আজ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল ও মামলা প্রত্যাহারসহ চার দফা দাবি সম্বলিত গণজমায়েত আমাদের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে—এটা কি নারীর পক্ষে অধিকার আদায়ের সমাবেশ, না পুরুষতন্ত্রের এক আত্মতুষ্টিকর অনুশীলন?
সারা দেশ থেকে হাজারো পুরুষ এসেছেন। পরিপাটি পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে তারা নারীকে নিয়ে দিনভর আলোচনা করেছেন। নারীকে অভব্য ও অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। তারা নাকি নারীর সমঅধিকার চান না, ন্যায্য অধিকার চান। বক্তৃতার মঞ্চে একের পর এক আলোচক বলেছেন, নারী কী পরবে, কোথায় যাবে, কীভাবে জীবনযাপন করবে, তার উত্তরাধিকার কতটুকু হওয়া উচিত। বলা হয়েছে, নারী সংস্কার বিষয়ক কমিশন বাতিল করতে হবে, তাদের রিপোর্ট বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে তারা রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে নামবেন। এই পুরো আয়োজনজুড়ে ছিল একটি আশ্চর্য অনুপস্থিতি —নারী।
নারীর জন্য কথা বলা হচ্ছে, অথচ নারীকেই সেখানে অনুপস্থিত রাখা হলো। এই অনুপস্থিতিই প্রশ্ন তোলে, আসল উদ্দেশ্য কী? নারীর ন্যায্য অধিকার রক্ষা করা, নাকি তাকে কথিত ‘ভালোবাসার’ মোড়কে নিয়ন্ত্রণ করা?
বক্তারা সবাই বললেন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম নারীকে সম্মান দিয়েছে। কথাটি সত্য। পবিত্র কোরআনে নারী ও পুরুষকে একে অপরের বন্ধু বলা হয়েছে (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ৭১)। নবী মুহাম্মদ (সা.) নারীর শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর অপর স্ত্রী আয়েশা (রা.) ছিলেন একজন সাহসী, প্রভাবশালী ও বুদ্ধিমতী নারী, যিনি রাজনৈতিক বিষয়েও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ২২০০ -এর অধিক হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা তাঁকে হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়দের কাতারে স্থান দিয়েছে। ফিকহ, তাফসির, আরবি ভাষা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ছিল বিস্তৃত জ্ঞান। নারী সাহাবিদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী। ইমাম জুহরি ও অন্য অনেক তাবেঈ তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করেছেন। পুরুষ সাহাবিরাও তাঁর জ্ঞানের কাছে আসতেন, প্রশ্ন করতেন এবং উপকৃত হতেন।
প্রশ্ন হলো, সেই ইসলামের নাম নিয়ে যদি নারীকে সমাজের মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, তাহলে সেটা কি ধর্মের অপব্যবহার হয় না?
আজকের সভায় নারীর পক্ষে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁদের কেউই নারীর জীবন বাস্তবতায় বসবাস করেন না। নারী কিভাবে চলবে, তা পুরুষ ঠিক করছেন; অথচ নারী নিজেই তাঁর মতামত প্রকাশ করতে পারছেন না। এটা যেন সেই সুপরিচিত ‘আপনার জন্যই তো করছি, আপনি বুঝবেন না’ ধরনের দয়ার রাজনীতি।
নারীর শরীর, পোশাক, চলাফেরা নিয়ে যে পরিমাণ আগ্রহ এই বক্তাদের, তার অর্ধেক আগ্রহ যদি নারীর কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা আইনগত নিরাপত্তা নিয়ে দেখানো হতো, তাহলে হয়তো এই সমাজ আরও এগিয়ে যেত।
এই সমাবেশে সরকারের একাংশের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও বক্তৃতা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, শুধু একটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়—রাষ্ট্র-সমর্থিত কিছু কণ্ঠও নারী প্রশ্নে একরকম রক্ষণশীল অবস্থান গ্রহণ করছে।
নারীর উপর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক এই দ্বিমুখী চাপে নারীর নিজস্ব কণ্ঠ ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে পড়ছে।
এমন বাস্তবতায় আমরা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই? একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের অধিকার নিয়ে আলোচনা হবে, সেখানে সেই নাগরিকের অংশগ্রহণ থাকবে না—এমন পরিস্থিতি অগ্রহণযোগ্য। নারী তার অধিকারের প্রশ্নে নিজেই কথা বলবে, তার হয়ে অন্য কেউ কথা বলবে না —এমনটাই হওয়া উচিত একটি ন্যায্য রাষ্ট্র ও সমাজের ন্যূনতম শর্ত।
নারীর অধিকারে বিশ্বাস করলে তাকে কথা বলার সুযোগ দিন। মঞ্চে জায়গা দিন। আলোচনায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করুন। নারীকে তথাকথিত ‘ভালোর সংজ্ঞা’য় বাঁধার চেয়ে বরং তার নিজস্ব ভালো বুঝে নেওয়ার অধিকারটুকু একান্ত তার কাছেই থাকতে দিন।
লেখক: সাংবাদিক
৩ মে ২০২৫