Posts

ফিকশন

ছায়ার মানুষ পর্ব ১

May 2, 2025

Radia

Original Author Radia Moni

121
View

মানাফ একজন তরুণ সাংবাদিক। ঢাকার ব্যস্ত জীবন থেকে একটুখানি ছুটি নিয়ে সে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এক গ্রামে, নাম ধুলামাটি। গ্রামের প্রকৃতি যতটা মনোমুগ্ধকর, তার চেয়েও বেশি রহস্যময়। শীতের ধোঁয়ায় ভরা সেই গ্রামে মানুষের মুখে মুখে ঘোরে একটি গুজব—রাত নামলেই নাকি জঙ্গলের দিক থেকে আসে ছায়ার মানুষ।
মানাফ প্রথমে বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করেছিল। গুজব বা ভয়ভীতি ছড়ানো গ্রামীণ কল্পগাথা—এটাই ভাবছিল। কিন্তু গ্রামের প্রৌঢ় মুরুব্বি ফজলু চাচার চোখে ভয় দেখার পর কৌতূহলটা যেন রক্তে ঢুকে গেল।
ফজলু চাচা বললেন, “বেটা, রাত হইলে বাড়ি থেকে বের হইস না। ওই ছায়ার মানুষ চোখে পড়লে তুই আর তুই থাকবি না।”
কয়েকজন লোকও নিখোঁজ—তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। শুধু জানা যায়, তারা রাতের বেলায় শেষবার জঙ্গলের ধারে গিয়েছিল।
এ সব শুনে মানাফ সিদ্ধান্ত নিল, এই রহস্যের পেছনের সত্যটা সে খুঁজে বের করবেই। এটাই হবে তার ক্যারিয়ারের বড় ব্রেক।
তৃতীয় রাত। চাঁদ ছিল না, হালকা কুয়াশা জমে উঠছিল। মানাফ হাতে একটি ক্যামেরা ও টর্চলাইট নিয়ে একাই জঙ্গলের ধারে গেল। তার ঘড়িতে রাত ১টা। চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা, যেন প্রকৃতিও শ্বাস বন্ধ করে আছে।
হঠাৎ করে জঙ্গলের গা ঘেঁষে একটি অস্বাভাবিক শব্দ—খস খস, পাতার ঘষাঘষির মতো, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে যেন কোনো নিয়ম নেই।
তারপর সে দেখল—একটা ছায়া। মানুষের মতো আকৃতি, কিন্তু খুবই লম্বা। মুখ স্পষ্ট নয়। সেই ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
মানাফ গলা শুকিয়ে গেলেও সাহস করে ক্যামেরা তুলল। কিন্তু ফ্ল্যাশ চালু করতেই কিছুই দেখা গেল না—ছায়াটা যেন হাওয়ার মতো উধাও হয়ে গেল।
অবাক হলেও সে পিছু হটল না। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে সে একটি পুরনো পোড়োবাড়ি দেখতে পেল। বাড়িটা কেমন যেন কাঁদছে—হাওয়ার সাথে যেন কান্নার শব্দও আসছে।
বাড়ির দরজাটা খোলা, ভেতরে ঢুকে মানাফ দেখল জায়গাটা ধ্বংসস্তুপ। দেয়ালে শিকল, ছেঁড়া ছবি, আর পুরনো কাঠের একটা খাট।
এক কোনায় পড়ে থাকা পুরনো ডায়েরি খুলে সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত লেখা—“মানুষ নয়, ছায়া ছিলাম আমি, এখনো আছি।”
তার নিচে লেখা: “এই বাড়িতে যারাই রাত কাটায়, তাদের ছায়া আর ফিরে যায় না।”
ঘড়ির কাঁটা ৩টার দিকে গেলে হঠাৎ দরজাটা ঝাঁপ করে বন্ধ হয়ে গেল। বাতাস বন্ধ, টর্চ নিভে গেল, ক্যামেরা বন্ধ—চারদিক নিঃসাড়।
তারপর দরজার পেছনে দাঁড়ানো সেই ছায়া। এবার খুব কাছে। শীতল একটা শ্বাস গলায় লাগছে। চোখে তাকাতে সাহস পেল না মানাফ। কিন্তু একটা কণ্ঠস্বর কানে বাজল—
“তুমি লিখবে আমার গল্প, তাই তো এসেছো? লিখো, কাগজে নয়—রক্তে।”
সকালে গ্রামের কিছু মানুষ খুঁজতে গিয়ে পেল একা একটি ক্যামেরা। খালি, ছবি নেই। পাশেই মাটিতে লিপিবদ্ধ ছিল কয়েকটি লাইন—
“ছায়ার গল্প কখনো ফুরোয় না। মানাফ গিয়েছিল আলো নিয়ে, ফিরে এসেছে ছায়া হয়ে।”
তবে এখানেই গল্প শেষ নয়। ঢাকা ফিরে এসে মানাফের বন্ধুরা লক্ষ্য করল, সে যেন আগের মত নেই। চোখে ঘুম নেই, মুখে হাসি নেই।
আর প্রতিরাতে তার লেখা ডায়েরিতে নিজে নিজেই যোগ হতে থাকে অদ্ভুত শব্দ—ছায়ার ভাষা।
একদিন তার লেখার খাতা থেকে ভেসে উঠল ছায়া। আর সে রাতেই মানাফ উধাও। তার ঘরে পাওয়া গেল সেই পুরনো ডায়েরি, যার পাতায় লেখা ছিল—
“এখন আমি লিখি না, আমাকেই লেখা হয়।”

Comments

    Please login to post comment. Login