আরিয়ান কিছু বলার আগেই মেয়েটা দ্রুত রতন ভাইয়ের দিকে ফিরে গিয়ে বলল,
“দশ মিনিট পরে আসো, যাও তো এখন।"
তার কণ্ঠে একরকম তাড়াহুড়ো আর অস্বস্তি ছিল।
রতন ভাই কপাল কুঁচকে গেল, ঠোঁট বাঁকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কিরে হেনা, এখনও কাজ শেষ হয়নি রে? কী করিস তোকে তো স্পেশালি পছন্দ করেই পাঠালাম।”
তারপর একটা কুৎসিত, ঘৃণাজাগানো হাসি দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“যাও তো, বাজে বকিস না।”
মেয়েটা—যার নাম হেনা—দরজা বন্ধ করে দিলো।
আরিয়ান চুপচাপ তাকিয়ে আছে। মাথার ভেতর যেন বাজছে হাজারটা প্রশ্ন।
সে ফিসফিস করে বলল,
“এইসব… এটা কী হচ্ছে এখানে? আমি কেন এখানে? গতকাল রাতে…”
হেনা কিছু না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল—
“সব বলবো… কিন্তু আগে তুমি নিজেকে সামলাও। যেটা হয়েছে সেটা… তোমার ভাবনার চেয়েও ভয়ংকর।”
এই বলে হেনা ধীরে ধীরে পাশে রাখা একটি ব্যাগ থেকে আরিয়ানের জামা-কাপড় বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
তার চোখে কোনো আবেগ নেই, কণ্ঠটা ছিল একেবারে মাটি মতো ঠান্ডা—
"পরে নাও সাহেব, আমি পিছনে ফিরছি।"
আরিয়ান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকলো।
তার মাথার মধ্যে একটা ঘূর্ণিঝড় চলছে—
সে কোথায়, কীভাবে এখানে এল, কী ঘটেছে—কিছুই মনে নেই।
কিন্তু এখন এসব প্রশ্নের থেকেও আগে, নিজেকে অন্তত এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করা দরকার।
সে কাপড়গুলো হাতে নিয়ে দ্রুত পড়ে নিলো।
হেনা তখন জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে, চুল ঠিক করছে।
আরিয়ান একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল—
"হয়েছে…"
হেনা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো, তার চোখে ক্লান্তি আর একটা অদ্ভুত সহানুভূতির ছায়া।
হেনা ধীরে ধীরে পিছনে ফিরে আরিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সাহেব, এখানে রতন ভাই যত মানুষকে এনেছে, তারা সবাই এক রকম ছিল… লোভী, দাগি, নেশাগ্রস্ত। কিন্তু তুমি… তুমি তাদের মতো নও।
তোমার চোখে আমি একটা আলাদা যন্ত্রণা দেখেছি।
এই জন্যই… তোমার সাথে কিছু কথা বলবো। সময় খুব কম।”
আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো, গলার স্বরটা কাঁপছিল,
“কী বলবে তুমি? কী হচ্ছে এখানে? আমাকে… কে এনেছে এখানে?”
হেনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“তুমি নিজেই এসেছিলে, কিন্তু পুরোপুরি হুশে ছিলে না। রতন ভাই তোমাকে জোর করে এখানে আনেনি, কিন্তু... তোমাকে নিয়ে কী প্ল্যান করছে, সেটা আমি জানি।
এটা কোনো সাধারণ জায়গা না।
এখানে যারা একবার আসে, তারা আর সহজে বেরোতে পারে না।”
আরিয়ান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
হেনা তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললো,
“তুমি চাইলে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারো। কিন্তু এখনই, এই মুহূর্তে। দরজার পেছনের করিডোরে একটা দরজা আছে।
ওটাই তোমার একমাত্র পথ।”
হেনা চোখ নামিয়ে বললো,
"আর সাহেব… তোমার কিছু খারাপ ছবি রতন ভাই তুলে রেখেছে। যেটা সে সব সময় করে। এটা ওর পুরনো কৌশল… যারাই এখানে আসে, তাদের ঘোলাটে অবস্থায় ছবি তোলে, ভিডিও করে… তারপর ব্ল্যাকমেইল করে। এই ভাবেই ওনার পেট চলে।"
আরিয়ান যেন আকাশ থেকে পড়লো। মাথা ঘুরে উঠলো।
সে যেন এক মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারছিল না—নিজের ওপর রাগ করবে, না লজ্জায় মাথা নত করবে। তার কণ্ঠ শুকিয়ে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগলো।
“আমি… আমি এমন কিছু করিনি… আমি তো শুধু… আমি তো তৃষাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম…”
হেনা আস্তে বললো,
“আমি জানি, তুমি সেইরকম কেউ না। আমি চোখে দেখেছি… তুমি কারও জন্য কাঁদছিলে… তৃষা? হয়তো তাকেই খুঁজছিলে। কিন্তু এখন তোমার সময় নেই। যদি আজ এখান থেকে না যাও, কাল তুমি নিজেকে চিনতেও পারবে না।”
এই সব শুনে আরিয়ান রাগে গর্জে উঠলো, “আমি কেন পালাবো? আর তুই নিশ্চয়ই রতনের সাথে মিলে এই কাজ করিস! রাতভর ছেলেদের সাথেই থাকিস — তোর মুখে ভালো কথা মানায় না হেনা!”
হেনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মুখে কোনো দুঃখ বা অপমানের ছাপ ছিল না। শান্ত গলায় বললো, “সাহেব, আপনি যা বলছেন সবই ঠিক। কিন্তু আমি—”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ দরজা বিকট শব্দে ভেঙে পড়লো। রতন হুঙ্কার দিয়ে ঘরে ঢুকলো, চোখে আগুনের মতো রাগ।
“হেনা! তুই শুধরালি না এখনও? তোকে কতবার বলছি মায়া দেখাস না তোদের মতো পণ্যের আবার মায়া কিসের?”
এই বলে রতন দু’জনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কোনো কিছু বোঝার আগেই হেনা আর আরিয়ান—দু’জনকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেললো। আরিয়ান ধস্তাধস্তি করলেও সে অসহায় ছিল।
রতন দাঁত বের করে হেসে বললো,
“তোরা না বুঝিস, না শুনিস। যা, এখন বাইরে যাই। রাতে আসতাছি... তখন তোদের ব্যবস্থা করমু।”
এই বলে সে দরজাটা ধাক্কা মেরে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ঘরটা তখন অন্ধকার আর নিস্তব্ধ। একটা নিঃশ্বাস আর দড়ির খসখস ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
চলবে......