Posts

চিন্তা

এনসিপির মৌল দর্শন কী?

May 4, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

137
View

নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) এখনও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা আদর্শিক ভিত্তি স্পষ্টভাবে জনসমক্ষে উপস্থাপন করেনি। তবে দলটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড, নেতৃত্বের ভাষ্য এবং অঙ্গভঙ্গিতে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এটুকু স্পষ্ট —তারা হয়তো আরেকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে গেল ৫৪ বছরে ধর্মভিত্তিক দলগুলো ৫ থেকে ১০ ভাগের বেশি জনসমর্থন এখনো পেয়ে দেখাতে পারেনি।

গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন নারী অধিকার, বহুত্ববাদ, সাম্যবাদ কিংবা রাষ্ট্রধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চায় এনসিপির উপস্থিতি থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

গতকাল ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ শেষে এনসিপির শীর্ষস্থানীয় নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রয়েছে, মানুষের মাঝে ধর্মভীতি রয়েছে, যা সকল ধর্মেই... এই বিষয়গুলো যেন আপসের জায়গায় না আসে, আমি সেটাই বলেছি।" তিনি দাবি করেন, ইসলামিক মূল্যবোধ-বিরোধী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি তিনি তোলেননি।

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যে চার দফা দাবি নিয়ে হেফাজত মহাসমাবেশ করেছে, তার প্রধান দাবি ছিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করা এবং সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে বহুত্ববাদ বাদ দিয়ে ইসলামী আইনকে প্রতিস্থাপন করা। প্রশ্ন উঠেছে—এই দাবি-দাওয়ার মঞ্চে এনসিপির সক্রিয় উপস্থিতি কি একপ্রকার আদর্শগত ঐক্য নয়?

বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপি যদি সত্যিই এক নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধি হতে চাইত, তাহলে তাদের নেতার এ ধরনের সমাবেশে অংশগ্রহণ এবং বিতর্কিত ইস্যুতে অস্পষ্ট মন্তব্য কোনওভাবেই কাম্য নয়। বরং এতে করে দলের আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এটা নিছক ব্যক্তিগত মতামত নয়। আমি এটিকে এনসিপির অবস্থান হিসেবেই দেখছি।”  
তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারপন্থী দল হিসেবে এনসিপি এখন বিভিন্ন মঞ্চে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলছে এবং নিজস্ব অবস্থান জনসমক্ষে তুলে ধরছে। যদিও দলটি এখনও তাদের গঠনতন্ত্র বা নীতিমালা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি, তথাপি তাদের কর্মকৌশল ও কাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযুক্তি ঘটাতে আগ্রহী—তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর এনসিপির উত্থান এক নবতর রাজনৈতিক সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই সম্ভাবনা যেন ধূলিসাৎ হতে বসেছে।"

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা এনসিপি যদি নারী অধিকার প্রশ্নে পশ্চাৎপদ অবস্থান নেয়, তাহলে তা শুধু রাজনৈতিক ভ্রান্তি নয়, আদর্শগত দেউলিয়াত্বও বটে। এই প্রেক্ষাপটে আন্দোলনের অন্যতম নেতা উমামা ফাতেমার বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ:
"জুলাইয়ের পর মেয়েদের সাইডে বসায় দিয়ে এখন রাজনৈতিক পাড়ায় নারী অধিকার নিয়ে সালিশ বসছে! সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন বাতিলের দাবি যারা তুলছেন, তারা কি বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত? সেখানে নারীদের বাস্তব সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু কমিশন বাতিলের দাবি তোলা মানেই নারীর অধিকার অস্বীকার করা। নারীরা ব্যবহারের বস্তু নয় যে, ক্ষমতা সুরক্ষিত হলেই রান্নাঘরে ফেরত পাঠানো যাবে।"

তাঁর বক্তব্যে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে, তা শুধুই নারীর অধিকার নয়, গণতন্ত্র ও প্রগতির প্রশ্নেও জরুরি হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের মোট ভোটারের অর্ধেক নারী। এই জনগোষ্ঠীর অধিকার অস্বীকার করে কোনও রাজনৈতিক দল যদি হেফাজতের মতো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মুখপাত্রে পরিণত হয়, তাহলে তাদের গণভিত্তির প্রশ্নে সন্দেহ থেকেই যায়। হেফাজতের ইতিহাস বলে, তারা মেয়েদের শিক্ষা সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, পোশাককর্মীদের ব্যভিচারী বলে আখ্যা দেয়, এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্র বাতিল করে ধর্মীয় শাসনের স্বপ্ন দেখে।
এই প্রেক্ষিতে এনসিপির অবস্থান যদি হেফাজতের সঙ্গে অভিন্ন হয়, তবে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের জন্য তেমন কোনো স্থানই অবশিষ্ট থাকবে না। বহুত্ববাদী গণমানুষের কাছে গিয়ে ভোট প্রার্থনার কোনো মুখ থাকবে না।

সময় এসেছে, এনসিপিকে তাদের আদর্শ ও দর্শন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। নচেৎ, জনগণ ঠিকই বুঝে নেবে —এরাও নতুন মুখোশে জরাজীর্ণ পুরোনো চেতনারই তল্পিবাহক।

লেখক: সাংবাদিক 
৪ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login