একদিন, ইতিহাসের ধুলোপথে, দারুল উলুম দেওবন্দ এক দৃপ্ত প্রতিজ্ঞার মিনার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধু ধর্মশিক্ষা নয়, বরং জ্ঞানের অবারিত দ্বার নিয়ে বসেছিল। ব্রিটিশ শাসনের বিপক্ষে হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের প্রতীক। কাসেম নানুতুবির সেই দর্শন আজ কোথায়? তাঁর অনুসারীরা শাসক শ্রেণীর কোলে চড়ে ক্ষমতাকে চায় কুক্ষিগত করতে। শাসককে বলে জননী। অথচ যেই শাসকের বিমাতাসুলভ আচরণে শাপলায় রক্তাক্ত হয় কওমের সন্তানেরা। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে কওমের সন্তানেরা যখন রক্তাক্ত হয়, তখন খালিদের উত্তরসূরী সস্ত্রীক যায় প্রমোদ ভ্রমণে। মরুর তীব্র দাবানল যেন ভারতবর্ষে এসে হানা দেয়। হওয়া বদল করা যেন তখন হয়ে পড়ে একান্ত জরুরি। তুরাগ পাড়ের জমায়েতও রক্তাক্ত হয় ক্ষমতার মোহে। অথচ দেওবন্দ একসময় বলেছিল — আমরা মানুষ থেকে দূরে যাব না, মানুষের হাতেই রাখব হিসাবের খাতা, আমাদের ভাত-কাপড় আসবে কওমের দানে, আমরা হব কওমের সন্তান। কওমের জবাবদিহিতার বন্ধনে বাঁধা থাকবে আমাদের জীবন ও মৃত্যু। যা পরওয়ার দিগার মহান আল্লাহর দরবারে উত্তম বলে বিবেচিত হবে।
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে একই মঞ্চে বসিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করেন মিশরের ক্বারী আব্দুল বাসিত আব্দুস সালাম। নারী ছিল এমনই সম্মানের। নারী তো মায়ের জাতি। অথচ কবে থেকে সেই নারীর মুখ গুনাহের মানচিত্র হয়ে উঠলো আমরা তা বুঝতেই পারলাম না। সেই মানচিত্র ঢেকে ফেলতে লাল, সবুজ, সাদা কাপড় আমরা জোগাড় করলাম। নারীর অধিকার মানেই অশ্লীলতার সমুদ্র কবে হলো আমরা জানতেও পারলাম না। রিফর্ম মানে হয়ে উঠল ফতোয়ার শিকল। সেই দেওবন্দের অনুসারীরা আজ নারীকে ভরা মজলিসে পতিতা বলে গালি দেয়। নারীর সম্মান নিয়ে একটুও ভাবে না। অথচ অযৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে হতে পারত বাহাস। অথচ সমাজপতিরা তাদেরকে ব্যক্তি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলো।
আজ কওমের সন্তানেরা কোথায়? আজ সেই দেওবন্দের উত্তরাধিকারীরা দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্ত প্রাচীরের ভেতর, যেখানে প্রশ্ন নেই, কেবল ফতোয়া আছে। যেখানে কওম নেই, কেবল কওমের নামে শাসন আছে। এক ইউটোপিয়ান কওম তৈরি করে তার নেতৃত্ব দাবি করে বসেছে একদল মানুষ; যারা সমাজে খুব বেশি না হলেও নিজেদেরকে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি ভাবে। একদা যে উসুল হাশতেগানা মানুষের কাছে মাথা নত করবার শিক্ষা দিয়েছিল, আজ সেই উসুল ব্যবহার হচ্ছে ক্ষমতা চর্চায়। কৃষকের ঘামের টাকায় যেই মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, সেই মাদ্রাসায় ভর করে কৃষকের বিবি-কন্যার সংগ্রামকে অস্বীকার করা কেন? কৃষকের ফসল কৃষাণী মাঠ থেকে মাথায় করে নিয়ে আসলে তুমি ফতোয়া দিয়ে গরিব কৃষকের ওপর জুলুম করো কেন? কৃষাণীকে ঘরে রাখাই যদি তোমার ফতোয়ার কাজ হয় তাহলে কৃষকের ফসল ঘরে তোলার দায়িত্ব তুমি নাও। সে বেলা তোমার ফতোয়ার বই কোথায় থাকে?
হে কওমের ইমাম, এই প্রশ্নগুলো কী কবরের নিঃশব্দতায় শুয়ে আছে? আজ মাদ্রাসার দরজায় লেখা — প্রশ্ন করা হারাম। হ্যাঁ, হারামই। কারণ একবার অধস্তন প্রশ্ন করা শিখে গেলে কারো কারো মসনদ নাই হয়ে যেতে পারে। আজও কওম টাকা দেয়, কিন্তু জবাব পায় না। কওম ছেলে পাঠায়, কিন্তু হিসাব পায় না। মরে পড়ে থাকে শাপলা আর শাহাবাগের দ্বন্দ্বে। অথচ প্রশ্নই তো ছিল আলোর দরজা। তোমার সিলেবাসকে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে পাল্লা দিতে হচ্ছে তখনও তুমি ক্ষমতার মানচিত্র মেলাতেই ব্যস্ত। প্রশ্নকে ভয় পেয়ে আজ সেই সিলেবাস বুড়ো চক্ষুর শাসনে জড়িয়েছ, যেখানে নতুন কিছুর কথা মানেই বিদ্রোহ। এক কালের মুজাহিদ আজ এক আঙ্গুল নড়াতে ভয় পায়, যেন নতুন কোনো বাতাসে তার বেহেশতের চাবি উড়ে যাবে। নারীকে তুমি শিক্ষিত করতে চাও না, অথচ প্রসূতি মায়ের জন্য খুঁজে ফেরো একজন নারী ডাক্তার। নারীর কোনো অধিকার থাকতে নেই তোমার সিলেবাসে।
যারা মানুষের জমি লুটে নেয়, যারা মানুষের টাকার হিসাব দেয় না, তারা আজ বড় মঞ্চে বসে ঈমানের অভিভাবক! তাদের কণ্ঠে 'ইসলাম রক্ষা'-র শ্লোগান। অথচ ইসলামকে যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। সঙ্গী হয়েছে খালিদের মত বীর, ওমরের মত শাসক।
কে মরল শাপলায়, কে হারাল জুলাইয়ে তার খোঁজ নেয়নি কেউ। শাপলার রাতে গুলিবৃষ্টি হতে যারা সাহায্য করল, স্টেজ ছেড়ে পালালো নিজেকে বাঁচাতে, তারা কী কওমের সন্তানের মৃত্যুর দায় নেবে না? তবে শুনে রাখ, এরপরও তোমাদেরকে যারা বিশ্বাসী ভেবেছিল, তাদেরকে তোমরা কী জবাব দেবে? একদিন জবাবদিহিতার শিখা জ্বলবে, মাদ্রাসার দেয়াল পেরিয়ে প্রশ্ন আসবে। বলাৎকার হওয়া প্রতিটি শিশু এসে হাজির হবে তাদের দাবি নিয়ে আর সেই প্রশ্নে ভাঙবে ক্ষমতার মিথ্যা মিনার।
