT Technology Review.
• Turner, D. (2024). In vitro gametogenesis: The future of human reproduction? Nature Medicine.
• Saitou, M. et al. (2021). Generation of functional gametes from stem cells in mice. Cell Reports.
লেখক: সাংবাদিক
২৮ এপ্রিল ২০২৫