দারিদ্র্য কেবলমাত্র অর্থনৈতিক নয়, বরং এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক চ্যালেঞ্জ—যা দীর্ঘদিন ধরে নীতিনির্ধারক, গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে বিদেশি সহায়তা, মুক্ত বাজারনীতি, কিংবা গণতন্ত্র কোনটি সবচেয়ে কার্যকর—তা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। একদিকে যেমন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ্রি স্যাকস মনে করেন যে, দরিদ্র দেশগুলো ভৌগোলিক ও পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম এস্টারলি মনে করেন, বিদেশি সাহায্য বরং এসব দেশকে আরও বেশি পরনির্ভরশীল করে তোলে।
স্যাকস তার বই The End of Poverty (২০০৫)-এ যে মত তুলে ধরেছেন, তা মূলত "দারিদ্র্যের ফাঁদ" তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। তার মতে, দরিদ্র দেশগুলোকে এই ফাঁদ থেকে মুক্ত করতে হলে ধনী দেশগুলোর উচিত ধারাবাহিক ও সুপরিকল্পিত বিদেশি সাহায্য প্রদান করা। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, বছরে প্রায় ১৯৫০০ কোটি ডলারের সহায়তা যদি ২০ বছর অব্যাহত থাকে, তবে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব।
অন্যদিকে এস্টারলি মনে করেন, এসব সহায়তা দারিদ্র্য দূর না করে বরং রাজনৈতিক দুর্নীতিকে উসকে দেয় এবং জনগণকে নিজেদের সমস্যা সমাধানে অনুৎসাহী করে তোলে। তার মতে, টেকসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি ও গণতন্ত্র—যেখানে মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
এই তত্ত্বভিত্তিক তর্ক-বিতর্কের বাইরে এসে অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যানার্জী ও অধ্যাপিকা এস্থার ডুফলো সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। তারা দারিদ্র্য নিরসনের উপায় অনুসন্ধানে গ্রহণ করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি—রেন্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল (RCT)। সাধারণত ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকারিতা যাচাইয়ে ব্যবহৃত এই গবেষণা পদ্ধতিকে তারা প্রয়োগ করেছেন সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে, যাতে প্রকৃত কার্যকারিতা যাচাই করা যায়।
RCT পদ্ধতিতে গবেষণার জন্য একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে এলোমেলোভাবে দুইটি দলে ভাগ করা হয়। একদলের উপর নিরীক্ষণমূলক কর্মসূচি বা উদ্যোগ চালু করা হয়, অন্যদল থাকে আগের অবস্থাতেই। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেখা হয়, দুই দলের ফলাফলে কোনো অর্থবহ পার্থক্য দেখা যাচ্ছে কি না।
এই পদ্ধতির প্রয়োগে ব্যানার্জী ও ডুফলো ভারত, বাংলাদেশ ও কেনিয়ার মতো দেশে বাস্তবায়িত নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে এমন কিছু ফলাফল তুলে এনেছেন যা উন্নয়নচিন্তায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
কেনিয়ায় স্কুল উপস্থিতি ও কৃমিনাশক বিতরণ:
কেনিয়ায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল—বিনামূল্যে বই, ইউনিফর্ম সরবরাহ কিংবা অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। তখন একটি বেসরকারি সংস্থা পরীক্ষামূলকভাবে কিছু স্কুলে কৃমিনাশক ওষুধ বিতরণ করে। দেখা যায়, যেসব স্কুলে এই ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, সেসব জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এমনকি আশপাশের স্কুলগুলোতেও কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, কারণ স্থানীয়ভাবে কৃমির প্রকোপ কমে যায়। এটি প্রমাণ করে—সঠিক সমস্যা চিহ্নিত করে যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে ছোট উদ্যোগ থেকেও বড় পরিবর্তন সম্ভব।
ভারতে রেমেডিয়াল শিক্ষা কার্যক্রম:
ভারতের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হচ্ছে—দুর্বল শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়া। অধিকাংশ সময় শিক্ষকরা মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উপর বেশি মনোযোগ দেন, ফলে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা আরও পেছনে পড়ে যায়। Pratham নামের একটি সংস্থা কিছু স্কুলে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে বিকেলে অতিরিক্ত পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে। ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের পাঠ ও গণিত দক্ষতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এই পরীক্ষাও দেখিয়েছে যে, ‘এক পদ্ধতি সবার জন্য’ এই নীতিতে কাজ হবে না; বরং পার্থক্যভিত্তিক পরিকল্পনা দরকার।
সার্বিকভাবে RCT পদ্ধতির ব্যবহার একটি নতুন বার্তা দেয়: দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কোনো মহাপরিকল্পনা বা সর্বজনীন তত্ত্ব প্রয়োজন নেই। বরং, ছোট ছোট বাস্তবভিত্তিক পরীক্ষা ও তথ্য-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। এভাবেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণাপদ্ধতি হয়ে উঠেছে দারিদ্র্য নিরসনের হাতিয়ার।