ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীনের "জবানের স্বাধীনতা: ’মত’ বনাম ’মব’" -জমজমাট আলোচনাটা সবার শোনা দরকার।
সাংবাদিকতা কী?
সাংবাদিকের প্রশ্ন করবার অধিকারের সীমা কতদূর? গণমাধ্যম হাউজগুলোর কর্মী সুরক্ষার নীতিমালা কেমন থাকা উচিত? সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার প্রতি রাষ্ট্রের বিহ্যাভিয়ার কেমন হওয়া উচিত? সিভিল রাইটস কী?
সববিষয় একসাথে জানতে এই এপিসোডে চোখ রাখা দরকার। সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে প্রশ্ন করে বিব্রত করার দায়ে তিন সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল এটা।
বাসস সম্পাদক মাহবুব মুর্শেদ ও নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনীম খলিল ছিলেন হোস্ট খালেদ মুহিউদ্দীনের অতিথি। তাদের আলোচনা শুনলাম।
তাসনীম খলিল বললেন, শেখ হাসিনাকে কোনো দিন যদি বাংলাদেশের কোনো আদালতে হাজির করা হয়, সেখানে তাকে ডিফেন্স করে (সে তো অ্যাকিউজড, তার তো ডিফেন্স পাওয়ার অধিকার আছে। আমি মনে করি এখনও আপনারা এটা অস্বীকার করবেন না) তখন যদি তার উকিলরা বলে, উনি একটাও খুন করে নাই। বাংলাদেশে ১৪০০ লোক মারা যায় নাই, তাহলে কি বাংলাদেশে ওই আইনজীবীর অধিকারও হরণ করবেন?
মাহবুব মুর্শেদ প্রতি উত্তরে জানালেন, দেখেন উকিলের পেশা একটা, সাংবাদিকের পেশা একটা। সাংবাদিকরা যখন শেখ হাসিনার উকিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেটাকে আমি সমর্থন করবো না। কিন্তু উকিল যদি উকিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেটাকে আমি সমর্থন করবো। জবাব শুনে হেসে দেন তাসনীম খলিল।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এটি সাংবাদিকদের যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকার দেয়, তবে তা অবশ্যই আইনসঙ্গত ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
অপরদিকে বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া চাকরিচ্যুত করতে পারে না। চাকরিচ্যুতির জন্য যথাযথ কারণ, প্রক্রিয়া এবং নোটিশ প্রদান বাধ্যতামূলক। যদি কোনো সাংবাদিককে শুধুমাত্র প্রশ্ন করার কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়, তবে তা শ্রম আইনের লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক শ্রম আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।
আন্তর্জাতিকভাবে সাংবাদিকদের ক্ষমতা ও রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার অধিকারটি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনি ও নীতিগত কাঠামোতে তা স্বীকৃত।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্র (UDHR), ১৯৪৮ এর ধারা ১৯ -এ বলা হয়েছে:
“প্রত্যেকেরই মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নির্বিঘ্নে মত পোষণ করা এবং কোনো সীমা ছাড়াই যেকোনো মাধ্যমে তথ্য ও ধারণা অনুসন্ধান, গ্রহণ ও প্রচার করার স্বাধীনতা।” এই অনুচ্ছেদ সাংবাদিকদের কর্তৃপক্ষ, সরকার বা অন্য যেকোনো ক্ষমতার প্রশ্ন করার অধিকার দেয়।
আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত চুক্তি (ICCPR), ১৯৬৬ এর ধারা ১৯ (২) -এ বলা হয়েছে:
“প্রত্যেকেরই প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে; এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সকল প্রকার তথ্য ও ধারণা অনুসন্ধান, গ্রহণ ও প্রচার করার স্বাধীনতা, যেকোনো মাধ্যম ও সীমান্ত নির্বিশেষে।” বাংলাদেশ ২০০০ সালে ICCPR-এ অনুসমর্থন করেছে, তাই এটি আমাদের দেশের ওপরও বাধ্যতামূলক।
UNESCO বারবার বলেছে:
“Journalists have the right to investigate, question power, and publish without fear of reprisal.” এটি বলেছে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র টিকবে না।
ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ হিউম্যান রাইটস (ECHR বহু মামলার শুনানিতে বলেছে):
“The press acts as a public watchdog and must be allowed to question and criticize government without fear of punishment.
Reporters Without Borders, Committee to Protect Journalists (CPJ) ইত্যাদি সংস্থা বারবার বলে থাকে যে:
• সাংবাদিকরা প্রশ্ন করবে বলেই তো সাংবাদিকতা।
• কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই তাদের ভূমিকা।
আন্তর্জাতিক আইনে সাংবাদিকদের কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করার অধিকার সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত। এ অধিকার হরণ বা তাদের প্রশ্নে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্র, সরকার, উপদেষ্টা, বাসস প্রধান কারোরই আসলে নাগরিকদের মানবাধিকারের বিরুদ্ধে কথা বলবার সুযোগ নাই।
লেখক: সাংবাদিক
২ মে ২০২৫