মানাফের চোখে ঘুম নেই গত কয়েক রাত। রাদিয়া—তার ছোট বোন—দু'সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হয়েছে। পুলিশ শুধু রিপোর্ট নিচ্ছে, কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। ইকরি, মানাফের একমাত্র বন্ধু যাকে সে বিশ্বাস করে অন্ধের মতো, পাশে দাঁড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মাঝেমাঝে অদ্ভুত আচরণ মানাফকে ভাবায়।
রাত ২টা। মানাফ আবার সেই একই স্বপ্ন দেখল—একটা পুরনো কাঠের বাড়ি, মেঘলা আকাশ, আর একটা মেয়ের কান্নার শব্দ। ঘামতে ঘামতে উঠে বসে সে, এবার ঠিক করে, যা কিছুই হোক, রাদিয়ার খোঁজ বের করতেই হবে।
তাদের গ্রামের প্রাচীন অংশে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। গ্রামের মানুষ বলে ওখানে নাকি কিছু একটা “আছে”—অদৃশ্য, ভয়ানক, কেবল রাতেই নড়াচড়া করে। ইকরিকে সাথে নিয়ে মানাফ সেখানে যায়। বাড়িটার ভেতরে ঢুকতেই হাড় হিম করা ঠান্ডা, আর একটা গন্ধ—জল মেশানো পচা মাংসের মতো।
হঠাৎ নিচতলার মেঝেতে একটা গোপন দরজা দেখতে পায় তারা। নেমে যায় নিচে। সেখানেই দেখতে পায় রাদিয়াকে—একটা কাঁচের খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে, মুখে তালা মারা! আর তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে… ইকরি!
“সব মিথ্যা ছিল মানাফ,” ইকরি হেসে বলে। “আমি কখনোই তোমার বন্ধু ছিলাম না। রাদিয়াকে ব্যবহার করেই আমি তোমার সত্যিকার রূপ দেখতে চেয়েছি। এই বাড়িটা আমার, আর এখানেই সত্যি আর মিথ্যার খেলা চলে।”
মানাফ বুঝতে পারে, এখন যদি সে কিছু না করে, তাহলে শুধু রাদিয়াই নয়—তার জীবনও শেষ হয়ে যাবে।ইকরি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মানাফের দিকে, হাতে একটা সরু ছুরি। তার চোখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই, আছে এক ধরনের উন্মাদ আনন্দ।
"তোমার মতো মানুষদের মুখোশ ফাটিয়ে দেখানোই আমার কাজ, মানাফ," ইকরি বলে। "তুমি ভাবো তুমি ভালো, সাহসী? না, তুমি একজন দুর্বল ভাই, যে নিজের বোনকেও রক্ষা করতে পারেনি।"
মানাফ পেছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালের গায়ে ঠেকে যায়। হঠাৎ তার চোখ পড়ে একটা পুরনো লোহার রডে। ইকরি ছুরি তুলতেই, মানাফ বিদ্যুৎগতিতে রডটা তুলে আঘাত করে তার হাতে। ছুরি ছিটকে পড়ে যায়।
এক মুহূর্তের সুযোগে সে রাদিয়ার খাঁচার তালা ভাঙতে শুরু করে। হাত কেটে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে থামে না। অবশেষে তালা খুলে যায়। রাদিয়া কাঁপছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে ধড়ফড় করে।
ইকরি আবার উঠে দাঁড়ায়। এবার তার মুখে রাগ নয়, অদ্ভুত এক হাসি—
"তোমরা যেও, মানাফ। আমি আজ হেরে গেলেও, ছায়ার খাঁচা কখনো খালি থাকে না। কেউ না কেউ আবার আসবেই…"
বাড়ির ভেতরে হঠাৎ ভয়ানক শব্দ—কাঠ ভাঙছে, দেয়াল ফাটছে। সব কিছু যেন ধসে পড়ছে।
মানাফ আর রাদিয়া দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। পিছনে তাকিয়ে দেখে, ধুলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ইকরি আর সেই বাড়ি।
তারা বেঁচে গেছে। কিন্তু মানাফ জানে, সব শেষ হয়নি।
সেই রাতে তার ফোনে একটা অজানা নাম্বার থেকে একটা মেসেজ আসে—
"ছায়া কখনো মরে না।"