Posts

উপন্যাস

"মেটানয়ান"

May 4, 2025

Tahmid Hasan

Original Author তাহ্‌মিদ হাসান

335
View

বডি অফ রিয়েলিটি

মানুষের স্বাতন্ত্র্য নির্ভর করে তার ‘বডি অফ রিয়েলিটির’ অস্তিত্বে। নিজেদের চেতনার সেনসেশানকে যদি আমরা খুব কাছ থেকে বিশ্লেষণ করে বুঝতে চাই, তাহলে তিনটা ধারণা অবধারিতভাবে আমাদের অস্তিত্বকে নির্দিষ্ট করে। প্রথম যে স্তরের বাস্তবতা আমরা ধারণ করি তাকে বলা যেতে পারে ফিজিক্যাল চেতনার বাস্তবতা। মানে যে বাস্তবতা আমরা দেখছি, বুঝছি বা নিজেদের উদ্দেশ্যে তৈরি করছি, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বাস্তবতা। আরেকটু সহজ করে বললে উপস্থিত সত্যের বাস্তবতা।

দ্বিতীয় স্তরের বাস্তবতা হচ্ছে সাবকনশাস/আনকনশাস চেতনাকেন্দ্রিক বাস্তবতা। যখন আমরা উপস্থিত সত্যগুলো নিজেদের মস্তিষ্কে স্বপ্নাকারে দেখি, তাকে ‘উইল’ দিয়ে ম্যানিফেস্ট করি। আর প্রকৃতির বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার চিরন্তন সত্যে পর্যুদস্ত হয়ে কোনো আধ্যাত্নিক দর্শন খোঁজের উদ্দেশ্য লাভে তাড়িত হই, সেই সামষ্টিক মস্তিষ্কের বিস্তৃতিকে বলা হয় সাবকনশাস/আনকনশাস চেতনার বাস্তবতা। 

শেষ স্তরের বাস্তবতা হচ্ছে আধ্যাত্নিক বাস্তবতা বা মেটাফিজিক্যাল কনশাসনেস। আধ্যাত্মিকতা চিরন্তন, এর সময় বা টাইম ডাইমেনশানের সাথে আমাদের কী সম্পৃক্ততা তা আমরা ইনহেরেন্টলি জন্মের ন্যারেটিভেই বুঝতে চাই। অথচ এটারনিটির ন্যারেটিভে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। এখানে সবকিছু একসাথে ঘটে। আকাশে মহাবিশ্ব দেখলেই আমরা কিছুটা ধারণা পাই এই সামগ্রিক অস্তিত্বের সত্য। এই চেতনায় আমরা নস্টালজিয়াকে মাপি, ঈশ্বরের দ্বারস্থ হই এবং নিজেদের জন্য শান্তির বা ট্রাংকুইলিটির ন্যারেটিভ তৈরি করি। আমরা স্বর্গ খুঁজি কিংবা অসহায় ‘কোনোজন’ নরকেই শান্তির খোঁজ করে।

মানবজন্মের বিচিত্রতা এই ‘বডি অফ রিয়েলিটি’র সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। “মেটানয়ান” বইটি ফ্যান্টাসিকে ধারণ করা ‘বডি অফ রিয়েলিটি’ কেন্দ্রিক অস্তিত্বের একটা কাল্পনিক সত্য বা গল্পের চেষ্টা মাত্র। আমাদের মস্তিষ্ক সম্বন্ধীয় যত বাঁধার দেয়াল, তাকে এটারনিটির বাস্তবতায় দেখার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আমরা বলি না “যা হয় ভালোর জন্য হয়”, এর অর্থ আমরা নির্ধারণ করি ‘ডিটারমিনেস্টিক’ বা ‘পূর্বনির্ধারিত’ সত্যের আবরণে। আমার নগণ্য চিন্তায় আমি ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করতে চাই ঠিক এভাবে, ঈশ্বর বা গডলি এন্টিটি আমাদের প্রোবাবেল সব বাস্তবতা দেখেই আমাদের বেঁচে থাকার সত্যের জন্য এই ‘জীবন’ ক্ষেত্রের অনুষঙ্গগুলো নির্ধারণ করে দেন। যেই বাস্তবতাগুলো ঈশ্বর বা গডলি এন্টিটি প্রোবাবেল সত্যের আবরণে দেখে আসেন, তার মনুষ্য চেতনার বিচরণে লুপহোলগুলোর মাঝে কেউ নিজেকে কীভাবে আবিষ্কার করে? কীভাবে নিজেকে খুঁজে পেতে পারে?

“মেটানয়ান” বইটি সেই চিরন্তন খোঁজের যাত্রা। বাকিটা পাঠকগণ পড়েই নিজেদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন সেই আশাটাই করছি। 

Preface

গতরাতের দুঃস্বপ্ন 

আমার মাথায় কি নতুন কোনো গণ্ডগোল বাঁধল কি না বুঝলাম না! বাসায় লিফট নাই, সবার সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হয়। আজ এক কাজে তিনবার নিচে নামতে হইছে, বেসিনের কলটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি নিজেই সমাধান করি এই সমস্ত খুচরা সমস্যা। প্রতিটাবার নামবার সময় তিনতলায় একটা আপুকে ক্লান্তিহীনভাবে উপরে উঠতে দেখছি। আমি যখন উপরে উঠতেছিলাম, তখন কোনো কারণে তাকে দেখি নাই। হ্যাঁ, হইতে পারে ব্যাপারটা কাকতালীয়। সাততলা বিল্ডিংয়ে আমাদের বাসা পাঁচতলায়। আমি উপরে উঠবার সময়, তিনি হয়ত আমার বাসার উপরে অবস্থান করতেছিলেন। নামবার সময় তিনি নিচ থেকে উপরে উঠতেছিলেন। তার সাথে আমার কখনো কথা হয় নাই, তিনি কি এই বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা কি না তাও বলতে পারব না। এখানে কিছুদিন পরপর নতুন ভাড়াটিয়া ওঠে, তাই সবার সাথে চেনাজানা থাকে না। 

এই মেয়েটার একটু গাটুশগুটুশ শরীর, চোখ নামায়ে যাচ্ছিলেন প্রতিবার। আমার তার সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। যেহেতু নিজে একই কাজ করতে তিনবার নামছি আর তাকে একই জায়গায় তিনবার দেখছি, আমার সন্দেহ হচ্ছে আমরা একটা টাইম লুপের ভেতর আটকে গেছি। টাইম লুপ না হইলেও সিনক্রোনিসিটি যে ঘটছে তা বলাই বাহুল্য। কোনো এক আর্টিকেলে পড়েছিলাম, দুইটা অসম্পর্কিত ঘটনা পাশাপাশি অবজার্ভারের কাছে একটা অর্থবহ অভিজ্ঞতা তৈরি করলে তাকে না কি সিনক্রোনিসিটি বলে। ইউনিভার্সের সূক্ষ্ম চক্রান্তগুলো না কি এমন উদ্ভট ল্যান্ডস্কেপে ধরা পড়ে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে তেমন বৈশিষ্ট্য আমি খুঁজে পাই না, যদিওবা অনেক অদ্ভুত ঘটনাই আমার জীবনে ঘটছে। আপুকেও তেমন ক্যারেক্টার মনে হইল না। খুব সাধারণ দেখতে ভুলে যাবার মতন বেশভূষা। অবশ্য, নট নেসেসারিলি সবার তাক লাগানোর মতো এপিয়ারেন্স থাকতে হবে বিশেষ কিছুর জন্য। যাই হোক, আমাদের যোগাযোগ হওয়াটা জরুরি। আমি তার জন্য অপেক্ষা করব। মাথায় গন্ডগোল ছুটাইতে না কি বাঁধাইতে অপেক্ষা করবো তা ভাবতে যেয়েই গিট্টু লেগে যাচ্ছে।   

ঘুম থেকে উঠেছি দেরিতে, লাঞ্চ রেডি করে খাইতে যেয়ে সময় গড়ায়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভাবতেছিলাম এক্সবক্সে গেম খেলে আরও কিছু সময় নষ্ট করবো, ভাল্লাগতেছে না। অদ্ভুত কিছু মাথায় ঢুকে গেছে তো, এখন তার উদ্দেশ্যে ধাওয়া দিতে ইচ্ছা করতেছে। আমার প্রবলভাবে মনে হয়, আমি বেশ দ্রুত উন্মাদের কাতারে চলে যাব। আমার চারপাশের সকল ঘটনাসমূহ ম্যানুফ্যাকচারড হইতেছে এই উপসংহারে পৌঁছাবার জন্য। উপসংহার কেবলই উপসংহার না, একটা নতুন বাস্তবতা তৈরিতে তার অবদান শিরোধার্য। এমনও হইতে পারে, আমি বেকার দেখে এতশত উদ্ভট চিন্তা করি। জীবনকে খুব সাধারণ চোখে দেখলে ভালো উপায়ে ব্যস্ত থাকা যায় না। এসব কিছুই না, আমার ইউনিভার্সের মিডিয়ামশিপে প্রচণ্ড আস্থা, ভাবতে ভালো লাগে আমি নিজে তেমন একজন- আমার খুঁজে পাইতে ভালো লাগবে এমনই একজন। কেমন বাংলা সিনেমার লিরিকের মত এক্সপ্রেস করলাম নিজেকে, ধুর! 

বেশ কিছুদিন বিকালে বের হওয়া হয় না, এলেবেলে ব্যবস্থায় সময় চলে যাচ্ছে। আজকে তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছু একটা করতে হবে এমন প্রস্তুতি মাথায় অটো সেট হয়ে থাকে, এজন্য অস্থির অস্থির লাগে। যাই করতে যাই, আনন্দ খুঁজে পাই না। বারান্দায় যেয়ে আরামসে সিগারেট ফুঁকে কতক্ষণ নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া যায়? আড্ডা দিতে যাই না, কেমন একটা প্রতিযোগিতা চলে বন্ধুদের ভেতর সারাটাক্ষণ। ওদের হেলদি মনোভাবে নিজেকে মিশাইতে পারি না। পেছনে ফিরে তাকাইলে এই সময়টাকে আমার অপারগতার আখ্যান বলে সংজ্ঞায়িত করবো নিশ্চয়ই। ভলান্টারি কাজ খুঁজতে হবে, সময়টা কাটে তাতে। কিন্তু বয়সের ডিমান্ড তো চাকরি, কোনো জায়গা থেকে রেসপন্স পাচ্ছি না। কি যে অসহ্য লাগে! 

আচ্ছা আমি মনোটোনাস চিন্তা বারবার ক্যান করি? দে সে যে আপুটা এখনো সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতেছে, হা হা। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে তার ব্যাপারে খোঁজখবর করা যাইতে পারে। কিন্তু আমার তাকে ক্যান এত অদ্ভুত চরিত্র মনে হচ্ছে? সিঁড়ির ক্ষেত্রফলের কারণে? বাস্তব এত ইন্টারেস্টিং না কি, বিশেষ করে বেকারদের বাস্তবতা? বাস্তব ইন্টারেস্টিং না কি অন্যকিছু জানি না। ঠিক এইমাত্র আমার চোখের সামনে, এই বারান্দাটার সামনে দিয়ে উপর থেকে কেউ একজন ঠাস করে নিচে পড়ে গেছে। হৃদয় নিস্তব্ধ করে দেয়ার মত শব্দ হইল একটা, এটা মানুষ বোমার শব্দ ! সুইসাইডের বিচ্ছিরি জীবন ঘড়ি থামায়ে দেয়ার শব্দ।

না, আমি ভুল দেখতেছি না। ঐ আপুটার মাথা নিচে থেঁতলে পড়ে আছে। রক্ত তার টগবগে ঘোড়ার মত ফুঁসে ফুঁসে বের হচ্ছে। ঠিক একই স্রোতে মানুষ জড়ো হচ্ছে। আতঙ্ক আর কৌতূহল মিশে সেখানটায় যাচ্ছেতাই অবস্থা। একটু পর সবকিছু আমার সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আমি পৃথিবীটাকে জানতে পারবো না। 

এই মেয়েটা কি তখন তিনবার চেষ্টা করে সুইসাইডের সাহস সঞ্চয় করতে পারে নাই? হয়ত রেলিং এর কাছে যেয়ে ফেরত চলে আসছিল। আমি যতবার তাকে দেখে নামছি ততবার সে মরতে চেয়ে উপরে উঠতেছিল? কি আজব!  উনি মরে যেয়ে কি প্রুভ করছেন জানি না, আমাকে হাস্যকর বানায়ে ফেলছেন। আমি জানি না এখন কি করব, প্রচণ্ড কান্নার শব্দ শোনা যাইতেছে। এই অবস্থা থেকে বের হইতে হবে, বাসায় থাকা যাবে না। হাস্যকর টাইম লুপের সিঁড়িটা এখন নিউজ পোর্টাল। পাশের বাসার মানুষ তার পাশের বাসায় খবর পৌঁছাইতেছে। আমি ঠিক তখনকার কায়দায় নিচে নামতেছি, কোনো পরিবর্তন নাই। 

মনে ছবি ভেসে উঠতেছে সকালবেলার, দুপুরবেলার। চাইতেছি ক্ষমতা খাটায়ে মেয়েটাকে আবার সিঁড়িতে তুলে আনতে। সে উঠতে থাকুক, বারবার ব্যর্থ হইতে থাকুক। মৃত্যু যেন বারবার ব্যর্থ হয়। মৃত্যু বারবার ব্যর্থ হইলে সোসাইটি তো জিতে যায়, হয়ত কোনোভাবে মানবতাও জিতে যায়। সোসাইটি ধন্য ধন্য করে মৃত্যুকে উদযাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যার মৃত্যু হবে তার জীবন হইতে হবে আকর্ষণীয়-পরম কিছু। যার একটা মুহূর্তে সবকিছু হারায়ে যায়, যে জানে সে আর ফিরে আসতে পারবে না-তার জন্য আমাদের স্থায়ী অবিশ্বাস; ক্রমশ ক্ষয় হইতে থাকা দুঃখ, সভ্যতা, মানবতা সবকিছুকে পরাস্ত করে আমরা মহাসুখে নিদ্রা উদযাপন করি! 

ঠিক এই মুহূর্তে বেঁচে থেকে কি হবে জানতে ইচ্ছা করতেছে। পরমাত্নীয়রা, বন্ধুবান্ধবরা শুধু সোসাইটিতে আমাকে ঘিরে সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করবেন। ছেলে-মেয়েদের জন্য একই ব্যবস্থা-বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে চাইবে তারা, এসবে আমার সত্যি কি যাবে আসবে? আমি কি জীবনের প্রতিটা অন্তরঙ্গতায় এই প্রশ্নগুলো থেকে পালাইতে পারবো? মানুষ হয়ত আমাকে স্যাডিস্ট বলবে, আমার এই ধরাবাঁধা অস্থিরতা থেকে মুক্তিটা পর্যন্ত নাই। তাহলে কেন এত ‘বেঁচে থাকা’ ‘বেঁচে থাকা’ করা?   

এখন রাত হইছে। আমি যে জায়গাটায় আছি তাতে নিরাপত্তা নাই, যখন তখন যে কেউ এসে আমার ক্ষতি করে দিয়ে যাইতে পারে। আমার সঙ্গ নিরাপত্তায় জর্জরিত কিছু প্রশ্ন আর রেলওয়ের সিকিউরিটি গার্ডের হুইসেল। ওরা এই ঘুণে ধরা ব্যবস্থাকে নিরাপত্তা দেয়াতে বদ্ধপরিকর দেখে আমার হাসি পায় ! মানুষ তো নিরাপত্তার অভাবেই অপরাধ করে। রাতের দুষ্কৃতকারীরা নিরাপত্তার অভাবে সংঘবদ্ধ, ওদের বেঁচে থাকার রসদ অপরাধের চাহিদা। এই গোটা সিস্টেমটা একটা অদৃশ্য ধূসর দানব। সাদা-কালোয় মেশানো মানুষের ডিজায়ার হজম করতে করতে দানবটা পঁচে যাচ্ছে, যেদিন মরে যাবে সেদিন আমরা সব রং আলাদা করতে পারবো। আমার মতো অজস্র সুপ্ত হুইসেলব্লোয়াররা অপেক্ষা করতেছে সেই ইউটোপিয়ার জন্য।               

একটা মৃত্যু, একটা শহর যার মাঝে একটা রেললাইন এঁকেবেঁকে যেয়ে প্রত্যেক মুহূর্তে আমার দুঃসংবাদ ফেরি করতেছে। শান্তিনগরের প্রতিবেশি আত্নাকে আমি  এখানে টেনে নিয়ে আসছি। সে সবাইকে বলে গেছে গোপনে কোথাও বেড়াইতে যাইতে চায়, তাকে ঘিরে আমার একরাশ উৎকণ্ঠা- নতুন জায়গাটায় তার জন্য শান্তির ব্যবস্থা আছে তো? না থাকলে আমার ওয়েসিসে সে যেন আসে, হয়ত আমরা বাতাসের সাথে কথা বলা শিখবো, হয়ত আমরা আঁধারের জমিতে বাগান করবো, অনেক গান একসাথে গাবো, হয়ত অনেক সুর আনন্দে আনন্দে নষ্ট করবো। জোছনা রাত্তিরে আকাশ থেকে আমাদের জন্য পেগাসাসের পাল ছুটে আসবে। 

আমার অমন্ত্র এই কুশ্রী মন খারাপের রাতে সার্থক। একটু দূরে রেললাইন দিয়ে এদিকে একটা ঘোড়াকে আগাইতে দেখা যাচ্ছে। সাদা ঘোড়া, এই ম্রিয়মাণ আলোতে রুগ্ন-ভগ্ন অবস্থায় পিঠে যেন কালো পর্বত বয়ে নিয়ে আসতেছে। রাতের কারণে চোখের দীপ্তি নিভে যায় নাই, সবুজাভ দ্যুতি, জ্বলজ্বল করতেছে। ওর হয়ত ধারণা আমার কাছে খাবার আছে, নয়তো কিছু করতে পারবো ওর জন্য। দেখা যাক কি হয়। একটু দূরে সবজির আড়ত আছে, ও এখানে আসলে একসাথে যেয়ে ওর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবো। 

অবাঞ্ছিত ঘোড়া, আমাদের এই আজব দেশে বেশিরভাগ ঘোড়ার মালিকেরা দরিদ্র, ওরা ঘোড়া পালে আয়ের উদ্দেশ্যে। সময়ের বাস্তবতায় ঘোড়ার ঐতিহ্য এখন মৃতপ্রায়, পুষতে না পারবার অপারগতায় ঘোড়াটাকে হয়ত ছেড়ে দেয়া হইছে এই করুণ শহরে। বেচারা একদিন ধুঁকে ধুঁকে মরে পড়ে থাকবে কোথাও, আমরা তার লাশ সরাইতে যেয়ে হুলস্থুল করবো। 

কি আশ্চর্য, ঘোড়াটা পুরাপুরি ইকুইপড। স্যাডেল, স্টিররাপ, হল্টার সবই গায়ের সাথে বাঁধা। আমার একদম সামনে চলে আসছে এখন, ওর চোখের ভাষায় সাহায্যের আবেদন। আমি সামনে আগাই, নিশ্চয়ই পিছে পিছে আসবে। না ঘোড়াটা সামনে এসে পথ আটকাইল, চায়টা কী? বেচারাকে ইগনোর করতে পারতেছি না, শব্দ করতেছে, গলার স্বরে কাতরতা আছে। হাঁটার পথ আটকায়ে স্টিররাপের দিকে ইঙ্গিত করতেছে। পিঠে উঠি এটাই কি চাইতেছে? সম্ভবত ! এই আঁধারে আমি ঘোড়ার পিঠে উঠে কি স্বপ্নলোকে যাব? হাহা ! আমার তো তাই  মনে হচ্ছে ! অদ্ভুত দেখাক বা যাই দেখাক আমি ঘোড়ার পিঠে চড়বো। ঘন রাত্তিরে ঘোড়ার পিঠে করে ঘোরাফেরা কয়জনের সৌভাগ্য আছে? এর আগে কখনো ঘোড়ার পিঠে চড়ি নাই। স্যাডেল ধরে স্টিররাপ বেঁধে আমি উঠলাম, বেশ এক্সপার্টের মতই উঠলাম। ঘোড়াটা আপনা-আপনি যেদিক থেকে আসছে ঠিক সেখানে চলা আরম্ভ করলো, ঐ জায়গাটা পুরাটা অন্ধকার। আমি কিছুই ঠিকমতো দেখতেছি না। 

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে আমরা রেললাইন ধরে আগাচ্ছি, আগে পিছে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নাই, কোনো মানুষ নাই। ঘোড়াটা আস্তে আস্তে দৌড়াচ্ছে, রেললাইনের পাথরে ওর ক্ষুরের শব্দে একটা অতিপ্রাকৃতিক মূর্ছনার সৃষ্টি হইছে। ভুল শুনতেছিলাম না কি জানি না, দূরে কোনো এক জায়গা থেকে বাঁশির সুরও ভেসে আসতেছিল। মন আমার অস্থির হয়ে গেছে, সাবধান করতেছে বারবার। ঘোড়াটাকে লাইন থেকে সরাইতে হবে। যেকোনো সময় ট্রেন চলে আসতে পারে, একটু নিচে পাশেই রাস্তা করা। আমরা রাস্তায় যেয়ে চলি না ক্যান? 

ট্রেনের হুইসেল শোনা যাইতেছে। পেছন থেকে ট্রেন আসতেছে, আমাদের সরতে হবে। কিন্তু ঘোড়াটা সরতে চাইতেছে না, বেশ খানিকটা উপর থেকে নিচে নামতে দ্বিধা করতেছে। হল্টার টেনে ওর মাথা বাঁয়ে রাস্তার দিকে ঠেলার চেষ্টা করতেছি, কি জ্বালা ! একগুঁয়ে ঘোড়া কিছুই শুনতেছে না, ওদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে? এদিকে ট্রেনের শব্দ আস্তে আস্তে বাড়তেছে, প্রায় কাছাকাছি চলে আসছে। আমি কি নেমে যাবো ওর পিঠ থেকে? আররে ! শালা দৌড়ানোর গতি বাড়ায়ে দিছে। লাফ দিয়ে এখন নামতে গেলে হাড্ডিগুড্ডি ভাঙবে নির্ঘাত, তাও ট্রেনের নিচে পড়ে লাশ হয়ে যাবার চাইতে ভালো। ট্রেনটা বোধহয় আর চল্লিশ ফুট দূরত্বে আছে। আমার মাথা কাজ করতেছে না। এই ঘোড়া কি নরক থেকে আসছে না কি? কিছু না ভেবে আমি ঝাঁপ দেবার জন্য প্রস্তুত হই, জানি মুহূর্তের মধ্যে লাশ হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কিছু হবার নাই, স্টিররাপে পা আটকে গেছে। নাহ্‌, এই পর্যন্তই আমার যাত্রা। খারাপ লাগতেছে শেষ মুহূর্তে সুন্দর কোনো স্মৃতি মনে করতে পারবো না। মৃত্যু কাউকে একদমই সময় দেয় না। কাউকে জড়ায়ে ধরতে ইচ্ছা করতেছে…ট্রেনের কর্কশ হুইসেল শেষটা একঘেয়ে করে ফেলতে চায়, আমি সামনে হেলে কোলবালিশের মত ঘোড়াটার গলা জড়ায়ে ধরলাম। ঘোড়াটা দাঁড়ায়ে গেল, যেন ওর দায়িত্ব শেষ।

ট্রেনটা লাইন চেঞ্জ করে পাশ দিয়ে ছুটে গেল দুই মিনিট আগে। আমি বিশ্বাস করবার জন্য সময় নিতেছি। একদম পারফেক্টলি রেইলওয়ে সুইচের কাছে এসে থামছি আমরা অথবা ঘোড়াটা দ্রুত দৌড়ে এসে এখানে থামছে। আমার হৃৎপিণ্ডের গতি কমে আসতেছে তারপরও। জানি না কি ঘটতেছে আমার সাথে। অবশ হয়ে গেছি। ঘোড়াটা আরেকটু সামনে যেয়ে দুই লাইনের মাঝে যেয়ে থামছে, পাথরের উপর তরল কিছু লেগে আছে, হয়তো রক্ত। পাশের লাইনে কেউ পড়ে আছে, সাদা ফ্রক পড়া একটা মেয়ে!

স্টিররাপ থেকে আমার পা ছুটে গেছে, ঘোড়াটা চার পা ভাঁজ করে বসে পড়ল, যেন আমি নামতে পারি। আমার মাথা কাজ করতেছে না, যা বুঝতেছি হয়তো ঘোড়াটা এই মেয়েটার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে আসছে। পাথরের উপর পা ফেলে দেখি হাঁটু কাঁপতেছে। কোনোভাবে সোজা দাঁড়ায়ে থাকতে পারতেছি না। আমি পড়ে গেলাম, মেয়েটার পাশে যেয়ে শরীরকে ধরে রাখতে না পেরে পড়লাম। মেয়েটার চেহারা আমার খুব চেনা। 

আমার স্বপ্নের সত্তা, আমার গোপন সত্তা যার চেহারা বাস্তবে দেখবো বলে ভাবি নাই, সে আমার দিকে তীব্র হাহাকারে তাকায়ে আছে। ওর কপাল ফেটে রক্ত ঝরতেছে। মনে হচ্ছে আমরা দুইজন শূন্যের উপর ভেসে আছি, নিচে কোনো পাথর নাই, মাটি নাই। দুইজনের পায়ের কাছে মাথা খারাপ ঘোড়াটার চোখ দিয়েও রক্ত অশ্রু ঝরতেছে। সবার ফোঁটাগুলো একসাথে ঝরে টুপ টুপ বৃষ্টির মত শব্দ করতেছে। সবচেয়ে আপন মেয়েটা আমাকে কিছু বলতে চাইতেছে। “আমাকে বাঁচাও, আমি এই পৃথিবীতে আসতে চাই নাই,” বলে ওর চোখ স্থির হয়ে গেল, ঠোঁট থেমে গেল। খুব কাছে যেয়ে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চাইলাম, সেখানে প্রাণ নাই। মুখের ভেতর থেকে গাঢ় অন্ধকার বের হয়ে ওকে গিলে ফেলতে চাচ্ছে, সম্ভবত আমাকেও। 

যা দেখলাম, যা দেখতেছি সব স্পষ্ট দেখতেছি। যা ঘটতেছে সত্যি সত্যি ঘটতেছে, অনন্তকাল ধরে ঘটতেছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনো মূল্য নাই এখন। সময় যত গড়াচ্ছে মেয়েটার চেহারা, আকার সব পরিষ্কার হচ্ছে। হ্যাঁ, ও রোদেলাই, যার নাম আমি অনেক পরিচয়ের পরে ঠিক করছিলাম। আমার দিকে শেষ যেভাবে চেয়ে ছিল বা এখনো আছে তাতে স্পষ্ট বুঝতেছি আমাকে ও জানতো, আমার উপর আস্থায় তার অভ্যাস ছিল ! আরও কিছুক্ষণ পর ঘোড়াটা চলে গেল, রীতিমতো অদৃশ্যই হয়ে গেল। কয়েকটা ট্রেন এসেও রোদেলার উপর দিয়ে চলে গেল, ওর হাতের একাংশ, পায়ের নিচটুকু তাতে আলাদা হয়ে গেল। রক্ত ছিটে এসে আমার মুখ ধুয়ে দিল, যেন আমি ঘুমাইতে না পারি - জিভে যেন ঘটনাটার স্বাদ লেগে থাকে !  ভোরের বিষাদ আভায় শরীরের টুকরা টুকরা খণ্ডাংশ দেখে আমি পরিষ্কার হইতে চাচ্ছি আমাদের অস্তিত্ব আছে কি না, থাকলেই বা তা কীভাবে কোনো অস্তিত্ব হয়?

মৃত্যুময়তায় যেহেতু পুরা রাত থেমে ছিলাম, তাই ভোর অন্য কিছু জানায় নাই। পড়ে থাকা লাশের সত্যই সে আমাকে প্রজেক্ট করতেছে। এই সত্য শুধু আমার জন্য, পুরা সময়টায় আর কেউ আসে নাই। মৃত্যুর ঘেরাটোপে বা লুপে একদিন বাঁধা পড়ে ছিলাম, কোনো রহস্যের খেলায়, উপলব্ধি হইল। অচল নিষ্প্রাণ অবস্থা থেকে যখন বসতে পারলাম আমার মনে হইল আমি আরেকটা পৃথিবীতে প্রবেশ করলাম। উঠে দাঁড়াবার পর যখন হাঁটতে পারতেছি আমার মনে হচ্ছে, আমি না, অন্যকেউ হাঁটতেছে……

ঘুমানোর পর আমি সম্ভবত সত্য দেখবো, বাস্তব দেখবো।                   

                       

স্বপ্ন আমার দুই হাত ধরে আব্বুর পায়ের উপর পা রেখে হাঁটাইতে হাঁটাইতে সত্যের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। আমি হাঁটতে পারি না, তাই স্বপ্ন আমাকে সাহায্য করতেছে। অবশ্য আব্বুকে দেখতে পাই না, স্বপ্ন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতেছে- আমি বামুন হয়ে গেছি তার রাজ্যে। সামনের পরিবেশ বলতে একটা আস্ত ভয়েড, প্রচণ্ড শীতল। এখান থেকে সব অস্তিত্ব শুরু হয়ে এখানেই শেষ। আমার অনেকদিন এখানে থাকতে হবে, এটা পূর্বনির্ধারিত। একটা মহা মহা পরিচয় দেখা দিবে আলোর আয়োজনে, ভয়েডটা এত আলো শুষে নিতে পারবে না। ও এই পরিচয় ফ্রেমে ধরে রাখবে কিছুক্ষণ, আমাকে এখানে নিয়ে আসা হইছে এই মুহূর্তটা দেখবার জন্য। আমি সবচাইতে ইন্টিমেট স্মৃতি বহন করে পায়ে পায়ে ভর করে এইখানটায় চলে আসছি। আমার কিছু প্রশ্ন আছে, এইখানে উত্তর পাওয়া যাবে।

“এখানে কারা আসে?” দুইটা কণ্ঠ স্বপ্নে কথা বলে, ‘যেন’ আর ‘কারা’। আসলে অবজার্ভ করে, অনেকটুকু নিজেরা জেনে তার থেকে অল্প কিছুটা জানায়ে ওরা মিলায়ে যায় চোখ খুললে। ওদের কেবল স্বপ্নে মনে করতে পারি আমি, তবে ওরা আমাকে সবসময় দেখে আসতেছে, এমনটাই মনে হয়! এখন কিছু বলতেছে না, অবশ্য ওরা হুট করে কিছু বলে না। সময় নেয়, আমি প্রস্তুত কি না বুঝতে চায়।

“তুমি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রস্তুত হবে।” বলল ‘কারা’।

“কিসের প্রস্তুতি?”

“মেল্টিং লাইনে পৌঁছাবার প্রস্তুতি। আমাদের তোমাকে দরকার।”

“তোমরা কারা?”

“এই কথা শুনবার অপেক্ষায় ছিলাম, এত এত ইন্টারেকশানে তুমি আমাদের এই কথা জিজ্ঞেস করো নাই। আমরা ছুটে বেড়াই। তুমি বলতে পারো আমরা আদিম প্রাণ, অবশ্য প্রাণ বলতে তোমরা যা বোঝো আমরা ঠিক সেরকমটা না, আমাদের উপস্থিতি আকার দিয়ে সংজ্ঞায়িত না।” 

“তোমরা বিমূর্ত? এক্সপ্রেশান?”

“না, ঐ যে বললাম, তোমরা সংজ্ঞায়িত করতে যেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেল। এই গ্রহে আমাদের উপস্থিতি হতে পারে ঈশ্বরের ধারণার মত, তবে আমরা তা না। তোমাদের নিয়ে আমাদের আগ্রহ আছে।”

“এতদিন তোমরা ছিলে না?”

“তোমাদের ভবিষ্যতে আধ্যাত্নিকতার নতুন কনসেপ্ট দরকার। তবে আমাদের সবাইকে প্রয়োজন নাই। আমরা ছিলাম কি না তা হাস্যকর প্রশ্ন, আমরা সবসময় থাকি, তোমাদের ভাষায় বলতে গেলে সবসময় থাকবো।”

“তোমরা ওমনিপ্রেজেন্ট?”

“হ্যাঁ, তোমাদের চেতনায়। বলতে পারো আমরা ক্রিপ্টো এনটিটি। এই মহাবিশ্বের প্রয়োজনে আমরা আপাতত এভাবে পরিবর্তিত।”

“তোমরা ভয়েড? ভয়েডে প্রাণ আছে?”

“ভয়েড আমাদের একধরনের গেইটওয়ে বলতে পার। তোমরা যেমন মহা উদযাপন করতে চেতনায় স্বর্গ তৈরি কর, আমরা উদযাপন করতে এখানটায় আসি। তোমাদের উদযাপনের সাথে আমাদের পার্থক্য হচ্ছে, আমরা পরিচয় ছেড়ে যাবার উদযাপন করি।” 

“উদযাপনে কি তোমাদের ওমনিপ্রেজেন্স বিলীন হয়ে যায়?”

“বলা যায় অনেকটা তাই। আমাদের মাঝে কেউ কেউ চেতনা বিসর্জনে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়। ওরা শেষবারের মত ভয়েডগুলোয় আলো জ্বেলে হারিয়ে যায়, মেল্টিং লাইনে কনশাসনেস প্রিজার্ভ করে হারিয়ে যায়। ইউনিভার্সে ঘোস্ট ম্যাটেরিয়াল হিসাবে ওরা অনন্তকাল কোনো কিছুকে কেন্দ্র না করে অরবিট করতে থাকে। অনেকটা ভূত-অভূত লক্ষ-কোটি প্রাণের সাক্ষী বহন করা উল্কার মতো, কিন্তু ওদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের প্রোগ্রামে ওরা ধরা পড়ে না, আমরা ওদের তারপরও খুঁজি, যেভাবে তোমরা মৃত প্রিয়জনকে খোঁজো। তোমাদের প্রতি আমাদের আগ্রহ সেই কারণেই, আর আমাদের ক্ষমতা আছে।”

“হ্যাঁ, আমাদের ক্ষমতা নাই কিন্তু তোমরা আমাকে খুঁজে বের করলা ক্যান?”

“তুমি ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি করতে পারো। তোমার আকাঙ্ক্ষার ডাক ভিন্ন মাত্রায় পোঁছায় এবং আমাদের প্রোগ্রাম তা ধরতে পারে। তোমার অরায় ভয়েডের এনার্জি দৃশ্যমান।”

“আমি ফোর্থ ওয়াল ভাঙতে পারি?” 

“হ্যাঁ।”

“মেল্টিং লাইন কি?”

“এক গন্তব্য থেকে পরের গন্তব্যে যাবার রাস্তা। তোমার ক্ষেত্রফল এখানে টেনে নিয়ে আসবে তোমাকে, কিছুদিন অপেক্ষা করো।”

“আমার বাস্তবতা জঘন্য, তোমরা কি আমার জন্য কিছু বদলাইতে পারবা?”

“আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, তুমি মৃত্যু নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। মৃত্যু শেষ অবস্থান না, তুমি অসীমতা অবলম্বন করো।” 

“এটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।” ওরা বিড়বিড় করে কিছু বলতেছে, পরিষ্কার শুনতেছি না।

“মানুষের ইতিহাসই ষড়যন্ত্রের, ইউনিভার্সের প্রচণ্ড কমপ্লেক্স একটা ঘটনা তোমরা। যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছো, যুদ্ধ করে ভবিষ্যতে টিকে থাকবে। অসীমতার মাপকাঠিতে বরঞ্চ তোমরা একটা সমস্যা, একটা ষড়যন্ত্র !” 

“তোমরা এই সমস্যা ঠিক করতেছো না ক্যান? আমার ধারণা তোমরা চাইলেই পারো।”

“আমরা অরগ্যানিক এভল্যুশনকে ডিস্টার্ব করি না।”

“তোমরা ছুটে বেড়াও কি কারণে?”

“রিয়েলিটি তৈরি করতে, আমরা সুপারডিটারমিনেস্টিক। বাকিরা যেন আমাদের হয়ে বিশেষ খেলাটা খেলতে পারে, আমরা সেই খেলার ক্ষেত্র তৈরি করি।”

“হ্যাঁ, আমি ভুলে গেছিলাম তোমরা ওমনিপ্রেজেন্ট সত্ত্বা। আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবা?”

“আমরা জানি তুমি কি চাও। রোদেলা মেয়েটাকে বাঁচাতে চাও, তুমি চাচ্ছো তোমার হয়ে আমরা যেন তোমার রিয়েলিটিটাকে রিকন্সট্রাক্ট করি।”

“সেটা কি সম্ভব?”

“তাতে আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক হয় না।”

“আমি তোমাদের জন্য কিছু করলে তখন কি সম্ভব?”

“পুরোপুরি সম্ভব না, তুমি যদি আমাদেরকে তোমার বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করতে দাও তবে কিছুটা সম্ভব।”

“এতে কি কারও ক্ষতি হবে?”

“হবে।”

“আচ্ছা আমি বুঝলাম না, তোমরা কি অলরেডি আমার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে বসে নাই?”

“আমরা এই যোগাযোগটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“তোমরা অপেক্ষা করো কীভাবে? অপেক্ষার ধারণা তো তোমাদের ক্ষেত্রে খাটে না।” ওরা বিড়বিড় করতেছে আবার। নিজেরা কিছু ডিসাইড করতেছে। 

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, বামুনের কালো জগত নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার কাছে অসহ্য লাগতেছে। ওরা থেমে গেছে, কিছু জানাচ্ছে না। শেষটায় মিথ্যা বলতেছিল, স্বপ্নে আমি সুবিধা করতে পারতেছি না। তবে কোর কনশাসনেস আমার সাথে আছে, আব্বু এখনো হাত ধরে রাখছে। ঘুম থেকে উঠে আমি স্বাভাবিক থাকতে চাই। আমার সামনে ‘যেন’ আর ‘কারা’ রোদেলার কয়েক খণ্ডের শরীর প্রজেক্ট করতেছে, ভাঙা আয়নাতে। ওরা যন্ত্রণার ব্যবস্থা ক্যান করতেছে আমার আইডিয়া হচ্ছে না। নিজের ইচ্ছায় জেগে উঠতে পারবো কি না আমার সন্দেহ হচ্ছে।

“অনিম এটাই সত্য, আমরা দুঃখিত!” দুজন একসাথে বলে উঠল। স্বপ্নেও আমার চোখ বুজে আসতেছে। আমি অশ্রু চাই, আব্বু কাঁধে হাত রাখল। সে হাত ছেড়ে দেয়াতে কি না জানি না, আমি সমস্ত ভার নিয়ে ভয়েডের অন্ধকারে মিশে গেলাম।

                                                                           

প্রত্যেকটা পত্রিকা কিনে গতরাতের ঘটনাটা খুঁজলাম, কোথাও পাইলাম না। অনলাইনে পোর্টালগুলোয় খুঁজলাম, পাইলাম না। মগবাজারের সেই রেলপাড়ায় যেয়ে খোঁজ নেয়া ছাড়া উপায় নাই। আমি মুখে কিছু তুলতে পারতেছি না, মনে হইতেছে কিছু খাওয়ার সাথে সাথে রক্ত গিলে ফেলব। ধ্যান ধরে মনকে শান্ত করবার জন্য যতবার নিজের নদীটার কথা মনে করবার চেষ্টা করছি, কারবালার ট্র্যাজেডি রূপকের মত ধরা দিতেছিল- নদীর পানি ক্যাটক্যাটে লাল, লোহিত। যেন আমি একটা মহাযুদ্ধে হেরে গেছি, আমার রাজ্য রক্তে প্লাবিত। 

বন্ধের দিন, শান্ত ভাই দুইটা মুরগি নিয়ে আসছিল, ওদের জবাই দেবার সময় শান্তির জন্য আমার বারবার কবরের কথা মনে হচ্ছিল। মাথার ঠিক নাই, ভাইকে বলছিলাম, “ভাই চলেন, ওদের কবর দেই।” ভাই রসিকতা মনে করে হাসল কিছুক্ষণ, আমার অবস্থা বুঝতে পারে নাই। রাতে টিউশনি আছে, যাওয়া উচিত কি না বুঝতেছি না। গেলে বোধহয় কিছুটা ভালো লাগতে পারে, আমার যাওয়াই উচিত। তার আগে মগবাজার হয়ে যাইতে হবে। 

                   

এলাকাটায় ঢুকবার পর মনে হচ্ছে, এখানে আসাটা ঠিক হয় নাই। যাই ঘটুক বা না ঘটুক ট্রমাকে আমি ফের ডেকে নিয়ে আসছি, স্টুডেন্ট পড়াইতে যেয়ে কি হাল হবে ভেবে কূল পাচ্ছি না। সকালে ফোন করে স্টুডেন্টের গার্ডিয়ান একরকম ধমকই দিছে, গতকাল পড়াইতে যাই নাই। আমার না মনেই ছিল না, সুইসাইড দেখার পর সোজাসুজি কিছু চিন্তা করতে পারতেছিলাম না আসলে। এখন যাইতে ইচ্ছা করতেছে না, যাওয়াটা পুরাপুরি পাগলামির পর্যায়ে পড়ে, কারণ চিন্তার উপর নিয়ন্ত্রণ নাই আমার। আর খালি গতরাতের স্বপ্নের কথা মনে করতে চাচ্ছি, কিছুই মনে পড়তেছে না। আমার বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটে গেছে স্বপ্নে, যার কারণে আমার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নাই। চারপাশে প্রচুর অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে আর আমি আতঙ্কের মধ্যে সবকিছুর ভেতর দিয়ে যাবো। চিন্তা করতে করতে দাঁড়ায়ে গেছি, কেন্দ্রস্থলের কেন্দ্রে এসে উপস্থিত আমি। গোটা জায়গাটা অপরিচিত ঠেকতেছে এজ ইফ আমি কখনই এই জায়গাটায় আসি নাই, এই ছোট কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত পৃথিবীটার সাথে আমার মোলাকাত হয় নাই। সবাই এত অসম্ভব রকমের ব্যস্ত বিভিন্ন কাজে যে আমার মনে হচ্ছে কাউকে যেয়ে লাশের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে তাদের সময়ের অপচয় হবে। আমি যাই চায়ের দোকান খুঁজি, সেখানে মানুষের অলস সময় থাকে।                               

চা খাইলাম তিন কাপ, সাথে সিগারেট। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কি না বুঝতেছিনা। লাশের ব্যাপার তো, যদি আমাকে কোনো কারণে সন্দেহ করে তাহলে কী হবে? এতদূর এসে এই কথা মনে হবার পর নিজেকে কষে গালি দিতে ইচ্ছা করতেছে। আমার পাশে এক ছেলে বসে আছে, পার্টটাইম কামলা মনে হয়। এইদিকে সবজি কাঁচামালের আড়ত, ছেলেটা এখানেই কোথাও কাজ করে। এখন কাজ নাই দেখে বসে বিড়ি খেয়ে আরাম করতেছে। তাছাড়া এলাকায় কি হয় না হয় তার ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা থাকে ওদের। ওকেই জিজ্ঞেস করা যাক, একটু ভেবে নেয়া দরকার কীভাবে প্রশ্ন করবো যাতে আমাকে কোনোরকম সন্দেহ না করে।

“ভাই, এইখানে আশেপাশে কোথাও রেলে মানুষ কাটা পড়ছে? আমি সাংবাদিক, একটা কল পেয়ে আসছিলাম।”

“হ্যাঁ, পড়ছে তো হকালে। টেরেনের একবারে নিচে পড়ছে মাথাটা। হায়রে মানুষ! এই আছে এই নাই!” 

গায়ের লোম দাঁড়ায়ে গেছে। “ছেলে না মেয়ে?” 

“আরে নাহ্‌, হেয় আছে গাঞ্জা খাইয়া চোদ ! মামা কেউ মরে নাই। আমি সক্কাল থেইকা এইহানে।” চায়ের দোকানদার বলল।

“আপনি শিউর?” জিজ্ঞেস করলাম।

“আরে হেয় জানে বাল্ডা ! হালারপো পুলিশ আইছে দেহছ নাই? মামা কাটা পড়ছে একজন।” বুঝলাম না ভাই ! পোলাটা খুব জোর দিয়ে বলতেছে।

“পিনিক চোদাও আমার লগে? তুমি এইহানে আহ কহন, আর আমি আহি কহন? পুলিশ আইল আর আমি দেখলাম না?”

“গাঞ্জা তো লাগে তুই নাশতার লগে মিশায়া খাইছস, নাকি হকাল হকাল বউরে না লাগাইতে পাইরা মাল মাথায় উইঠা গ্যাছে !”

“সাম্বাদিক দেইখা মজা নেওন চুদায়ো না……”

এরা দুইজন ঝগড়া শুরু করছে। আমি কেটে পড়ি ! বাল, কি বিপদ ! সামনে বাজারের দিকে আগাই, দেখি ঐখানে কি বলে। বাজার তো সকালেই বসে, ওদের ঠিকঠাক জানবার কথা।

একই কথা বললাম ওদের, আমি সাংবাদিক ব্লা ব্লা, ওরাও একই কাজ করলো। কেউ বলল মারা গেছে, কেউ বলল কেউ মারা যায় নাই। ওদের জিজ্ঞেস করবার একসময় বাজার করতে থাকা এক ছেলে আমারে বলতেছিল, “এদেখি শ্রোডিঞ্জারের ক্যাট ! বেঁচে আছে একই সাথে বেঁচে নাই। মারা গেছে একই সাথে মারা যায় নাই!” 

আমার মাথা আউলানোই ছিল, নতুন করে আউলানোর ব্যবস্থা হইল আর কি ! রেললাইনের সেই জায়গাটায় যেয়ে লাভ নাই, যেখানে লাশটা পড়ে ছিল সাথে আমিও ছিলাম, কারণ খুঁজে পাবো না। একটা রেলওয়ে সুইচের কাছে ছিল জায়গাটা, কিন্তু এরকম সুইচ এখানে বেশ কয়েকটা আছে। ঘোড়াটা অন্ধকারে কতদূর যেয়ে সেখানে থামছিল তা খেয়াল নাই। এরপর একটু দূরে যেয়ে নতুন পরিচয় দিয়ে ঘোড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম, কেউ বলতে চাইল না, অনেকে পারলো না। শেষে জিজ্ঞেসার জিদ দেখে এক পাগল ভিক্ষুক বলছিল, অনেকেই নাকি একটা দুর্বল সাদা ঘোড়ারে এইখানে মাঝে মধ্যে ঘুরতে দেখতো, তবে যারা দেখছে তারা কিছুদিন পরই মারা গেছে !

আমি কি জাগতিক সব ভয় নিয়ে এই পৃথিবীর কাছে এসে থামছি, না কি পৃথিবী তার নিজের জড় করে রাখা সব ভয় নিয়ে আমার কাছে এসে উপস্থিত হইছে? আমি জানি না !

অনিম আর চেতনা ঈশ্বর

ঘুম ভাঙল ভোরে, একটা তাজা দুঃস্বপ্নের রেশে। চোখের পাতা মেলবার পর থেকেই মাথা ঝি ঝি করতেছে প্রচণ্ড! কিছু কিছু স্বপ্ন দেখলে আমার মাথা ধরে, এই দুঃস্বপ্ন সেই মাথা ধরানোর দুঃস্বপ্ন যার কিছুই মনে থাকে না। যাই হোক, কোন কারণ ছাড়াই সেলফোনে সময় দেখলাম। দেখা আর না দেখা যা সমান কথা।  

কোনো পূর্ব নির্ধারিত সূচি নাই, বেকার মানুষ বলে কথা। সারাদিন হেঁটে ঘুরে শুধু টেনশন কুড়ায়ে বেড়াই। এদিক-ওদিক যাকেই পাই বলে বেড়াচ্ছি একটা চাকরির চেষ্টা করতে। কোনো গতি অবশ্য এখনও পর্যন্ত হয় নাই। গতকাল ফুপুর বাসায় দুপুরে ভাত খাবার সময় নিজের দুরবস্থা নতুন করে বুঝে আসতে হইল। গত কয়েক মাস যাবত ধারণার মাপকাঠিতে রাতদিন জোর মাপতে হচ্ছে কোন কোন বিরহের বন্যায় কতটুকু ভাসতেছি, আর কতটুকু ডুবতেছি । ফুপুর গা-জ্বালানো বাড়তি কথা তাতে কিছু আবেগ যোগ করছিল মাত্র। নিয়ম করে তার বাসায় দিনের বেলা খাইতে যাইতে হয়, আমার মিলের টাকা তাতে কিছুটা বাঁচে। এ মুহূর্তে বাসায় রাতের খাবারের সামর্থ্য শুধু। টিউশনের অল্প কিছু টাকা থেকে এর চাইতে বেশি কিছু আশা করতেও দোষ। টাকার টানাটানিতে গত মাসে শখের বন্ধু সিগারেটটারেও বিদায় জানাইতে হইছিল প্রায়। খরচের হাতের সব জায়গায় সিলগালা দেয়ার চেষ্টা চলতেছে। তিন মাসে তাতে কিছুটা গোছায়ে বাকির খাতা বন্ধ করা গেছে। বাবার কাছে কিছু চাই না, তারপরও মাসের শুরুতে তিনি কিছু টাকা পাঠান। 

এমনি এমনি নিকোটিনের বিষ ছাড়া এই জগতে আর কিছু পাওয়া যায় না। গুণিজনেরা কিছু কথা সত্য বলছেন, “নেশার টাকা আর ডেটের টাকা ভূতে যোগায়।” আমি প্রেমহীন মানুষ, এই পরম সৌভাগ্যে আমি আপাতত আহ্লাদিত। অযথা বাড়তি খরচের কোন প্যারা নাই। তাই বাণীর প্রথম অংশটাই শুধু পরম স্বস্তির। কিছু ভ্রান্ত ধারণা নেশাখোরদের R.N.A তে পেরেক মেরে গেঁথে দেয়া আছে দেখেই, এখনও চিপায় যেয়ে মাঝেমধ্যে দু-চারটা সুখটান দিতে পারি। 

মর জ্বালা! এরে বলে বেকারত্বের অভিশাপ। আকাইম্মা মাথা নিজেরে বিনোদন স্পট বানায়ে পাস্ট-প্রেজেন্টের যাবতীয় কুচিন্তা নন্সটপ করতেই থাকে। আমার মত মিডিওকাররা এত অসহায় ক্যান? এত অসংখ্য আজাইরা চিন্তাগুলো আমাদের মাথাতেই কেন কোন দিগ্বিজয়ী আইডিয়াতে প্রতিস্থাপিত হয় না? আমি নিজের জন্য কোনো আশা দেখি না। কিন্তু ইতিহাস আবার ভিন্ন কথা বলে। পৃথিবীর অসংখ্য কিংবদন্তি এক প্রকারের পুনর্জীবিত হইছেন বেকার জীবনের কলুষতা থেকে। তারা নিশ্চয়ই নির্দ্বিধায় মাথার যাবতীয় অভিশাপগুলোকে আয়ত্তে আনতে পারেন। তাদের দ্বৈতসত্তায় নিজেদের উপস্থিতির চেয়ে বড় অন্য কোনো মেধাবী বসবাস করে। মনুষ্যের ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধতার আবর্তে সেই মেধাবীরা অবলীলায় প্রবেশ করেন এবং স্বপ্নের বিভিন্ন মাধ্যম হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। যেমন আইনস্টাইন আবির্ভূত হইছিলেন থিওরি অফ রিলেটিভিটি দিয়ে অথবা ইলন মাস্ক আবির্ভূত হলেন টেসলা কিনে, স্টারলিংকের অদ্ভুত আইডিয়ায় কিংবা স্পেস এক্সের মঙ্গল জয়ের ঘোষণা দিয়ে।  

বিধি আমার মত মেধাবী বিশেষকে তৈরি করছেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর ফসিল দিয়ে। যার কূলকিনারা করতে করতে আমি হুদা ব্রাশ হাতে নিয়ে পেস্ট না মেখে একটু পরেই সবকিছু এমন-এমনি শুরু হবে জেনে নিতান্তই একটা বেকুবের আকার ধারণ করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়ে আছি। মাথাটা আমার লজ্জা পাইতে বিশেষ ওস্তাদ। এ্যাসোসিয়েশন অফ থটের নিজস্ব শক্তিতে মাত্রই সে গত শুক্রবারের বিশেষ লজ্জার ঘটনা আমারে পুনরায় মনে করায়ে দিছে। তাড়াহুড়ার কারণে সেইদিন বক্সার ছাড়া প্যান্ট পরে পড়াইতে গেছিলাম। মাঝে-মধ্যেই আমি এইভাবে বাইরে যাই। গ্র্যাভিটি সবসময় ফিল করতে ইচ্ছা করে না, আমি চাই স্পেসে ভাসতে। পিচ্চিকে পড়ানোর এককালে বাথরুমে শিশি দিতে যেয়ে খুব সম্ভবত যিপ পুরাপুরি না আটকায়ে বের হয়ে পড়ছিলাম। শালার স্টুডেন্টের পেন হঠাত করে পারফেক্ট কমিক টাইমিং করে নিচে পড়ে গেল আর আমার রিজেনারেটিং প্রোপার্টির কিছু অংশ মান-ইজ্জতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। লজ্জার মাথা খেয়ে ওরে বললাম, “সবারটাই মাটির তৈরি একই বস্তু। আল্লাহ্‌ নিশ্চয়ই তোমার জন্য কোনো ডায়মন্ডের ব্যবস্থা করেন নাই। হাসার কিছু নাই, পড়াতে মন দাও।” ছোট বাচ্চাদের ক্রমাগত মধুর হাসি সবসময় কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা না। আমি জেনে রাখলাম। 

যাই হোক, আটটার কালে বের হইতে হবে। প্রথমে বাস স্ট্যান্ড, এরপর সোজা ধানমন্ডি, জালাইল্লার অফিসে। হারামজাদা ওর অফিসে চাকরির ওপেনিং আছে বইলা দুই মাস চক্কর কাটাইতেছে। খারাপও অবশ্য লাগে না তেমন। দশটাকা বাসভাড়া দিয়ে যাই আর বন্ধুর পশ কলিগদের সাথে বসে একশ টাকার ‘ব্রাঞ্চ’ সারি। বেকার অবস্থা এক্কেবারে খারাপ না। নিজের দুঃসময় চাইলে অন্যের উপর দিয়ে চাপায়ে দেয়া যায়। 

বর্ষা আসতে বেশি দেরি নাই। যথারীতি ঢাকার প্রতিটা রাস্তায় এখন খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব। অতি নির্মম এসমস্ত খোঁড়াখুঁড়ি রাস্তায় হয়, না রাস্তায় থাকা জনগণের মাথায় হয় তা জানতে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ। ভাবতেছি, এ শহরে আমরা ফিউচারে কিভাবে সাসটেইন করবো? সরকার উন্নয়নের বিলবোর্ডে আমাদের বিক্রি করতেছে, আসন্ন ভবিষ্যতে এই শহর হইতে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর ২.০। বিশৃঙ্খলা থাকবে কেবল জাদুঘরে, বিরোধী দলের শাসনামলের সময়কার কিছু সংগ্রহীত ছবিতে। 

বাসে আমার পাশের কিছু যাত্রী বলতেছিল, “উন্নয়নের জন্য কিছুদিন কষ্ট তো সহ্য করতেই হবে। দেশটাতো আমরা এমনে এমনে পাই নাই। অনেক কষ্ট করে অর্জন করছি।” আমি এদের একজনকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই, আপনি কি বিটিভিতে চাকরি করেন?” ভদ্রলোকের গায়ে এটলিস্ট ডিজিটাল স্পর্শ আছে। আমি সারকাজম করছি কি না কাউকে না পুছায়ে পুরা এক মিনিট সময় নিয়ে চিন্তা করলো। কিছু বলতে যাবে এমন সময়ে তার পাশে একটা মেয়ে এসে বসে। এরপর তিনি আমাকে আর পাত্তা দিলেন না। যদিও ভাবছিলাম উলটা হবে। নিজেরে যাচায়ে নায়ক হওয়ার বদ অভ্যাস তো খালি মানুষেরই আছে। 

একটা জাতি কি পরিমাণের অসহায় এইটা ঢাকার রাস্তায় না ঘুরলে বুঝা যাবে না। আমি অসহায় অবস্থা থেকে বাঁচার আইডিয়া টোকাইতেছি। নিজেরে আইডিয়া দিলাম আমরা কষ্টসহিষ্ণু, প্রতিনিয়ত ধৈর্য আয়ত্ত করে করে একসময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধৈর্যশীল জাতিতে রূপান্তরিত হব। নেক্সট জেনারেশনের জন্য যা অতি দরকারি পথ্য সমান। এরা এর চাইতে অস্থির ভবিষ্যতকে পরম্পরায় প্রাপ্ত ধ্যান নিয়ে আগলে রাখবে। ওরা ধ্যানে-জ্ঞানে হবে প্র্যাক্টিক্যালি মডার্ন। আগাছার মত এখনই বিল্ডিং ভর্তি সারি সারি ইউনিভার্সিটি দেখা যায়। কিছু বিল্ডিং আছে, যেটার দুইতলা পর্যন্ত স্কুল, চারতলা পর্যন্ত কলেজ আর ছয়তলা পর্যন্ত প্রফেশনাল একাডেমি। মানে! ট্রেনিং তো এখন থেকেই শুরু হয়ে গ্যাছে। ছোটবেলায় এক বিল্ডিংয়ে ঢুকেই বড় হয়ে গ্র্যাজুয়েট। গণহারে সব ইউজলেস পাবলিক টয়লেট এই এরাই সুপরিচিত সব মেথডে নিশ্চয়ই ফিউচারে একেকটা যুগোপযোগী বিদ্যা প্রতিষ্ঠানে ট্রান্সফরম করে ফেলবে। আমার খুব ভরসা । এই শহর বিশাল অংকের একটা ভিক্ষুক জেনারেশনও লালন করতেছে। ফুটপাতে চিৎ, কাত বোর্ডিং-এর বিজনেস নিশ্চয়ই ওদের জন্য খারাপ কোন আইডিয়া হবে না। তাছাড়া এদের মাথায় আরটিস্ট্রির নাই অভাব। ভাবনাতীত কোনো সিস্টেম এক্সপানশন আমরা চিন্তা ছাড়াই দেখব। 

“ভাড়াটা বের করেন।” কন্ডাক্টর সুধায়।

ভাড়া দিতে যেয়ে এই লোকগুলোর জন্যও কিছু মাথায় আসল। এরা চাইলে দোতলা বাসগুলোর উপরের জায়গাটা কিচেন করে  ভাড়া দিতে পারে। জ্যামেই তো বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাচ্ছে অনেক সময়। অফিসটফিস করে গেণ্ডা বাচ্চাদের জন্য রান্না করার এনার্জি হয়তো অনেক বাবা-মার ভবিষ্যতে থাকবে না। হোম ডেলিভারিতেও জ্যামের আবার ঘন যোগাযোগ আছে। গরমে, জ্যামে পচে যাওয়া খাবার খাওয়ার চেয়ে গণ কিচেনে রান্না করতে করতে বাসায় পৌঁছানোর আইডিয়া বেটার, সময় সাশ্রয় হবে প্রচুর। চাইলে ডেলিভারি সার্ভিস, রেস্টুরেন্ট আর ট্রান্সপোর্ট মালিকরা মিলে ত্রিমুখী পার্টনারশিপে এই সার্ভিস উদ্বোধন করতে পারে। তাতে সবার স্বার্থটাও রক্ষা হয়। 

টাকা হইলে আমি নিজেই একদিন এই স্টার্টআপ শুরু করবো। যদি না জ্যামে বসে থেকে থেকে বুড়া হয়ে যাই। প্রতিদিন ছয়-সাত ঘণ্টা করে জনগণরে বুড়া বানানোর অধিকার কোনো সিস্টেমের নাই। আমার প্রোমশনাল পে অফ লাইন হবে, “অনিশ্চয়তাকে আমাদের খাঁচায় বন্দী করুন, আপনার মূল্যবান সময়গুলোর সঠিক ও সুন্দর ব্যাবহার নিশ্চিত করুন।” 

আপাতত জ্যাক মা মার্কা আইডিয়া আর এক্সাইটিং লাগতেছে না। তিনটা ঘণ্টা লাগায়ে অফিসে আসার পর ওয়েটিং রুমে বসে আছি আরও প্রায় একঘণ্টা। চারটা ঘণ্টা ‘অনিশ্চয়তার খাঁচা’, ‘জ্যামের চিৎকার’ আর ‘বাকহারা আইডিয়া-কাব্যে’ আমার নাখাস্তা অবস্থা। বিশ মিনিটের একটা ন্যাপ নিতে পারলে খিদাটা ফিল করতাম না। কিন্তু কামার্ত পেট আবার কিছু না নিয়ে ঘুমাইতেও পারেন না। আসলে বলা উচিত তাহার জনক আমার বিদিগ মস্তিষ্কই নার্ভে ঢোল পিটিয়ে জানান দিতেছেন এই মহানগত বিনিয়োগের। আমার জালাইল্যারে এদের কারণে আর বন্ধু ভাবতে ইচ্ছা করতেছে না। কিন্তু সারভাইভালো ইনসটিংক্ট বলতেছে অন্তত আরও কিছুক্ষণ ভাবতে। অলিম্পিকের ম্যারাথন এইখানে মিটিংয়ে পরিণত হইছে, আধাঘণ্টা আগে আমাকে ওদের পিয়ন এসে জানাইল। সেই ম্যারাথন কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্যই শেষ হবে। আফটার অল ওরা তো মানুষ, এটলিস্ট জালাইল্যা এখনও মানুষই আছে। ধর্ম চেঞ্জ করে আমেরিকান ডোপপাপীতে রূপান্তরিত হয় নাই। 

চোখের পর্দা কিন্তু প্রথাবিমুখ। উনি অফিস-ক্লাসের-রাস্তার কাস্টম মানেন না। মেজাজের সুর না চড়তে দিয়ে চোখের মণি জড়ায়ে ধরেন। আমারটাও তিনি যথাসময়েই জড়ায়ে ধরছিলেন। কিন্তু যথাসময়ে ছাড়তে পারেন নাই। কেউ একজন ‘শব্দ-টানে’ তারে সরায়ে দেয়। আমি দেখি ট্রে হাতে নিয়ে একটা কুৎসিত মেয়ে দাঁড়ায়ে আছে। আমি কুৎসিত ক্যান হাজারবার বলবো না এইটা নিয়ে পরে আরেকদিন গবেষণা করবো, এখন সম্ভব না। এই মেয়ে ওর মেকাপের চাইতে আরও কুৎসিত কণ্ঠে জানাইলো, “জালাল ভাই, আজকে ইম্পর্ট্যান্ট একটা ভিজিটে বের হয়ে গেছেন। আপনাকে ফোন দিয়ে পরে জানাবেন কবে আসতে হবে।” 

আমি দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করতেছি। বন্ধুকে বর্তমান অবস্থায় অপরিচিত ভাবাতে কোন সার্থকতা নাই। আসলে ভাগ্যের কথা ট্রেতে রাখা কিছু বিস্কুটে লেখা আছে। মেয়েটাও চোখের ভাষার সাথে চট করে সেটাই জানায়ে দিলো। 

“আপনি কি চা পেয়েছেন?” ব্যবহার মোটামুটি, খারাপ না। প্রশিক্ষিত একটা কণ্ঠ তার। শুধু এই ব্যাপারটাই খারাপ। 

“এই বিস্কুটটার পুরা প্যাকেটের দাম কত? ”

বেচারি আমার স্বভাব জানে না, কি করবে! সংবেদনশীল মুখে প্রশিক্ষিত ভাব ধরে জানায়, “ইন্ডিয়ান বিস্কিট, দাম হবে নিশ্চয়ই। পুরা প্যাকেট কত, পাঁচশ হইতে পারে ম্যাক্স?”

“আপনি কি এইখানে পুরা প্যাকেটটাই দিয়েছেন?”

“অফকোর্স, এইটা একটা মাল্টিন্যাশনাল ফার্ম। গেস্ট বাজেট আপনি আইডিয়াও করতে পারবেন না।” 

আমি মুখে গরিবি তৃপ্তি মেখে জানাইলাম, “ওরে জোস! এসে পুরা লস খাই নাই তাহলে। ভাড়া দিয়ে কষ্ট করে এসে এক্সপোর্টের মাল কয়জনের ভাগ্যে জোটে?” 

“সরি?”

আমি শেষবারের মত তার দিকে তাকায়ে মন থেকে একটা মিষ্টি হাসি দিলাম। যদিও জানি না হাসিটা কতটুকুন মিষ্টি দেখা গেল। এরপরও তারে যথেষ্টই বিভ্রান্ত করা গেল। বিভ্রান্ত চেহারায় মেয়েটাকে দেখতে এখন ভালো লাগতেছে। ভালো লাগা আরও বাড়াইলাম শার্টের বুক পকেটে ধপাধপ কয়েকটা বিস্কিট ভরে। মুখে তার চেয়ে দ্রুতগতিতে আরও হালিখানেক বিস্কিট পুরে তার সামনে দিয়ে হেলতে দুলতে অফিস ত্যাগ করলাম। বেচারির চোখে রক্ত চলে আসছে। জিনের চোখের মতো লেন্সটার কারণেও হইতে পারে অবশ্য। আমার এত ভাবার সময় নাই। 

পরবর্তী গন্তব্য ক্যাম্পাস। বিকাল কাটানোর উপযুক্ত স্থান। অমি, শিশিরদের কল্যাণে ওই পরিবেশে এখনও মরচে পড়ে নাই। ভাগ্য আবার বিড়ম্বনা না চুদাইলে বিনা পয়সায় দুই-চারটা সুখটানও হয়ত দেয়া যাবে। আহা! এখনই চিন্তা করতে কত আরাম লাগতেছে। সেইসব সুখটান ! প্রকৃতির রস মাখানো একেকটা সুখটান!

অমি, শিশির কেউই ক্যাম্পাসে নাই। দুইটা থাকে একসাথে, উধাও হয় একসাথে। নিখাদ প্রকৃতিপ্রেমী তারা। মানুষ অথবা ওদের ভাষায় ময়লামুক্ত থাকতে যখন তখন সলিটিউডের খোঁজে বেড়াইতে যায়। আফসোস আমার, আমি কোনো দলে পাকাপাকিভাবে ভিড়তে পারি নাই। স্টয়িসিজম পেয়ে বসছে ইদানিং। সারাদিন গেঁড়ে বসে থাকে না, খুব অল্প সময়ের মতো থেকে হাত নাড়িয়ে টা টা দিয়ে  চলে যায়। আরও কিছুদিন কমিউনিটির উচ্ছিষ্টের মত পড়ে থাকলে ব্যাপারটা পাকাপোক্ত হয়ে যাবে। থাক, ভাল্লাগে না এসব চিন্তা করতে। 

ক্যাফেটেরিয়ার মোটামুটি ফাঁকা এক কোণে জানালার পাশে একা বসে আছি। আমার দুই টেবিল সামনে পরিচিত কয়েক জোড়া ছোটমুখের অনুপাদেয় সঙ্গীত কানে বাজতেছে। চারজনের একটা ব্যান্ড এরা। দুইটা মেয়ে সাবা আর মুন মোটামুটি গিটার বাজায়। মুন একুস্টিক বেজ বাজায়। জ্যাজের মতো রিদম রাখতে ট্রাই করে। ওরা এখনও শিখতেছে, সারাদিন নিজেদের স্টাইল আর গান নিয়েই পড়ে থাকতে দেখি। মুখস্থ মেলোডির স্বাদ পাই না। ব্যাপারটা নতুন অবশ্যই, তবে মাঝে-মধ্যে খারাপ মনে হয়। যেমন এখন আমার জন ডেনভার শুনতে ইচ্ছা করতেছে। এরা একই সাথে ভিন্নরকমের উপস্থাপনা দিয়ে আমাকে আকর্ষণ করতেছে, আবার মাথা প্রচুর খাটায়ে ওদের কমপ্লেক্স প্যাটার্ন বুঝতে উৎসাহ দিতেছে। জাপ্পা সবসময় শোনার মত আর্টিস্ট না, কিন্তু ডেনভার, ডিলানকে যেকোনো মুহূর্তে শোনা যায়। সিমপ্লিসিটি মাথাকে রুল করে আসলে। ইশতিয়াক যে ওদের ব্যান্ড লিডার কাম ভোকাল, কিং ক্রিমসন, জাপ্পা, ব্যারেট করে করে কান পচায়ে ফেলে। সাবার গিটার বাজানো ওর কারণেই হয়তো জঘন্য লাগে। অডাসিটি আয়ত্তে আনা এত সহজ না। মেয়েটাকে যার জন্য এঞ্জয় করতে দেখি খুব কমই । কনফিউজড মিউজিশিয়ান দেখতে মায়া লাগে। বেচারাদের ক্রিয়েটিভিটির স্পেস থাকে না। 

এই ছেলেটা বোধহয় এদের নতুন ড্রামার। আমি মনোযোগ দিয়ে ওর স্পুন-গ্লাসের বিট শুনতেছি। আচ্ছা, ওর বিটগুলো চুরি করে বাইরের চত্বরটায় ফালায়ে দিলে কেমন হয়? জানালা মন ভালো করা সূর্যের আলোর রেশ ধরে রাখছে। উদাসী অপলক তাকায়ে দেখি বাইরের মানুষগুলো এখন আমার বিটের সিঙ্ক্রোনাইজেশনে ঘোরাফেরা করতেছে । কি সুন্দর একটা আয়না, সবাইকে নিজের ইচ্ছামত দেখা যায়, আওয়ার গ্লাস শেপ। “Life itself is an artiste”, ইনডিড। 

জগত চিন্তা আবার প্যাকপ্যাক শুরু করছে । ওরা চেঁচাচ্ছে আর আমাকে থামায়ে বলতেছে, “হইছে তো অনেক, এখন সুচেতনা ধারণ করো। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে নাও পরে ভাসাইতে পারবা, আপাতত কর্মের বাস্তবতাকে ধারণ করো।” অদ্ভুত হাস্যকর!

কষ্ট লাগে মন থেকে একটা সুন্দর মুহূর্ত নাই হয়ে যাওয়াতে। অপেক্ষার একেকটা রঙ্গ শুধুই লাইফের না দেখা সব স্টেয়ারকেসে। অসীম সেসব সিঁড়ি, তাতে টিভিসির সস্তা কিছু পে অফ লাইনের মত লেখা, “টাকা কামাও, দেশ ও সমাজ বাঁচাও”। পৃথিবীর তাবৎ মানুষকুলের অপেক্ষারত অন্তিম জিজ্ঞাসা, “তোমার চাকরি হচ্ছে না কেন? মেধা আর চেষ্টায় এত ঘাটতি থাকলে হবে কিছু?” মনে মনে সবাইকে জোরালো একটা প্রতিউত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেও পচে যাই। আসলেই, চার বছরের মার্কেটিং-এ আন্ডারগ্র্যাড আর এক বছরের পোস্টগ্র্যাড কি কাজে আসতেছে আমার? কাউরে পাল্টা উত্তর দেয়ার ক্ষমতাও তো নাই। ভান করে কি লাভ?

মনোযোগ সরাইতে হবে। আশার দ্যুতির প্রদীপে ফুঁ দিতে হবে। বাসায় যেয়ে বিডি জবসে সার্কুলার খুঁজতে হবে। স্যালারি রেঞ্জ আপডেট করে ত্রিশ থেকে কমায়ে আনব পনের হাজারে। দেখি, বিকোই কি না। এই বাজারে আমার চাইতে একটা প্রমাণ সাইজের খাসি বেশি দামে বিক্রি হয়। এমন নির্মম সত্য নিজ থেকে জানার পর এইখান থেকে পালায়ে যাওয়াই সর্বাপেক্ষা উত্তম। 

“কিরে পাঠার পো। পাঠার মত হা কইরা কি দর্শন গিলতাছস?”

যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আশপাশের জগত থেকে বিচ্যুত ছিলাম, তাই ভালো ছিল। কেওয়াজের রেওয়াজ মেনে শোকের দাবানল আরও তিনগুণ উসকায়ে দিতে সামনের চেয়ারটায় হেঁটে এসে উপস্থিত হতে চলেছেন অত্র এলাকার নামধারী বিশিষ্ট পাপীসন্তান 'জনাব আহাদ'। এই বান্দা কোনোকালে অন্যের বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল না। ব্যাচের ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ড বলে কথা! সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর এই যুগে প্রথাগত জ্ঞানকে বিভিন্নভাবে কপিপেস্টে ঝালিয়ে অজস্র মাধ্যমে ছড়িয়ে তিনি গত কবছরে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব পরিণত হইছেন। মজা করে বা নিখাদ বন্ধু হিসেবে কৌতুকীয় অপমান দূরে থাক, তার ছায়ার উপর দিয়ে হেঁটে গেলেও কয়েক হাজার ফলোয়ার বাহিনীর বিশেষ ক্লাসের অবমাননা হয়। মেজাজ চাঙে উঠে গ্যাছে ওরে দেখে। দেখি, টেবিল ভর্তি করে আমার সুন্দর দৃষ্টিশক্তিটাকে ব্যাহত করে ফলোয়ার নিয়ে বসে পড়ছে। কি আর বলবো ! 

“তোর জগতের কয়েকশ পাঠার গন্ধ গিলতেছি। তুই একবার ট্রাই করে দেখ। তোর টাইপ গন্ধ, সহ্য করতে পারবি ইনশাআল্লাহ।”  

“সাংঘাতিক ব্যাপার ! তুই বাইচা আছস ক্যামনে? নাকে ঘামাচির দানার মত কিছু উঠছে কি না চেক কর। আঙ্গুল ঢুকায়ে দেখতো, ফোলা ফোলা লাগে নাকি কিছু?” 

“শালা নাস্টি ! খাটাইশের বাচ্চা !” তিনজন অনুজ ফলোয়ার হাসতে হাসতে প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছেন। আহাদ তো আর হাসেন না, তিনি মানুষকে হাসান। 

যত কিছুই হোক ও আমার বেইজ্জতি ইঙ্গিতে একটা আলট্রা এটাক চোদায়ে বসছে। আমি পাল্টা আল্ট্রা কিছু বলার প্রেপ নিতে যেয়ে তর্জনীর দিকে তাকাইলাম। ঘটনার রিফ্লেক্সটা সবাই দেখে ফেলল। অন্যদের কি বলবো, ভাব নিয়ে না হাসার চেষ্টা করে থাকাটা পুরাই বৃথা যাবে। উলটা কাঁদার উপক্রমে হাসির জোয়ার আসতেছে। ঠেলে হাসতে হাসতে টেবিলে থু ছিটকে পড়তেছে। ইশ ! জীবনটা কি আসলে? ভাবা দরকার। “এইটা কি নালার মধ্যে কুঁড়ায়ে পাওয়া কোনো এক টুকরা হীরার দানা?”

ভাবতে অবাক লাগে, এই দেখতে পারি না বান্দাদের সাথে এতক্ষণ আড্ডা দিতেছি। একটু পরে যে পার্টি হবে তারও প্ল্যান করতেছি । খুব দরকার ছিল আজকে আহাদকে।    

তৃপ্তি? জগতের চুলের চেতনা থেকে আপাতত আমি মুক্ত।     

রাত ১:১১

ইউটিউব থেইকা ফোনে একটা অযাইচ্যা নোটিফিকেশন আসল। “মিস্টার যেনো তেন ভ্লগার আপলোডেড আ ভিডিও।” বাল খা হালা ! আছি মিয়া পশ স্টেট অফ মাইন্ডে, একটা পশ জায়গায়। আহাদের একতলা ম্যানসনে। চিকচুক মিলায়া আছি সাড়ে সাতাইশ জন। কোনো ভ্লগ মারানর টাইম আছে এখন! মাথা আছে পুরা ডীপ সি কনশাসনেসে। একই সাথে এত্ত ভার, আবার এতই হালকা মনে হইতেছে যেকোনো মুহূর্তে কয়েক মহাসাগরের জোট বাঁধাইয়া পুরা কন্সটেলেশনের সব গ্রহ-নক্ষত্র দখল কইরা ফেলবো। ক্রনিক হিস্টেরিয়ার মতো বিশেষ তরল আর MDMA একসাথে জানান দিতেই আছে, তুমি আমাদের ‘চুদের বার’ ভরছ । ব্যাপার না, আমি খাস মাল। সুপ্রাচীনকালের ট্র্যাডিশন ধইরা রাইখা এদের মাথাঘুরানো বিশ্রী বদহজম সমেত ডায়রিয়ার মত বমির গন্ধও হজম  কইরা ফালামু ইনশাল্লাহ। শালার ইনশাল্লাহর টাইমিং দেখি ভালো না। নো প্রবস, চল্লিশ দিন পর দুইদিন সত্যিকারের রোজা রাখমু। বুঝলাম না, টাল মাথায় হুদাই কুরআন-হাদিস আসে কি করতে? আবার আমি ঢাকাইয়া পোলাও বা হইলাম কখন? আইচ্ছা পাপের তো লজ্জা নাই, আর আমার তো আগে থেকেই নাই। কিন্তু আল্লাহর দোয়ার আমার পর্যাপ্ত পরিমাণে দরকার। ওঠার শক্তি পাইতেছি না, উইঠা মাথাটা ধুইতে হবে। এরপর ঠান্ডা একটা পিনিকে ছোট কইরা একটা পট মাইরা দিব। তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ, এগুলো আমি কি চিন্তা করতেছি!

আলহামদুলিল্লাহ আমি দাঁড়াইতে পারছি। সামনে জালাইল্যা হারামি পাছা ব্যাকা কইরা ল্যাটায়া পইড়া আছে। আমার মত ভালো মানুষ আসলে পৃথিবীতে দুইটা নাই। দুপুরের ওই সিরিয়াস বাইঞ্চুদির পরেও তার সাথে গ্লাস শেয়ার করছি। হালা কি জানি বিড়বিড় করতাছে।   

“কিরররে, চুতিবা লালা! কি অস?” চুতিবা খালা কইছি? নাতো, চুতিয়া হালাই কইছি। মুখে কথা বাইজা পড়তেছে না কি? হইতে পারে। মালে, লালায় মালারন্য অবস্থা হইতেই পারে।

সবাই জোকারি করল, আমি করলাম না। ক্যান? জালালের প্যান্টটা হেইচ্যা টান দিয়া জাইঙ্গা টাইনা পাছা ফাঁক কইরা রাখলে কেমন হয়?  সবুজ জাইঙ্গা আর একটু কালো পাছায় অন্যরকম সুন্দর দেখা যাইতেছে ছেলেটাকে। একদম পারফেক্ট ঘর মোছার আধা ভেজা ত্যানার মত দেখা যাইতেছে এখন। কিন্তু মাতারীর জীবন নাই ক্যান? একটু টেরটাও পাইল না। মাছি গেলার মত মুখ কইরা ঘুমাইতেছে। ইয়াক! বমির ঢাক বাজা শুরু করছে বুকে। হায়রে যন্ত্রণা, খোদা বাঁচান!

হাঁটতেছি না টয়লেট আমাকে ভাসায়ে নিয়ে তার দিকে নিয়ে যাইতেছে বুঝতেছি না। তবে গডস্পিডে আগাইতেছি, একটু থামা উচিত। টয়লেট কই জানি না তো, রিকল করি। আমি লিভিং পার কইরা ডাইনিং-এর সেন্টার টেবিলের মেজ পার কইরা কয়েক কদম ভাইসা আইসা আবার এখন ডাইনিং রুমের মাঝখানে। ওহ, ডানে বেসিন ছিল খেয়াল করি নাই। 

“ঐ দেখা যায় ওয়াশরুম

      ঐখানেতে যাই,

সেইখানেতে বাস করে 

      আমার গুহ্যদ্বারের সাঁই।”       

ওয়াও ম্যান! কমোডের পুলকিত হওয়া উচিত এমন ডেডিকেটেড ছড়া শুনলে। আহ! এইদিকের জানালাটা দিয়ে বেশ নির্মল বাতাস আসতেছে।অসম্ভব গা-জুড়ানো, প্রাকৃতিক, পিনিকের সম্প্রীতির বাতাস যাকে বলে। হালার বাসায় সপ্তাহে আটদিন পার্টি হয় মনে হয়, জায়গায় জায়গায় মুডলাইট বসানো। লিভিং এর রিডিং ম্যাট্রেস ঘেঁষা ওয়াল জুইড়া মুডলাইট। আরেক পাশে ফ্রেম বাঁধাই ছবির মাঝখানে আর্টওয়ার্কের মত মুডলাইট। বাহারি আরজিবি স্মার্টল্যাম্পের ঝিম ধরানো আলোও আছে তাদের সাথে। মাতাল আরও বেশি হইছি আলো আর ছবির দিকে তাকায়া কিসব উল্টাপাল্টা গান গাওয়ার কারণে। ডাইনিং এর এই জানালার পর্দায় স্টিচ করে গাঢ় নীল আলোর স্ট্রিপড মুড লাইট বসানো, হালা আহাদ, তোর রাতে ভাত খাইতেও পিনিক লাগে। যত কিছুই হোক, ছেলে টেস্টফুল, শৌখিন ঘরানার। বাসার ইন্টেরিয়রে টেস্টের ইকো-সিস্টেম আছে। 

ওমাগশ! সাইডে বেব দেখা যায় দেখি। খেয়াল করি নাই তো। জানালার একপাশে গ্রিলের সাথে মাথা ঠেকায়া দিনদুনিয়া ভুলায়া আমার মত পাগলা বাতাস গিলতেছে। মেয়েটার সিল্কি চুলগুলো রাশি রাশি নীল আলো ধরে অল্প বাতাসটায় খুব সুন্দর দোল খাইতেছে। কিরে মাথা আমার চক্কর দিল ক্যান? মরার মাথা! আবার গোটা পৃথিবী ঘুইরা আইসা এই সুন্দর জিনিস দেখতে হবে? কত কষ্ট, সময় নষ্ট। থাক, তাকানোর চেষ্টা করি তারপরও। সত্যি কথা  বলতে কি, শিশি তখন চাপে নাই আমার। এমনেই এইদিকে আসছিলাম। ধুর, কারে বুঝাই এসব।

“Hey you, prick! What the hell! এমন লালাঝরা কুত্তার মত তাকায়ে কি দেখ ? দাঁড়াইছে কিছু?”

বুঝলাম না। শালি এমনে আমার ফিল মাইরা দিল ক্যান? আমি ভদ্র ঘরের সন্তান, কিছু কমু না। চুপ থাকি। 

“O hello চুতিয়া, কি সমস্যা? মেয়ে দেখছ নাই আর আগে? মাল খাওয়া বিশ্রী চোখে এখনও তাকায়ে আছস ! চোখ আর নিচেরটা নামায়া অন্য রাস্তা মাপ।” 

হালার ঘরের হালি, ফেসটাও দেখি নাই তোর। এমনে চিন্তা করতাছে ক্যান? শালি জানে, ওরে কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগতেছে, কি কমু।

“আপনার কাছে উইড হবে? কিছু মনে কইরেন না, পিনিকের দোষে আর আপনার লাল গাল থেকে যেই সুন্দর আলোটা বের হইতেছে না! ঠিক ঐটার দোষে এমনে তাকায়ে আছি। বাট, এতক্ষণ আসলে তাকানো উচিত হয় নাই। সরি, কিছু মনে কইরেন না আপা।”

“হাহা, জোক দুনিয়ার। এক কুত্তা কিছুক্ষণ আগে জোর কইরা রুমে নিয়া ল্যাপ ড্যান্স নিতে চাইছিল আর এখন এই কুত্তা আসছে গাল বুঝায়া গাঞ্জা খুঁজতে। তোরা মরস না ক্যান, কুত্তারা!” 

প্যান্ট চুইয়া স্রোতের মত কি জানি নামতেছে আমার। ফাক! কান্না আসতেছে। কি ঘটতেছে এগুলো। কিছুই না। মরা একটা মাইনষের দুইদিক দিয়ে সমানে পেশাব বের হইতেছে!

হ্যাংওভার না ছাতা, মন আজাইরা কারণে খারাপ। টয়লেট আমারটা আমিই পরিষ্কার করি। কষ্টের কথা হচ্ছে কোনোদিন বমি পরিষ্কার করা লাগে নাই। নিজেরটা তো নাই, অন্য কোন শালার পুতেরটাও না। আমি সারাজীবন রুমমেট হিসাবে পাইছি আঁতেলের ছাওদের। এখন যেইটা থাকে ইনিও এক মহা আতলা। ইহজগতে চাকরি আর বউরে ছাড়া কিছু চিনেন না। এই দুই বিচিত্রে তার বিনোদনের মাত্রা। আমি নিজেই তো এক মহা বিনোদন, কুড়াইতেছি যত্রতত্র সব বিচিত্র বিনোদন।

সাতসকালে বন্ধুর বাসায় সুইপারির কামলা দিতেছি। প্যান্টে পেশাবের গন্ধ নিয়ে আসলে কোন সুইপারও কামলা দেয় না। রাতটা শেষ হইল দুঃস্বপ্নে, সকালটাও শুরু হইল দুঃস্বপ্নে। শেষ হওয়ার কোনো নাম নাই । এখনও চলতেছে, আরও তিন চুতমারানির বমির গন্ধের বেগে। আরে চুতমারানি তো দুইটা! মলি আর অরিন, অন্য মালটা তো পিয়াল। যাত্রাবাড়ীর ত্রিশ টাকার নামকরা টুয়া ‘পিয়াল’। আমারে কেউ বলবে, এইটা কি কোনো অলিখিত রুল যে প্রত্যেকটা নরমাল মানুষের কপালে এই জাতীয় টুয়ার অস্তিত্ব থাকবেই থাকবে? এই পার্ভার্ট চুতমারানির পিকনিকের কাহিনি মনে পড়লে নিজেরে এখনও কি জানি মনে হয়! খোদার ডেডিকেটেড ‘নালা’! গাঞ্জা খাইয়া রাতের বেলা লিসা, আমরিনদের রুমে যাইয়া বেচারি দুইটার ঘুমের ভিতরে টুয়াবাড়ির বিশেষ প্রথায় ওদের আন্ডারওয়্যার চুরি কইরা আমাদের ডর্মে আইনা পিন্ধ্যা-মিন্ধা কি এক বিতিকিচ্ছিরি খ্যামটা নাচ দিছিল। শয়তান হিজড়াদেরকে ভুল বুঝলে যা হওয়ার কথা আর কি ! ভাগ্যের এমন নিষ্প্রাণ চোদন, এই নামকরা ছাতাটার বমিও আমার সাফ করা লাগতেছে। 

আজিব, রাতে পুরা ডাইনিং মুইত্যা ভাসায়া এরপর গ্যালন গ্যালন বমি ঢাইলা সাফ না কইরা আমিই না খচ্চরের মত ঘুমায়া পড়লাম। বেচারিদের দোষ দেই কেমনে? হ্যাংওভার নিয়া ঘুম থেকে উইঠা এই বিচ্ছিরি আইশটা গন্ধ কারও সহ্য করতে না পারারই কথা। যে যেখানে পারছে আমার খাইশটা কাণ্ডের প্রতিবাদে তীব্র নিন্দা জানায়া ঢাইলা দিছে। আহাদের কাজের ছেলেটা আসে দুপুরে। একবারে রান্না কইরা, ঘরদোর পরিষ্কার কইরা চইলা যায়। এখন বাজে সাড়ে দশটা। কর্পোরেট কামলাগুলো আমারে ধুইয়া নাক সিটকা গ্যাছে কামলা দিতে। জাতির বাদ বাকি ভবিষ্যত কিছু গেছে ক্লাসে আর কিছু আছে আহাদের সাথে বেডরুমের বারান্দায় আইসোলেশনে। কেউ কি আমাকে ডাকে? কিছু শুনলাম মনে হইল। হ্যাঁ, আহাদ কিছু বলতেছে,

“ওরে, কেউ চাটগ্যাইয়া মুরগিটারে জিগা, ধোয়ামোছা শেষ হইছে কি না। গন্ধে কেউ বাঁচতেছি না। স্যার অনিম, জন্মের পিনিকসম্রাট, মাল গিলে-হাগে-মুতে-ঢালে সব একলগে। কি তাহার ট্যালেন্ট বাব্বারে বাব্বা! তোমরা যাওয়ার আগে দিয়া নিজেদের হাতে ছ্যাপ দিয়া ডেটল লাগায়া তারে কদমবুসি কইরা যাবা। না করলে এই মানবজীবন সার্থক হবে না।”

আমি ওর রুমের দিকে আগাইতেছিলাম। শুনি মাইয়্যা কণ্ঠের হাসি। এই হালারপুতে চিনি না জানি না এমন মাইয়াগো সামনেই নিজেরে যাতাইল সারাটা জীবন। মায়রে বাপ! মাথাটা ছ্যাঁত কইরা উঠল। আমি বেকার, বাপে কি করে কেউ কোনোদিন জিগায় না। দেখতে ময়লা-ধয়লা, কিন্তু কারও খাই-পড়ি নাতো। দুই টাকার উপকার করতে পারি না। আল্লাহ্‌ এই ক্ষমতা এখনও দেয় নাই, সাথে কারও বাল ছেড়ার ক্ষমতাটাও ক্যান জানি দেয় নাই। দিলে ছিরর‍্যা…… থাক, কন্ট্রোল হালার পো কন্ট্রোল। এইটা আরেকজনের বাসা, আর তোমার মাথা আপাতত কাজ করতেছে না।

ওয়াশরুম, ডাইনিং পরিষ্কার করা শেষ। এই বেডরুমের সোফাটা পরিষ্কার করা সম্ভব না, এটাচড কুশন কভার। ফার্নিচারের দোকানের পোলাপান দিয়ে ড্রাই ক্লিনিং করাইতে হবে। বমির হলুদ বিচ্ছিরি দাগ দেখলে করবে কি না সন্দেহ। ক্ষ্যাতা পুড়ি এইসবের, আমার জানার বিষয় না। যেই টুয়া বমি করছে এটা তার বাপের দায়িত্ব। গোসল করা লাগতো, মেইনলি প্যান্টটা চেঞ্জ করা দরকার। হালারপুতের কাছ থিইকা কোন ফেভার মারানোর দরকার নাই। আমি শেষ বইলা সোজা হাঁটা ধরি। 

“হালার পো আহাদ, ত্যানাগুলো নিয়া যাই, ডাস্টবিনে দিমু। ভালো থাক আর ত্যানাইছ না। যাই গা।” 

“এই খাড়া হুইনা যা।”

শালার ছেলে একটা প্যান্ট নিয়ে আসতেছে। বক্সার পইড়া ত্যালতেলা দুদের চর্বি ঝুলায়া, নাচায়া আসতেছে। কিঞ্চিৎ বিরক্তি বাড়ছে ওর হাসি দেইখা। এখন মাথাটা বেশি ধরছে। 

“চিটাগাইংগা খ্যাত ! অনেক কষ্টে পাঁচ বছর আগের একটা শর্টস পাইছি। এইনে ধর, তোর জিনিসের লাহান চিকন সাইজের। আর মুইতের গন্ধে কি লিফটের মানুষগুলোরেও মারতে চাস? ফ্রেশ হইয়া একবারে যা। পরারটা ত্যানার লগে বাইন্ধা ডাস্টবিনে হালায়া দিছ। নাইলে পাপ হইব তোর। বাপের জন্মের পাপ, হাহা!” 

“তোর প্যান্টরে, তোর লিফটরে, তোর পাপের খানদানরে আর তোর বাপরে আমি চুদি। যায়া মাল গিল আর ঠিকছে...জায়গায় গিয়া মাল ভর ! যাযাকাল্লাহ খাইরুন।” 

দরজাটায় অতিরিক্ত জোরে শব্দ হইছে। হালারে অন্ধের লাহান দেখতে পারি না। যাউকগা, ও কোনো বড় সমস্যা না । এমনিতে সবাইরে খুব খাতির করে কিন্তু সিচুয়েশন না জাইনা-বুইঝা আজাইরা ভাবটাও অসহ্য রকমের মারায়। ও মনে করুক, অপমান কইরা বড় বালডা উদ্ধার কইরা ফেলছে। হালার আমার জীবনে নাই কোনো প্রাইভেট প্রভাব, ও হইতাছে পাবলিক। আর খাজুইরা পাবলিকের এমন গায়ে বাজা পেইন আমার নেয়ার ইচ্ছা নাই। ধুমধাম উইড়া সিঁড়ি দিয়া নামলাম। দামই লিফটের ধার চুদলাম না। হাঁটা ধরমু না রিকশা নিমু বুঝতেছি না। মাল খাওয়া ঠাডা পড়া করুণ চেহারা নিয়া এই কুত্তা-মরা রোদে হাঁটার কোন কারণ নাই। রিকশাই ভালো, পকেটে টাকা আছে তো?

একটা টেক্সট আসছে ফোনে। “ I’m really sorry if I offended you that bad. You were crying like a baby back then. Let’s say we settle it up properly. Like with a proper introduction… If you want though… (Slightly smiling face emoji)”

আমার কম দামি রেডমি নোটে, সানলাইট ব্রাইটনেস অনেকখানি মাইরা দেয়। টেক্সট পড়তে মুখের কাছে নিয়া দেখি এইখানেও মুতের বাঁশ দিতেছে। তামশা না কি বুঝলাম না। এমন অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আমি প্রেম প্রেম গন্ধও পাইতেছি। না না ভাই, নিজের প্রেম প্রেম এমন বিদীগ গন্ধ নিজেই ফিল কর। আর আম্মু ছোটবেলা থেকেই নিষেধ করছে আগবাড়ায়ে সুন্দরীদের কিছু জানাইতে নাই। 

জনাবা ভুলে কি নাম মেনশন করে নাই? সবকিছু এত গ্র্যান্টেড ধইরা নিলে ছেলেরা বাঁচে কেমনে? তাদের আরও কাজ তো থাকতে পারে। ট্রু কলার হাতায়া তার সুন্দর নামটা জানতে তাও ইচ্ছা হয়। 

“ রোদেলা”। বাহ, দিনের প্রথম রোদে নামটা টসটস করে ভাসতেছে। কি অদ্ভুত একটা দিন, রোদ ঝরে জন্ম নেয়া হয়তোবা কোনো বিশেষ দিন। বাঁচলাম, অন্তরের সাধু শেষমেষ তার আসল ভাষা খুঁজে পাইল। 

৩.

“ 'কারা', তুমি কি এমন অদ্ভুত কিছু এর আগে দেখেছো? এরা যেটাকে বলে বেড়ায় নির্ভেজাল স্বপ্ন? ওর নিউরনের কিছু তথ্য এতই সুন্দর, আমার জিলিয়ন ফোটনে সংকুচিত 'কনশাস-প্রিজম' উত্তেজিত হয়ে পড়ছে বারবার। আমরা সমগ্র মহাবিশ্বে আলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছি, যেখানে প্রাণ নেই সেখানে প্রাণের পরিবেশ তৈরি করছি। আম্পটিন নাম্বার অফ ইনফরমেশনস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কোনো সাদামাটা ইচ্ছেতে ডুবে একটা এমিগডালাকে এত পরিপূর্ণ হতে দেখি নাই। এই অতিক্ষুদ্র শিশুটির অনুভূতিগুলো ধরতে পারছো? সেরেটোনিনের রীতিমতো বিস্ফোরণ হচ্ছে। ওর শরীর পুরো নিষ্ক্রিয় কিন্তু ইন্দ্রিয় আন্দোলিত। দেখো, দেখো, কীভাবে নিঃশ্বাসে হাসছে। স্বপ্ন, বাস্তবতাটা কীভাবে বিশ্বাস করে হাসছে। সেটা আবার পায়ের তালুর কিছু অংশে নার্ভে টেনে লজ্জামত রক্তও জমিয়ে ফেলছে। শেষবার কবে এমন অদ্ভুত লেগেছিল মনে করতে পারো? আমার ধারণা আমাদের সবার অনুভূতিটা এখনও জীবন্ত।”

“ ‘যেন’ তুমি পুরো ঘটনাটাকে ওভাররেট করে ফেললে। আমাদের সেই আয়োজনের কথা নিশ্চয়ই তুমি ভুলে গেছো।” 

“হাহা, ‘কারা’ এদের সাইকোপ্লাজমে সুখের বাড়াবাড়ি কসমিক মহাযজ্ঞের একটা অতি ক্ষুদ্র নমুনাই। আসলে শিশুসুলভ নিষ্পাপ আনন্দে আমার নেশা ধরে গেছে। আর আমি কিছুই ভুলিনি।” 

“তারপরও মনে করে দেখো। সবাই শেষবার যখন এক হয়েছিলাম, সাত হাজার ডেসিলিয়ন হাইপারস্ফিয়ার থেকে আমাদের গ্র্যান্ড-গ্যালাকটিক অস্তিত্ব উদযাপনের ক্ষণটা। বিয়ন্ড ইনফায়নাইট অবস্থান থেকে ‘নিউ এটারনিটি ইভ’। প্রতিটা ডাইমেনশনাল স্টেশন, সাব-স্টেশন, স্টার কলোনি থেকে বীম পার্টিকেলের রেডিয়েটিভ কসমিক এক্সপো। দুর্দান্ত প্ল্যান! মহাজাগতিক ভয়াবহ উদযাপন। 

আমাদের শূন্যে মিলিয়ে যাবার কোনো ভয় নেই। এখনো পুরোপুরি জীবন্ত সে ঘটনার প্রত্যেকটা মুহূর্ত, নভোরা এক্সপার্টও বটে। ম্যাপে সুপার ম্যাসিভ ভয়েডগুলো দেখে পুরো প্ল্যানটা এক্সিকিউট করেছিল। আলোর সুতীব্র রোশনাই অদৃশ্য ভয়েডগুলোর ভেতরটা কিছুক্ষণের জন্য পুরো আলোকিত করে ফেলেছিল, ভাবা যায়? আমরা একে অপরের কনশাসনেসের সাথে জুড়ে না থাকলে ঐ অভিজ্ঞতাটা হতো না। নিজেদের নতুন আকার গড়েছি, ছেড়ে এসেছি, ফেমটো ফ্র্যাকশনে পরিবর্তিত হয়েছ। কিন্তু কোনো সুন্দর রূপ অথবা অস্তিত্ব ছাড়তে কখনও এত কষ্ট হয়নি। আমাদের ঘুরে বেড়ানো পরিচয়ের কারণে যা আসলে কখনো সম্ভব ছিল না। 

সবার অনুভূতিগুলো পুনরায় জীবন্ত করতে ঐ দিনটার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। উদযাপনে সবার একেকটা অংশ ভয়েডে মিলিয়ে যেতে দেখছিলাম, আমার মস্তিষ্কে শীতল বৃষ্টি হয়েছিল সেদিন। কোমল নাইট্রোজেন মস্তিষ্কের সুসংগঠিত আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে দিচ্ছিল না। মাথার বৃষ্টি থেমে যাবার পর দেখি কিরি-৯৯ প্রচণ্ড আলো দিচ্ছে। তারাটার খুব কাছাকাছি চলে আসায় সাব-স্টেশনের ফোর্স-শিল্ড তাপে ফেটে পড়ছিল। উইন্ডো স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি ছোট্ট এগার হাজার কিলোমিটারের ‘Digm-shuttle’-টা কিরি-৯৯ এর অরবিটে প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর কাটিয়ে দিয়েছে।”

“তুমি অনেকটা এই ছেলের মত 'কারা', ঘোরের জন্ম তোমার। সবসময় কিছু না কিছুতে বুঁদ হয়ে থাকতে পছন্দ করো। আমি নিজে আলাদা কিছু না। আমাদের নৃগোষ্ঠীর একটা অংশ সেই উদযাপনে স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জিলিয়ন,  জিলিয়ন সত্তা ঘোরের বশে আলোর মহাসমারোহে নিজেদের আস্তে আস্তে বিলীন করে দিচ্ছিল একেকটা ভয়েডে।”

“কি ব্যাপার মানুষের মত থেমে কী চিন্তা করছো?”

“আমার মনে হয়, ভয়েডের শেষ যাত্রার কিছু আরোহীরা এখনও বেঁচে আছে। এখানেই কোথাও আছে, এই 'পৃথিবী' গ্রহে। অজস্র কোটি লাইটইয়ার ঘুরে এখানে আশায় আসা। তুমি মাত্রই সব-শুরুর-আগের পৃথিবী ঘুরে আসলে, কাউকে বা কিছু পেলে?”

“বলা মুশকিল ‘যেন’। আমরা কনশাসনেস প্রিজার্ভ করে কমপ্রেসড ফর্মে এই গ্রহে এসেছি। তুমি, আমি সবাই 'জিওন-সেলে' লুকিয়ে আছি। ভয়েডের মেটানয়ানরা মেল্টিং লাইন থেকে আমাদের মত কনশাসনেস রিক্রিয়েট করতে পেরেছে কি না আমার সন্দেহ হচ্ছে।”

“তোমার কি মনে হয় না, ওরা প্রিজম ফরম্যুলেশন এনকোড করে যেকোনো গ্যালাক্সির স্টার ফরমেশনের এডজাস্ট ম্যাটেরিয়াল হিসাবে বেঁচে বেড়াচ্ছে? আমাদের রেসের ডাইমেনশনাল শিফটের জন্য যা একান্ত জরুরি?”

“মনে হয় না। একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না? শুরু থেকে সবকিছু। স্পেস টাইম থেকে শুরু, এরপর মাল্টি-ডাইমেনশনাল ক্রিপ্টো এনটিটি হয়ে অন্যদের উদ্দেশ্যে বেঁচে থাকা। কোনো সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছিল না ওরা এই প্রসেসে।”

“এরপরও ওরা মেটানয়ান। এক্সিস্টেন্সের স্পিরিটকে নিশ্চয়ই একসময় স্বীকার করে নেবে।”

“হয়ত, এরজন্য আমাদের এই সিস্টেমের প্রতিটা লিভিং অরগ্যানজিমকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডি-কন্সট্রাক্ট করতে হবে।” 

“এদের নিজেদের রি-কন্সট্রাকশনের হিস্ট্রি নাই? এভ্যুলুশনের সংজ্ঞায় প্রতিটা সুপেরিয়র প্রাণীই তো তাই করে।”

“টিপিক্যাল বডির বিলুপ্তি আছে। এলিয়েন মিউটেশনের কমপ্লেক্স জেনোমে ইউনিভার্সে টিকে থাকবে। এভাবে আবর্তন মেটানয়ান সেল রিজেক্ট করেছে, তুমি ভালো করেই জানো, ডি-কন্সট্রাক্ট করা ছাড়া কোন উপায় নাই।” 

“ 'কারা' আমার বুদ্ধি হচ্ছে কোনো একটা যোগাযোগের অপেক্ষা করা। যেহেতু আমরা অরগ্যানিক এভ্যুলুশনকে ডিস্টার্ব করি না, তাই নিজেদের সেলগুলো কমপ্যাক্ট রেখে সুদূরে ইনফরমেশনের জন্য চাইলেই অপেক্ষা করতে পারি।”

“আমি তো তাই করছি। কিন্তু তোমার প্রটেকশন বারের আগামাথা কিছুই বুঝছি না। তুমি এই ছেলেটার দেহে এত ক্ষুদ্র হয়ে কেন বসে আছো? আমাদের উদ্দেশ্যের বৃহত্তর স্বার্থের সাথে এই অতি ক্ষুদ্র অবস্থানের তাৎপর্য কী? কারও নিউরন কোষে বসে বর্তমান নামক অবসাদে আক্রান্ত হবার বিশেষ কিছু কি আছে?” 

“আমি ছুটে মজা পাব না এই গ্রহে। অপেক্ষাই তো করবো, আর তাছাড়া তুমি আছো কিসের জন্য? সব তথ্য তো এমনিতেই পেয়ে যাচ্ছি।”

“ধারণ ক্ষমতার বাইরে কিছু ওর মাথায় লুকাতে যেয়ো না, যেহেতু তোমার কাউকে possess করার কোনো ইচ্ছা নাই।” 

“আমি কি লুকাবো? এদের মাথায় আদি ভৌতিক কিছু কারণে অনেক তথ্যই সংরক্ষিত। যেনতেন ভাবে শেপ শিফট আয়ত্তে আনতে পারলে, এরা তোমাকেও পাত্তা দিবে না। এদের একেবারে ফেলে দেবার কোনো কারণ নাই”

“বুঝলাম ‘যেন’, তোমাকে হিট পুশ করতে হবে। রোদেলার ক্ষুদ্র উস্কানির মতো উষ্ণ কিছু। সুবুদ্ধি আর সচেতনতায় তোমার আহাম্মকি সত্তর বছরের টাইম ডাইল্যুশন ধেয়ে নেমে আসবে প্ল্যাঙ্ক ইউনিটে। আর সবকিছু বাদ দেই, তোমার এদের নিয়ম মেনে থাকতে হবে, এদের ভাষায় কথা বলতে হবে, ভালো কথা। আমি এই নিয়ম মানতে নারাজ।” 

“হাহা, এই ছেলের লালাগ্রন্থীতে যথেষ্ট হরমোনাল হিট আছে । তোমার আহাম্মকি মার্কা হামবড়া ভাব ভেজানোর জন্য যা খুব উপযুক্ত।”

“তুমি নিজে একটা ধড়িবাজ। চাইলে ছেলেটাকে ঐ লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে পারতে। হিউমার এক্সপ্লোর করতে চেয়ে দিলা পেশাব করায়ে।”

“আমি ওর প্রেশার কমাতে চেয়েছিলাম। ইউরিনে সুগারডোজ অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়ছিল, ঐ মেয়ের ঝাড়ি খাওয়ার পর সবকিছু ভুলে হাবা হয়ে থাকলে হার্ট কোলাপস করতে পারতো। আমি ওকে উল্টো সেভ করেছি। আচ্ছা একটা প্রশ্ন, তুমি সকালে কিছুক্ষণের জন্য রোদেলার শরীরে কি করছিলে 'কারা'?” 

“তুমি পুরো মানুষ সেজে বসে আছো দেখছি। চাইলেই তো জানতে পারো অথবা সুপারডিটারমিনিজমের ক্ষমতা খাটিয়ে ওদেরকে বেঁধেও ফেলতে পারো। করছো না কেন?” 

“ফেইটের ইকুয়েশন বোঝার চেষ্টা করছি । অনিশ্চয়তার সাথে এদের ওঠা-বসা। আমি সব জেনে বসে থাকলে কোন চিল নাই।”

“এরা হাস্যকর একটা জাতি, সারাক্ষণ একজন আরেকজনকে গালি আর দোষ দিয়ে বেড়ায়। কোন ইকুয়েশনের অপেক্ষায় সময় নষ্ট না করে বসে বসে ওর মাথায় আরও কিছু স্বপ্নদেবী তৈরি করতে থাক। সময় ভালো যাবে।”

“তুমি আমার সিক্রেসি কোড মেইনটেইন করলে খুব খুশি হবো কারা।” 

“এই ছেলের অরা থেকে পজিটিভ ফিল্ড রিফ্লেক্ট করছিল। আমি জানতে চাচ্ছিলাম কি ব্যাপার ! যা দেখলাম, তুমি মহা রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছো।”

“আরে মাথার মধ্যে অযথা সিম্যুলেশন তৈরি হয়। স্বপ্নের বিরূপ যন্ত্রণা আছে মানুষের। আগবাড়ায়ে যন্ত্রণার ভবিষ্যত দেখে ফেলে, আমি যা দেখতে চাই না।”

 “রোদেলাকে অন্য কেউ খেয়ে দিলে তোমার কি?”

“ এটা কি বললে?”

“ তুমি চাও ছেলেটা জাদু-স্বপ্নের মায়ায় মিশে থাকুক। সহজ, উষ্ণ কিন্তু ভীষণ কোমল। তোমার তৈরি অবনি দেবীটা দেখতে অসাধারণ, আমার ভীষণ সুন্দর লাগছিল ওদের জড়াজড়ির ধরনটা । কিছুক্ষণ পর অনিম ছেলেটা সি-১১৯ নক্ষত্রটার মত সুন্দর আচরণ করে ঘুমিয়ে পড়ল।” 

“ওয়াও! মানুষ সাজতে চাও না আবার ঢং ধরে মানুষের আবেগ মাখিয়ে কথা বলো। কিছুটা ইনফ্যাচুয়েশন জন্ম নিয়েছে তাহলে? ভালো এদেরকে তাড়াতাড়ি ডাম্প করো না, নাহলে অনেক কিছু মিস করবে।” 

“তুমি মিস করছো কিছু, দেখো এইমাত্র কাকে যেন দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। দেখে মনে হচ্ছে, কিছু ক্রোমোজোম হাস্যকরভাবে বের হয়ে যাবে।”

“হুম, ওয়েট ড্রিম বলে ওরা। ডিউরেশনটা বাড়িয়ে দিলে কিছু মজার দৃশ্য দেখা যাবে, দেখবে?”

“হাহা, এইগুলো কী? মাথাকাটা জড় পদার্থের মতো কতগুলো মেয়ে দেখছে। না তোমার অবস্থা এক্কেবারে খারাপ না ‘যেন’, ফান আছে।”

“জি, এজন্য কিছুক্ষণ থামতে হয়। আর কতো ছুটবে 'কারা'? এই ইউনিভার্স বড় বিচিত্র, নতুন নতুন সিচুয়েশনের সাথে খাপ-খাওয়ানো শিখতে হবে। দেখবে, সবকিছু ‘লিট’ লাগছে।”

“Yes, Supreme Entity ! নাহলে ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না। হাহা !”

এখনও মায়ের গর্ভে থাকা কোনো হাফউইট রাইটারের গড়বড় বাস্তবের গল্প এটা। অনিমকে কেন্দ্রীভূত করে এই হঠাৎ গল্প গম্ভীরভাবে নেয়ার কিছু নেই। একেবারে ফেলে না দিলে নিজেদের কিম্ভূতকিমাকার বাস্তবতাকে চাইলে পরাবাস্তবতায় মেশানো যায়, অপমান করা যায়। পরিশেষে, পরিশুদ্ধ ভালোবাসাতেও নেড়েচেড়ে দেখা যায়। 

আজ লিনিয়ার ফ্যাশনের একটা বিরস দিন ছিল অনিমের। রোদেলার সাথে প্রথম ডেট গড়িয়েছিল কেবল ত্রিশ মিনিট। খুব সাধারণ কিছু বিষয় নিয়ে তাদের মাঝে অনুভূতিহীন বাক্যের আদান-প্রদান ঘটেছিল । বাসায় এসে দুইজনই যা পুরোপুরি  ভুলে গেছে। এমন দিন, এই পাতানো গল্পের জন্য খুব আদর্শ কিছু না। তাই প্রচণ্ড জোরপূর্বক একটা প্যারালাল ধাক্কা দিয়ে পাঠকগণকে জানাইতে চাই, কথিত সংলাপ, গল্পের অতি-গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রবিশেষ। কারও দৃশ্যকল্পনা অবশ্যই না। কসমিক যাত্রায় ব্যাখ্যাতীত অনেক কিছুই হতে পারে। কোনো ব্যাখ্যার উপস্থিতি পছন্দ না হলে, এই জগতের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। নিয়ম মেনে সব ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা ধরিয়ে দেবার।   

একদা বিশিষ্ট আত্নভোলা একজন মনীষী কহিয়াছিলেন, “বাছা, ভালো লাগলেও কিছু করিতে ইচ্ছা করিবে, মন্দ লাগলেও কিছু করিতে ইচ্ছা করিবে। সুতরাং, যাহাই মনে চায় তাহাই ভেজে খেয়ে ফেলো।” গল্পের জন্য এই বাণীর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। 

পরিশেষে, কোনো সত্তাই এই নিয়মের ঊর্ধ্বে নয়।                  

৩.

“বাবা হাল ছাড়িস না। তনিমা চেষ্টা করছে ওর বন্ধুবান্ধব ধরে কিছু একটা ম্যানেজ করতে। চৌদ্দগুষ্টির কেউ তোর লাইন অফ ইন্টারেস্টের সাথেও রিলেটেড না। তোর ফুপা বেঁচে থাকলে খুব ভালো একটা চাকরি নির্দ্বিধায় ম্যানেজ করে ফেলতো। লোকটার নেটওয়ার্কিং সাংঘাতিক ছিল। আর বেশিদিন তো হয় নাই, গ্রাজুয়েট হয়েছিস মাত্র ন’মাস। এত বড় একটা দেশ স্বাধীন হতেও ন’মাস লেগেছিল। কত ত্যাগ, কত রক্তের পরে এই স্বাধীনতা আসল । তোর তো খালি বসে বসে মশার কামড় খাওয়া লাগছে। টেনশন করিস না, একটা কিছু তো হবেই।”   

“জি ফুপু।” আমি নিতান্ত অনাগ্রহের সাথে উত্তর দিলাম। কেউ কি আমাকে বোঝাবে চাকরির অপেক্ষার সাথে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের কি সম্পর্ক? বাড়তি কথা বলা মুরুব্বিদের সাথে হ্যাঁ/না ছাড়া কিছু বলার থাকে না কেন? তার বাসায় প্রতিদিন আসা বন্ধ করতে হবে। আমি ব্রাঞ্চ সারতেছিলাম। খাবার সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাপুরুষের সাধু-গীতেও আমার ভীষণ অরুচি। স্বয়ং মা কিছু বললেও আমি ডিসক্লেইমার দেই,  “শান্তিপূর্ণ রিযিকপর্ব ইমানের অঙ্গ। ইবাদতের মর্যাদায় আঘাত হানলে এরপর থেকে এই মুমিনের দেখা পাবা শুধু ইদচান্দে।” আর এই ফুপু মহিলাটার প্যানপ্যানানির ‘বাড়াবাড়ি পর্ব’ খাবার শেষ হবার পরও চলতেছে। 

কয়েক মাস আগেও তার আচরণ ছিল সহনীয় মাত্রায়। দুই-তিনদিন তার বাড়িতে না আসলে মায়েদের অত্যাচারের মত সেধে কল করে বাড়িতে ডাকতেন। “ বাবা কি খাচ্ছিস না খাচ্ছিস, ফুপুর বাসায় এসে কয়দিন থেকে যাস না কেন?” 

চাকরি নামের পরিবর্তনের সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে না, কিন্তু সবচাইতে কাছের মানুষগুলোর আমার প্রতি দিনান্ত বিমূঢ় আচরণের অকারণ সাক্ষী হচ্ছি। মৌন ভান দেখানো আহাজারির কলের গান আর কতকাল সহ্য করতে হবে? আসলে  মানুষের ঠেকাও পড়ে নাই আমাকে বাসায় বসায়ে প্রতিদিন ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়ানোর।   

“আলুবড়াটা কেমন লেগেছে খেতে? দই দিয়ে মেরিনেড করে ডিপ অয়েলে ফ্রাই করেছি। কোরালের সাথে কম্বিনেশনটা পারফেক্ট যাবার কথা। তনিমা রাতে ডিফরেন্ট কিছু না পেলে আবার খেতে চায় না বুঝেছিস। এই বয়সে এত্তবড় একটা ধামড়ি মেয়ের জন্য এত এফোর্ট দিতে কার ভালো লাগে?” 

ভালো না লাগলে হরতাল ডাকেন! 

“... শুধু মা এটা খেতে ইচ্ছা করে, ওটা খেতে ইচ্ছা করে। জামাইটা বাইরে থেকে আসলে আমাকে ইউনিক রেসিপি রেঁধে খাওয়ায়। এত্ত ভালো একটা ছেলে পড়েছে কপালে, মাশাআল্লাহ্‌ মহাগুণী। মাঝেমাঝে ওরা করে কি জানিস অনিম……”

“ না।”

“দুজন বিশাল এরেঞ্জমেন্ট করে আমাকে সারপ্রাইজ ভ্যাকেশনে নিয়ে যায়। গতবার সিলেটের একটা রিসোর্টে কি কাণ্ডখানাই না করল………” 

দয়া করে অনাগ্রহটা একটু বুঝেন ফুপু!

“আরে শোন…… তুই থাকলে ওদের কেমিস্ট্রি দেখে খালি বিয়ে করতে চাইতি। তোর বিয়েটা হয়ে গেলে চিন্তা কর, তোর বউ আর আমরা মিলে যখন তখন এমন ট্রিপ প্ল্যান করতে পারবো।”

God bless me। 

“এরপর তোর বাসায় হুট করে যেয়ে তোর বউকে বিরক্ত করবো। আচ্ছা, তোর বউ না হয় পরের মেয়ে হবে, তুই কখনও বিরক্ত হবি না তো?” 

“হেহেহে, কি যে চিন্তা করেন ফুপু! আমি থাকবো সুইচের মত। টেপা, বন্ধ করা যাবতীয় দায়িত্ব খালি আপনার। আপনি না থাকলে আমি মানুষ হইতে পারতাম?” নিরুপায় ঘোড়া সবচেয়ে বড় পার্ফরমার। আসলে এন্টারটেইনার, সামনের ট্রেনার যার চেহারা দেখলে প্রতিনিয়ত বেটার ট্রেনিং-এর তাগিদ অনুভব করেন। 

“হ্যাঁ, তাই হবে কিন্তু বুঝে রেখো, বাবা। আমাকে এখন যেভাবে বিরক্ত করছিস, তারচেয়ে ত্রিশগুণ বেশি বিরক্ত করব তোদের।” 

লও ঠ্যালা। ক্লিয়ারকাট বুঝে নাও অনিম, আর চাইলেও নির্লজ্জ হইতে পারবা না। কিন্তু আমি উলটা মহিলার নির্লজ্জতার সীমা কোথায় যেয়ে ঠেকে দেখে ছাড়বো। এই যে বসলাম, তো ধ্যান শুরু। দেখি উনি কতক্ষণে থামেন। 

“তোরা দুজন নিশ্চয়ই খুব ভালো চাকরি করবি ! আমার না মাথায় ঢুকে না, তোর চাকরিটা কেন হচ্ছে না? রেজাল্ট তো তোর খারাপ না, আরেকটু স্মার্ট হতে পারস না?” 

Not again Allah, please । “............ আমি তো বুড়িয়ে যাচ্ছি বাবা, বেঁচে থাকতে থাকতে তোকে সেটল্ড দেখতে চাই।”

প প প প। বিপ বিপ বিপ ।

“শরীর ইদানিং খুব ভেঙ্গে পড়েছে। গতকাল তুই আসবি বলে হাই প্রেশার নিয়ে আমার কিচেনে ঢুকতে হলো, মাঝে মাঝে তৃষা ফুটফাট রান্না করে আমাকে বাঁচায় বিপদ থেকে। এই মেয়েটা অসম্ভব কাজের………” 

ভন ভন ভন। পুত পুত পুত। 

“বিশ্বাস কর ! আজকে তো পা উঠানোর শক্তিটুকু ছিল না। কিন্তু কি আর করা! ভাইয়ের ছেলে তুই, তোকে আজেবাজে কিছু খেতে দেয়া যায় না। কাজের মেয়ের রান্না খেতে ফুপুর কাছে আসিস না নিশ্চয়ই !” 

একই আলাপ, একই বেদনা,  এদের মাথা কোন বেদনার সিস্টেমে প্রোগ্রাম করা ভাই। চেহারাটা ভালো করে দেখা দরকার। ধবল, নাদুসনুদুস, কিন্তু হাত নাড়ানোর শক্তি আবার ঠিকই আছে! আশার কথা চেহারায় বিরক্তিতে ক্লান্তির ভাব সুস্পষ্ট । চোখের পাতা নেমে আসতেছে প্রায়। আমি জিততে চলেছি । আপনি বিরক্ত হয়ে মারা যাবেন ফুপু, আমি উদ্ভিদ হয়ে বসে থাকবো।

“আমি কালকে থেকে রোজা রাখব বুঝলি, নাতির মানত করেছি । আর ভালো হয় আমার জন্য, সকাল-বিকাল রান্নার ঝামেলা নাই। চিড়া-মুড়ি খেয়ে ইফতার সেরে নেব। তোরা কি বুঝবি রান্নার যন্ত্রণা……... “

মহিলা সিরিয়াস চালাক। অথচ বাবা কত সরল একটা মানুষ। হুদাই কিনা জানি না, কিন্তু বাবার জন্য খারাপ লাগতেছে।

“............ আমি নাম দিয়েছি ‘ডিজিটাল গদি জেনারেশন’, আরাম আর ফাঁকি ছাড়া কিছু বুঝতে চাস না……...”

আমার লজ্জাবোধক হাসি ‘প্রোগ্রাম’, তুমি চালু হয়ে যাও। 

“তনিমা কিন্তু মার কষ্ট বুঝে। স্যালারি প্রচুর পায়। সেদিন পিজ্জা, ডাম্পলিং কি কি যেন নিয়ে আসল । মেয়েটার কষ্টের রোজগারের টাকা খেতে কি যে একটা তৃপ্তি কাজ করে জানিস, অনিম।” 

উফ ! অনিম হাসি কন্টিনিউ, উনার ফুয়েল প্রায় শেষের কাছে। কি হইল, ফুপি থামলেন ক্যান? বেচারি অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার হাসিমুখের দিকে। 

“তোর চাকরিটা হয়ে গেলে তুই কিন্তু এ সওওওব খাওয়াবি। ভাবিস না আবার, মেয়ের কথা বলে খোটা দিচ্ছি। তোর বেকার চেহারা দেখতে আর ভালো লাগে না। ভাইয়া কত আশা করে আছেন………” 

জিত্যা গেলেন আজকে ! এখন আমি পগারপাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে যাবো। আর সম্ভব না আমার পক্ষে। উদ্ভিদ তোমায় লাল সালাম। 

“ আচ্ছা ফুপু । আজকে উঠি । টেনশন করবেন না, পেয়ে যাব একটা কিছু। আপনি শরীরের যত্ন নেন । পারলে নিয়ম করে হাঁটেন, ঝরঝরে লাগবে।”

“আরে বোস। বিকাল চারটায় তোর মতো বেকারের কি কাজ? হাহা! বুড়োদের কম্পানি দিলে নেকি আছে গাধা। মহানবির হাদিসটা ভুলে গেলি? নবি বলেছেন মুরুব্বিদের ইচ্ছা সম্মান করতে……”

ইচ্ছা সম্মান করতে গেলে তো মরে যাওয়া লাগবে খোদা! আমারতো মনে হয় নবিজি তাদের সম্মান রাখতে বলছেন শুধু। একটা মেন্টাল মুরুব্বি আমারে গুলি খেয়ে মরে যেতে বললে কি আমি গুলি খাবো? আশ্চর্য পেইনরে ভাই! 

“একদিন তুইও কিন্তু বুড়া হবি, তখন দেখিস সবাইকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করবে……”

আমারে কোরিয়ার রিভেঞ্জ সাগার ফ্যাক্টরি থেকে আমদানি করা জীবনের একেকটা লাল-নীল সুতা দেখাইতেছে বুড়ি। পুরাই ব্লকবাস্টার পেইন ভাই।

“আর খেয়েই নোয়াখাইল্যা গরুচোরগুলোর মত দৌড় দিবি না। লজ্জা রাখ মনে, তুই কোন এলাকার পয়দা ভুলে যাস না……”

আমি আমার স্বল্পভাষী বাবাকে ছাড়ায়ে সাধু-সন্ন্যাসীদের লেভেল অতিক্রমের কাছাকাছি। আফসোস এমন বৃথা মানবজন্মের। এই জাতীয় সংগ্রামের গল্প কাউকে বলে সার্থকতায় ভেসে যাওয়া কোনোদিন সম্ভব না। 

“তোর হয়েছে কি বলবি? কেমন সিরিয়াল কিলারগুলোর মত চেহারা বানায়ে চুপ করে ছিলি তখন।”

“ না খাওয়ার পরে ঝিম ধরে ফুপু। এইজন্য চুপচাপ আছি।”

“ কই দেখে তো মনে হচ্ছে না। কেমন অদ্ভুতভাবে হাসছিলি সারাটা সময়।”

মারছে! আমার ফায়ার সার্ভিসের পানি দরকার।

“এই আজকালকার ছেলেপেলেদের কিছু বুঝি না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বেয়াদবের মত চুপ করে থাকে। ঐ……… উপরে ওটা ফ্যান, ঘুরছে। কি দেখিস তুই? ঐখানে কী? আমার দিকে তাকা। ইসস্, তোর চোখের এত বিচ্ছিরি অবস্থা কেন? ইঁদুরের গর্ত বানিয়ে বসে আছিস। এই, তুই কি নেশাফেশা করছিস?” 

“না।”

“না মানে! এই আমি বুড়াফুরা সব ভুলে যা। ঝেড়ে কাশ, নিজের বন্ধু মনে কর।” 

এইটা একটা অসুস্থ প্যারানয়েড মহিলা। ইলেকট্রিক থেরাপি দিয়ে তার মাথা বন্ধ করা দরকার। আমারে ছেড়ে দিলে সে কি মারা যায়? না কি বাসায়……

“ফুপু, আমি আপনার বাসায় আর আসবো না। আপনি ভালো থাকেন, বাবাকে কিছু বলবেন না প্লিজ……”

শিট! এটা কি করলাম।

“এই হারামজাদা, তুই কি করছিস আমার ভাইয়ের টাকা দিয়ে………”

তাজ্জবের ঘরের সিজ্জত! চিৎকার দিয়ে কান লাগায়ে দিতেছে ক্যান? এই বুড়ি তুই কিছু জানোছ? 

“এই তুই দাঁড়া কোথাও যাবি না। আমারে রাগ মারাও, বইসা বইসা বাপের টাকা উড়ায়ে নেশা মারাও। এই তুই আমার থেকেও তো আজকে দুই হাজার নিছস। মনে করো কিছু বুঝি না। তুই দাঁড়া, শাড়িটা বদলায়ে আসি। খবরদার! চুপচাপ বসে থাক……”

“বাপের টাকা উড়াই না খালি, আজাইরা কথা বলবেন না। আমার টিউশনি ছিল, চলে গ্যাছে, ছেলে রেজাল্ট খারাপ করছে। নিজের ইজ্জত মাইরা আপনার এইখানে আইসা খানার টাকা বাঁচাই, কি উল্টাপাল্টা ভাবা শুরু করছেন? আপনি উপকার করতে পারবেন না, আত্নীয়তা রাখবেন না, যথেষ্ট বুঝাইছেন । আমার এখন সময় নাই বসে বসে আপনার আজাইরা কল্পকাহিনি দেখার। যাই।” 

“ দাঁড়া, ভাইয়ারে কল দিয়ে শোনাই, তুই আমারে এতক্ষণ কি বলছিস !”

মারে মা ! কান্নাকাটি শুরু হইছে। বিধি এই ধরা হতে মোকে উঠিয়ে নিয়ে যাও । এত্ত মেলোড্রামা মানুষ কেমনে মারাইতে পারে!

“সেইদিনকার পিচ্চি, আজকে ড্রাগ-ফাগ নিয়ে মায়ের মত ফুপুরে কি বলছে এইসব। নিজে তো বুঝে না, বাবা-মার কি কষ্ট হয়, ব্যক্তিগত কষ্টের কথা বাদই দিলাম………”

“ হাহাহা !”

“ ভাইয়া…… তোমার ছেলেটা…... ”

আমারে কেউ শান্ত কর, বাপরে ফোন দিলে খবর আছে পর্যাপ্ত। সিচুয়েশন ম্যানেজ কর অনিম শালারপুত!

“ভাইয়ার ফোন ঢুকছে না কেন? আল্লাহ্‌ কি গজব নিয়ে আসলা তুমি আমাদের জন্য……… ধুর, কল যায় না। এই, তুই তোর বাপকে কল দে।”

“হা হা,মানে কী? আমারে কি কুত্তা কামড়ায়? আজব পেইন ভাই। ফুপু মাথা ঠিক করেন।”

“চুপ, হারামজাদা চুপ! তোর আজকে আমি ড্রাগ টেস্ট করাব। গেটে ফোন দেই, যাতে আটকায়ে রাখে তোরে। তুই আমারে কি মনে করছিস? কি ইতর হইছে শুয়োরের বাচ্চা। ভাইয়ার রক্তের টাকাগুলো এইভাবে……”

অনিম ছুইটা যাও, তার হাত থেকে ফোন নিয়ে ভাগ। ওয়েট, ইন্টারকম আছে। এই বিপদ তোমার মারে আসলেই বাপ বানায়ে ফেলবে। চিন্তা করো, এই মহিলাকে কীভাবে শান্ত করবা চিন্তা করো। শালার কালকে মরিন আর ওর জামাই আমারে একশবছর পায়া মদ গিলায়ে দিছে । খাইছি কিন্তু মোটে তিন পেগ। এই বালের হুদাই মুখগন্ধ খাওয়ার জন্য ডোপ টেস্টে খামু ধরা, বাল এইটা মানা যায়? আমি যাইতাম তার সাথে কিন্তু এরপর বাপকে কি বুঝাবো? এই ফ্যাকড়ার কোনো মানে আছে? অন্যদিকে, বুড়ি ‘পুলিশ-দৃষ্টিতে’ আমারে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেছে। শালার, কি উদ্ভট বিপদ...   

“এই তুই কি ফন্দি বের করতেছিস ! অনেক চালাক ভাবো নিজেকে। টেস্ট করাইলে ধরা খাবা, চান্দু। তোমার দিন শেষ। ফোন যাচ্ছে দারোয়ানের কাছে, বস চুপচাপ। আরেকবার বেয়াদ্দবি করলে এরপর সোজা জঙ্গি সাজায়ে পুলিশে দিবো।”

“ফুপু, আর ইউ ইভেন টকিং সেন্স? ফর গডস সেক, একটু বুঝার চেষ্টা করেন। ওকে, আমি কালকে একটা পার্টিতে একটু মদ খাইছিলাম । এইরকম পার্টি তো সবাই করে। তনিমা আপুকে জিজ্ঞেস করে দেখেন, ওরা ফ্রেন্ডরা কি করতো। আপনি কি বুঝেন না এসব? আমি অনেস্টলি বলতেছি, অকেশনাল ইভেন্ট ছাড়া কোনো বাড়াবাড়ি করি নাই জীবনে। আমার কি নিজের বাবার চিন্তা নাই। শান্ত হন একটু ফুপুমণি আমার, আমি না আপনার ভাইস্তা। আপনাকে মার মত সম্মান করছি আজীবন।”   

“তোর সম্মানরে আমি গুল্লি মারি। বোঝা শেষ আমার তোমার সম্মানের ধরন।” 

“ধুরও, পেইন রাখেন তো ! ব্যাপারগুলো আল্লাহর ওয়াস্তে বুঝেন।”

“এই, তুই কি করলি এটা, কুত্তার বাচ্চা! আমার হাত ধরে ফোন নেয়ার সাহস কে দিছে তোকে? তুই তো মানুষ খুন করবি। ইন্টারকমের লাইন খুলতেছিস কেন? ঐটা নষ্ট কুত্তা। কুত্তাটা ইয়াবা খেয়ে আসছে, আমি শিওর… আমি রীতিমতো স্কেয়ার্ড তাকে অবসার্ভ করে।  আল্লাহ্‌...”

“ফুপু শুনে যান”

যা করতে চাই তার উলটা হয়। মাই গড! আর ইন্টারকমে রিং ক্লিয়ার শোনা যায়। বুড়ি এতো মিথ্যা বলে ক্যান ? শিট, যাইতেছে বারান্দায়... 

“হারামজাদা, মায়ের ইজ্জত দিয়ে থাকলে পিছে আসবি না খবরদার। এই সানী, সানী…… কই তুমি? শুনে যাও। সব কাজের সময় কই থাকে…...”

সিকিউরিটিরে ডাকতে গ্যাছে, যা হওয়ার হোক। ধইরা রিহ্যাবেই তো পাঠাবে, মানুষ থাকে তো, সমস্যা নাই…… চুপ করে বসে থাক অনিম গাধার বাচ্চা। তোমার চোখের পানির কোনো দাম আছে ? নাই । কেউ কি আসতেছে ? আসুক। এই উলটা দুনিয়া তোমার জন্য না। বুড়ি যা করার করছে, পাড়া উঠায়ে চিল্লায়ে আর কি নতুন ক্ষতি … নিজেরে একটু মাফ করতে পারেন না তিনি? মানুষকে বাঁচতে দেন না! ওরা কেউ জানে রিহ্যাব কী? কেমন লাগে ঐখানে যাইতে? 

মাথা নামায়ে কতক্ষণ থাকবো? কেউ আসে না ক্যান? চোখে দেখার কিছু আছে আসলে? আমি ভয় পাওয়ার মত কি কাজ করছি? ফুপু কি বিছানায় শুয়ে কাঁদতেছেন?

“তোমার ফুপুর শাটার বন্ধ করে দেওয়া হইছে। যেয়ে দেখ, উনার বোধহয় লাইফ সাপোর্ট লাগবে।”

বিশ্বাস হইল না কথাটা। মাথা মশকরা করা শুরু করছে। সত্যি সত্যি হইলে ভালো হইত অবশ্য।

বেল বাজতেছে চৌদ্দ ঘণ্টা ধরে। বুড়ি দরজা খুলে না ক্যান?

[ মরা মানুষ দরজা খুলতে পারে না ]

কি হাস্যকর কথা ! ফুপু মারা যাবেন কেন? কিন্তু চারপাশে কেমন আতংকের মত সাইলেন্স । আজিব ! আমার কি ?

বেল বেজেই যাচ্ছে। “ম্যাডাম আমারে খুঁজছিলেন?” শোনা যায়, সিকিউরিটির কথা শোনা যায়। ফুপুর কি হইল? আমি কি পালাব? 

[ না ! ভুলেও না ! ]

ফুপুকে দেখে আসি।

৪.

কার্ডিয়াক হসপিটাল

১ম দিন

ফুপু লাইফ সাপোর্টে। আইসিইউ ইউনিটের বাইরে সব আত্নীয়স্বজন প্রায় বিধ্বস্ত।  তনিমা ছাড়া কেউ তার জন্য আশা দেখছে না। অনিম বিদঘুটে স্বরে এই পরিস্থিতির কারণ খুঁজে বেড়াচ্ছে । খুব কুৎসিত ব্যাপারটা, কিন্তু ওর মনে হচ্ছে ফুপুর অমোঘ পরিণতি ওর জন্য শুভ। বোধগুলো চেপে খুন করা যায় না? ধৈর্য ক্রমেই অধৈর্যে পরিণত হচ্ছে,নিজেকে মানুষ মনে হয় না ওর। মনে হচ্ছে আপাত বিপদ থেকে বাঁচতে চাওয়ার কারণে, ভজঘটে সবকিছু বিকট আকার ধারণ করলো । এমন কারও হয় কখনও? পরিচিত বা প্রিয়জন কেউ, তার সামনে বসে তারই নিকটজনের কারও মৃত্যুকামনার অপচিন্তায় নিজের স্বার্থপর  মুক্তিচিন্তা করছে।

ফুপু যদি বেঁচে যান এবং কথা বলা শুরু করেন, তিনি নিশ্চয়ই তার এই পরিস্থিতির জন্য একসময় অনিমকে দায়ী করবেন। তনিমা কিংবা তার বাবা-মা এরপরও কি প্রশ্রয়মাখা আদর কণ্ঠ ধরে তার সাথে কথা বলবে? তার দুই চাচা আর দুই ফুপু আর তাদের ছেলেমেয়েদের কিছু দূর অপগামী চিন্তা ওর মাথায় প্রতিনিয়ত ধাক্কা খায়। কোনো ক্রাইম না করলেও ওর স্বভাব তাদের কাছে ঠেকবে ক্রিমিনালের মতো। অনিম এসবই ভাববে, বাইরের কোনো ভাবনা আর তাকে ভাবাতে পারবে না।   

ছোট চাচার একটাই ছেলে। বয়স মাত্র চার হলো কয়দিন আগে। বড়দের নিষেধ সত্ত্বেও পায়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করছিল, “ফুপু লাইফ সাপোর্টে বেঁচে থাকবেন কয়দিন? আমরা কি প্রতিদিন এভাবে দেখতে আসবো?” অনিম জানতে চায়, এসব প্রশ্নই কেন? উত্তরগুলো তো ওর জন্যও বিভীষিকা। খেলু প্রেষণা খোঁজার সমস্ত চেষ্টা করতে যেয়ে নিজেকে আরও নির্বোধ মনে হয়- “হতেই পারে, ছেলে-মেয়েদের দেয়া কষ্ট বাবা-মা’রা সহ্য করতে পারেন না”। শুধুই প্রশ্ন, আমাদের হৃদয়ে এত মায়া ভরা কেন? 

“ব্যাপারটা তোমার জন্য উলটা, তোমার হৃদয় মায়ায় পূর্ণ প্রায় প্রতিটা মানুষের জন্য। ফুপুই একজন, তোমার একটা সত্তা না বুঝে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।”

নিজেকে নিজে সাধা এই বোকা বোধগুলোর কোন অর্থ আছে? তনিমা আপু তাকে কিছুক্ষণ পরপর ধরে কেঁদে ভাষাহীন অনুযোগ করছেন। কারও নিশ্চয়ই কখনও এতিম হওয়ার আহ্লাদ জাগে না। 

“ঝিম ধরা আবেগগুলো ঝেড়ে তুমিও কাঁদো। শূন্য শরীরে ঘুমাতে যাও। জানবে প্রচণ্ড নিদ্রায় শান্তি আছে। সেখানে তোমার বিশেষ কল্পনাগুলো জেগে আছে তোমাকে শান্ত করতে।” 

অনিম ভাষা-ভাষা চোখে একটা মায়ামূর্তি দেখছে। রং বদলে ফেলতে পারে সে মূর্তি। ‘শুভ্র-নীল-কাল’ অপ্সরী যাকে বলে। কিন্তু কেন? অবচেতনের যোগাড় করা শান্তির ব্যাবস্থায় ওর ঘেন্না ধরছে। এই মূর্তির ওর এখন কোনো প্রয়োজনে আসবে না।

“মাকে, সব অবস্থাতেই জড়িয়ে ধরা যায়। অনিম তোমার মা আছেন না?”

“তাহলে তনিমা আপু ধরতে পারছে না কেন?”

“তুমি জানো কেন।” 

“আমি জানি না।” 

“সবাই জানি, শুধু মাদের ধর্তব্য ধরে নেই। সত্য নীল বিষের মতো আমরা সবাই জানি। তোমার বাবা চাচাদের দেখো, তারা শক্ত। এমন যন্ত্রণা সহ্য করেছেন দেখে। তারা এখনও পারছেন, তাই তোমাকেও পারতে হবে।” 

“তাদের মনে প্রিয় কারও জন্য মৃত্যুকামনা নাই।”

“তুমি কয়েক মিনিটের যন্ত্রণার কন্সিকয়েন্সকে এত পাত্তা দিচ্ছো কেন? বাসায় যেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে নামাজ পড়ে দোয়া করবে। ক্ষমা চাও নিজের জন্য। মাথা ঠান্ডা রাখো, দেখ বাবা-চাচারা তাইতো  করছেন। তারা কিছুই করেন নাই, তারপরও তারা ক্ষমা চাচ্ছেন। পরিশুদ্ধির নিয়মে ভাবো।” 

কথাগুলো একান্তে আওড়ে যায় অনিম। ওর মা চিন্তিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। উঠে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। অনিমের নিজেকে নাটুকে মনে হয়। ও হুড়মুড় করে ছুটে পালিয়ে গেল। হসপিটালের মানুষজন দ্ব্যর্থ দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখছে। কিছুক্ষণ পর এই পরিবেশের নিয়মে সবকিছু স্বাভাবিক হবে, হয়তোবা। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে অনিম নিজেও তাই বোধ করছিল। দুঃসংবাদের কারখানা ছেড়ে আসার পর সব যন্ত্রণা নিয়ম মেনে স্বাভাবিক রাস্তায় চলতে শুরু করে। তাই পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওর একটা সিগারেট খেতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করবে।

“যেন?” 

“আমি কিছু করতে চাই না, কিছু জিজ্ঞেস করো না ‘কারা’। এদের ক্ষত এদেরকেই ঠিক করতে দাও।” 

“তুমি কাজটা ঠিক করনি, আর ওরকম করতে যেও না।”

“ইনসেন্সিটিভিটি দেখতে তোমার ভালো লাগবে? তখন কিন্তু কিছু বললে না।”

“রিহ্যাব নামক অবসারভেশন সেন্টারটার অভিজ্ঞতা হতো, খারাপ কি?”

“সোশিওপ্যাথ কারা, ভালো মানুষ হয়ে বের হওয়ার আনুপাতিক পরিমাণ খুব কম সেখানে। সেখানকার ডাক্তাররাও কেন যেন দিনশেষে বিশ্বাস করেন পুরো সিস্টেমটাই ভীষণ গোলমেলে।” 

[তোমার ফুপুর শাটার আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হইছে] অনিমের কানে বাজছে কথাগুলো। 

“এই ছেলে জেনে বসে আছে ওর নিজের ভাবনা নয় ওসব। তুমি সিরিয়াস মুহূর্তে অমন হালকা চালে কথা বললে কেন?”

“অনিম ওভাবেই ক্ষোভের অনুভূতি জানতে অভ্যস্ত। আমি আলাদা কেউ হয়ে কিছু জানাতে চাই নাই।”

“ও নিজেকে দুষছে, অস্বাভাবিক জেনেছে তা বোঝা হলো।”

“হুম।” 

“অডিটরি হ্যালুসিনেশনে থেকে সরাসরি যোগাযোগ করবো না কি এখন থেকে?”

“ওর অল্টার ইগো ভেঙ্গে গেছে। তুমি কিছুদিন এভাবে যোগাযোগ করতে পারো । খুব সাবধানে আনন্যাচারাল পারসোনালিটিটা কন্ট্রোল করো। ধরতে পারো, কিছুদিন পর ওদের বিশেষজ্ঞরা এই সমস্ত অসুবিধা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।” 

“এসব তুমি করো, আমি দেখি। নতুন নার্ভ কম্পালসগুলোর রিঅ্যাকশন-রিফ্লেক্স বিহেভিয়ার পুরোপুরি বুঝতে আমার সুবিধা হবে।”

“স্প্লিট সেলের কথা ভুলে গেলে না কি? তুমি নিজে সিম্যুলেট করছো না কেন?”

“অসংখ্য বাইনারি কো-অরডিনেটস তৈরি হবে, মজার কিছু হবে না। তুমি চাইলেই ফোরথ রিয়েলিটির ইমপালস তৈরি করতে পারবে। যেহেতু, তথ্য তুলনায় এই গ্রহে তুমি আমার থেকে সমৃদ্ধ।” 

“সরাসরি রিজেক্ট করবে ওর সিস্টেম। ওরা মূর্খ প্রজাতি, ভয় পায় এসবে। ঘোস্ট সাবমিশানে নিজে যেয়ে রিহ্যাবে এডমিশান নেবে। তবুও আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।”

“ওকে এখনই ডিকন্সট্রাক্ট করতে যেয়ো না। শুধু অভিজ্ঞতা জেনারেট করবে, আমি পরে ডি-সিম্যুলেট করে নেব।”

“ ‘যেন,’ ডিকন্সট্রাক্ট আমার একার পক্ষে সম্ভব না। ওদের অরগ্যানিক বডি অফ রিয়েলিটির স্বতন্ত্র চেইন আছে। অনিম নিজে সরাসরি তিনটা রিয়েলিটির পার্টিসিপেন্ট। মেটানয়ান কোড অফ কন্ডাক্ট অক্ষত থাকছে, দুশ্চিন্তা নাই।”   


 

কার্ডিয়াক হসপিটাল

২য় দিন

আজকে কয়েকজন আত্নীয় নেই। এক চাচি এসে চলে গেছেন, তার বাচ্চাদের পড়াশোনা আছে। তাদের আবার সবসময় এক্সাম লেগে থাকে। মেজো ফুপা, ছোট ফুপা দুইজনের কেউই অফিস থেকে সময় বের করতে পারছেন না। দুলাভাই কাল আসছেন দেশে, এমনিতে কিছুক্ষণ পরপর সবাইকে কল করছেন। তনিমা কারো সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় নাই। একটু আগে অনিমকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফয়সালের সাথে কথা বলতে হয়। তিনি সবার মত নিয়ম মেনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে হলো?’ অনিম জানায়, সে ঘুমাচ্ছিল। সিকিউরিটি এসে ফুপুকে খুঁজলে তাকে ডাকা হয়। বিছানায় ফুপু শ্বাস নিতে পারছিলেন না। এরপর অ্যাম্বুলেন্স কল করা হয়।   

অনিম কিছুক্ষণ আগে নামাজ পড়েছে। পরিশুদ্ধির স্বাভাবিক নিয়ম তার কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। বাবা তার পাশে বসে একমনে তসবি পড়ছেন। তিনি বললেন, “ফুপু তাকে সবসময় খুব আদর করতেন। মনে সাহস রেখে দোয়া করলে কোমা-স্লিপ থেকে উঠে তিনি আরও বেশি আদর করবেন।” 

ভাবনা আবার পেছনে চলে যায়। ফুপু মেকি ভালবাসা দেখাতেন। যাই হোক, সত্য তার নিজের কাছেই আবর্জনার মতো মনে হচ্ছে। তিনি যদি আসলেই বেঁচে যান, হতে পারে ভাবতে শুরু করবেন এই ছেলেকে তখন ভুল বুঝেছিলেন। 

“যেন, তুমি কি করলে? সুন্দর ভবিষ্যৎ সম্ভব জেনেও ঐ কাজ করলে কেন?”

“ঐ মহিলা কার্মায় প্রবল বিশ্বাসী, কার্মার প্যারাডক্সে ফেঁসে গিয়েছিলেন। প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে। তিনি চেয়েছিলেন মাথায় ভাসতে থাকা ঐ ফেইক রিয়েলিটির পার্টিসিপেন্ট অনিমকে খুন করতে। খারাপ কিছু চেয়েছিলেন, তাই তাকে তার পাল্টা সত্য জানতে হয়েছে।” 

“তার শরীরের শেষ নিশ্বাসগুলোয় অনিমের খুনি চেহারা বেঁধে ছিল। ছেলেটার প্রতি অসহ্য ঘৃণা জেনে তার দেহ-আত্না পরাজিত হয়েছে। এই ডিপ রুটেড কনশাসনেস কি সুস্থ হলে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব?” 

“এদের পরিবারগত হাস্যকর পদ্ধতিতে তিনি অনেক ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন। তিনি ঝাড়বেন তো নাই, উলটা এই ছেলেকে বাবা-মা থেকে বিচ্যুত করার সমস্ত নাটক করবেন।” 

“দেখ, তার আত্নারও কোনো ক্ষমতা দেখছি না। থাকলে তিনি দেখতেন, কিছু ভালো কাজ বা দর্শনের কারণে তার জন্য এতগুলো মানুষ এখানে বসে প্রার্থনা করছে।” 

“আত্নার ক্ষমতা নাই কেন?” 

“দুনিয়াবি জিনিস নিয়ে মেতে থাকতেন, এই জন্য। প্রার্থনা করতেন, বিশ্বাসে বল পেতেন না। স্পিরিচুয়ালিটির ধারে কাছে ছিলেন না। তার কাছে এসবের বিশেষ পাত্তা নাই।” 

“মুখস্থ পড়ার মত ভালো কথা বলতেন। শিখিয়ে দেখা আবেগে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতেন। নিজের মূল্যবোধ নিজে নির্ধারণ করতেন না।” 

“তার প্রাচুর্যের সান্নিধ্য আছে। তিনি কখনও এসবের প্রয়োজন বোধ করেননি।”

“তুমি তাকে ভালো শিক্ষা দিয়েছো।” 

“মনে হয় না। মূর্খ মহিলা, কার্মা প্যারাডক্স না জেনে কোমায় চলে গেছে। শিক্ষায় লাভ-ক্ষতির হিসাব থাকে। তিনি এসবের ঊর্ধ্বে।”

“আমার তোমাকে মূর্খ মনে হচ্ছে, যেন। যাকে শিখানো যাবে না তার শিক্ষা হবে অনেকটা এরকম।” 

“কোমা শিক্ষা? কারা একটা আইডিয়া আছে।”

“কি?”

“অনিমের ভাবনা দেখো, পরিষ্কার হবে।”

যদি ফুপুর কোনো ধরনের ডিমেনশিয়া হয়ে ঐ ঘটনা মুছে যায়, তাহলে কী হবে? আরে ছাতার মাথা! খালি আনাপশানাব চিন্তা, ধুর!

“সমস্যা কি তাতে? বুঝলাম না।” 

“থট কন্ট্রোল করছে। ওর ধারণা ওর চিন্তা ভাবনাগুলো সাইকোপ্যাথিক।”

“না, আইডিয়াটা খারাপ। ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার রোগীদের স্মৃতি-বিকৃতিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়।”

এর চেয়ে স্বাভাবিকতা ভালো, তাতে কেউ মরে গেলেও ক্ষতি নাই। আবার মৃত্যুচিন্তা!

“উনি বেশি দিন বাঁচতেন না এমনিতেও। উনি বেঁচে গেলে তুমি অর্ধমৃত জীবন দিয়ে কি করবে? ছোট্ট একটা বাটারফ্লাই ইফেক্টে তোমার বাস্তব হতো খুব করুণ।” 

শাউয়া, তুই থাম! রেডিওচোদা থিওরিস্ট বাল। চ্যাঙের ইনার ভয়েস এমন ভিলেনের হোগা চাটা শুরু করছে কবে থেকে? নামাজ পড়ে ঠিক করতে হবে সব। 

“যেন, আমার ইচ্ছা করছে একটা মানুষের শেপে যেয়ে মূর্খটাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে আসি। ”

“লেট মি, কারা।” 

অনিমের মনে মনে কথা বলা ওর মা'র একদমই ভালো লাগছিল না। ঘোর কাটাতে উনি ওর গালে একটা ছোট চড় কষিয়ে দেন। বেচারা অবাক হয়ে মা'র দিকে তাকিয়ে থাকে। 

“তুই বাসায় যা। আমরা আছি এখানে, ঘুম দরকার তোর।”

অনিম কিছু বলল না। বাসায় যেতে ভালো লাগবে না। ওর প্রবল মনে হচ্ছে ফুপু জেগে তনিমা আপুকে জড়িয়ে ধরবেন। আদতে দৃশ্যটা দেখতে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। এদিকে ফুপারা চলে এসেছেন। ব্যস্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, লাইফ সাপোর্টে কয়দিন দেখবেন। আজকে ডাক্তার পরিষ্কার করেছেন তার জন্য আশা না রাখাই ভাল।

“যেন, তুমি তো হত্যা করে ফেললে?” 

“টেকনিক্যালি, আমি হত্যা করি নাই। তার হার্টবিট কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করেছিলাম। আর হ্যাঁ, কিছুটা অত্যাচার করেছিলাম তার মাথায়। কিন্তু মহিলা নিশ্বাস নিচ্ছিল ভুলে যেয়ো না।”

“দুর্বল প্রাণী, বেঁচে থাকার জন্য অনিমকে প্রতিদিন মুরগি খেতে দেখি। ওর তখন আমার চিন্তা গায়ে লাগানোতে  কি এমন ডিগনিটি ছিল?” 

“এরা নিজেদের ভালো কামনাকে সেন্সিবিলিটি বলে।”

“আচ্ছা ! ডুয়াল নেচারের আইডেন্টিটি।”

“ব্যাপারটা ওরা নিজেরাও খুব একটা পছন্দ করে না।” 

“অনিম, তোমার Yin Yang মনে আছে না? জীবনটাকে প্রস্তুত করতে হয় এই ডুয়ালিজমে। কসমিক রুল।”

অনিম বোবা হয়ে গেছে। নিজের স্বর হারিয়ে গেছে কি না ভাবছিল। কিছু মনে হওয়া কণ্ঠের কথা শুনে সে জীবন ওলটপালট করতে চায় না। তার একান্ত পরিচয় আসলে কোথায় ঘনীভূত? টেনে আলাদা করলে কেউ তাকে চিনতে পারবে? সে নিজেই কি নিজেকে চিনতে পারবে?

 “ওর খারাপ লাগায় আমাদের বাজে অংশগ্রহণ আছে।”

“অল্টার করতে চাও?”

“ না থাক, থাকি এভাবেই।” 

কার্ডিয়াক হসপিটাল

৩য় দিন

যেকোনো মুহূর্তে ফুপুর লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হবে। ডেথ এরেঞ্জমেন্ট চলতেছে। উনি কার স্বাক্ষরে অথবা কার সিদ্ধান্তে মারা যাচ্ছেন এটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কাউকে সত্য ঘটনাটা খুলে বলা। ফুপু হাইপার টেনশনের রোগী ছিলেন। রেস্পন্সিবিলিটি বলে, তাদের অনমনীয় পালসগুলোকে ট্রিগার করে এমন কিছু করতে নাই। কিন্তু তার সাথে ভয়ানক অন্যায় হইছে। কারও না কারও তো অবশ্যই জানা উচিত ছিল কি হইছিল। বাবা? মা? বড় চাচা না কি তনিমা আপু? ফয়সাল ভাইয়া হয়ত ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সবাই ব্যস্ত, আসল ঘটনা না জেনে তার মাটির ঠিকানা করতে ব্যস্ত। তার বেডের চারপাশে আমলনামায় ব্যস্ত। 

কোনো ফেরেশতা খোঁজা দরকার। কাঁধের ফেরেশতারা বোবা, কায়াহীন রোবট। অতি অবশ্যই এখন আজরাইলকে খোঁজার দরকার নাই। উনি বলবত আছেন। সবার চোখে-মুখে এই বান্দার ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। সত্য হোক কিংবা মিথ্যা, তার অস্তিত্ব আসল সময়ে ভয়াবহ। 

ফুপু মারা গেছেন। আজরাইল চলে গেছেন। না কি যান নাই? হসপিটালেই তো তার কারবার। 

খুনিরা কেমনে বাঁচে? কেউ জানে না। ওদের প্যানিক অ্যাটাক হয় না? ওরা পানি খেয়ে খেয়ে পাগল হইতে চায় না? চাওয়ার তো কথা। 

মুখে থুথু আসছে, আলজিব শুষে নিচ্ছে। চোখের জীবন-তৃষ্ণা মেটানোর সাধ। ধু ধু উদ্যানে কোনো আত্না নাই। কেউ আপনমনে পা জোড়া সিঁড়ি বেয়ে নামাইতে থাকে। আমি কোনো মেয়ের সুন্দর কান্নার শব্দ ধরে নামতে থাকি। আমি এসবে আছি তাহলে ? না, আমার কান্নার স্বর সুন্দর লাগবার কথা না। কে বলে এসব কথা? কেউ মারা যাবে, আমি স্বর পেয়ে জানি কেন? এই ক্ষমতা দিয়ে আমার কোনো কাজ নাই।  সবচেয়ে সরল ও সুন্দরতম কিছু, তুমি কি ধরা দিবা? সম্ভবত একটা মানুষ হিসাবে যাকে কেউ চিনে না। যার মৃত্যুর আগাম নড়ন চড়ন জানার কোন উপায় থাকবে না!

মস্তিষ্কগর্ভের সাবলীল বাসিন্দারা নিজ নিজ কণ্ঠ নিয়ে সান্ত্বনা জানাচ্ছে। আমি ছেলেমানুষ, সাদা পোশাকের অজস্র দেবী পালছি জন্মান্তর। নিযুত দেবীরা সেই শাশ্বত কোমলস্বরে ডুকরে কাঁদতেছে। সবাই চোখের সামনে একে একে এসে কপালের ঘাম মুছে বলতেছে, “ভয় নাই। আমরা ‘অবোধ নারীইন্দ্রিয় মায়াধর্ম’ নিয়ে জন্মি নাই। তুমি তোমার সুন্দর চাইলেই ছুঁতে পারো। আমাদের তুমি এখন দেখতে পারছো, ছুঁয়ে দেখবে?” কেউ সিঁড়িতে স্তব্ধ বসে এসব দেখতেছে, শুনতেছে। 

“যেন! যেন! ওকে ছাড়ো, জ্বরে মারা পড়বে। ছেলেটার শরীর তৈরি হয় নাই, তুমি ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

“ভয় নাই, শুধু ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছি। সময় হয়ে গেছে 'কারা'।” 

কাঁচ বাঁধানো ফায়ার এক্সিটের দেয়ালে একটা বাচ্চা মেয়ে মার্শমেলো খেতে খেতে দেখছিল, বেশকিছু ‘টুইন এঞ্জেল’ একটা ভাইয়াকে নিয়ে দেয়ালের পিছনে ‘স্ট্রেঞ্জ’ একটা লিফটে করে উপরে উঠছে। তার আরও স্ট্রেঞ্জ মনে হচ্ছে, কারণ এত সুন্দর একটা গল্প কেউই বিশ্বাস করবে না।   

তখনই ধুম করে পাওয়ার চলে যায়। জেনারেটর ঠিক হতে হতে হসপিটালে আরও তিনজন আইসিইউর পেশেন্ট মারা পড়ে।

চোখ খুললে অনিম দেখে সে ইমার্জেন্সির বেডে। বাবা-মা, তনিমা আপু সাথে ফয়সাল ভাইয়া, দুই ফুপু, ছোট চাচা, মেজো ফুপা, কাজিন ইমু, রাশা, সামিহা উদ্বিগ্নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ এখনও কিছু জিজ্ঞেস করছে না। শুধু চোখে সান্ত্বনা জানাচ্ছে। বড় ফুপু পাশে বসে আলতো করে হেসে কপালে হাত রাখলেন। অনিমের চোখে পানি এসে গেল।           

   

জলমানব

আমি একটা কাল্পনিক ট্রেনে চেপে কোন সিনেম্যাটিক গন্তব্যের দিকে আগাচ্ছি। সিনেম্যাটিক বলতে গন্তব্যে পৌঁছানোর গল্প অর্থে আর কি! রিয়েলিজমটা এখানে টু ডাইমেনশনাল। কালের পদচারণা নাই এই গল্পে। স্থান আর পাত্রের যোগসাজেশে গল্পকে অপরিপূর্ণতা দেবার ইনটেনশানে আছি। তা সময়ের ডিটেইল না থাকলে গল্প এমনিতেই অপরিপূর্ণ থাকে। এরপরও স্থান আর পাত্রের অরগ্যানিক জার্নিতে একধরনের ইন্টারপ্রেটেশানে গল্পে পরিপূর্ণতা চলে আসতে পারে। আমার টুল হইতেছে সব ভেগ প্রোপার্টিস। এসব গল্পকে কতখানি গল্প বলা যাইতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ আছে, তবে অবশ্যই তার সিনেম্যাটিক মাত্রা থাকতে হবে। 

বাইরে থেকে ট্রেনটা দেখতে ‘ট্রেন অফ টুমরো’র মত। আমি ‘মারকিউরি’র কথা বলতেছি, হেনরি ড্রেফাসের ‘মারকিউরি’। যার নামে নামকরণ সেই রোমান দেবতা মারকিউরি ট্র্যাভেলারদের গড, কমার্সের গড, ট্রিকস্টারদের গড। দেবতাদের মধ্যে সবচাইতে চালাক দেবতা বলা হয় তাকে। হাতে পার্স নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি মানুষের ওয়েলথ ফরচুন রিপ্রেজেন্ট করেন। এই ট্রেনের প্রতি কামরায় তার একটা বিমর্ষ নগ্ন মূর্তি আছে। মূর্তিগুলো হুবহু রেপ্লিকেটেড, একটা চুলের পার্থক্য ধরতে পারবে না কেউ। তিনি এই স্পিরিচুয়াল ট্রেনের ম্যাটেরিয়ালিজমের সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশান। দুনিয়া নামক আন্ডারওয়ার্ল্ডের বার্তা বহন করতেছেন তিনি নিঃশব্দে। 

মাঝে মাঝে ইচ্ছা করতো বিকল্প চরিত্র হইতে, এখানে আমি তা পারতেছি। সবাই পারতেছে। এই ট্রেনের যাত্রীদের সবার আসল পরিচয় আছে। এই ট্রেনের গল্প হইতেছে এখানে হঠাৎ করে কিছু চাইলেই পাওয়া যায়। আমার চাওয়া রূপকথা, মিথিক্যাল ডেস্টিনি। এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের আজব রাজ্য হোক বা স্লিপিং বিউটির প্রিন্সেস অরোরার অজানা ঘুমের রাজ্য, আমি রূপকথা চাই। আমি যেন দুধে-ভাতে রূপকথার চরিত্র হয়ে উঠতে পারি।

একধরনের মেয়েলি নিবেদন নিয়ে আমি এই ট্রেনে চড়ে বসছি। এর মাঝে আমার ফিমেল কাউন্টারপার্ট দরকার। ওর মধ্যে আমি পুরুষালি নিবেদন খুঁজবো। অযথা জটিল স্থিতি তৈরি করে মনের মাঝে গান বাজাইতে বাজাইতে…...আমি যাত্রা করবো। প্রধান সমস্যা হইতেছে, কোনো প্রকারের সামাজিক ক্রাইসিসকে সঙ্গে করে আমি যাত্রাটা করতে পারবো না। বাবা-মা দুজন বিস্মৃত এই ট্রেনে। আসল পরিচয়ের কোনো হাহাকার নিয়ে আমি ট্রেনে উঠি নাই, অন্যদের কথা জানি না।

তো প্রেমিসটা এরকম। এখন তাহলে কি ঘটতে পারে? লেখকের গল্প হারানোর অক্ষমতার মৃত্যু কি ঘটতে পারে? ঘটতেই পারে! রক্তমাংসের স্বপ্ন শুরু হয়ে মাঝপথে থেমে তাড়াতাড়ি শূন্যে বিলীন হয়ে যাইতেই পারে। এভাবেই তো গল্পের অপরিপূর্ণতা পরিপূর্ণতা পাবে। এসব সবই ঘটতেছিল, ফিমেল কাউন্টারপার্ট তার আবেদন নিয়ে হাজির হইতেছিল...ঠিক তখনই, লেখায় ঠাসা কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে যেয়ে ট্র্যাশ বিনে পড়লো।

আমার জীবনটা লেখকের এই ইগ্নোর করা জীবন। সিনেম্যাটিক গন্তব্য হইতেছে ফ্যান্টাসি হয়ে উঠতে না পারবার অযোগ্যতায় উচ্ছিষ্ট জীবনধারণ। পরিচিত স্বরের পৃথিবীর অবহেলার অপরিচিত স্বর হয়ে উঠছিলাম এক ভিন্ন জন্ম থেকে। জনপদের মানুষরা সে কাহিনি জানলে আমাকে কোনো প্রশ্ন ছাড়া আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসবে। এখন আমি পুরানো যন্ত্রণার কথা মনে করতে চাচ্ছি।

সমস্যাটা মানসিক, যন্ত্রণা মনের আকারেই নিজের আবির্ভাব জানায়। আমার জন্য ‘মন’ খুব রোমান্টিক একটা শব্দ, তারপরও তার ব্যবহার করলাম। ট্যাবু মনস্তত্ত্বে সাধারণত যেসব ব্যাপারকে রোমান্টিসাইজ করা হয় তা ইনহেরেন্টলি শয়তানি। হ্যাঁ, যৌক্তিক অনেক বিষয়ই মানুষ ট্যাবু করে রাখছে, আমি মানি, জানি। কীভাবে বোঝানো যায় ব্যাপারটাকে আসলে আজ পর্যন্ত বুঝি নাই। এই যা, সময় ঘুরে ফিরে প্রসঙ্গ টেনে নিজের অস্তিত্ব নির্ধারণ করতেছে। আমার গল্প এখনো শেষ হয় নাই, কাল্পনিকতাকে আশ্রয় করে আগাইতে চাই, যতটুকু সম্ভব। আর গোটা সমস্যাটাই আমার কল্পনার, এখানে কিম্ভূতকিমাকার একধরনের বাস্তবতা আছে। সেটাই বলা যাক।

পানি নিয়ে আমার একধরনের প্রাইমঅর্ডিয়াল ফ্যাসিনেশন আছে। সাঁতার কাটতে যে খুব পছন্দ করি তা না, পানি শুধু দেখতেই ভালো লাগে। সাঁতার কাটলে মনে হয় ম্যাজিকটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি হয়তোবা পুকুরের ধারে, দীঘির ধারে, নদীর পাড়ে, সমুদ্রের পাড়ে একটানা একা বসে থাকতে পারবো। কোনো ক্লান্তিময়তা আমাকে গ্রাস করতে পারবে না। পানির নিচে অজস্র জগত লুকানো মনে হয় আমার। গুপ্ত-আদিম-পরাক্রান্ত জীবেরা শ্লোকগাঁথা নিয়ে বিচরণ করতেছে একটা ইন্দ্রজালের আড়ালে, কল্পনার জন্য এসব মহা উৎসব। বিস্মিত হবার ইন্দ্রিয় জাপটে ধরে পথের শেষ কোণে ওদের বিচরণে মহান কিছু ধরবার চেষ্টায় মত্ত থাকতাম। না দেখা- অস্পর্শের মাঝেই ভূত-অভূতপূর্ব সব ঘটতে থাকে। একটা বিশ্বাস গাঢ় হয় যে আমি স্পেস আর টাইমের ‘থিন রেড লাইনের’ অভিযাত্রী , লাখ লাখ বছর বেঁচে থাকবো। 

মায়েদের অরা অনুভব করা যায়। শিশুরা বেশ ভালো করেই অনুভব করতে পারে মায়েদের আবেষ্টন। বড় হবার পরেও মায়েদের উষ্ণতা অনুভব করা যায়, আমি পারি না করতে। যে আদর আমার প্রাণভরে গ্রহণ করা উচিত সেখানে বিকৃতি মিশে আছে- নিজের উপর সন্দেহ আর ঘৃণা মিশে আছে- মায়ের জন্য একধরনের মায়া মিশে আছে যে মায়ায় আকুতি নাই। পানি তার বড় একটা কারণ। 

পানির কাছে বসে আমি সবসময় অপেক্ষাও করি। এই কিছু একটা এখনি বের হবে জেনে মন ধ্যান ধরে বসে থাকতো। ছিপিতে মাছ আটকাবার অপেক্ষা করে শিকারিরা, আমার শিকারের ইন্ধন নাই। মনে হইত কেউ কিছু একটা দিয়ে যাবে, এই অসহ্য নীরস পৃথিবীর মাঝে আমি অন্যলোকের সন্ধান পাবো। পানিতে ডুবে কেউ মারা গেলে তার হয়ে ফেরেশতারা এসে সান্ত্বনা দিয়ে যায়, আব্বু বলতো। বাড়ির পুকুরে আমার জন্মের আগে কেউ ডুবে মরছিল। সেই ব্যক্তি পানির ভেতর থাকে কি না আমি সচেতনে জানতে চাইতাম না কখনোই, আমার আগ্রহ ছিল অনেক কিছুকে ঘিরেই। অবচেতন মস্তিষ্কের সাথে ফাইজলামি করে তা বোঝার জ্ঞান আমার নাই। আমার মাথাটা পানির কল্পগাঁথায় মিলেমিশে গেছিল। এই বুঝি কোনো আত্না ডুব দিয়ে উঠে জাদু দেখায় ! আমি অপেক্ষা করতেই থাকি…… 

কোনো এক বিকালে আমি বরাবরের মতই একা পাড়ে বসে ছিলাম । অযত্নের পুকুরটা অপেক্ষায় অপেক্ষায় ততদিনে শ্যাওলা গজায়ে ফেলছিল। বাড়ির বাসিন্দারা বাতাস খাইতেও পুকুরে আসে না। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো ঠিকরে বের হচ্ছে, বাতাসে শান্তি শান্তি ভাব-একটু অড, বৃষ্টির দিনে সেদিন বৃষ্টি হয় নাই। রোদের একরোখা তেজ সারাদিন ভুগায়ে গেছে, কিন্তু বিকালে কিছু একটা হইছিল বাতাসের, একটু শীত শীত করতেছিল গা টা। শ্যাওলার আস্তরণের দিকে তাকায়ে থাকতে থাকতে আমি একসময় বড় বড় বুদবুদ ফুটতে দেখি। বুদবুদ অনেকক্ষণ ধরেই ফুটতেছিল, আমার মাথাও প্রায় আউলায় যায় যায় অবস্থা। দেখলাম দুইটা হাত পাখির ডানার মত ছড়াইতে ছড়াইতে কেউ আমার দিকে আগায়ে আসতেছে। হাত দুইটা এত কনভিন্সিংলি পানি কেটে আগাইতেছিল দেখে মনে হইতেছিল পানি তার ঘরবাড়ি, মায়ের মত চেনা। এক এক করে তার চুল-চোখ-নাক-মুখ-ঠোঁট-গলা দৃশ্যমান হইল। সবটাতে কোনো ‘কলিং’ এ সাড়া দিতে আসবার দূতিয়ালি। আমার পা ততক্ষণে সিমেন্টের সাথে গেঁথে গেছে, ছুটতে চাইলেও ছুটতে পারব না। আমি লোকটার চোখের দিকে তাকায়ে নির্ভার হবার চেষ্টায় রত, ক্যান বলতে পারব না। লোকটা নগ্ন ছিল তারপরও ক্যান আশ্বস্ত হইতে চাইছিলাম জানি না। 

তেমন কিছু আর হয় নাই সেদিন, আমারে কি এক অজানা মাছ হাতে তুলে দিতে চাইল। এতটুকু জানি মাছটা এই পুকুরের না। আমি হাতে নিয়ে রাখতে পারলাম না, মাছটা ফস করে পিছলায়ে পানিতে চলে গেল। লোকটা মাছ ধরতে কি না জানি না, ডুব দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এ হইল প্রথম অবিশ্বাস্য ঘটনা।

এত বড় ঘটনা আমি চেপে গেছিলাম। আমার মনে হইত কাউকে বলে ফেললে আমি কিছু একটা মিস করবো, ঘটনাটা পার্সোনাল মনে করতাম। খুব ছোটবেলা থেকেই আলাদা ঘরে ঘুমাই। আলাদা থাকাটা আমি উপভোগ করতাম। মনে প্রশ্ন এসে জমা হইতেছিল, উত্তরের কন্ট্রাডিকশনে আমি আরও অসুবিধায় পড়লাম। সব একপাশে সরায়ে আমি দ্বিতীয় এনকাউন্টারের জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। এর মাঝে অবশ্য আমি ঘাটলায় যাচ্ছিলাম, কিন্তু লোকটা দেখা দেয় নাই। 

চারপাশে একের পর এক অশুভ ঘটনা ঘটতে থাকে। আব্বু-আম্মু আলাদা হবার সিদ্ধান্ত নেন। সুস্থ সবল ছোট চাচাতো ভাই ইকরাম আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে ঘুমের মধ্যে মারা যায়। কানাকানি হইত আমার ছোট মামা রেইপ করে শ্বাসরোধ করে সেই রাতে তাকে মেরে ফেলছিল। ছোট মামা আমাদের ঘরে থেকেই পড়াশোনা করতেন। আম্মু তার প্রভাব খাটায়ে ডিভোর্সের ম্যানুপুলেশন গেইম খেলে এই হত্যা ধামাচাপা দিতে পারছিলেন। চাচা-চাচিরা আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখা বন্ধ করে দিলেন। আমি একলা খাবার খাওয়া শুরু করি। একলা খাবার খাওয়া আমার কাছে ক্যান জানি অশুভ মনে হইত, মনে হইত শাস্তি পাইতেছি অকারণে। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহতে আমি নিজেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করলাম, বড়রা তখন এসব ঘটনার কার্যকারণ খুঁজতে ব্যস্ত। মৃত্যুর কারণ জানলেও মৃত্যু ঠেকানোর উপায় তো মানুষের কাছে থাকে না। তারপরও মানুষ মাথা ঘামায়। মাথা ঘামায় হয়তো বা নিজেদেরই স্বার্থে কিংবা আমার স্বার্থের সংশ্লিষ্টতায়, সেখানে আবার আমার নিজের কোন অংশগ্রহণ নাই, উপস্থিতি নাই। আব্বু-আম্মু তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবতে-ঝগড়া করতে আমাকে আর সময় দিতে পারতো না। আমাকে কিছু বোঝাতে বোধহয় তাদের লজ্জা করতো। দুঃসময় তার নিয়ম মোতাবেক সবখানে প্যাঁচ লাগায়ে রাখছিল। আমার মনে ভিতরে ভিতরে শুভ দিনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছিল। সেই পুকুরকে ঘিরে কি না বলতে পারবো না, আমি সব আশা ব্যক্ত করতাম। 


আমার চারপাশে ক্রমশ চেপে ধরা ফাঁকা দেয়ালের সুযোগ নিলেন জলমানব। এবার কিছুটা অনুভূতি নিয়ে আসলেন, দুই মুঠি খোলা রেখে একসাথে জড় করে পানি জমায়ে খুব সাবধানে ভেসে আসতেছিলেন তিনি। তার হাতে পানির অংশটুকু থেকে সাদা রশ্মির বিকীরণ দেখা যাচ্ছিল। ড্যান্সিং পার্টিকেলস ! যেন আলোর কণা জীবন পেয়ে নাচতেছিল। আমাদের দুইজনের দেখা হবার করিডোরটায় তখন একটা আকর্ষণ বল তৈরি হইছিল, ছোট বড় সব মাছ উপরিতলে শ্যাওলা সরায়ে কিলবিল করতেছিল। ঐ সময়টায় মনে হইতেছিল আমি যেকোনো কিছু করতে পারবো, চাইলে উড়তে পারবো, ভেসে থাকতে পারবো। এই আনন্দের সূত্র কোথায় জিইয়ে ছিল কে বলতে পারবে? লোকটা আমার কাছাকাছি এসে শেষমেশ থামলেন। তার হাতের জড় হওয়া জলে আমি দেখলাম…...দেবতুল্য একটা শিশু আলতো নড়নচড়নে কোন একটা জগতে আসবার প্রস্তুতি নিতেছে। পানিতে শিশুটা ঐ ছোট জায়গাটায় তীব্র আলোর জাদুতে জড়ায়ে আদতে জানান দিচ্ছিল ভবিষ্যতের। আমার প্রবল মনে হচ্ছিল, উদ্ভিদেরা কানাকানি করে খবরটা পৌঁছায় দিতেছে বিভিন্ন মাত্রায়। যার প্রকাশ ঘটবে খুব সামনেই, বোধাতীত ব্যপ্তিতে। 

জলমানব ডুব দিয়ে চলে গেলেন। রেখে গেলেন আঁধার, কুচকুচে আঁধার। ঘটনা মুহূর্তেই উবে যাবার পর সেকেন্ডের কম সময়ে আগমন ঘটল রাতের। আকাশগঙ্গায় এত অজস্র তারা আমি আর কোনো জীবনে দেখি নাই। মহাজগতটা আমার কাছে ধূমকেতুর মত ধরা দিল, মহাশূন্যের এই অজস্র তারাগুলো সব যেন ঐ মুহূর্তে আমার দিকে তাকায়ে আছে। আমার কান্না আসতে লাগল। ফ্যান্টাসির প্রবল অস্তিত্বে আমি নাই হয়ে গেলাম, ব্যাপারটা ঘোর বিষাদের। আমি নিউরনের কাঁপুনি টের পাচ্ছিলাম। অবিরত একটাই ব্যথা পিয়ানোর রিভার্স নোটের মত বেজে যাচ্ছিল, সাথে দৃশ্যপট; পেছন ধাওয়া স্বপ্ন। আমি লোকটাকে এটলিস্ট ধন্যবাদ জানাইতে পারি নাই, মাথার বিশ্রী অবিশ্বাসের জন্য। 

দুইদিন পর জানলাম আম্মু কনসিভ করছে, আমার কাছে মোটেও অবাক লাগে নাই। ঠিক সেই সময়ে আম্মু সন্তান চাচ্ছিল কি না পরিষ্কার ছিল না তবে আব্বু খুশি হইছিল, এর পেছনে হয়ত তার ষড়যন্ত্র ছিল, হাহা, যাই হোক আলাদা হবার চিন্তা তাদের মাথা থেকে দূর হয়। আমি তো খুশিই, বেশ খুশি, মনেপ্রাণে চাচ্ছিলাম একটা বোন হোক আমার। আমাদের দুইজনের জন্য আলাদা জগত তৈরি করতে তৎপর ছিলাম আমি। যেকোনো ভাবনার যেকোনো ইচ্ছার সংশ্লিষ্টতায় অনাগত বোনকে জুড়ে দিতেছিলাম। ঠিক করছিলাম স্পেশাল ঘটনাগুলো, আমার দুনিয়া, একমাত্র তার সাথে শেয়ার করবো। নতুন করে কিছু চাওয়ার ছিল না দেখে পুকুরপাড়ে আমি তখন যাইতাম না। বুঝে গেছিলাম কিছু চাওয়ার থাকলে জলমানব দেখা দেন। সমীকরণ খুব সহজে মিলেও গেছিল। অবশ্য যখন তখন কিছু পাবার ইচ্ছা নিয়ে আমি পুকুরের সামনে দাঁড়াইতাম। এই মনে হইত ছোট বোনের জন্য একটা খেলনা চাই, ও দেখে যাতে খুশি হয় এমন কিছু একটা চাই, কোন রেসপন্স পাইতাম না। কে জানে হয়ত জীবনের উপর প্রভাব পড়ে না এমন কিছুতে জলমানবের আগ্রহ ছিল না। তিনি বড় বড় খবর দিতেই আসবেন। 

অবচেতনে লোকটার প্রভাব বাড়তেছিল। আমি তাকে স্বপ্নে দেখা শুরু করলাম। আমার ঘটনাগুলোর সাথে ভয় নামক কৌতূহলের যোগসাজশের কারণে স্বপ্নগুলো বেশিরভাগ সময়েই বিদঘুটে দেখাইত। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাইত, মনে হইত স্বপ্নের মাধ্যমে তিনি আমাকে ডাকতেছেন, যোগাযোগ করবার চেষ্টা করতেছেন। আমি আধোঘুমের চেতনা নিয়ে পুকুরটার কাছে যাইতাম, স্পষ্ট খেয়াল থাকত না কিছুই। 

আম্মু প্রায়দিন আমাকে সকালবেলা পুকুরঘাটে আবিষ্কার করতো, সেখানেই ঘুমায়ে পড়তাম কি না! তার মনে আমাকে নিয়ে সন্দেহ জন্ম নিছিল। আম্মু আমাকে ফলো করলো এক রাতে। এলাকার কুকুরটা আমার সাথেই ঘাটলাটায় বসে থাকত। সম্ভবত পাহারা দিত, কেউ আসতেছে কি না চোখ রাখতো। সেই রাতে আম্মু আমাকে পুকুরের দিকে সম্মোহনে আগায়ে যাইতে দেখে ভীতিকর কিছু আন্দাজ করতেছিল। কুকুরটা পুকুরের এই স্পেসটাকে সিকিউর ক্যান রাখতে চাইত জানতাম না, সে আম্মুকে দেখে দৌড়ে কামড়াতে গেল। কোনোভাবে তাকে নিরস্ত করা গেছিল। তবে আম্মু প্রচণ্ড ভয় পাইছিল, যে ভয় অস্বস্তিকর। যার কারণের সাথে অশুভ ইঙ্গিত জড়ায়ে থাকে। 

আম্মু আমাকে অশুভ ভাবা শুরু করছিল। কবিরাজরা তখন নিয়মিত আসতেছে বাসায়, অবশ্য কিছুই পাইতেছিল না। আমার উপর এক্সরসিজম চালাইতে চাইছিল কেউ কেউ, আব্বু কানে নেয় নাই। আমার ব্যারামের চাইতে ঝাড়ফুঁকের উপর অবিশ্বাস তার প্রবল। কিছুই হইল না আমার, খালি আম্মু দূরত্ব রেখে চলা শুরু করছিল। আমার বোনকে ‘ওউন’ করা শুরু করছিল, তার ইন্সিকিউরড জগতে আমার স্থান নাই। মুখে কিছু বলে নাই আম্মু, জানতে অসুবিধা হয় নাই আমার আকাঙ্ক্ষার জগতে চিড় ধরছে, হ্যাঁ, আমার মানতে অসুবিধা হচ্ছিল - সবসময় পারলেও ক্যান জানি বেছে বেছে সে সময়টায় নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা হচ্ছিল। আমি উপেক্ষিত হইলাম প্রবলভাবে, আদর থেকে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বস্তির জিজ্ঞাসা থেকে। না চাইতে স্বাধীনতা পাইলাম। আমার কোনো কিছু খেয়াল করবার কেউ নাই, আমার সমস্যাগুলো জানবার ব্যাপারে কেউ নাই। মায়ের বায়বীয় কোল থেকে আলগা হইতে চাই নাই, ডেস্পারেটলি তার সান্নিধ্য কামনা করতেছিলাম।

আমি পুকুরপাড়ে একা একা মন খারাপ করে বসে থাকতে পারতাম। কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতেছিল না। জলমানব তৃতীয়বার দেখা দিলেন এমন ঘোর অন্ধকারে। আমি সেবার পুকুরের দুই সিড়ি নেমে পা ডুবায়ে রাখছিলাম। তাকে দেখতে তর সইতেছিল না আমার। কিন্তু এভাবে দেখবো ভাবি নাই। সেবার জলমানব গলা ডুবায়ে ভেসে সামনে আসতেছিলেন। মুখটাই শুধু দেখা যাচ্ছিল, তার চোখে খারাপ সংবাদ দেবার ইঙ্গিত ছিল। প্রতিবার আড়ষ্ট থাকলেও সেবার সারভাইভাল রিফ্লেক্স কাজ করছিল। আমি ধুপ করে দুই পা পেছনে চলে গেছিলাম। তিনি আগাইতেছিলেন সাপের মতন পানিতে কোনো শব্দ না করে । সেটা কীভাবে সম্ভব আমি জানি না। আমাদের দূরত্ব কমতে থাকে, চার হাত, তিন হাত এরপর দুই হাত…… তার শরীর দৃশ্যমান হইতে থাকে। আমি এখনও বিশ্বাস করি যা দেখে আমার মূল সত্তার মৃত্য হইছিল সেই সময়। হাস্যকর অবশ্যই, ভৌতিকভাবে হাস্যকর! তার জঠরে সন্তান ছিল ঠিক আম্মুর মতো। 

আমার দিকে তাকায়ে কাঁদলেন একবার মনে হইল, হাতও বাড়াইলেন। আমি সেখান থেকে স্রেফ দৌড় দিয়ে পালাইলাম, হৃৎপিণ্ড ফেটে যেন হাতে চলে আসতে চাইতেছিল। আমার সত্যি বিশ্বাস হইতে চায় নাই আমি বেঁচে ছিলাম। কেউ আমাকে কাছে চায় না জানাই ছিল। সেই ভয়ংকর রাতটা প্রত্যেকটা পারস্পেক্টিভ থেকে নিষ্ঠুর। রাত পার করাটা ছিল মৃত্যু যাত্রার মত। সকাল আদৌ আসবে কিনা আমি নিশ্চিত ছিলাম না, নিঃসঙ্গ একা আমি কোন মরণগামী ছাড়া আর কিছুই না তখন, আর কিছুই না।                 

মায়ের পেট থেকে আমার বোন ছিনতাই হইল। কেমন যেন না ব্যাপারটা? যন্ত্রণার শিকড় খুঁজতে যেয়ে উনি কীভাবে সন্তান হারাইল, তার ডিটেইল মনে করতে চাই না। শুধু এতটুক জানি কারও মৃত্যু হইছিল আর জলমানব তাকে নিয়ে গেছেন। তাই কি? আমার কি কোনোরকমের সংশ্লিষ্টতা নাই?

অবশ্যই আছে, আমি সবসময় তাই বিশ্বাস করে আসছি। আমি নির্বোধের মত চাওয়া-পাওয়ার খেলা খেলতে বসছিলাম, জানতাম মনে মনে বড় পরিবর্তন চাইলে সব ঘটতেছিল, তারপরও আমি চাইতাম ভাল-খারাপ সবকিছু। কেবল বিশ্বাস হয় আমার হাত থেকে প্রথমবার ম্যাজিক ফিশটা না ফসকাইত আর আমি যদি মাছটা কীভাবে ধরতে হয় জানতাম এতকিছু ঘটতই না।                                   

আম্মুর মাথায় নিশ্চয়ই দ্বিতীয়বার নাড়িছেঁড়া কষ্টের সম্ভাবনা খেলা করতো। কোনোভাবেই তিনি তা চাইত না বলে আমি সর্বক্ষণ তার আশেপাশে থাকতাম। আমি যে দোষ করছি তার কাছে থাকলেও ভুলতে পারতাম না। মায়ের সান্নিধ্যে প্রশ্ন মিশে গেল। চাওয়া-পাওয়া মিলে গেলে তাতে প্রশ্ন মিশে থাকে তার উপলব্ধি হইল। আমার নতুন সত্তায় ইচ্ছের রং খেলা করতো না। তাতে ভূত সত্তা প্রশ্রয় পায়। নিজের কাছে নিজে অপরিচিত হয়ে উঠা হয়। আচরণ হয়তো অপরিবর্তিত থেকে যায় কিন্তু কিছুই আর আগের মতো থাকে না। 

তবে আগন্তুকের দেখা না দেওয়ায় আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতার পোষে চলাফেরা করতে পারতেছিলাম। আসল যন্ত্রণা তখনই জাল বুনতে থাকে। মস্তিষ্ক বাই ডিফল্ট ডিফেক্ট তৈরি করে, ডাউট তৈরি করে। আমার ক্রিয়েটিভ মস্তিষ্ক নিজ থেকে একটা মানুষ তৈরি করলো আমার ভেতর, সেই কাল্পনিক ট্রেনের কাউন্টারপার্ট। পাশের ফাঁকা সিটে যাকে বসতে দিতে চাইছিলাম সে বসল, ভর করল আমার পৃথিবীতে। আমাদের যাত্রা শুরু হইল। খুব দ্রুত সিংক হয়ে গেল আমাদের। চিন্তার আদানপ্রদান ঘটল, দৃষ্টিভঙ্গি শেপে আসল। আমরা একসাথে পৃথিবীর নতুন নতুন দিক আবিষ্কার করতে থাকলাম। প্রথম প্রথম তাকে বন্ধুই ভাবতাম। আমাদের বোঝাপড়া সহজ ছিল। আসলে অতটা সহজ ছিল না, সবকিছু বোঝাইতে হইতো। শিশুদের পাঠ দেয়া লাগতো, এয ইফ সে মাত্রই ঠিকঠাকভাবে কথা বলা শিখছে, মাত্রই কিছু দেখে বিস্ময়ের প্রকাশ ঘটাইতেছে। পুরোপুরি আলাদা সত্তা ভাবতে যা খুব সাহায্য করছিল আমাকে। কিন্তু একটা জিনিস সারাক্ষণ ভাবাইত আমাকে। এই আত্না কি মৃত বোনের ছদ্মবেশে আমার সাথে যোগাযোগ ঘটাইতেছিল? না কি কল্পনার জটিল গুড় তত্ত্ব নিছক একটা আশ্রয়ে নিজেকে জানান দিয়ে যাচ্ছিল? 

আমি সেই ‘ফেস’ এ ছিলাম যে ‘ফেস’ এ শারীরবৃত্তীয় চাহিদার কোনো সীমানা থাকে না। আমি তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হইতে চাইলাম, নিজের কামনার পরিপ্রেক্ষিতে। সে খেলতে লাগলো, ভাবল একটা নতুন গল্পের অবতারণা ঘটবে। আদতে তো সব মস্তিষ্কের খেলা ! ডুয়ালিজমে ছারখার হওয়া লাগল। যৌনতার আনন্দময় পৃথিবীতে আমি নিষ্করুণ যাযাবর। কারও কাছে যেতে পারতেছি না, কাউকে কল্পনায় এনে ঠিকঠাক প্রাইভেসিটা পাচ্ছিলাম না। প্রতিটা স্তরে যেয়ে আমি কৌতুকীয় হাসির শব্দ শুনতাম, কিছুই ভালো লাগতো না। 

লজ্জার বাঁধ ভেঙ্গে মেয়েটা যৌনতার দুয়ারে প্রবেশ করল। সুই স্বতন্ত্র আত্নার সিঙ্ক্রোনাইজেশনে অরগ্যাজমের যে মাত্রায় মোহাবিষ্ট হইলাম, তা আর কোনো কিছুতেই খুঁজে পাইলাম না। এরপর পরিস্থিতি ভেদে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলাম, কখনো আমার কৃপাদাত্রী বোনের ভূমিকায় আবার কখনো কৃপাদাত্রী প্রেমিকার ভূমিকায় সে রোল প্লে করতে থাকে। এই নিয়মের হেরফের হয় নাই, কারণ সন্দেহ দূর করবার মত কিছু ঘটে নাই। রিলেজিয়াস মিথলজির উৎস আমাকে স্বাভাবিক থাকতে সাহায্য করতো। এরপরও আমি দুমড়ে মুচড়ে যাই মাঝে মাঝে, মন বিকলাঙ্গ মনে হয়। ট্রেন থেকে আমার গন্তব্যে, আমার স্টেশনে নামতে পারি না। 

চেতনা সরাসরি আঘাত করলে আমি গা থেকে পানি ঝেড়ে উঠি কোনো না কোনো বাথটাব থেকে। এরপর ঘুম ছাড়া আর কিছু মাথায় থাকে না। ঘুমের ভেতর আবছা অবস্থায় সেই জলমানবের চেহারা মনে করবার চেষ্টা করি। অদ্ভুত কারণে সেখানে নিজের চেহারা ভাসতে থাকে, গর্ভধারিণীর ট্রমাটাইজ আকার ভাসতে থাকে, অন্তিম শূন্য ভয়েড দৃশ্যমান হইতে থাকে।

আর পরিচয় ভেঙ্গে যাইতে থাকে। আমি কোনো না কোনো সৃষ্টিকর্তা খুঁজি, তার পানে চেয়ে হাত পেতে থাকি।

 


De-construction Phase-1

“আত্না বলতে চায় আমার দুইটা পৃথিবী, কেন?”

 

৫.

হ্যালো আপু, কেমন আছো?”

“এইতো, আছি।”

“তোমার ফ্লাইট কবে যেন?”

“তিনদিন পর।”

“তুমি বিজি?”

“একটু, গোছাগুছি করতে জান চলে যাচ্ছে। এত্তগুলো জিনিস নিতে হচ্ছে। তুই বল কি বলবি।”

“তুমি ফয়সাল ভাইয়ার বাসায় না?”

“হ্যাঁ, আসবি এখানে?”

“না আপু, আমার ইস্কাটনের বাসায় যাবার একটু দরকার ছিল। ভাইভার প্রিপারেশনের কিছু নোটস রেখে আসছিলাম, এখন খুব দরকার।”

“তুই যাবি কেন? আমি কাউকে পাঠিয়ে দেই, তুই আমাকে ডিটেইলস টেক্সট কর।”

“আপু আমার মনে নাই, কোথায় রাখছিলাম। কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না। সমস্যা নাই, আমি যেয়ে আনতে পারবো।” 

“সমস্যা নাই, সেটা তোমার মাথা আপাতত বুঝতেছে না ভাইয়া। তুমি সুস্থ হয়ে নাও, আমি মেজো মামার কাছে চাবি রেখে যাব। এরপর যখন মন চায় যেতে পারবা।” 

“আপু সমস্যা কেটে গেছে, ফুপু নাই আমার বিশ্বাস হয়।” তনিমা আপু থেমে গেলেন।

“আচ্ছা, এসে নিয়ে যা।” 

ফুপুর বাড়ির সামনে টং-এ চা খাইতেছি। এক লোক আমাকে আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড় করায়ে রাখছে। আর এক মরার জাদু সেট করে রাখছে সেলে, কল দিলে কল ঢোকে না। কিন্তু ফিরতি কল আসে। ভাষাভাষা জ্ঞানে যদ্দুর জানি, কিছু ডিলার স্যাটেলাইট আইডিকিট ইউজ করে এভাবে ক্লায়েন্টদের কনফিডেনশিয়াল গুডস ডেলিভারি দেয়। যাই হোক, আমার অন্য ধান্দা। ত্রিশ মিনিটে বিশ বার কল দিছি, এখনও সে কলব্যাক করে নাই। 

কল আসছে। “ হ্যালো ! কই ভাই আপনি?” আরে ধুর লাইন কেটে গেছে।

একজন আচমকা এসে বলল, 

“ভাই চলেন।”

“সরি, আমাকে বলতেছেন?” 

“জি ভাই, আপনি ফলস একাউন্ট থেকে কন্ট্যাক্ট করছিলেন?”

“বুঝলাম না।”

“ ‘মাইডার্কস্পেস’! আইডি নেম, ‘ফলস একাউন্ট’? আমি সাইকিক টেক সল্যুশন থেকে মীর। আমার আরও আধা ঘণ্টা আগে আসার কথা।”

আজকাল হ্যান্ডশেকের কালচার চেঞ্জ হয়ে গেছে। মানুষ আলতো করে হাত চাপে। আমি সেকেলে মানুষ। নরেন্দ্র মোদীর ফিফটিজের স্টাইল এখনও ছাড়তে পারি নাই। শক্ত হাতে শেক করতে যেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খাই। এর হাত এত তুলতুলে কেন? এই শুকনা ছেলেই কি কাজটা করবে? আরেকবার ভেরিফাই করা উচিত। আর জানাও দরকার পোলা কোন সেলে ঐ আইডিকিট ইউজ করে। বরাবরের মত কল ঢুকল না। তিনি ফোন বের করলেন। ধুর, আমার কৌতূহলে মাটি চাপা পড়ল। হালায় স্যামসাং গুরু সেল থেইকা কল দিতেছে।

“ ফোন পিক করেন। কথা বলে ভেরিফাই কইরা নেন।”

সামনে যেয়ে দেখবো কোন নাম্বারে কল দিছে? বাহ্‌ ! চিন্তাটা কি! কেউ দেখছেন? আমি মাশাআল্লাহ্‌ দিন দিন একটা হাস্যকর প্রাণীতে পরিণত হইতেছি।

“না লাগবে না। কিন্তু আপনি তো বিশ মিনিট ধরে আমার পাশেই বসে ছিলেন। কি ভাই? পুলিশ-ফুলিশ কিছু চিন্তা করছিলেন না কি?”

হালার আরেকটা সেল পকেটে, শিওর। আইডিটা ঐ সেলে, নাম্বার ডাইভার্ট করছে হাতেরটায়। একছের চালু তারা, কাজ শেষ করে আইডি হুদ্ধা সেল ফালায়ে দিবে। 

“না ভাই।” খুবই পোলাইট হাসি। “ বিল কত হইছে মামা?”

“ভাই, রাখেন। আমি দিচ্ছি।” 

পোলাইট হাসি বিস্তৃত হচ্ছে। থুতনির ডান পাশে সেলাইয়ের দাগ। তারপরও ক্রিমিনাল ভাব নাই। চেহারায় এত ভদ্র ভাব। কেজি টু এর পর এই প্রথম কোনো ভদ্র ছেলের চেহারা দেখলাম। অল্প কথার ছেলে, এটাও ভালো। আমার পয়সা সরায়ে বিল দিয়ে দিল, প্লাস পরোপকারী। গরীবের ত্রাতা মব সাইকো। সাইকো না বইলা সাইকিক বলা ভাল। “আমরা আগাই তাহলে।” 

“ভাই, ‘মাইডার্কস্পেস’ আইডিটায় ক্লোনের কি কারবার করে রাখছেন?”

“কেন? কি হইছে ভাই?”

“যেই ওয়েবএড্রেস থেকে আইডি পারচেস করছেন……”

“ওয়েইট ভাই, আমি আইডি কিনি নাই ।”

“অঅ্‌…… আচ্ছা । আপনি হ্যাকার?”

“না, এমনে টুকটাক ইন্টারেস্ট সবার থাকে ভাই।”

“এনিওয়ে, ফলস একাউন্ট নামটা একটু শিশুসুলভ, যদি হ্যাকারের পারসপেক্টিভ থেকে চিন্তা করি।”

“আমি হাস্যকর মানুষ ভাই। নাইলে কোন মান্দারপো প্রিটেনশাস ইলুমিনাটি হইয়া ডিস্কাউন্টে ফেইক পাবজি প্যাক সেল করে, কন? ছাগল মাথার কিছু গান্ডু আবার ঐ লিংকে ক্লিক মারায়া নিজের সস্তা আইডেন্টিটি ডাম্প করে। মাননে, আমি ছাড়া আরও কত গান্ডু এই পৃথিবীতে। দেখে পুলকিত হওয়া লাগে। ”

“ভাই, এত ডিপ্রেসড হচ্ছেন কেন? মাথা কিন্তু শার্প আপনার। খুব ভালো হ্যাকার লাগবে আপনাকে ট্রেইস করে বের করতে।”

“আফসোস, কেউ করলো না। আর গান্ডুগুলোরে বেইচ্যা খাইয়া মজা নাই ভাই।”

“সেটাই, টিকটকে ভিডিও করবে, বলবে আইডি চুরে নিয়ে গেছে, এখন থেকে এই আইডিতে নাচবো।”

“ভাই এসে পড়ছি।” 

“ডোর খুলেন।” 

আমি চারপাশে তাকাইলাম। ভাগ্য ভাল, ফুপুরা ফুল ইউনিট নিয়ে থাকতেন। আত্নামুক্তিতে কোন ইন্টারাপশন হবে না। মাথায় খচখচ শব্দ হচ্ছে। 

“ভাই, এইখান থেকেই রিচুয়াল শুরু করেন।”

“আমি কিছু ফিল করি নাই, আর এইখানে কিছু করাটা রিস্কি। ঘাবড়াবেন না ভাই। আপনার মত কারও এমন প্রবলেম, আমার মানতে অসুবিধা হয়।” 

সাধু কথা শুনে হাসি আসে।

দরজা খোলা মাত্রই সব পেইন মাথায় একত্রে জড় হওয়া শুরু করে। থাকো পেইনবাসীগণ! তোমরা স্মৃতি কোলে নিয়ে বসে থাকো। আমার কিছু করার নাই। ফুপুর বাসা দেখি এখনও ঝকঝকে তকতকে। কেয়ারটেকার সানী এসে রেগুলোর ধোয়ামোছা করে বোধহয়।

“ভাই, সব জানালা বন্ধ করেন। পুরা ঘর এয়ার টাইট করেন।”

“আর কিছু?”

ঠোঁটে সেই অমায়িক হাসি। 

“মেইন লাইনের কানেকশন অফ করেন আর দশ মিনিটের মধ্যে সূর্য ডোবায়ে ফেলেন। বিন্দুমাত্র রেডিয়েটিভ পার্টিকেলস থাকলে তার কগনিশন লোকেট করতে অসুবিধা হবে।”

সূর্য ডুবতে ডুবতে আরও এক ঘণ্টা। শেষ বকা খাইছিলাম এই সোফাটায় বসে যেখানে সাইকিক মহাশয় বসে আছেন এখন। ফ্যাক্টটা কি তাকে বলার দরকার আছে? সংশয়ে বসবাস আমার। আরও স্পষ্ট করে বললে ‘ইনডেফিনিটে’। এত না ভেবে কাজটুকু সারি। জানালা চেয়ে প্রায়দিন সন্ধ্যাকালে বড় আমগাছটায় কাকদের ঘরে ফেরা দেখতাম। আমি জানতাম ‘মানুষ-সকল’ ফলজ বৃক্ষে পাখিদের আনাগোনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রাখছে। কিন্তু এই আমগাছটা লিঙ্গে পুরুষ। তাই এতে অগুনতি কাকের বাসা। ঠিক বসন্তের মুকুলের ঝাঁকের মত। ফুপা যত্ন করে গাছটা পুতছিলেন। বাসায় নতুন কেউ আসলে উনি মজা করে বলতেন, বাসার পেছনে তার বড় ছেলে কানে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । হায়রে কানে আঙ্গুল, কাকদের বিকট চিৎকারে কানে ফলহীন ফেল্টুশ গাছের আঙ্গুল দিয়েই দাঁড়ায়ে থাকার কথা। ফুপার রসবোধ সমৃদ্ধ আসলেই। ডেভেলপারদের বাসা লিজ দেয়ার সময় ফুপু অনেক কষ্টে গাছটাকে বাঁচাইছিলেন। তারা কেউই নাই, কিন্তু তাদের এই ছেলে যুগ যুগ ধরে নতুন বন্ধু পাতানোর শাস্তিস্বরূপ কান ধরে ঠায় দাঁড়ায়ে থাকবে। 

প্রায় বন্ধ অবস্থার এক ফাঁকে জানালা গলে কিছুটা বাতাস ঢুকল। আকাশে বিদ্যুৎ আলো বিস্তৃত কালো মেঘে কিছু কি জানান দিল? কাকদের দেখা যাচ্ছে। সবটাই স্বাভাবিক। সেপ্টেম্বর মাস, বর্ষা এখনও আছে তাই পাখিরাও তাড়াহুড়োয় ঘরে ফিরবে। কিন্তু তারপরও শরীরের লোম দাঁড়ায়ে যায়। মনে হইল, বাতাসে ভর করে টুপ করে কিছু একটা ঢুকে গেছে। 

ব্যাপার কি? সাইকিক মহাশয় সোফায় ঘুমায়ে পড়লেন কেন? 

“হ্যালো বড় ভাই, খুব টায়ার্ড নাকি?” 

বড় ভাই তড়াক কইরা চোখ মেললেন। হাসি পাইল। একটা হিউম্যানবট ‘মাত্রই নতুন ডিরেকশন আইছে’ চালে ধপাধপ ব্যাগ থেকে ইন্সট্রুমেন্ট বের করল। যেন তিন মিনিটের মধ্যে মিশন একমপ্লিশ করতে হবে। আমি ভুল কিছু চিন্তা করি না আজকাল। এই ব্যক্তি ফ্রিকোয়েন্সি মিটার টাইপ কি সব বস্তু দেখি সেট করতেছে। আবার কেউ ইউজ করতে চায় না সেই ইনক্সের ল্যাপটপ সমেত দুইটা হেডফোনও বের করল। ডিজিটাল সাইকিক দেখি। আত্না কি হ্যাক কইরা অন্য লগে পুশ করব? সাইকিকদের লগ নামক প্রতীকী জোনে থাকবে ট্যারট সেট, তুষের সমারোহ, ডজনখানেক মোম বা কিছু ঘটিবাটি, বড়জোর ব্লাডব্যাগ। এই হালায় ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে কি করবে?

“ভাই, এইটা ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেটর। আমি ইনফ্রাসাউন্ডে একবার সেট করবো, দেন আল্ট্রাসাউন্ডে আরেকবার। প্রোগ্রামের রেঞ্জে হাই-লো দুইটা ফিল্ডেই কিছু পাইলে ফারস্টলি পজিশন বের করবো।”

“ও, তারপর?” হালায় কি আসলেই সাইকিক? 

“পরেরটা পরে, আগে নেন হেডফোন কানে দিয়া থ্র্যাশ মেটাল শুনেন।” 

“সো কুল ব্রো!”

“হোল্ড, জানালায় তিন লেয়ারের ভারি পর্দা দেন নাই ক্যান?”

“সব জানালায়?”

“হ্যাঁ ভাই, নাইলে গ্লাস ফাটবে। সম্ভব হইলে ব্ল্যাঙ্কেট জড়ায়ে দেন।”

জেটের শব্দে প্রায় সময় গ্লাস ফাটে এমন নজির আছে। আল্ট্রাসাউন্ড তো ভয়াবহ ব্যাপার, হাজার লেয়ারের পর্দা দিলেও কোনো গ্লাস বাঁচানো সম্ভব না। নট একচ্যুয়ালি, ডেন্স এট্মস্ফিয়ারে গ্লাস এমন টর্চার হোল্ড করতে পারে। আর জেটের শব্দটা আসে বাইরে থেকে, গ্লাস সেখানে অনেকটাই নেকেড। 

আমি যে আলমিরা খুলব আমার কাছে চাবি আছে ! আরে কি আশ্চর্য ড্রয়ার আনলকড!  আরে কার কি লাগবে? দুই বাংলার তিনটা শীতও শর্ট পইরা যাবে।

ব্রুফ্‌ফ্‌ ! হোল্ডারে ব্ল্যাঙ্কেট ঠিকমত রাখতে যেয়ে জান কাবাব হয়ে গেছে।

“ভাই একটু রেস্ট নেন কিছুক্ষণ।”

“আর রেস্ট! চুপচাপ বইসা খালি মনিটর করবো। আপনি হেডফোন কানে দেন।”

দিস ড্যুড ইজ কাইন্ডা কুল। মিউজিকের রিদমে হেড টিল্ট কইরা স্লিক ম্যানারে ভূত ধরে। ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয় একটা ডিজগাইজড হিটম্যান যার লেভেল অফ প্যাশন ফায়ারি ইন্ট্যাক্ট।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফ্লোর কাঁপা শুরু করছে। ওপেথ ‘ব্লিক’ গানে আমাকে অভয় দিয়ে বোঝায়, 

                            “Plunging towards bereavement faster yet

                             Clearing though...

                             Devious moments in your eyes 

                             Moved me from relief 

                        Breath comes out white clouds with your lies

                   And filters through me” 

My mind is baffled by these senses of gravity. It hurts me knowing I’m not even close to someone’s true feelings. We’re always fooling around. So tired of pretending that we give nothing but only shits about everything. Why? 

“The never ending problems of metal music. That goes to the core and punches your silly motions or I’d say emotions.” আর কত রেইজ নিয়ে বমি করবো? এতক্ষণ ছিলাম ফানি অর সো কলড ‘উইয়ারড নোশনে’। কিছুদিন ধরে ক্রমাগত অড নোটে বাজতেছি। শান্তি আজকাল কিউরিওসিটি নামক মশলা মাখায়ে খাইতে চাই। ঠান্ডা বাতাসের মত গায়ে ধরে রাখতে চাই না। এনিওয়ে, মীর সাহেব কি ‘ফুপু-ভূত’ পাইছে? পাইলে কিছু কথা জিজ্ঞেস করতাম। আছি দশ হাত দূরত্বে, কথা বললে পৌঁছাবে না আর লাইট জ্বালানোর তো ব্যবস্থাই নাই। উনি একদৃষ্টিতে স্ক্রিন দেখতেছেন। তিন ঘণ্টা ধরে এই কারবার চলতেছে। মেজাজটা আর ঠিক রাখতে পারতেছি না। শালারে যেয়ে থামানো লাগবে এখন। 

ফিল্ড অবসারভেশন টেমপ্লেটে তেমন কিছু শো করে নাই। হালারপুতে কয় আরও কয়দিন অবসার্ভ করতে চায়। 

“ভাই, আল্ট্রাসাউন্ডে যদি আত্না ছ্যাড়াবেড়া হয়ে যায়, তাইলে তো কগনিশন দেখবো না। আপনার কী মনে হয়?”

“ভাই, আমারে আগে লজিক বুঝান। ভূত মাতারি পার্টিকেল হইতে যাবে ক্যান?”

“আপনি কবচ পইড়া জিন তাড়াইতে চাইছিলেন ক্যান?”

“হাস্যকর কথা, আপনি জানেন না বাবা-মায়েরা কেমনে রিএক্ট করে? তাদের শান্তির জন্য পড়ছি।” 

“ভালো কথা, আপনার বিশ্বাস নাই। আপনাকে বুঝাই, সাইকিকদের প্যাটার্নটা কেমন। Everyone could be a psychic, but not everyone could be a medium.  আপনি ট্রান্স স্টেটে কি চাইলেই যাইতে পারেন?”

“থার্ড আই চাক্রা?”

“হ্যাঁ, কিছু সময় পারি বা হ্যালুসিনেটেড ড্রাগ নিলে পারি। বাট এটাতো অবভিয়াস, আই নো দ্যাট ফিলিং। তাই বলে ভূত দেখার মত বিলিভেবল রিয়েলিটি দেখার মত অবস্থা হয় নাই।”

“আপনি মিথ্যা বলতেছেন। আমি ইজিলি সেন্স করতে পারি আপনি সাইকো ট্রমার এক্সপেরিয়েন্সের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন।” 

“That I’m not ready to believe. তাও আমি চাই এই রিয়েলিটি চেঞ্জ করতে। যার কারণে আমি আপনার হেল্প নিচ্ছি।”

“আমার কাজ আপনাকে রিজনিং- এ আনার ট্রাই করা। আপনি সায়েন্টিফিকলি চেষ্টা করে দেখলেন, যে ভৌতিক কোন এনটিটি আপনার থট ইভেন্টে এক্সিস্ট করে না।” 

“Thought event? You mean this place?” 

“হ্যাঁ, যেইখান থেকে সবকিছুর শুরু। আপনি এখানে তাকে দেখতেছেন না হয়তো। কিন্তু জানেন, কোর মেমোরি থেকে ইরেজ করতে হলে অথবা থার্ড কোনো ম্যাটার দিয়ে সলভ করতে চাইলে আপনাকে এইখানেই আসতে হবে।”

“ভাই, আপনি তো থেরাপিস্ট না। Tell me something that I don’t know.”

“আমি মিডিয়ামশিপ দিয়ে ট্রাই করতেছিলাম, দেখা দূরে থাক কোনো কিছু শুনি নাই।” 

“চ্যান্টিং ছাড়া?” 

“I don’t curse spirits. That’s not my job.”

“Then trade something valuable with her. Maybe she’s within me. You just couldn’t see through it.” 

শালারপুতে হাসে কেন? 

“ভাই দেখেন, আমি রিচুয়ালস বলেন অর প্রসেস বলেন এগুলোর সাথে পরিচিত না। রিচুয়াল মিডিয়ামশিপ একটা মেডিটেটিভ সাবজেক্ট। আমার এত সময় হয় নাই কখনও।” 

“ Bhai, you need healing. Let me try that.”

“Can’t we just trade something? I don’t want her to stay in my world.”

“If she curses you, then I’m afraid I can do nothing. But I think there’s a slight chance that healing would work.”

“আপনি কি হিপনোটাইজ করার চিন্তা করতেছেন? Did that before.”

“আমি এতটাই নরমাল মানুষ না ভাই। Just give me your permission.”

“ওকে, ডু ইট।” 

মীর চোখ বন্ধ করে কনসেন্ট্রেট করতেছে। আমি কি চোখ বন্ধ করবো? হ্যাঁ, দেখা যাচ্ছে নিজেকে। বিশাল বড় একটা ক্রেটারের মাঝামাঝি একলা বসে আছি। চারপাশে অথৈ সমুদ্র। এত বড় বিশাল একেকটা ঢেউ অথচ গা শুকনা। পৃথিবীর সব মানুষ বোধহয় মারা গেছে। বহু বছর খুঁজে কাউকে না পেয়ে মন খারাপ করে বিশাল একেকটা ঢেউ সঙ্গে করে গা ভাসানোর চেষ্টা করতেছি। তাও ঠিকমত পারি না কিংবা পারি নাই। তাই ভাসাভাসি সহ্য করতে না পেরে মাথা ধরে। এভাবে কি অনন্তকাল ধরে বসে থাকবো? 

সবকিছু উলটা ঘুরতে শুরু করে। ঢেউ পেছনে যাচ্ছে, পায়ের নিচে শক্ত মাটি দিক পরিবর্তন করতে শুরু করে। আমি ধরে রাখতে পারতেছি না। একটু পর সবকিছু একসাথে ফেটে পানিতে মিশে যাবে। কিন্তু পানিতে তো কিছু নাই। আফ্রোডাইটির সন্তানেরা এই নিঃসঙ্গ গ্রহ রিজেক্ট করছিল। আমি আকাশে তারা খোঁজার চেষ্টা করি। কিছু সময় এদের দেখা পাওয়া যায়। নাহ, জমাট ক্লোরিন সরবে না। ওদের একঘেয়ে সোডিয়াম বিকিরণ আমাকে পাগল হইতে নিষেধ করছিল।

পা জোড়া হাঁটু পর্যন্ত পানির নিচে দেবে যায়। মাটির শক্ত আকর্ষণ ছাড়তে চাচ্ছি না। কিন্তু জলের আকস্মিক রঙ্গঢঙ্গে গডেস ভেনাস আবছায়া থেকে জন্ম নিতেছেন। কি সুন্দর! গডেস সদ্য জন্মানো দুইটা তারার বাচ্চা কোলে আগলে রাখছেন। কেউ তাহলে আসলেই চায়, আমি মৃত্যুর পরেও এই বাইনারি তারা দুইটার বড় হবার পবিত্র যাত্রায় অংশ নিই। ভেনাসের আমার জন্য অত মায়া কেন? তার চোখ বন্ধ করে সমুদ্র নিয়ে কাঁদার কি দরকার?

আমি বোধহয় হবো কোন সুন্দর আত্না। মাছের কান্না আমরা দেখি না। ভেনাস মাতা ওদের জলজ অস্তিত্বের ক্ষুদ্র অনুযোগ নিয়ে একটু আগে জানাইছেন,  “এই সমুদ্র এখন থেকে তার। একটু পরপর তার আফ্রোডাইটিরা আবেগের যত ইচ্ছা রং ছড়াবে।” ভালো হইল। এই গ্রহে কোনো হিমালয় ছিল না। আমি আফ্রোডাইটির রঙ্গে গোসল কইরা একদিন আমার জানা সবচেয়ে পবিত্র দৃশ্য হিমালয় হয়ে উঠব। কত কাজ আমার। এত আনন্দ রাখবো কোথায়? 

“কেন, হিমালয়ের তুষার ঝড়ে!” 

“ঐ দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর।”

“ভাই কল্পনা করলে সবই সুন্দর।”

আমি চোখ খুলি। মীর ভাই আমাকে খুশিচোখে দেখতেছেন।

“থ্যাংকস ভাই। It really happened. I’m happy now.”

“That’s what I love about this job. People won’t fail and I feel complete, contempt.”

“You should be a legit Narcissist. That should be your pride meter.”

ছেলেটা নিজের অমায়িক হাসি সহসাই ভুলতে দিবে না। বিদায় জানানোর আগ পর্যন্ত সে চোখেমুখে হাসি ধইরা রাখছিল। 


 

৬.

বাসায় কিঞ্চিৎ সমস্যা। মা আছেন প্রায় তিন সপ্তাহর কাছাকাছি। ওইদিকে রুমমেট বড় ভাইয়ের বৌ আজকে সকালে আসছে। আমি বুঝতেছিনা রাতে কোন উপায়ে ঘুমাব। শোবার ঘর মোটে একটা। বেচারা সরাসরি কিছু বলতে পারে নাই যে, মার জন্য তার চিপা ডাইনিং এর একপাশে বেড করে ঘুমাইতে সমস্যা হইতেছে। তার বৌ আসলে আমি অবশ্য মশাদের অভয়ারণ্য প্রত্যাখ্যান করে কোনো সুহৃদের আশ্রমের খোঁজ করি। ম্যারেড কাপলের প্রাইভেসি দেয়াতে আমার অরুচি নাই। কিন্তু অবস্থা এমন আমি চাইলেই মার সাথে চিটাগং যাইতে পারতেছি না। তাছাড়া অশান্তির কারণ নিজস্ব পদ্ধতিতে দমানো আমার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ছিল। মা তার মত করে অনেক চেষ্টা করতেছেন। কোয়ান্টাম কাউন্সেলিং আর প্রার্থনায় ওনার স্বাস্থ্য আমার চাইতে বরং বেশি ভেঙে পড়ছে। ভূত অসুখে মানুষের সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। বোধ করি, ক্যান্সারের রোগীদের রুটিন মাফিক মেডিকেশনেও এত ঝামেলা নাই। 

সিগারেট খাইতে ছাদে আসা লাগে। দুইদিন আগেও মা শিশুদের মত ট্রিট করতো। কি ছাদে কি বাইরে, একা ছাড়ত না কোথাও। বাকি সবার মত তারও ধারণা জন্মে গেছিল আমি সুইসাইডাল ফেসে বসবাস করতেছি। কখন কি করি না করি কিছুর ঠিক নাই। অনেকদিন কেউ মনের খায়েশমতো যত্ন নিচ্ছিল না। মাঝে মা যত্নের বাড়াবাড়ি করে সেই আক্ষেপ মিটায়ে ফেলছেন । তার যত্নের ‘কয়েক হাজার রকম’ এই তিন সপ্তাহ ধরা পড়ে নাই। এখন ফিল করতেছি। সরি, এমন চিন্তা মাথায় আসা উচিত না। ক্রিমিন্যাল মনে হয় নিজেকে। শহরের অতিরিক্ত আলো, আর ‘ধূলে-ধূলারণ্য’ গ্যাসযোগের কারণে রাতের আকাশে আগের মতো তারা দেখা যায় না। তাছাড়া অনিশ্চিত কুয়াশা তো আছেই। তারপরও চোখ বন্ধ করে তারা খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু কিলবিল করে সেই নতুন গ্রহটা নিজের মত করে ধরা দেয়া শুরু করে। বোধগুলো ষড়যন্ত্র প্রবণ। এরা কথা আর দৃশ্যে নিজেদের আটকায়ে রাখতে না পারলে মুখটারে বর্ষাকালের রাস্তা বানায়ে ছাড়ে। 

“অনিম সিগারেট টানতেছো? ডিনার রেডি, চল। নাতাশা আর আন্টি বসে আছে তোমার জন্য।”

“ভাই, সিগারেটটা শেষ করে নামতেছি। দিবেন না কি দুইটান?” 

শান্ত ভাইয়ের খালি পায়ে হাঁটার অভ্যাসটা আর ঠিক হইল না। ধূল মাখায়ে ঘরে ঢুকবে, বেড নোংরা করবে। আর মা ঝাড়ু দিবেন। 

“ভাই, আপনি স্লিপার পড়েন না ক্যান? মা দিনে কয়বার ঝাড়ু দিবেন বলেন?”

“আচ্ছা, আজকে নাতাশাকে বলবনে। আমরা মাটির মানুষ, বরফ শীতেও প্রাইমারিতে খালি পায়ে স্কুলে যাইতাম। পুরানা অভ্যাস তো, ছাড়তে পারি নাই।”

“ভাবী কেন ঝাড়ু দিবে? উনি আমার গেস্ট। আচ্ছা ঘুমানোর আগে আমি দিয়ে দিবোনে।”

“তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনিম। মুখ ফোলা-ফোলা কান্না-কান্না ভাবটা তোমারে মানায় না।”

“আমার চেহারার সাথে আবার ভাবের কোনো যোগাযোগ আছে না কি? জানতাম না।”

“সিগারেট আরেকটা ধরাই, বারবার ছাদে আসতে পারমু না। একটা কথা বলো তো, তুমি মিয়া কি গে না কি? কোনোদিন একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে শুনি নাই।”

“হাহা। না ভাই, সেলে গ্যাঁজানোর মত মানুষ নাই।”

“আজকালকার পোলাপান হাগতে গেলেও মাইয়া নিয়া যায়। তোমার মিয়া সমস্যা আছে কোথাও। কড়া ছ্যাকম্যাক খাইছিলা না কি?”

“না ভাই, ছ্যাকম্যাকও খাই নাই। আমার সব পয়সাওয়ালা মেয়ে পছন্দ হয়। নিজে হইতেছি ফইন্নি।”

“এখনকার মেয়েদের মেন্টালিটি তো একটু চেঞ্জ হইছে।”

“ভাই মেন্টালিটি চেঞ্জ হইছে কিন্তু সমাজ চেঞ্জ হয় নাই। এখনও বিয়ে করতে সিকিউরিটি ডিপোজিট ভরতে হয়। আবার ডিভোর্স দিতেও পয়সা লাগে।”

“সত্য কথা। ফইন্নি চেহারার মাইয়ারও সোশ্যাল সিকিউরিটির জন্য লাগে বিশ লাখ। সামনে কিন্তু পুরুষ জাতির জন্য অগ্নিপরীক্ষা। চাকরি মাকরি কইরা বাল বিয়া করা যায়। না বৌ পালা যায়।” 

“চেহারার বিষয়টা বাদ দিলে কথাটা খারাপ বলেন নাই। আমার ট্যালেন্ট আর হার্ডওয়ার্ক বিক্রি কইরা আমি কারও সিকিউরিটি মানি যোগাইতে পারমু না ভাই। কারও লাইফের সিকিউরিটির লাইবেলিটি আমি নিতে চাই না।”

“আর ভাই, লয়্যাল্টি নিয়ে হারাদিন থাকবা দুশ্চিন্তায়। কোনো মানে নাই এসবের।”

“থাক, আমার জন্য খারাপ লাগানোর অ্যাক্টিং করার দরকার নাই। আমি বুঝি সব, ভাবি থাকলে আপনার চেহারাটা দেখলে কিন্তু অন্যকিছু মনে হয়।”

“আর ভাই, আমি কি মানুষ আছি না কি। তখনও অ্যাক্টিংটাই করি। অফিসে কলিগ আর বসগো লগে অ্যাক্টিং। দিনেরাতে বাপ-মার লগে এক্টিং, বন্ধুগো লগে অ্যাক্টিং, সবজায়গায় অ্যাক্টিং।

“কিছু অ্যাক্টিং করতে ভালো লাগার কথা। ডি ক্যাপ্রিও হুদাই জ্যাকের রোলটা চুদায় নাই ভাই।” 

বেচারার মনটা এবার জেনুয়েনলি খারাপ হইছে। ভাবির সাথে আজকে রাতের পগমফাইট খেলাটা আর হচ্ছে না। 

“ ভাই, ভাবি আর মা ঐ রুমে ঘুমাক। আমি আর আপনি আজকে একটু কষ্ট করে ম্যানেজ কইরা নেই।”

“হ, আচ্ছা চলো। এখন খাইতে যাই।” 

“খাওয়া দাওয়ার পর ভাবিকে নিয়ে ছাদে রাতের কুয়াশায় ভিজে গল্প করেন। ভালো লাগবে।” 

শান্ত ভাই মুচকি হাসে। পারভারসিভ হাসি না, সুন্দর মায়াময় ভালোবাসায় রিক্ত হাসি। আমি খেয়াল করে দেখলাম ভাবির মাঝেও ব্যাপারটা অনুপস্থিত। কে জানে? শুধু শহুরে মেয়েগুলোর মাঝেই ব্যাপারটার উপস্থিতি কেন? আধা শহুরে বাসিন্দাদের কিছু সংযত স্বভাব এখনও অক্ষত। 

মা খুব মজা করে খাচ্ছে। ভাবি রান্না করছেন দারুণ। অনেকদিন পর জমিদারি আয়েশে চিতল মাছের পেটি দিয়ে ভাত খাচ্ছি। আরও একটা সুন্দর দৃশ্যের সাক্ষী   হইতে পেরে ভালো লাগতেছে। আমার রক্তের ভাইবোন নাই, কিন্তু অল্প কয়দিনের পরিচয়ের ভাইভাবিরে নিয়ে ডিনার করতেছি। ভুল বললাম, আসলে বেঁচে নাই। একটা ছোট ভাই ছিল। ভাইটা আট মাস টেনেটুনে বেঁচে মারা গেছে। অসম্ভব আক্ষেপের কথা, তখন ভর্তি কোচিং করতে মাত্র ঢাকায় আসছিলাম। প্রথম বছরে কোথাও টিকলাম না। পাড়ায় যেয়ে মুখ দেখাইতে লজ্জা লাগবে দেখে জেদ নিয়ে ঢাকায় পড়ে থাকি। ঘোষণা দিয়ে পণ করছিলাম ভালো কোথাও না টিকে বাসার পথ ধরবো না। সেই সময় ভাইটা হয়। ওর মারা যাওয়ার দুইদিন পর আমি সিলেটে এক্সাম দিতে যাই। আমি বেচারার চেহারাটা ঠিক করে তিনটা দিনও দেখি নাই। 

নতুন বউদের হাসির শব্দ অগ্রাহ্য করা যায় না। হাজার বিষাদের মধ্যে হারায়ে থাকলেও তারা অ্যাটেনশন টেনে নিজেদের নতুন আইডেন্টিটির সাথে মানুষের পরিচয় করায়ে ছাড়বেন। রাস্তার ফকিরদের যাদের পৃথিবীর যেকোনো বিষয়ে আগ্রহ ধরানো মুশকিল, তাদেরকেও দেখি নববিবাহিতা দেখলে হা করে তাকায়ে থাকতে। যাই হোক, নাতাশা ভাবি খুব লাজ মেখে কথা বলতেছেন মায়ের সাথে। শাশুড়ি ফিগার দেখেই এরকম আচরণ কিনা পরিষ্কার না। মূল ব্যাপার বোধহয় আরেকটা। মেবি উনি চাইল্ড এক্সপেক্ট করতেছেন। কথা বার্তাও কিছুটা সেই প্রসঙ্গকে ইঙ্গিত করতেছে। 

“আন্টি ছেলেকে ছাড়া চিটাগঙে কেমনে থাকেন? কষ্ট হয় না? আমিতো জীবনেও পারবো না।”

“ বজ্জাতগুলোর হাত থেকে মুক্তির জন্য একসময় প্রার্থনা করবা ঈশ্বরের কাছে। এগুলো সামনে থাকলে অশান্তি বেশি । দূরে থাকলে মনে হয় আমি ঈশ্বরের খাস বান্দা।”

“আন্টি কি যে বলেন! এখনকার ছেলেপেলেগুলোর তুলনায় অনিম অনেক ডিসেন্ট। আমার তো আজকালকার জেনারেশনের ছেলেমেয়েগুলোকে অন্যরকম মনে হয়। অনেক চিন্তা ভাবনা করে চারপাশ নিয়ে, খুব ক্রিয়েটিভ হয় ওরা।” 

“আমি মোটেও ক্রিয়েটিভ না ভাবি, অন্যরা হইলে হইতে পারে।”

“আচ্ছা নাতাশা, এই যে তুমি বললা কথাটা এখনকার জেনারেশনের পোলাপান। তুমি নিজে কোন জেনারেশনের?”

ভাবির চেহারাটা অমায়িক লাগতেছে দেখতে। বিয়ে করলেই মুরুব্বি হইতে চায় কেন মেয়েরা খোদা মালুম। 

“দুইদিন পর বাচ্চা কাচ্চা হবে। জেনারেশনের ট্রেন্ড মেনে চলার সময় থাকবে না কি ! কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরলেই জীবনের সব মজা শেষ, বুঝলা শান্ত। এগুলো তোমরা ছেলেরা বুঝবা না।” 

“বয়সটা মনে বাড়ে আন্টি, শরীরে না। আমার বন্ধু সজীব, তুমি চিনবা অনিম। দুই বাচ্চার বাপ যেটা। এখনও শর্টস পইরা আমাদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়, পাশ দিয়ে সুন্দর মেয়ে গেলে চাইয়া থাকে।” 

“কি বিশ্রী স্বভাব!” ভাবি নোংরা খাওয়া চেহারা বানায়। উনি কি কোনো সুন্দর ছেলে দেখলে তাকায় না না কি?

“আচ্ছা বুঝলাম তোমরা একেকটা যৌবনের জ্বালা ধরা তেজোদীপ্ত নক্ষত্র। এখন আমাকে আজকে চা বানায়ে খাওয়াবে কে? অনিম না তুমি? নাতাশা রান্না করছে আর আমার তো কিছুদিনের ছুটি। যাও দুই কুতুব একসাথে ভালো করে চিনি মেপে মেপে চা বানায়ে আন।”

শান্ত ভাই খুকখুক করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেছে। নিছক পাশ কাটানোর ইঙ্গিত না কি মা আরও কিছুদিন থাকবেন শুনে বিরহে কাশতেছেন বোঝা গেল না।

“চলো নাতাশা আমরা নেটফ্লিক্স আর চিল করি। ওরা চা বানাইতে থাকুক।”

“আন্টি আপনি তো পুরা বস। এই অনিম কিছু একটা রেকমেন্ড করো, ভালো একটা মুভি দেখে ঘুমাই।” 

“আরে বাচ্চা ছেলে ও কি বোঝে সিনেমার, আমি তোমাকে দেখাইতেছি। আসো রুমে...”   

মার কাণ্ডকারখানা দেখলে এত লজ্জা লাগে। এত শো অফ একটা বুড়া মহিলা কেমনে করতে পারে আমার আইডিয়া নাই। বেচারা শান্ত ভাইয়ের জন্য মায়া লাগতেছে। ছাদে মেক আউটের প্ল্যান কাল পর্যন্ত মুলতবি। বাসাটা বেশি ছোট। খালি আরেকটা স্পেয়ার রুম থাকলেই বেচারার এই দুর্দিন দেখা লাগত না।

আশ্চর্য, শান্ত ভাই শোবার দশ মিনিটের মাথায় কীভাবে গভীর ঘুমে তলায়া গেল। জঘন্য চেহারা বানায়ে সেল ঘাঁটতেছিল একটু আগে। পাঁচ মাসের পোয়াতি পেটের সাথে এই চেহারা দেখলে আপনাতেই বিরক্তি ধরে। আরেকটা টেনশান পাত্তা না দিলে হচ্ছে না। মর্নিং উডে না জানি কে কার পাছায় বাজায়া সকালে একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটাইয়া বসি। এত চিপা বিছানা হইছে, সোজাসুজি না শুইলেই বিপদ। দুইজন একই পাশ করে ঘুমাইলে দুর্গন্ধ নিশ্বাসে বমি করা লাগবে। কিছু করার নাই, ছাদে গান শুনে কোনোরকম রাতটা পার করে দেয়া লাগবে। এমন উদ্ভট আতংকে আমি ঘুমাইতে পারবো না।

নক্ষত্রহীন রাত, আসবাবি একেকটা অবয়ব অন্ধকার গিলে খেয়ে ফেলছে। নিঃশব্দে অন্ধকার দেখা আমার পরম কাঙ্ক্ষিত একটা মুহূর্ত। ছাদের দরজা তখন নামার কালে আটকানো হয় নাই। সাততলার সিঁড়িতে ছাদে আঁধারের জড় করা আবছায়া আলো প্রতিফলিত হয়ে কিছুটা পড়ার কথা, পড়ে নাই। সিঁড়িতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্যাপার কি? ছয়তলার নাফিসা আপুরা তো সিঁড়ির লাইট নেভান না কখনও। আমার অবশ্য অন্ধকারে সমস্যা হয় না। সবকিছু খুব পরিষ্কার দেখি। গত একমাস একটু বেশিই দেখতেছি। বায়বীয় আত্নাদের পর্যন্ত ছাড় দেই নাই।

শিট! শেষমেশ এই বিনিদ্র অনিঃশেষ প্রহরেই পেছনের ভূতদের কথা মনে করতে হইল বাছাধন ! দরজা ভেঙ্গে এখনও দুই কদম আগাই নাই, কিন্তু মনে হইতেছে পেছনে সিঁড়িতে কিছু একটা শব্দ খেয়ে খেয়ে ভেসে আসতেছে। শুধু মনে হওয়ার কারণেই কি এমন ভয় পাইতেছি? জানি না শরীরের লোম কি বুঝে দাঁড়ায়ে যায়। অতিরিক্ত কনফিডেন্স মারায়া রাতের ওষুধগুলো খাইলাম না। নিজেরে দুর্বল ভাবাও অবশ্য বোকামি ছাড়া আর কিছু না। বডির সমস্ত পজিটিভিটি এনগেজ করে নেগেটিভ চ্যানেলে রিলিজ করে দিতে হবে। মাথার ভেতর কিছু দুঃস্বপ্নের ফ্রিকোয়েন্সি স্টোর করে রাখা আছে। এ মুহূর্তে অক্সিজেনের দরকার নাই, সমুদ্রের নব্বই মিটারের ঢেউ দরকার। ফিয়ারের চেইন অফ ওয়েভ থেকে এই মহিলা কিছুতেই সরতেছেন না। তাকে নিশ্বাসবিহীন খাঁচায় আটকে কাবু করতে হবে, সময় কম।               

কিন্তু উনি পালান আর একটু পরপর উদয় হয়ে আমাকে পা ধরে পানিতে ডোবানোর চেষ্টা করেন। আমার ঝড় থামানো উচিত। কি বিশ্রী ! অন্ধকার পুরা বিদঘুটে দেখা যাইতেছে। আমি নিজেকেই দেখতেছি না। পকেটে তো সেল আছে। সামনে রেলিং পর্যন্ত যেভাবেই হোক পরিষ্কার দেখে হেঁটে যাইতে হবে। কিন্তু শব্দখোরটা ফিসফিস করে মুখের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু যেন বলতে চায়। আমি ওর কোন অস্তিত্ব পাত্তা দিবো না। না দেখা বর্তমানে সে ক্ষমতাহীন এবং ধীরে ধীরে বিলীন হতে যাওয়া অবর্তমান। বাল! আমি কি আহাম্মকি সিদ্ধান্ত নিলাম না? গড’স চেস-এ বিনা কষ্টে তার কাছে পুরা প্ল্যান এক্সপোজ করে দিলাম।

আড়ালে মৃত মহিলাটা ঠোঁটে বিষাক্ত আলো জ্বালায়। কোনো শব্দ করে না, শুধু ঠোঁট কাপায়। আমার গলা চেপে ধরে রীতিমতো কথা গেলানোর চেষ্টা করতেছে এই ‘ওয়ার্মস্ট্যাক’। জানাইতেছে রেলিং এর উপর না বসতে। কারণ ভয় পেয়ে নিচে পড়ে গেলে আমার সদ্যজন্মানো প্রিয় গ্রহটা লালরক্তে ফেটে যাবে। এই আফটারম্যাথ সম্ভবত আমার অবচেতনের। গ্রহটায় ভেনাস তার অনুচিত বিচরণ সহ্য করবেন না বলেই, আমি এই কুৎসিত পরাবাস্তব তৈরি করতেছি। কিন্তু এই বায়বীয় আগন্তুক কিছু বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে বারবার আমার অতিন্দ্রীয়ে আসতেছেন। অনেকটা ‘ঘোস্ট-বাগ’ এর মতো। যাকে স্বাভাবিকতার আপোষে নিয়ন্ত্রণ করা যাইতেছে না। আমি অবশ্যই তাকে সঙ্গে রেখে আমার পৃথিবী অস্তিত্বে ভ্রমণ করতে চাই না। যেখানে সকাল হলেই সূর্যবলে সব জীবন ছাপোষা, সাধারণ। এই ‘ঘোস্ট বাগ’ কে প্যারালাল সাব-এক্সিটেন্সের ফর্মুলায় লিমিট করতে হবে। একধরনের র‍্যানডম স্ক্রিপ্টে সাজায়ে মাথার এলগরিদমে ইনপুট দিতে হবে। 

বিবর্তনবাদ তত্ত্বে এর উৎস, অবয়বের পরিক্রমা নির্ধারণ করা কেন জরুরি হবে না? সব চেতনা যদি বিবর্তিত হয়, এই চেতনাও বিবর্তনের লম্বা সুতার বাইরে থাকবে কেন? বানরের পাঁচ সুতা দিয়ে বেঁধে এই ‘ব্লাডথার্স্টি মেনিয়াক থরোলি আনইন্টেলেকচুয়াল এক্সিস্টেন্স’ কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। সব সমস্যারই আঁতেল গোত্রীয় সমাধান আছে। সো ইউ বি রেডি টু মেক ইয়োরসেলফ রিজনেবল, হন্টেড সামওয়ান! আমি রেলিং এর উপরেই বসলাম। ছাদে তোমার নতুন খেলাঘরে আপাত অন্ধত্বের ধার চুদলাম না। 

“তোর গলার স্বরটা ধার দে।” বরাবরই শরীরের পেছন দিকটায় এদের আকর। ব্রেইনটারে পাছা বানায়া তার ছিদ্র দিয়ে ঢুকতে চায়। সামনে আসেন না ক্যান? পারলে আসেন। 

“দেহহীন লাশের চোখ দেখছস অনিম? মারা যাবার আগে আমার মণি দুইটাই শুধু নড়াচড়া করতেছিল। আমার শেষ দুই মিনিটের অসহ্য যন্ত্রণা দেখবি?”

এই অনুভূতির সাথে আমার পরিচিতি নাই, কোনোভাবেই নাই। অসম্ভব ঘটনাটা রীতিমতো চেতনার গোচরেই ঘটতেছে। এর আগে কি কখনও এরকম অবাস্তব ভাবনা সাবকনশাসলি দেখার চেষ্টা করছি? 

“উত্তর হচ্ছে…… না।” চোখ দুইটা কি কথা বলল? না! রেলিংয়ে সাদা ফেনা হয়ে বোধহয় গড়ায়ে পড়তেছে। সাদা ফেনা হয় কীভাবে? গলে পড়া ‘Sclera’ থেকে? আমার ঘাড়ে বৃদ্ধার হাত কখন আসল? হাতটা আবার গলা বেঁয়ে আমার চিবুকের দিকে আগায়। থুতনিটা মুঠি চেপে ধরে ধীরে ধীরে পেছনে নেয়। আমার চোখ স্থির হয়ে দেখে মহিলাটার চোখের কোটরে কিছু নাই। নিজ নড়চড়ে এই জমজ দৃষ্টি-প্রাণ সমস্ত শক্তি শেষ করে সাঁতরাচ্ছিল, একটা অন্তহীন কুয়ার ভেতর।

ধরাধামে এখন কেবল প্রার্থনার ডাকের শব্দ। সকাল হয়ে গেছে। যাক, স্বাভাবিকতা কানে বাজে তাহলে। আমি কখন পুব দিকে ছাদের ফ্লোরে রেলিং এর সাথে পিঠ ঠেকায়ে শুয়ে পড়ছিলাম খেয়াল নাই। মন বিশ্বাস করতে বলতেছে ‘তুমি হিপনোগজিয়াক। মেন্টাল স্টেট বারবার ফলস আওয়েকেনিং এর প্যারাডাইমের মধ্যে ঘুরপাক খাইতেছে।” আমার একটা কিছুও সত্য বলে মনে হয় না। 

এই যে খুব সুন্দর একটা ভোরের আলো ধরে ছাদের গোটাগোটা তুষার আগমনি শিশিরে ত্রিশ মিনিট ধরে হাঁটতেছি আর গান শুনতেছি এটা কি সত্য না মিথ্যা? গ্রে ডেফিনেশনে এটা হইতেছে গত দেড় মাসের ননস্টপ হরোর শো এর লুসিড রিয়েলিটি। ফাক এভরিথিং! 


 

৭.

চেম্বারটা বিশাল বড়, তের জনের গাদাগাদি করে বসা লাগবে না। ক্লকওয়াইজ সেটআপে পনেরটা কোজি চেয়ার, পেশেন্টদের জন্য ট্রেতে এসপ্রেসো আর চারকোণা বেগুনি চায়না সিরামিকের হাফপ্লেটে মচমচে চারটা কুকি রাখা। বাকি পেশেন্টদের আপত্তি না থাকলে স্মোক করা যাবে। মন খুলে মনরে ন্যাংটা করার খুবই ভালো ব্যবস্থা। পশ্চিমমুখী জানালাটা দেখে ভার্সিটির ক্লাসরুমের কথা মনে পড়ে গেল। গোটা একটা দেয়ালের মাঝামাঝি থেকে দুইকোণ দখল করে রাখছে। সিলিংটা আবার ডিসট্র্যাক্টিভ। মাঝখানে হিটারের ভেন্টিলেটর আর তার চারপাশ জুড়ে ইলিবিলি টাইপোগ্রাফিতে সমগ্র মেন্টাল ভার্সের এক্সিবিশন সম্ভবত। সাদা আর কাঠরঙে পরিমিতি আছে পুরা পরিবেশটায়। আর কেউ আমার মত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এতকিছু দেখতেছে কি? আচ্ছা, দুইটা ছোট বাচ্চা। বয়স কত হবে ওদের? সর্বোচ্চ বিশ। এক ভদ্রলোক উৎসাহী হয়ে সবার আগে আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্ব শুরু করলেন। আমার ওতে গা নাই। ভাবতেছি বাচ্চাগুলোর সামনে নিজের এক্সপেরিয়েন্সটা কীভাবে শেয়ার করবো? আজকে কি তাহলে উঠে যাবো? প্রথমেই জানা উচিত ছিল এই ব্যাচের সবাই মেন্টালি ম্যাচিওর কি না। আর শুধু শুধু আড়াই হাজার টাকা পানিতে নষ্ট করারও কি মানে থাকতে পারে। হুদাই চিন্তায় টাইম ডাইলিউট করার কোনো কারণ নাই। প্রতিটা জায়গা আলাদা আলাদা পারপাস সার্ভ করে। সবাই এখানে নিজের চিন্তাই করতেছে। আমার সমস্যা কোথায়? 

কাউন্সেলর সাহেবার পরনে হিপটাইট ইয়োগা প্যান্ট । হাতে কফি নিয়ে হেঁটে এসে আমার পৌনঃপুনিক অ্যাঙ্গেলে বসলেন। গায়ের চাদরটা সামনে আলতো করে ছেড়ে মুখে মৃদু হাসিতে দ্রুত চোখ ঘুড়ায়ে সবাইকে একনজরে স্বাগত জানালেন। অপরিচিত মানুষদের দিকে একটানা তাকায়ে কথা বলাতে আমি রীতিমতো এলার্জিক । অন্যদিকে তাকায়ে কথা বললে বা শুনলে যা না শোনার মতই, কিছু ক্ষেত্রে কারও কারও ভুল পারসেপশন তৈরি করবে কি না বুঝতেছি না। এছাড়া চারজন, ইনক্লুডিং কাউন্সেলর ছাড়া আমি ঠিক করে কারও চেহারাও দেখি নাই। ম্যামের অনুকরণে বাকিদের ওপর একটা গ্ল্যান্স দেয়া যাইতে পারে। বাহ্! অর্ধেকের মতো পেশেন্ট আগে থেকেই আমাকে আড়াআড়ি অবসার্ভ করে আসতেছিল। তাদের মধ্যে দুইটা বিধ্বস্ত দেখতে মেয়েও আছে দেখি। গোটা জাতিটা ইনফরমাল, কেউ কারও দিকে একটু হেসে তাকাই না কেন বুঝি না। চেহারায় ইন্টারেস্ট খোঁজার ব্যাপারটা মুহূর্তেই হারায়ে ফেললাম। আর হাতে মগ ধরে রাখছি কিন্তু চুমুক দেই না। এইদিকে এত কষ্টের কফিটা নরমাল হয়ে গেল। কুকিজ ডুবায়ে আপাতত পদে আনা যাইতে পারে । যত যাই হোক, রেস্টুরেন্টের ফিলটা কিন্তু আলাদাই থাকে। ফ্রেশলি বেকড কুকিজের সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো কিছুর তুলনা হইতে পারে না। 

বুঝলাম না, পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল অথচ কেউ বলা শুরু করে নাই। এরা আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে কেন? রোল কল করতেছে অথচ আনসার করতেছি না, এমন কোনো ব্যাপার না কি? ম্যাম দেখি প্যাডে পেন দিয়ে কি জানি নোট করতেছেন, মিনিটস মেবি। উনার আমার দিকে নজর নাই। এদের কেউ কেউ এখনও অকওয়ার্ডলি লুক দিতেছে। কি করা উচিত? সবার পরিচিত কোনো সোশ্যাল জার্কের স্কিনে ঢুকে হেসে হেসে কুকিজের একরাশ প্রশংসা করবো? 

“স্মোক করলে কারও কোনো প্রবলেম?” কুকিলাইফ পেটে চলে গেছে । বাকি থাকল চার চুমুকের কফিলাইফ। এইটারে সিগারেটের সাথে শেষ করতে হবে। কেউ যখন কিছু জানায় না তখন প্যাকেট বের করে টানা শুরু করাই উত্তম। ম্যামের মুখশ্রীটা সুন্দর করে হেসে অনুমতি দেয়। অনেকটা সাবধানে জানানোর ভঙ্গি, আফটার অল চেম্বারটা তার। আমি এক ঠ্যাং আরেক ঠ্যাঙের উপ্রে উঠায়ে সিলিং এইম কইরা ধোঁয়া ছাড়ি আর দেখি। ওমা! মানুষজন সব নড়েচড়ে বসে ‘এখানে কিছু হইছে না কি’ বুঝ নিয়ে সেলফোন ঘাঁটা শুরু করে। শালার, প্রত্যেকটা প্রাণীর কনশাস মুভমেন্ট থ্রেডে থ্রেডে সিম্যুলেট করা। কি সিনক্রোনাইজড টাচ স্ক্রলিং সবার, প্রচণ্ড দৃষ্টি হিতকর। আইডিয়া বলতেছে আমার ধুমাধরা পার্টের যন্ত্রণায় হয়তোবা কোনো ভার্চুয়াল অস্তিত্ব কিছুক্ষণের মধ্যে ফারাফারা হইয়া যাবে। আজকালকার জীবন আসলে কোন বিদীগ গল্পকারের রচনা। যার সিকোয়েন্সের আমি কোনো মাথামুণ্ডু পাই না।

মাইক আথারটন হইয়া লারার তিনশ পঁচাত্তর রান হজম করলাম। পরপর পাঁচ জনের ড্রাগ এডিকশন জনিত পিটিএসডি কেস। এইটা কোনো কথা! কারও লাইফেই কি অন্য কোনো বড় ঘটনা ঘটল না? শেষটায় এক ডিলার মেয়ের কাহিনি শুনে মাথার রগ ফুলে গেছে। তার জামাইটাও এডিক্ট কাম ডিলার। দুইজনই একে অপরকে সারাক্ষণ ফিজিক্যালি-মেন্টালি এবিউজ করে। ফ্যামিলির কেউ তাদেরকে একসেপ্ট করতে চায় না। আবেগগুলোরে শেপে আনতে মেয়েটা কিছুদিন আগে কনসিভ করছিল, পরে মিসক্যারেজ হইছে। ওর কাহিনির ধারাবিবরণী চলাকালীন সেই সতের বছরের উঠতি মেথখোর আসর ছেড়ে পালায়ে গেছে। বিশাল ডিপ শিটে আছে বেচারি। পুলিশরে চান্দা দেয়া বন্ধ করার সাথে সাথে হয় ক্রসফায়ার নাইলে মাদক মামলায় মৃত্যুদণ্ড অন্যথায় যাবজ্জীবন। কোনো এনজিও, হিউম্যান রাইটস এই বালের সিস্টেমের এগেইন্সটে কিছু করতে পারবে না। ভুল সিদ্ধান্তগুলোয় কাদায় ডুবে ঘনকাদা হওয়ার সিস্টেম আছে, কিন্তু ঘনকাদাটারে রিসাইকেল করার সিস্টেম নাই। একারণেই বর্বর চেতনাবাজীর বাপরে ঠাপানোর চান্সটা পাওয়ার সাথে সাথে কেউ মিস করতে চায় না। 

দাদার বয়সী এক ভদ্রলোক তার গল্প বলার প্রস্তুতি নিতেছেন। তাকে দেখেই কষ্ট লাগতেছে। ঢোলা অফ হোয়াইট ট্রাউজারটার হেমলাইন দিয়ে ফর্সা হাড় জিরজিরে পা জোড়া বের হয়ে আছে। অবশ্য রাবারের কালো মোটা স্যান্ডেলের কারণেও পা দুইটা এমন দেখাইতে পারে। চোখ দুইটা পাথরের মত ভারি। একটু কেশে ফ্লোরের দিকে তাকায়ে হয়তো ভাবতেছেন কীভাবে শুরু করবেন। কে জানে তার স্টোরি কতটুকু হার্ডহিটিং হবে । মাথা উঠায়ে সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। আমি লাইটার আর সিগারেটের প্যাকেট পাস করে দেই। ভদ্রলোক আমার তিন সিট পরে বসছেন। সিগারেট হোল্ড করতে তার হাত কাঁপে, মাথার  লালচে সাদা চুল চশমার ডাণ্ডার পেছনে সরাতে তার হাত কাঁপে। সবকাজেই সম্ভবত তার হাত কাঁপে। কাঁপাটাই স্বাভাবিক, বয়স সত্তর ক্রস করছে নির্ঘাত।

“আপনি অনিম না?”

“জি।”

“আপনার মা এখানে এসছিলেন তিনদিন, কাউন্সেলিং দেখে গেছেন।”

“জি, ম্যামকে উনি রেকমেন্ড করলেন।” বৃদ্ধ সময় নিতেছেন। একটু বোর লাগতেছে। ওয়েইট করতে কখনই ভাল্লাগে না। ম্যাম রেফারেন্স ভেরিফাই করার পরও দেখি অবসার্ভ করতেছেন। খুব কিউরিওসিটি তার চোখে।

“ আপনার মা একটু ডিফারেন্ট অনিম। কিন অবসার্ভার, নিজে এসে থেরাপি নিয়ে আপনার জন্য কেমন হবে ব্যাপারটা বুঝতে চাইলেন। আপনি চাইলে কিন্তু উনি এটেন্ড করতে পারবেন।” 

“না না। এভাবেই ঠিক আছে।”

“ওয়েল, দিস ইজ আওয়ার ফিউচার ডক্টর তানজি, সে হাই টু ইচ আদার।”

পাশে একটা ছেলেও আছে। দুইজনের রিলেশন আছে মেবি। নাইলে ছেলেটাও হেসে গ্রিট করত না। 

“আচ্ছা পাশের জন ওর হাজবেন্ড, রুবেল। তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন দুজন। প্রবলেমটা মেইনলি তানজির। ডক্টর রুবেল শুধু মেন্টালি না, ফিজিক্যালি এসে প্রপারলি সাপোর্ট করছেন। আপনার মার মত, ভেরি কেয়ারিং।”

“দ্যাটস একচুয়ালি নাইস। ইভেন নাইসার টু হ্যাভ ইউ এমাং আস।”

বৃদ্ধ হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলেন, কেউই ঠিকমত শুনলাম না। বিড়বিড় করতেছেন। বেচারার সাইলেন্সটা নষ্ট করা ঠিক হয় নাই। তার মেজাজ সম্ভবত বিগড়ায়ে গেছে।

“আফজাল আংকেল কিছু বলবেন?”

“ছেলেটার সাথে সকালে কথা বললাম, ও আমাকে ছেড়ে আসতে রাজি হয় না।”

“আংকেল আপনি একটু সুস্থ হয়ে নেন, লেট আস হেল্প। আজকে নতুন কিছু পড়লেন?”

বৃদ্ধ, ম্যামকে অগ্রাহ্য করে নিজের পোষা রাগ নিয়ে মেঝেতে চেয়ে আছেন।

“একটা বুড়া মানুষকে অন্যদের কষ্ট-কথা জোর করে শোনাবার কি মানে অদিতি? আমাকে একটু জানাবা? সাহেব থাকেন বিদেশে, স্বেচ্ছায় ওল্ডহোমে গিয়েছি। কত ভালো ছিলাম ওদের সাথে, কত কিছু করার ছিল। তোমার বন্ধুকে আমি কোনো দোষ দেই না, তারপরও আমাকে নিয়ে তোমাদের এত মাথাব্যাথা কেন?”

“আংকেল আপনি হালকা হতে চাচ্ছেন না। এখানে সবাই আপনার ওল্ডহোমের বন্ধুগুলোর মতই। একটু বন্ধু ভেবেই দেখেন, দেখবেন প্রেশাস লাইফটুকু আপনাতেই শেয়ার করছেন। এখন আপনি চাইলে আমাদের কোনো জোক শোনাতে পারেন অর আপনার কোনো সুন্দর স্টোরি শোনাতে পারেন। বাতাসটা একটু ভারি হয়ে গিয়েছে, মন ভালো করা স্টোরিতে আই হোপ কারও আপত্তি নাই।”

“তোমরা না টেস্ট ফেস্ট করে দেখলা, আমার মেমোরির কোথায় জানি সমস্যা। স্মৃতি না থাকলে কিসের কথা আর কিসের গল্প।”

“আংকেল, আপনি কিন্তু ইম্প্রুভ করছেন। ওল্ডহোমের কথা কিন্তু ভুলে যাননি।”

বৃদ্ধ ঠায় বসে আছে। এবার চোখ বেঁয়ে তার পোষা দুঃখ বেড়িয়ে পড়ছে। জড়ায়ে ধরা উচিত কারও। হাগ সেশন হবে না? সবার শেষে হবার কথা। ম্যাম জোর করে মুখের সহজ ভাবটা ধরে রাখছেন। কিন্তু তার দুই চোখ মাপা যায়। খুব গভীর কষ্টটা অনুশোচনার সাথে মিশে আছে সেখানটায়।

“আমরা দশ মিনিটের একটা ব্রেক নেই। ব্রেক শেষ করে অনিমের এক্সপেরিয়েন্স জানবো।” 

সাম ফ্র্যাকশন অফ রিয়েলিটি ফিল করতেছি আসার পর থেকে। এরপরও পাগল হবার পর্যায় থেকে দূরে চলে যাই নাই । এখান থেকে বের হয়ে হয়তো বাসায় যাব। তারপর যতই পিল নেই না ক্যান, নিজেরে এই পৃথিবীর সাথে এসোসিয়েট করতে পারবো না। আদতে দরকার ভরপুর সেক্স করা। যাহা রিয়েলিটি কনজিউম করার ক্ষণকালীন শ্রেষ্ঠ তরিকা। তানজি মেয়েটাকে দেখে কিন্তু পুরা হর্ন বেজে উঠছিল। মাই মাইন্ড কাইন্ডা উইশেস টু লুক এট হার স্টাফস। একদমে পয়জন আইভির সেই কচি ড্রিউ ব্যারিমোর বাতাস বের করে আনছে মেয়েটা। আহা সেই অরগ্যাজমিক সময়টা! কত দ্রুত ফেইড হয়ে গেল। ইউনিতে ওঠার পর ফেমিনিস্টদের ব্রেকথ্রুর কালে মেয়েদের আসল নকল জিনিস দেখা বন্ধ করে দিছিলাম। যখন উলটা সবচেয়ে বেশি দেখার কথা। এরপর থেকে খালি পর্নস্টারদেরকেই ইজ্জত দিলাম না। 

পর্ণ দেখি না তিন মাসের কাছাকাছি। এককথায় নুনুর ক্রান্তিকাল চলতেছে বলা যায়। একটা পরিপূর্ণ উত্থান এখন যুগের দাবি। নেতিয়ে পড়া সময়টা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে হবে। সেক্সিটার জামাই বিজি ডক্টর। একটু আগে ক্লিনিকের কলে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। হাগ সেশনে আমার ভাই সবসময় তানজিরেই লাগবে । যদিও জানি না ব্যাপারটা কীভাবে ঘটবে। আপাতত গুলশান থেকে বনানী হেঁটে খাতির জমানোর ট্রাই করি না ক্যান। ও বসে আছে বনানীর পাশটায়। ফাঁকা ব্লকের ঝকঝকে ফুটপাথের এক কোণে একলা বিড়ি টানতেছে। নিশ্চয়ই কম্পানি দরকার।

“হেই, কি খবর! অনিম রাইট। প্লিজ সিট।”

“গুড থিং আপনি স্মোক করতেছেন। শেষের কয়েকটা পাফ শেয়ার কইরেন প্লিজ। দাদুভাইকে প্যাকেট দিয়ে আর চাইতে পারি নাই। বাই দ্যা ওয়ে ওনার প্রবলেমটা কি?” 

“শুনলেনই তো, লোনলিনেসের স্ট্রেস নিতে পারছেন না। এখানে আসার আগে সুইসাইড অ্যাটেম্পট নিয়েছিলেন। ফ্রিকোয়েন্টলি থ্রেট করে যাচ্ছেন, ওল্ডহোমে ফেরত দিয়ে না আসলে আবার অ্যাটেম্প নিবেন। ”

“অন্যদের প্রবলেমের সল্যুশন দেবার ক্ষমতা আমার নাই। তারপরও সিমপ্লি মনে হয়, ছেলেটা বাবাকে নিজের কাছে রাখলে ভালো করতো।”

“হুম, কি কি কমপ্লিকেশন্স যেন রয়েছে। ছেলের কয়দিন আগে ডিভোর্স হয়েছে। বাচ্চাদের কাস্টডির কেসে পানির মত টাকা যাচ্ছে। এইসব আর কি, নিও সোসাইটির ডার্ক কমপ্লিকেশন্স।”

“তার মেমোরি ইস্যুটা কি?” সিগারেটটায় ঠোঁটের চিহ্ন কমলা ঘ্রানে রেখে না মুছে কিছুক্ষণ দেখে একটু চিন্তা করে বাড়াইল। কোন হেজিটেশন নাই ওর। আমার ফিঙার টিপে ও স্টয়িকলি আঙ্গুল ছোঁয়। ফুলের টোকার মত এসে লাগে। ফিলস নাইস। 

“অ্যামনেশিয়া, ভেরি কমন এমাং এলডারলিজ। ডিসোশিইয়েটিভ মেমোরি, হঠাৎ করে আসে আবার হঠাৎ করে নাই।”

“Do you think it’s a good idea to be here? I’m kinda scared about approaching my experience, to be honest.”

“Works for me, never knew it feels so comforting hugging loners.”

“So you’re not considering me as a straight stranger.”

“I think you, I mean not only you but we are all painful big secrets. Holding these comfortably could be a really beautiful thing I’m hoping.”

“Beautifully thought, the kind of connection I felt we always needed. I think I understand you.”

“Cool ! I’ll hug you. অই, দশ মিনিট শেষ হয়ে যাবার কথা না?”

“Really, can’t wait to hug? I know I know, Don’t give that look. Sorry I was kidding. I mean to say you care like a mental surgeon literally.”

“Not that I only care, I want to cure and can’t wait to hear what’s your side of the story. Let’s move now.”

“We sit along, calming our breaths. She feels so pretty, I wish she wasn’t here.” 

নার্ভাস ব্রেকডাউন। বিচ্ছিরি অবস্থাটা নিজেরে এক্সপোজ করতে নিষেধ করে। কোনোভাবে পাশ কাটায়ে যাইতে পারলে খুব ভালো হইত। দুইদিনের মেয়েটা এই স্টোরি ডিজার্ভ করে না।

“সবাই সবাইকে চিনি, তারপরও আরেকবার পরিচিত হই। উনি অনিম, আজ জয়েন করলেন। সোফিয়া মিসকে তো চেনেন, তার ছেলে। এক্স ঢাকা ভার্সিটিয়ান। কিছুদিন হল এমবিএ শেষ করেছেন। আপাতত জব খুঁজছেন। আপনারা চাইলে আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন।” 

“ভাই আপনাদেরও ঝামেলা হয়? এইসব জায়গায় পড়লে ক্যারিয়ার তো ফুল সেট ভাই ! আর কত হ্যাপেনিং একটা প্লেস ঢাকা ভার্সিটি !”

“এভাবে কেন দেখছেন রাফসান? ট্রমা, স্ট্রেস এসব যে কারোরই হতে পারে। তানজি বিএমসি তে পড়ছেন, জানেন নিশ্চয়ই।” 

“থ্যাংকস ম্যাম, ভাই রাফসান, গাড়িতে চড়তে দেখলেই কেউ সুখে আছে এটা জানাটা ভুল। আমার যদি কোনো প্রবলেম নাও থাকতো এইসব স্টোরি শুনেই আমি এডিএইচডির ভিক্টিম হইতাম কোনো সন্দেহ নাই। সো ইন্সিডেন্টসের কোনো মা-বাপ নাই, বুঝলেন?”

“সরি ভাই, ভুল বুইঝেন না। আপনাকে দেখতেও অনেক কনফিডেন্ট লাগে, খেয়ালটা এই জন্যে আসছিল। প্লিজ ক্যারি অন…...”

“হিপনোগজিয়া নিয়ে কারও আইডিয়া আছে। আই মিন কখনও এসব কেইস পাইছেন কি না?”

“না।”

“তুমি হিপনোগজিয়াক? সো উইয়ার্ড। ইউ ডিডন্ট সিম দ্যাট গাই টু মি।”

“নট রিয়েলি, তানজি। আমি নরমাল থাকা প্রিটেন্ড করি। আমার মনে হয় সবাই কম বেশি করি এই জিনিসটা। আসলে……”

লেকচার লেকচার হয়ে যায় না ব্যাপারটা। এত এক্সাইটেড কেন আমি? নার্ভ জানায় এর চাইতে কুল ডিজঅর্ডার আর পৃথিবীতে নাই। হাস্যকর ! 

“লেট মি হেল্প, অনিম। সবাইকে বলছি, এইটা খুব স্ট্রেঞ্জ একটা ফেনোমেনা। ভিক্টিমের মনে হয় ফিজিক্যাল রিয়েলিটি ব্যাপারটা একটা ফেইক কিছু। কোনটা ড্রিম কোনটা রিয়েলিটি ব্রেইন ডিসাইড করতে পারে না। কিন্তু অনিম মেন্টালি যথেষ্ট স্ট্রং। ওর দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এই স্টেট অফ কন্ডিশনকে ওভারকাম করার। আমরা সবাই ওকে এপ্রেশিয়েট করি না কেন?”

আমার এদের চেহারা দেখতে লাগতেছে কোন ব্ল্যাংক টেপের মত যেখানে হুদাই কিছু তালির শব্দ অপ্রয়োজনে রেকর্ড হইতেছে। আচ্ছা, এদের সাথে কানেকশানের জন্য এত ডেসপারেট কেন হইতে হবে? কোথায় জানি শুনছিলাম কেউ বেঁচে আছে কিনা বুঝতে হইলে তার স্পর্শের দরকার। হাত ছোঁয়া স্পর্শের দূরত্ব অতিক্রম করতে না পারলে চিন্তায় স্পর্শ অথবা অনুভূতিতে স্পর্শ। গাছের মৃত পাতা ছোঁয়া আর প্রাণময় সবুজ পাতার ছোঁয়ার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। অদিতি ম্যাম এখানে কোনো অচেনা বৃক্ষের ছায়াস্পর্শদানকারীর ভূমিকায় আছেন। তার লিকুইডিটির রোলপ্লেতে নিশ্চয়ই কোনো অস্তিত্বখাদকের সমালোচনার জায়গা নাই। তাকে মাথায় আশ্রয় করে আগানো যায়।

“তারপর ইদানিং কেমন ফিল করছেন? আউট অফ বডি এক্সপেরিয়েন্সগুলো এখনও কি ঘটছে?”

“হরিবলি।”

“আপনার নার্ভ ঠান্ডা রাখার সুপারডোজড মেডিকেশনের পরও! মিস বলছিলেন, এক রিলেটিভ মারা যাবার পর থেকে মেইনলি আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন।”

“উনি যে মারা যাবেন এটা আমি আগেই জেনে গেছিলাম।”

সবার চোখ বড় হয়ে গেছে। আমি মোটেও এনজয় করি না ব্যাপারটা।

“প্যারালালি, উনি কিভাবে হাসিখুশিতে বেঁচে থাকতেন তাও আমি না চাইতেই জেনে গেছি।”

“কাছের কেউ মারা যাবার পর আমরা তাকে ঘিরে সবচাইতে সুন্দর কল্পনাগুলো সাবকনশাসলি ধারণ করি। আমাদের সুন্দর মনটা ভাবতে চায় তারা আনন্দ নিয়ে বেঁচে আছেন। আপসেট হবার কোনো কারণ নাই অনিম।”

“ম্যাম আমি জানি।” কিছু করার নাই, ছবিগুলো দেখাইতে হবে। “ আমি নিজের আঁকা কিছু ছবি দেখাচ্ছি। খুব সম্ভবত ক্লাস সিক্স-সেভেনের দিকে আঁকা, ডেট মেনশন করা আছে। আপনার সুবিধার্তে স্কেচ আর রিয়েল ইমেজের স্ক্রিনশট কোলাজ করা।”

“ইমেজটা আপনি আপলোড করেন নাই দেখছি। তনিমা কে জানতে পারি।”

“মৃতার মেয়ে, আমার কাজিন।”

“ব্যাপারটা কাকতালীয়। তবে আপনার ড্রয়িং সুন্দর।”

“কয়টা ছবি কাকতালীয় হয়, জানাবেন প্লিজ। আপনি স্ক্রল করে দেখেন, কোনো একটা পারিবারিক সেলেব্রেশনে আমি সবার লাইভ স্কেচ শুরু করি। সেসময় আমার মাথায় কি ঘুরতো আমার খুব ভেগলি মনে আছে।”

“আমি কিছু বুঝছি না, একটু ক্লিয়ার করে বলবেন?”

“আমি আশপাশের পরিচিত চরিত্রগুলোকে নিয়ে আর্ট সিরিজ স্কেচ করতাম। প্রথমে যে ছবিটা দেখলেন ওটা আমার দাদাবাড়িতে আঁকা। মা-ফুপুদের পা ছুঁয়ে ছোট কাজিনরা আশীর্বাদ নিতেছে, পেছনে বাবা-চাচারা হাতে কাস্টার্ডের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতেছেন। তো সেই থেকে শুরু। ওই উৎসবটা আমার অসাধারণ গেছিল। পরে ঠিক করছিলাম, অনেকটা গ্র্যাটিটিউডের মত এই প্রিয় মানুষগুলোরই সবচেয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ মাথায় নিয়ে নিয়মিত স্কেচ করব।”

“পরের ছবিগুলো?” সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ম্যামের হাতের উপর। হুজুগের দোষ দেয়া যায় না অবশ্য। আমার স্মৃতি থেকেই পুরাপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছিল ঘটনাটা। অনেকটা ম্যান্ডেলা ইফেক্টের মত। ভুলেই গেছিলাম এসব সময়ের অথবা অদৃষ্টের কোনো অস্তিত্ব আছে। মার সাথে চিটাগং যাবার পর শেলফের এককোণে স্কেচবুকটা পাই। বাকিটা ইতিহাস।

“এজ উইয়ার্ড এজ ইট সিমস, একেবারে সেম স্কেচের রেপ্লিকা! ফিউচারে সবার লাইফে বিভিন্ন সময় ঘটেছে, হসপিটালে বেবিবার্থসহ। একেকটা সিরিজের এক্স্যাক্ট কম্পজিশনের এক্স্যাক্ট রিফ্লেকশন।” 

“হ্যাঁ হুবহু, ওটা সাবাব। আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। এখন বলেন, আচ্ছা তার আগে স্ক্রল করে ফোল্ডারের উপরের ইমেজগুলোর দিকে যাবেন প্লিজ। অয়েল পেইন্টিং এর কাজ সেসব। হ্যাঁ, কি দেখলেন, মা ফিগারের মত কাউকে? উনি আমার ফুপু, যিনি মারা গেলেন কিছুদিন আগে। সাবকনশাস কি আসলেই টাইম ট্র্যাভেল করে কি না আমার জানা নাই। আরও আজগুবি আমি তার ভবিষ্যতের চেহারার একটা ক্ষুদ্র ডিটেইলও মিস করি নাই। একটা বিশ্বাস কেন এত পোক্ত আমি জানি না, কিন্তু আমি তখন তাকে এননিমাস জেনে এই কাজটা করছিলাম।”

“ আশ্চর্য রকমের প্যারানরমাল। এই ছবিগুলোর সাথে কেন কোনো ইমেজ নাই?”

“হ্যাঁ, আমি যা বলতেছিলাম, কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু না হইলে উনি এইভাবে বাঁচতেন।”

একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে সেলটা ঘুরতেছে। আচ্ছা দেখুক, জানুক, আমি একটা সাইকিক। না ভুল, জানা উচিত তাদের সামনে যে খুব ভাব নিতে চাচ্ছে সে একজন ভুলোমনা হাস্যকর সাইকিক।  

“উনি মারা গেলেন কীভাবে?”

“এই বিশৃঙ্খলাভরা পৃথিবীতে উনি একটা সাজানো গণ্ডগোল। কেউ তার স্মৃতি ধরে রাখতে চায় না দেখে উনি মরে গেছেন। তিনমাস বাসায় লাশ হয়ে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলেন। কেউ জানত না, আমি নিশ্চিত জানতাম।”

“তার মেয়ে কোনো খোঁজ নিতেন না?” 

“তনিমা আপুর কথা বলতেছেন? তাকে সাত বছর বয়সে এতিমখানা থেকে দত্তক নেন ফুপা-ফুপু। নিজেরা চেষ্টা করে পারেন নাই,তাই।”

“আপনি বলতে চাচ্ছেন……”

“ যা ভাবতেছেন তাই, মানুষ কুকুর না। লয়্যালিটি তার ধাঁচে নাই। উনি তার শ্বশুরবাড়িতে চরম সুখে দিন কাটাইতেছেন। কিছুদিন পর কানাডা চলে যাবেন, সিটিজেনশিপ হয়ে গেছে তাদের।”

“গার্ড-সিকিউরিটি, নেইবার কেউ কোনো খোঁজ নিল না? কি অদ্ভুত কথা?”

“চারিদিকে খুন রেপ হয়, ফুপু থাকতেন একলা, কাউকে বিশ্বাস করতেন না। আর ঢাকা শহরের নেইবার, জানেনই তো কেমন। বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করলে আমাকে ডাকতেন, মাঝেমধ্যে আমি যেয়ে থাকতাম। ”

“মিসের কাছ থেকে শুনলাম, আপনি তার ডেড বডি দেখে আতংকে মরতে বসেছিলেন প্রায়।” 

“হ্যাঁ, আমার কাছে তার বাসার স্পেয়ার কিজ থাকে। আমার মনে হচ্ছিল তিনি বেঁচে নাই। কিন্তু চেপে থাকতাম, কাউকে বলতাম না। তিনমাস কুৎসিত যন্ত্রণা সহ্য করার পর আর পারি নাই। যেয়ে দেখি উনি তেলাপোকার মত উল্টে পড়ে আছেন। কয়েক লক্ষ মাছি তার লাশের গন্ধ মেখে ঘরময় উড়তেছিল।”

“ক্যাচ এ ব্রেথ, অনিম। আপনি অসম্ভব সাহসের পরিচয় দিয়েছেন।” তানজি পিঠে হাত রেখে কোমল আশ্বাস দেয়। চেনা-অচেনা সমস্ত কুলাঙ্গারেরা বিকৃত হাসির ডালি নিয়ে অপেক্ষা করতেছেন আমার পেটে। আমাকে হাসতে দেখে কেউ বিষম খাইতেছে না।

শুধু কেউ একজন বোতলে ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়। পানি গিলে কিছু কথা বলতে হবে। এদের মিথ্যা ভরসা আর সহ্য করা যায় না।

“ম্যাম, আপনি খুব ভালো করে জানেন আমি মিথ্যা বলতেছিলাম। সত্যের মাঝখানে দিয়ে এক-দুইটা মিথ্যা তথ্যের খিচুড়ি বানানো মিথ্যা না। একেবারে প্লেইন মিথ্যা বলতেছিলাম।”

“আপনি এখানে এসছেন মনের কথা খুলে বলতে। আমি তাই শুনছিলাম।”

“ট্রিটমেন্ট প্রসিযারের কোড অফ কন্ডাক্ট মেইনটেইন করতেছেন?”

“অনেকটা তাই।” 

“আমার নিজের উলটা ভেরিফাই করে কষ্ট লাগতেছে। কেউ আমাকে আমার সত্য জানাইতে পারতেছে না কেন?”

“আপনি কোনো সত্যই বিশ্বাস করছেন না দেখে। এটা রিহ্যাব, আপনাকে নিজ থেকে বিশ্বাস করতে হবে আপনি কোন সিচুয়েশনে আছেন।”

“আমি বিশ্বাস করতেছি আপনাদের কোন পারপাজ নাই, টাকা খসানো ছাড়া।”

“এন্ড ইউ আর স্মার্ট এনাফ টু ডু ইভেন বেটার। প্লাস আপনার ঈশ্বরপ্রদত্ত কিছু ক্ষমতা তো আছেই। অনেক বড় একটা ড্রামার প্লট আপনার মস্তিষ্ক তৈরি করলো, তার কারণটা আপনি নিজেই ভালো জানবেন। আর তাছাড়া…...”

“এটা একটা রিহ্যাব, এখানে কেউ সত্যি কথা বলে না।”

“না অনিম। আমি বলবো, এখানে সবাই অনেক কিছু লুকোয়। আট বছরের এক্সপেরিয়েন্স আমাকে বারবার তাই বলে।”

“আমার মনে হইতেছে আমি আবারও স্বপ্ন দেখতেছি।” পিচ্চি ছেলে যার নাম রাফসান আমাকে কিছু বলতেছে কিন্তু মাথায় ঢুকতেছে না। আমি ধারণা করতেছি ও কি বলতে চায়, “ভাই, আপনি অযথাই নিজেরে হেইট করতেছেন। আমাদের সত্য মিথ্যা জানানোর দরকার নাই ভাই……”

“আমরা মন থেকে বিলিভ করি আপনি খুব অসাধারণ একটা মানুষ।” অতি চমৎকার সেসব হারমোনিতে ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকায়ে আছে। মনে হয় বুঝতে পারে নাই আমি কেমনে যেন জাইনা যাই, কে কী চিন্তা করতেছে বা কী বলবে। অতি নগণ্য একটা ক্ষমতা, কিন্তু অনেকের জন্য দুঃস্বপ্নের ঘোরের মত। আমার মনে হইতেছে হিপনোগজিয়ার সদাহাস্য রিয়েলিটিটারে বেন্ড কইরা সোজা করতে আরও অনেক সিস্টেমকে প্রশ্ন করতে হবে, আজকেও যা পারি নাই। খালি একটা ব্যাপার বিরক্তিকরভাবে গায়ে বাজে, যা প্রত্যেকটাবার ঘটে। কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে এইরূপ ‘নিদ্রা-জাগরণ’ পর্ব শেষ হইলে প্যান্টে করে অরগ্যাজমের চিহ্ন নিয়ে বসে আছি।

তানজি ঠেসে জাপটে ধরছে রীতিমতো। ঘাড়ের পাশটা আধা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। ঘাড়ে নাক চাপানোর পরও ওর ফোঁপানো থামে নাই। আচ্ছা ওর স্টোরিটা জানি কী? হঠাৎ ভুলে গেলাম। আচ্ছা মনে পড়ছে। সার্জারির ক্লাস করার পর থেকে লাশ বেডের নিচে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে জেনে ঘুমাইতে পারে না। সাহস না থাকলে বালের জোর করে সার্জন হইতে চাওয়ার কি দরকার ছিল? জীবন্ত স্বামী পাশে রেখে ঘুমাইলেও বেচারির সেক্স লাইফ বলতে কিছু নাই। আমার মতো অবস্থা। কিছু জায়গায় আমাদের ভয়ংকর মিল। বোধহয় কেউ যেন সাজায়ে গোছায়ে সব মিল বুঝায়ে দিয়ে চলে গেছে। 

“তানজি, লাস্ট কবে ওইরকম নাইটমেয়ার দেখছিলা?”

“হবে দশ-বার দিন। অনিম তুমি শিউর তোমার অরগ্যাজম হয়, বিচ্ছিরি একেকটা ড্রিম দেখে?”

“হ্যাঁ, বললাম তো খালি তোমারই হয় না। ম্যাম তো দেখলা জানাইলই এইটা একটা সেনসেশান, আমাদের মত কেসগুলোয় নিওরাল ডিসফাংশনে কিছু ক্ষেত্রে এরকম হইতে পারে।”

“ড্রিম ভেঙে গেলে আমি খুব সুন্দর একটা স্মেল পাই, তোমার গা থেকে এখন ঠিক সেই স্মেলটা আসছে।”

হাত দুইটা আপনাআপনি ওর পিঠ থেকে কোমরে চলে যায়। ওর কোমরটা পড়নের পাতলা কালো শিফনের চাইতে নরম। আমার দ্রুত বাড়তে থাকা হার্টবিটের শব্দ ও একমন দিয়ে শুনতেছে। 

“অনিম?”

“কি?”

“তুমি শিওর, এই ডিসফাংশন খালি নেক্রোফিলিয়াক সিরিয়াল কিলারদের ছাড়া অন্যদেরও হয়?”

“তাশফি, আমি তোমাকে আরামে জড়ায়ে ধরে আছি। ট্রাস্ট মি, সিরিয়াল কিলারদের ধারেকাছে নিজেদের খুঁজে পাইতেছি না।”

“তুমি মিউজিকের ফ্লোতে স্টেপ ফেলছ, দ্যাটস কিউট।”

“ওয়েইট, টিপিক্যাল হিন্দি সিনেমার সিনপাট্টি রিক্রিয়েট করতে যাইও না প্লিজ। পা দুইটা আমার পা থেকে নামাও।”

মেয়েটা জেন্টলসুইট নেচারের, ক্রেজি সুইট না। এই নেচারের প্রাণীদের প্রতিটা জেশচার আমার অসম্ভব পছন্দের।

“Do you care that I’m married?”

“A big No.”

নখগুলো দিয়ে খামচাইতে চেয়ে খামচায় না। শার্টের উপর একনাগাড়ে স্ক্র্যাচ করে। আঙুল-বাঙ্গুল ঘুরায়ে আঁকাবাকা অজস্র অদৃশ্য বৃত্ত এঁকে নিজেকে বুঝায়। ছোটখাট অভিব্যক্তি কত কিছু যে বলতে চায়, আর না জানি কত কিছু লুকাইতে চায়। দূর! এত ভাবাভাবির কি দরকার? সোজা গালে গাল ঘষে ঠোঁট চেপে চুমা খাওয়া শুরু করলেই হয়। 

এই রিয়েলিটিটা সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সত্য। এখন ঘুম না ভাঙলেই হয়। না ঘুম ভাঙলো নাহ। বাট, ম্যাম বাঁকা চোখে আমাদের মাখামাখি পর্ব মনযোগ দিয়ে দেখতেছেন। 


 

৮.

ঢাকায় ইস্কাটনের মতো জায়গায় এত বড় ফাঁকা বাসা পড়ে থাকতে আমি খালিখালি ভাড়া গুনে অনাত্নীয়র বাসায় থাকবো কেন? না হিপনোগজিয়া না ফুপু ভূত, কেউই আমার চুল ছিড়তে পারতেছে না। এমন জ্বালা-যন্ত্রণাতেও আমি দিব্যি বেঁচে আছি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো দুমাস পর থেকে নতুন চাকরিতে ঢুকবো। চাকরি জীবনে একটা সাজানো গোছানো সুন্দর বাসার বড় গুরুত্ব আছে। কেউ মুখে না বললেও আমি জানি, পরিবর্তিত দিনগুলোয় ঘোড়ার লেজে ভর্তি বিছানার ম্যাট্রেসে কখনই মেয়েমানুষের অথবা ভালো-বন্ধুর অভাব হবে না। আমার কোন ডিজঅর্ডার চোদার টাইম আছে।

না, তনিমা আপু কিংবা ফয়সাল ভাইয়া কারও চিন্তা-চেতনায় আমার আসন্ন সুবিধাভোগীর জীবনটা নাই। তারা শুকনামুখে বাসার চিপাচাপায় স্মৃতি কবর দেবার জায়গা খুঁজতেছেন। আর আমার মতো বিরষমুখী কাপুরুষে কেন যেন কোনো সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের আস্থা খুঁজতেছেন। অন্যদিকে সেক্স-ফেক্সের ভাবনায় আমার যাবতীয় নৈতিকতা দিনদিন সরু পাটকাঠির আকার ধারণ করতেছে। ‘তনিমা আপু’ তখন আর জানতে ইচ্ছা হয় না। তার মতন একটা অসাধারণ মেয়ের সাথে ব্যাকরণগত নিমিত্ত ভাঙার প্রবল তৃষ্ণা জাগে। তার উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ে জড়ানো হাই স্লিভ পিঠখোলা ফিরোজা ব্লাউজ ভেদ করে সরীসৃপের ধ্যানমগ্ন চোখে মাংসের ঢিমেতালা বেখেয়াল চলনের কারিকুরি আকর্ষণ, বিবিধ আরটিস্টিক নগ্নচেতনায় দেখতে ইচ্ছা হয়। ফ্যান্টাসির রেসকোর্সে ফয়সাল ভাইয়ের লাকি বেইটে লাথি মেরে নিজের ঘোড়াকে জেতাতে অশুদ্ধ ইচ্ছা হয়। সেইদিন এক রেপিস্টের কেস ফাইল পড়তেছিলাম। ঐ ব্যক্তি কনফেশানে বলছিল, তার প্রতিটা ভিক্টিমের মানুষ হিসেবে জীবনচলনের নীতিনির্ধারণে ভীষণ শ্রদ্ধা ছিল। একই সাথে সে শয়তানের প্রচণ্ড অলৌকিক ক্ষমতাকেও অস্বীকার করতে পারে নাই। তার ধারণা প্রত্যকেটা মানুষের বোঝা উচিত চেতনা ধারনের সংজ্ঞায় কোনো বাঁধাধরা প্রশ্নে কাবু হইতে নাই। কারণ মাপকাঠির ধারণায় যারা নিজেদের দেখে, তারা জানে আয়নায় তারা অতি ক্ষুদ্র দুর্বল একটা মানুষকে দেখে। একদিক থেকে ধারণাটা ভালো। আমি আয়না দেখাই বন্ধ করে দিছি, কারণ আমার মাথাই কুইন্টিলিওন আয়নার ল্যাবরেটরি।

“অনিম এইদিকে একটু আয় তো।”

“জি আসি।” আমি বুঝলাম না আমারে আর কি বুঝায়ে দেয়া বাকি আছে? ফয়সাল ভাইয়ের দিকে তাকাইতে মায়া লাগতেছে। বোধ করি, জামাইদের সমস্যার কোনো শেষ নাই। 

তাদের জেনমে ওভারলি প্রটেকশান কোডে কিছুদিন পরপর আপডেট দরকার, সিক্সথ সেন্সে তাতে মোটামুটি ম্যাচুরিটি আসবে।

“আম্মুর জামাকাপড়গুলো কি করবো? আমি না…... বুঝতেছি না।” 

“গয়নাগাটি?”

“ব্যাংকের লকারে রেখে আসছি। কিছু শাড়ি আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু বাকিগুলোর কি ব্যবস্থা? একটা বুদ্ধি দে।”

“থাকুক না, স্মৃতি হিসেবে থাকলো।”

“তুই সময়মত মথবল চেঞ্জ করতে পারবি? ছয়মাসের মধ্যে নতুন কিনে এনে কাপড়ে না রাখলে তো সব পোকা কেটে সাবাড় করবে।”

“মেজোফুপু, ছোটফুপুদের সাথে কথা বলে দেখ।”

“ভালো কথা মনে করায়ে দিছিস।” আপু প্রত্যেকটা শাড়ি স্নেহ চোখে দেখতেছে। কিছু শাড়ি আলাদা করে বিছানায় রাখলো। এই শাড়িগুলো হয়তো উনি পড়তো, সাথে নিয়ে যেতে চান। কিংবা ফুপুকে গিফট করছিলেন। আজকাল সবকিছু গেস করতে খুব ভালো লাগে। কোনো কাজ নাই তো।

মাঝেমাঝে সেলটারে ধইরা জোরে ফিক্কা মাইরা গুড়াগুড়া করতে মন চায়। সেলের আর দোষ কি, দোষ হইতেছে আমার কনডম পড়তে না চাওয়ার অপারগতার। না কি আমার বাপের? খোদা মালুম। তানজির টেক্সট বড়বড় হরফে কি এইসব বালছাল জানায় না কি কোন ডেসপারেট মা’র অতিবাসনার আহ্লাদ জানায়? 

“We made a little dancer in my belly. Funny thing is gadha asshole Rubel ta lafaye kude shobaike mishti khawacche. Btb, we’re celebrating our baby blue’s kickly-lickly first days of swimming. You must come by Sunday or ‘Sonday’ or ‘ Sundae’[ Pun intended ]. 

P.S.- ওর চোখ জ্যোতিষীর ইচ্ছার মত নীল না হলে কিন্তু পুরো পৃথিবীর খবর আছে।”

ঢং করে অরগ্যাজমের মায়া থেকে বলছিলাম কথাটা। এখন দায় চলে আসছে। বিরক্তিকর! তোমার বলদ খাসিটার সিড থেকেও বাচ্চাটার চোখের রং অন্য কিছু হইতে পারে। আমি বুঝলাম না, মেয়েরা এসব জানে কীভাবে? আই মিন ক্ষেত্রবিশেষে কোনটা কার বাচ্চা? পেটে কি ডিএনএ টেস্ট করার পিসিআর মেশিন সেট করা না কি? 

“অনিম তোর মন খারাপ কেন?”

“না আপু, আমি ঠিক আছি।” কী বাল বলবো? না চাইতেই বাবা হতে চলেছি, এইজন্য মেজাজ খারাপ?

“এই শাড়িটা দেখ, কি আশ্চর্য কিউট! আমার ফার্স্ট পহেলা বৈশাখের শাড়ি। আম্মু নিজে বানাইছিল। ঐদিন এ্যালবাম দেখে শাড়িটা খুব ধরতে মন চাইতেছিল। আজকে পেয়ে গেছি। কি যে ভালো লাগতেছে…… আমার বেবিটার একবছর হইলে ঠিক সেইম ঐ পিক্টার মতন আরেকটা পিক তুলব। কিউট লাগবে না?”

সেইদিনের বলা মিথ্যা কথাটা মনে পড়ল, ‘তনিমা আপু এডপ্টেড’। অবশ্য কেউ সত্য মিথ্যা দিয়ে আমাকে বিচার করে নাই। তাতে কি! আমার নিজের সত্য বাস্তব জানা বাধ্যতামূলক ছিল। করুণ ব্যাপার হইতেছে যখনই কোনো সত্যতা আঁকড়ে বসবাস করতে চাই, তখনই কোনো একটা ধুম্রজাল পরিস্থিতি এসে সবকিছু বিগড়াইয়া দেয়। কিছু সত্য থেকে পালায়ে বাঁচতে পারলে খুব ভালো হইত। তানজির সাথে আমার সত্য, সুতার প্রবল টুইস্টে জড়ায়ে থাকবে। ছেঁড়া সুতাতেও দুই সুতার অস্তিত্ব আছে। অস্বীকার করতে গেলে মিথ্যা জন্ম নিয়ে টানাটানি করা লাগবে। কি বিশ্রী একটা ব্যাপার!

এই লোকটার গা থেকে কবে নিজের গন্ধ বের হবে? ফয়সাল ভাই মানেই লিটারখানেক কয়েকগাদা সিনথেটিক কেমিক্যালের গন্ধ। আর পাশে বসে প্রথমেই কখনও কথা শুরু করেন না। পাথরসমৃদ্ধ আঙ্গুল দিয়ে সেলফোনের স্ক্রিনে টকটক শব্দ করেন। এখন অবশ্য একটা ডায়েরির পাতা উলটাইতেছেন। ব্যাপারটা কৌতূহলোদ্দীপক। ফুপুর হিসাবের খাতায় ঘুরে ফিরে আমার প্রসঙ্গে কিছু লেখা। ফয়সাল ভাই তনিমা আপুর চোখে তাকায়ে গাড় মমতায় ভিজে হাসছেন। “দেখিতো একগাদা অবসরে বুড়ি আমারে নিয়ে কি লিখত…

“অনিমের কফি- ৮৩৭ টাকা

  অনিমের দুই ডজন বারসোপ- ১৪৩৬ টাকা

  অনিমের আচারি সস- ১৪৫ টাকা

  অনিমের একজোড়া বাথরোব - ১৩৮৫ টাকা”

পরের পাতায় লেখা, “প্যান্টের ভেতরে গাঁজাসহ খাওয়ার পেপার পাওয়া গেছে। গাঁজা ভিজে যাওয়ার কারণে ফাংগাস ধরে ফেলছে। পড়লাম না বিপদে! পেপার না হয় কিনে আবার পকেটে রাখতে পারব। কিন্তু গাঁজা কোথায় পাবো? গাঁজা খাওয়া অনিম কিন্তু খুব মজার কম্প্যানিয়ন । একটা হাস্যকর গোমড়ামুখা দার্শনিক ভাব চলে আসে বাচ্চাটার চেহারায়।”

“আম্মু দিস ইজ রিয়েলি নট ফেয়ার। আমি বারান্দায় সিগারেট খাইতে যেয়ে ধরা পড়লাম আর তুমি ঐদিন থাপ্পড় মারলা!” তনিমা আপু উপরে তাকায়ে চিল্লাইতেছে। যেন ফুপি জানালার উপরে সানশেডের উপর পা ঝুলায়ে দুরন্ত কিশোরীর অভিমানে সবকিছু শুনতেছেন।

শিট ফুপু রোদেলার ব্যাপার দেখি পুরাটা জানতো। আল্লাহ... সব লিখে রাখছে,

“ভাইয়া, তোমার ছেলে ভার্জিন না। মিনিমাম বারদিন আমি না থাকা অবস্থায় বাসায় রোদেলা নামের একটা মেয়ে নিয়ে আসছে। মেয়েটা অবশ্য ভয়ঙ্কর সুন্দর (আমার চেয়ে কম)। 

বেচারার জায়গায় আমি থাকলে নিশ্চয়ই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারতাম না। পিচ্চি শয়তানগুলো এত সুন্দর মেয়ে কোথায় পায় আজকাল কে জানে? তারা নিরিবিলি কবুতরের খোপে কবুতর সেজে সময় কাটাইতে আসে বদমায়েশগুলোর সাথে। এরা দুনিয়া দেখবে কবে?

রাযিন, অনিম কি তোমার মত সুন্দর করে ভাবে? আমার জানতে ইচ্ছা করে…” আর পড়া সম্ভব না।

আমি রাব্বানি কুত্তার বাচ্চাটারে আস্তে আস্তে শেষ করলাম না কেন? তিনমাস মাংস খাবলায়ে, পচায়ে মাছি দিয়ে বমি করাইতে পারতাম না? পারতাম। কিন্তু আজগুবি এথিকস আমারে কিছু করতে নিষেধ করে…

“এই ডায়েরিটা তুই রাখবি অনিম?”

“আপু, রাব্বানি বাঁচলো কেমনে?”

“আমরা মেক শিওর করে গেছি ঐ অমানুষের বাচ্চাটা যাতে জীবনে জেল থেকে বের না হয়।”

“অনিম, আপাতত কোনো সিকিউরিটি রাখার দরকার নাই। কিছু উলটাপালটা দেখলেই সাবিতকে কল করবা। জেইল কিন্তু একেবারে কাছে, পায়ে হাঁটা দূরত্বে। মাঝামাঝে যেয়ে দেখা করে আসবা। ভালো হবে।”

“ভাইয়া, আমাদের কথা শুনো, কারই কিছু করার ছিল না। তুমি ওরে খুন করতে চাইছো, ও মরে নাই। ভালো হইছে, আমার লক্ষী ভাইয়াটার কোনো ঝামেলা হয় নাই।”

হ্যাঁ কোনো ঝামেলা হয় নাই। খালি ঘুমাইতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন জানতে হয়, একটা সিকিউরিটি গার্ড আমার কাপড়চোপড় পরে, আমার গায়ের গন্ধ মেখে আমারই সবচাইতে আদরের একটা মানুষের গয়নার জন্য, তার টাকার জন্য তাকে তিনদিন চোখ বেঁধে রেপ করে খুন করতে যাওয়ার সময় কোনো অজানা কারণে আমারই হাতে ধড়া পড়ছিল। আমি ওরে ছুরি দিয়ে কোপাইয়াও শেষ করতে পারি নাই। ও পালাইতে পারছিল, আমাকে ফুপুর লাশের সাথে তিনদিন জীবিত রেখে। মৃত আত্নারা তাদের যন্ত্রণা জানাতে পছন্দ করে। আমি না চাইতেও জানি অন্ধ বোবা হয়ে চেনা পরিচিত অসহ্য গন্ধের গা গুলোন জোরাজুরিতে তাদের কেমন লাগে। হয়তো এসব কারণে এই সুন্দর মানুষটা আজীবন একটা প্রেতাত্না হয়ে আমারে শাস্তি দিয়ে যাবেন, কোনো রাতের বেলায় পুরো পৃথিবীর শব্দ খেয়ে। কোনো দিনঘটিত স্বপ্নসমস্যায় সেজে। 

“তনিমা আপু আর ফয়সাল ভাইয়া তোমরা জড়াজড়ি করে ঘুমাও। আমারও ঘুম আসতেছে।”

“ অনিম!”
 

De-construction Phase-2

“ভুল অথবা শুদ্ধের পৃথিবীর জন্ম ”

৯.

রাতের চিঠি

১১-১০-১৯

সন্ধ্যায় থার্ড ফ্লোরের জ্যাক আর লিলির সাথে ইভ অনলাইন খেললাম। দুইমাস আগে খেলা শুরু করছি আর গত একমাস ধরে নেশার মত খেলতেছি। এখনও পর্যন্ত পাঁচটা স্টার সিস্টেম এক্সপ্লোর করতে পারি নাই আর এই দুই ভাইবোনের প্রায় দুই মাসে তিনশ স্টার সিস্টেম এক্সপ্লোর করা শেষ। কই থাকি আসলে? আমার মনে হয়, এই যমজ দুইটা কোন সিম্যুলেটেড প্রডিজি গেমার। গেমপ্লে দেখলে মনে হয় ১৪ বছর আগে এই বাচ্চা দুইটার জন্ম হইছে কোনো স্পেসশিপের কন্ট্রোল রুমে। দুইটার ম্যান্যুভার স্কিল  দেখলে এই দুনিয়াতে কোনো এলিয়েন আসার আগে বিশবার চিন্তা করবে।

তবে সবচেয়ে বড় কথা আংকেল-আন্টি দুর্দান্ত যত্ন করতে আজকেও ভুল করেন নাই। কুকুররা এত অসাধারণ প্যারেন্ট হইতে পারে আগে জানা ছিল না। মার্ক যাকারবার্গের জয় হোক। জনাব আপনার মানবতাবোধ আর জীবপ্রেমের সংযোগ স্থাপনকারী যুগপৎ ট্রান্সলেটর ডিভাইস ‘গুডবুক’ উদ্ভাবনের কারণে পৃথিবীটা আজকাল অনেক সুন্দর। দুইটা এতিম বাচ্চা সংকোচহীন অধিকারে মান্ধাতা আইনকে ধরাশায়ী করে দাবি করতে পারে তারা স্নেহপ্রবণ প্রাণীদের অভিভাবকত্ব কেন গ্রহণ করবে না! 

সিস্টেমের আমূল পরিবর্তনে গত এগার বছরে কিছু অসম্ভব কাজ হইছে। ছেলেমেয়েদের আগামী বছর থেকে কোনো পরীক্ষাই দিতে হবে না। ইন্ডিভিজ্যুয়াল অ্যাসেসমেন্ট আর একাডেমিক কাউন্সেলিং-এ ইচ্ছামতো সাবজেক্ট পছন্দ করে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত। নামজাদা প্রফেসররা সব জেলা ঘুরে ক্লাস নিবেন। বড় নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় বলে আর কিছু থাকতেছে না। সবার গবেষণায় শিক্ষাব্যয়ের যোগান মিটবে। সরকার বর্তমানে গবেষণা বাইরে বিক্রি করে ট্যাক্স এন্ড এক্সপেন্সের রিডিস্ট্রিবিশনে জোর দিতেছে বেশি। 

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য দেশজুড়ে সব সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের কারিকুলাম ঢেলে সাজানো হইছে। অবস্থা এমন কেউ চাইলে তার সারাজীবন ছাত্রবস্থায় কাটায়ে দিতে পারবে। পেটে ভাত ঢুকানোর জন্য কারও হুদাই টেনশন করতে হবে না। আফসোস আমার! পৃথিবীতে আর কিছু বছর পর জন্ম নিলে কি এমন ক্ষতি হইত! এসব ভাবতেছিলাম আর মন খারাপ হচ্ছিল। এরপর নিজের নতুন আবাসে ঢোকার আগে হাঁটতে বের হই। একটা পর্যন্ত রাতের ক্লান্ত আলোকিত ঢাকায় নিঃশব্দে হাঁটার চেষ্টা করলাম। 

লাভ হইল না, মনের অপূর্ণতাগুলো অজান্তে একেকটা হিমভেজা বড় রাস্তায় আছড়ে পড়ে পড়ে শব্দ করতেছিল। নিজের অপূর্ণতায় মন ভারি ছিল কি না? না। নাম না জানা পথের দুঃখী মুখগুলোর দিকে চেয়ে আমার রিহ্যাবের ঐ ড্রাগ অ্যাডিক্ট মেয়েটার কথা মনে করে মায়া হইতেছিল, ঐ বুড়ো বাবাটার চেহারা মনে করে মায়া হইতেছিল। কিছু নিয়ম আমরা এখনও পরিবর্তন করতে পারি নাই। আসলে চাই না করতে। কিছু মানুষ মরে গেলে কেন যেন, কারও কিছু যায় আসবে না। যেমন শ শ ট্রামের চিৎকারে পাখি রাস্তায় মরে পড়ে থাকলে কারও কিছু যায় আসবে না। ছোট থাকতে দেখতাম কোনো ঝড়-ঘূর্ণিঝড়-তুষারঝড় ওদের কাবু করতে পারতো না। আজকাল কি হইল কে জানে, যেকোনো উচ্চশব্দেই কান ফেটে এরা রাস্তায় মরে পড়ে থাকে। পরীবাগে একটা বকুল গাছের নীচে তিনটা চড়ুই পড়ে ছিল। ইচ্ছা হইল একটাকে কবর দিতে। হাতে নিতেই বুঝি চড়ুইটা এই শহরে নতুন ছিল। কারণ পাখায় পিচঢালা রাস্তার ধূলা নাই, বরফে লেপ্টা কালি নাই। ওর আত্না যেন শক্ত নীলে জমে বলতেছে, “আমাকে কেউ ভেজাল কলমে লিখে সৃষ্টি করছিল। আমি, তোমার মুঠোয় এভাবে জন্মাইতে চাই নাই।”

আমি কবি না, কিন্তু এদের নিয়া কবিতা লিখতে চাই। সবাই এসবে মাথা না ঘামায়ে মাঝেমাঝে এত স্বাভাবিক আচরণ কীভাবে করে। আমি দেখে অবাক হই। তাই বাসায় এসে একেকটা শূন্যতার গল্প হয়ে লিখতে বসি। কিছু সময় ছবি আঁকি। নিজের ক্রমশ গাঢ়, প্রকট হইতে থাকা সমস্যাগুলোর কথা আর মনে থাকে না। মনে থাকে না কিছুদিন যাবত ঝাপসা খেয়ালে এই রুমে কিছু অদ্ভুত দৃশ্য ঘটতে দেখি। দেখি প্রায়দিন কোন মানুষ চুপিচুপি আমার ভঙ্গিমায় নিঃশব্দে হেঁটে এসে টেবিলটায় এখন যেভাবে বসে কিছু লিখতেছি ঠিক তার নকল করে কিছু লিখতেছে কিংবা কে জানে...আঁকতেছে ! এই লেখার মেটাফোর হিসাবে এই খেয়ালে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস নাই যেহেতু তাই গোটা ব্যাপারটাকে একটা ‘খেয়াল’ বলতেছি। তবে আমি এই থিওরিকে ভিত্তিহীন পাত্তা দেই। 

সায়েন্টিস্ট হইলে খুব সুবিধা হইত আমার। পাত্তার মূল উৎস কি, কোন সময়ের লুকোচুরির ঘাপলা থিওরি কি না আবিষ্কার করতে পারতাম।    
 

মাইল্ড থেরাপি   

২২-১০-১৯

জন্মের পর থেকে আমাদের সবকিছু শিখায়ে দেয়া হয়। কোনো কিছু কিভাবে শেখা উচিত, আচরণ কেমন হওয়া উচিত, ইত্যাদি ইত্যাদি। একই খাবার, একই ধরনের পোশাকআশাক, একই ধরনের চিন্তাপদ্ধতি শিখেও দাবি করি সবাই আমরা আলাদা। কারণ কোনো একটা সুবিশেষ কোড সবাইকে রক্ষা করতে হয়। সত্তাকে পৃথক করার বা পৃথক জানবার কোড। দুর্ভাগাদের কপালে সে কৌশল নিজ থেকে শেখার ব্যবস্থা নাই। বাকিদের সহজ-জটিল সকল সমস্যা সমাধানের একেকটা পন্থা বা বিবিধ বাহারি কোড যার যার রক্ষাকবচের মতো কাজ করে। সমাজ ব্যবস্থা বা পৃথিবীর নিয়মকর্তারা ওরফে মেটাফিজিসিস্টরা এসব কোডের তথ্য নিয়ে কোনো দুর্বোধ্য খেলার আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন স্তর নির্ণয় করে। আমরা জানি না এইসব খেলা তারা কোন অস্ত্র নিয়ে খেলেন। তবে এটা জানি তারা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। 

ব্যাপারটার রহস্য লুকিয়ে আছে প্রত্যেকের শরীরের ভেতর। বিশেষ করে মস্তিষ্ক ফ্রয়েডীয় থিওরির আড়ালে কিছু সত্য গোপন করে, যার সবকিছুই আনকনশাস নয় বা ব্রেতোর পরাবাস্তব নয় বা কোন ফ্যান্টাসি ফোকটেলের ব্যাখ্যাতীত কোনো ঘটনা নয়। চিন্তার ক্ষমতা বলি বা অন্য যেকোনো কেন্দ্রীকরণ ক্ষমতার সংজ্ঞাতেই ব্যাখ্যা দিতে যাই না কেন, আমি বিশ্বাস করি সবকিছুর ব্যাখ্যা আছে। যেকোনো ক্ষমতাই কেবল আকার পরিবর্তন করে সাধারণত বড় থেকে ছোট হইতে পারে অথবা অতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম পার্টিকেল থেকে দৃশ্যগোচরের বাইরে বড় একটা সুপার কোয়েজার হইতে পারে। অন্য রূপ জানায়ে যারা সবাইকে অসহায় হিসাবে ধর্তব্য ধরে নেয় তাদের বিপরীতে আমার দ্বিতীয় সত্তা। মস্তিষ্ককে অল্প পরিচিত পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে যাদের নিষেধ, তাদের কারণেই আমার বিশেষ অবস্থান। আমি চাই আমি আরেকটা ভিন্ন মানুষ হই। স্যানিটির সংজ্ঞায় নিজেকে বেঁধে রাখতে চাচ্ছি না। আমরা কেউ জানি না আমাদের ক্ষমতা কতটুকু, শুধু জানি মরে গেলেই সব শেষ। মৃত্যু মানে কী? প্রথম স্তরে থেকে যে ধারণা পাই তা হলো, অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। অদৃশ্য থেকে অনুভূতিতে-স্মৃতিতে রক্ষিত থাকা যায়। জগত মৃতের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে না, কিন্তু অদৃশ্যের জন্য? 

জগত হায় হায় করে রব উঠায় তুমি আর আগের মতো নাই। কিছু একটা হইছে তোমার… যত্তসব আহ্লাদি প্রেমবোধ! অসংখ্য অনাহুত জটিল একেকটা লিফটে যাদের নিত্য উঠা-নামা তাদের পাশে অমন সহযাত্রীদের অভাব নাই। স্যানিটির জন্য তারা সবাই একেকটা অদৃশ্য কোড মেইন্টেইন করে। কোডের লগারিদমে আমার কোনো আগ্রহ নাই। অদৃশ্যের প্রোগ্রামার হইতে আমার যত আগ্রহ।

বিগত দশদিন আমি আরেকটা লিফটে চড়ছি। সেই লিফটের সহযাত্রীরা আমাকে সামান্য ভিন্ন আমিত্বের পৃথিবীর স্বাদ এনে দিছে। তারা জানাইছে আমার বর্তমান পৃথিবীতে প্রচুর খুঁত আছে, যেই খুঁত খুব দ্রুত ইরেজার দিয়ে মুছে অন্য কিছু এঁকে-লিখে ঢাকার বা পরিপূর্ণ করবার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাকি সহযাত্রীদের সেই খুশিতে মনে হচ্ছে এর পরিপূরক অন্য কোনো কিছুই হইতে পারে না। তারা সবাই এহেন প্রতিস্থাপিত ইউটোপিয়ান স্বপ্নের স্বার্থরক্ষায় অতিব্যস্ত, নিমগ্ন। দেহচেতনায় ডুবে আয়নার পৃথিবীকে তারা না বুঝেই অস্বীকার করে। তাদেরকে আমি বাথরুমে পায়খানার পর আয়না দেখে চিৎকার করে বলি পারসেপশন যে সত্যি এটা কি জ্ঞান-বিজ্ঞান হাতে কলমে প্রমাণ করে নাই? 

আমি নিজেই তো একজাতের প্যারালাল রিয়েলিটিতে জাগতাম, ঘুমাইতাম। তাই সেই লিফটের সহযাত্রীদের জানাতে অসুবিধা হয় নাই আরেকটা পৃথিবীতে আমার হঠাৎ চাওয়াতেই কারও অস্তিত্ব নাই হয়ে যাইতে পারে। প্রথমবার, আমার মার পেটের বোন অরার, কারণ আমি তার প্রেমে পড়ছিলাম। দ্বিতীয়বার, আমার মামা রাব্বানি, কারণ উনি নয় বছরের একটা ছেলে যে কি না আমার চাচাতো ভাই হয়, তাকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলছিলেন। সর্বশেষ আমার ফুপুর, যিনি শুধুই আমাকে একটা সমস্যা মনে করতেন দেখে। আমার ধারণা তার মৃত্যুর পর আমি নতুন এই পৃথিবীতে চলে আসছি।

তবে এই পৃথিবীতে আমার অনেক গুরুত্ব। কারও সংস্পর্শে আসা মাত্র আমি বলে দিতে পারি সে কবে মারা যাবে, কীভাবে মারা যাবে। আমি জানি আমার ফেইট ইকুয়েশনের ফলাফল দুর্দান্ত, যদি না আমি নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ঝামেলাগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেই। আমার বুঝা  হইছে, গত দশদিনে এসব সত্য জানার পর অতি অদ্ভুত ভাবে প্রেতাত্নাগোত্রীয় সমস্যা আমার আর হয় নাই, হবে না। ‘হবে না’-টা কোনো আশা ভর করে আসে নাই। আশা যেহেতু ইনফিনিটি না, আমি জানি আশার সংখ্যার প্রবাবল লিমিট কোথায় শেষ হয় বা হবে। এটা অবশ্য তেমন কিছুই না। সম্ভাবনা তত্ত্ব নিয়ে যে কেউ ঘাটাঘাটি করলে এখন এর সমাধান জানতে পারবে।

তবে আমি জানি না আমার জন্য বিচিত্র কিছু অপেক্ষা করতেছে কি না। ইন্টুইশন শরীরের এককোণে কব্জা মেরে বসে আছে। সব প্রশ্নের সাথে এই শালার খুব যোগাযোগ। প্রায় প্রতিটা উদ্দেশ্য জানতে তার কত উৎসাহ। ও আচ্ছা, ভুলেই গেছিলাম, ওর জন্ম এই পৃথিবীরও আগে। 

এত কিছু লিখে আমার প্রচণ্ড ঘুম পাইতেছে। রাতও খারাপ হয় নাই। ঘড়ির কাঁটা সাতটার কাছাকাছি। দেড় ঘণ্টা পর সকাল। ঘুম থেকে উঠে দেখবো সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে আলো দিতেছে। উত্তরের মানুষের কপালে কয়েক মাস আলো পড়বে না। বাংলাদেশে দিনের আয়ু এত কম, খুবই বিরক্তিকর !” লেখা শেষ করে সোজা বিছানায় কাটা কলাগাছের মত শুয়ে পড়লাম, কিন্তু চোখজোড়া টেবিল থেকে সরতেই চায় না। আছেটা কি ঐখানে? 

সেই খেয়ালটা ইগনোর করতে পারি না। জোড়ালাগা অস্তিত্বের ব্যাখ্যা যে লিখে রাখবো তা কি আমি আগে ভাগে জানতাম না? অবচেতনের হিসাব-নিকাশে ব্যাপারটা অদ্ভুত কিছু হয়তো না, আবার অদ্ভুত কিছুই। এসব ব্যাখ্যার উৎস-সূত্র-সমাধান জানতে আমার এত ছোটাছুটি কেন? ওমা, টেনশনে ঘুম উড়ে গেল দেখি! বাহ্‌, এই আনন্দ কোথায় রাখি। কতদিন পর চিন্তায় চিন্তায় আমি ঘুম মারলাম খোদা মালুম। সম্রাটরে দিয়ে এক কাপ কফি বানানো যায়। ভুল বলছি । তোতারে দিয়ে সুধায়ে কফি বানাইতে বলতে হবে । কি এক আজব পোলা দিয়ে গেছে মা। তোতার ডাকে উঠে, তোতার ডাকে ঘুমায়, তোতার আদেশে চলে। কাজকারবারও তোতার মত। মানুষের ধার ধারে না, তোতাসুরে চলে। মানুষ হিসেবে আমার আফসোসের কোনো সীমা নাই।
 

“ভুল/শুদ্ধের পৃথিবীর আত্নাদের গল্প কিংবা মিরর রিয়েলিটি”

১০.                          

বাইরে ভারি তুষারপাত। রাস্তায় আজকাল নতুন ল্যাম্প বাসানো হইছে, ইয়েলো ফিল্টারড লাইট। কাছে গেলে বাতিটা সাদা দেখা যাবে। কিন্তু দূর থেকে বাতি বাঁধানো একেকটা রাস্তা দেখলে মনে হয়, নীলছায়া সামনের পৃথিবীটা ধরে রাখছে। বরফি বাতাস পুরো ব্যাপারটায় একটা জাদু আবহ এনে দেয়। বাঙালি শীতেও জ্যোৎস্না মিস করতে চায় না। তাই সিটি কর্পোরেশনকে দিয়ে এই অন্য রাজ্যের আয়োজন। তারপরও একটা ব্যাপার আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ মিস করি। মধ্যরাতের রিকশাফেরির ক্রিং ক্রিং ঘণ্টা। তুষারদিনে সেই ছোটবেলার মত বারটার দিকে ছুটে বের হয়ে আইসক্রিম খাওয়া হয় না। মিষ্টি দিনগুলোয় প্রায়দিন কম্বল চাপায়ে একেকটা নিয়ন ফেরি দেখে রাজ্যের স্বপ্ন মেখে ছুটতাম। আইসক্রিম মামারা একেকজন সন্ত। কতদিন যে নিজের জন্মদিন বলে ফ্রি আইসক্রিম খাইছি হিসাব নাই। সন্ত মামারা সবকিছু জেনেও ভুলে যাওয়ার ভান করতেন। ভান না করলে বিচ্ছু বাচ্চাদের রূপকথার গল্পে অংশগ্রহণ করবেন কি করে! পরম্পরায় প্রাপ্ত এত সুন্দর সংস্কার আর কোনো পেশায় আছে কি না আমার জানা নাই। আজকালকার বাচ্চারা এদের দেখে না, কারণ কী? মেগাশপ আর লাইফস্টাইল মল, সবকিছু বড় আকারে দেখতে চেয়ে আমরা কি নস্টালজিয়া সিনথেটিক ড্রাগে রূপান্তর করতেছি না? 

আমার বড়লোকি কাজিনদের মোমেন্টারি উৎপাতে এখন পুরান দিনগুলোর কথা আরও বেশি মনে পড়তেছে। মিথ্যামিথ্যি জন্মদিন বানায়ে ঠান্ডা ভ্যানিলা বার খাবার আনন্দ আসল জন্মদিনের অতিথিরা বুঝবে কি করে? তাও ভালো, পারিবারিক ঐতিহ্য কেউ পালন করতে ভুলে যায় নাই। সবাই সাথে করে কেক নিয়ে আসছে। বার্থডে বয়ের নাম লেখা প্রত্যেকটা কেক বারটার পর নাম উচ্চারণ করে একসাথে কাটা হইল। মা থাকলে ওদের আয়োজন দেখে খুব খুশি হইতেন নিশ্চয়ই।

রাশা আর ইমু উত্তপ্ত তর্কের জন্য কোনো নতুন বিষয় খুঁজে পায় না কেন কে জানে। সোফার দুই মাথায় ওদের আলাপের মাঝখানে বসে আমি কোনো রস খুঁজে পাই না। শীতল ঝাপসা জানালা ভাপ দিয়ে মুছতে মুছতে রাস্তার নতুন আলো দেখে আমি পুরাণে হারায়ে গেছিলাম। কথাটা কি ঠিক বললাম? ধুর! বললাম হবে ক্যান? হবে, ‘ঠিক মনে করলাম তো?’ আমাদের অতীত কি কোনো কাল্পনিক পুরাণের মত ঠেকে না?

“God is very much alive and it’s a proven fact. I don’t care about your damned religion.” রাশা ঘাড় বাঁকা করে অদৃশ্য তালগাছে ঝুলে তর্ক করে সবসময়। অবশ্য ড্যাম কেয়ার ভাবটা ওর পার্সনালিটির সাথে খুব মানায়।

“Religion is art and the way of everything we perceive. বিগ ইভেন্ট সাপ্রেশনে উনি নিজেকে মৃত ঘোষণা করছেন। ‘আমি নাই তাই আমি আছি’ এটা কোনো জটিল প্যারাডক্স না। প্রথম অংশটায় প্রতিটা ধর্ম আমাদের ইন্ডিকেট করতেছে উনি নাই, কিন্তু ধংসের পরের সৃষ্টিতে উনি আছেন। এইটার মানে শুধু একটাই। তাঁর ত্যাগ আমাদের স্মৃতিতে জীবিত এবং প্রতিটা নতুন সৃষ্টিতে তাঁর দর্শনকে যাতে আমরা অস্বীকার না করি। এত এত ‘মেসায়া’, আর তাদের এত এত প্রফেসি মানুষকে কেন ভুল পথ দেখাবে?”

“Today’s world is different. আমাদের নিজেদের প্রফেটিক পলিসি তৈরি করার ক্ষমতা আছে। আর তুমি আমাকে এখনও বুঝাইতে পারলা না গডের বেঁচে থাকার চিন্তা কেন ফরবিডেন?” 

“Because God believed in limiting thyself. ফরএভার এক্সপান্ডিং ইউনিভার্সে কেউ চাইলে তাঁকে সব জায়গায় ক্যারি করতে পারবে না। Imagine being on any terrestrial planet given the name of ‘Z’, where you’ll find nothing but insects, like creatures. নেগেটিভ কলিং ওখানে কী কাজে আসবে? You’ll only find difficulties there. Cause no God’ll be there to give you safety.”

“I think feeling safe is more important. আরও একটা কথা, ঐ সমস্ত প্ল্যানেটে তোমার সো কলড পজিটিভ কলিং অর এনচ্যানটিং এ গড রিমেমবারেন্সে এলিয়েনদের কাছ থেকে তোমার সেফটি গ্যারান্টি কি?”

“গড’স প্রেজেন্স ক্যারি করার কারও ক্ষমতা নাই। কালেক্টিভলি রিমেমবারেন্স ক্যারি করার ক্ষমতা সবার আছে। এইটা হিউম্যানিটিতে এম্প্যাথির রোল প্লে করে। তোমার রিভার্স সাইকোলজির গাছে একটু পানি ঢালো। খালি ডালপালাই দেখ কিন্তু কোন ফল দেখো না।”

“Being intelligent is very powerful, and with a strong will, it brings up possibilities.”

“It is curiosity that drives us toward intelligence and thus introduces new possibilities.” 

“God’s undying quote.”

ইমুর মেজাজ চড়ে গেছে। হাস্যকর ছেলেমানুষি খোঁচায় কী উত্তর দিবে আমার দিকে চেয়ে জানতে চায়। আমি তারচেয়ে হাস্যকর কিছু চিন্তা করতেছি।

“ঈশ্বর আছেন হাইপারস্ফিয়ারের ঐ প্রান্তের কোনো সেভেন ডাইমেনশনাল হেভেনে। আর তোমাদের এই ডিসকাশন সাউন্ড করতেছে কোনো ডেড পার্টিকেলের মতো। আমি এইসব ফালতু ডিসকাশনের পার্টিসিপেন্ট হয়ে মাথা ধরাইতে চাই না।” 

আমি বোধহয় ভালো ফাইজলামি করতে পারি না। পিচ্চি দুইটা পাঁচ সেকেন্ড চুপ করে আমার চেহারা দেখে। ওরা কী বুঝতেছে আমি ভালমত জানি। “ভাইয়া, তুমি এত লেইম কেন?” পাঁচ বছর আগে এগুলোরে কাদায় গড়াগড়ি করতে দেখতাম। ওদের সাথে বয়সের ব্যবধান বেশি, অতএব দূরত্বের ব্যবধানটাও বেশি। কলেজ পড়ুয়া বাচ্চাকাচ্চা কোনো পার্টির সোফায় বসে তর্ককথায় নিশ্চয়ই দুনিয়া কাঁপানো তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলবে না। তাই ছোট তত্ত্বকথার আলোচনার আগুনে নিজের কাপড়পোড়ায়ে উলঙ্গ হবার চাইতে ভালো বাকিদের কিছুক্ষণ সময় দেয়া। জানি না এরা কী প্ল্যান করছে। আজকের রাতটা কি এখানেই কাটাবে সবাই? একটা ছোটখাট ড্রাইভে আশুলিয়ার ফ্রোজেন লেকে ঘুরে আসা যাইত। কিছু কিছু বোট রেস্তোরাঁ সারারাত খোলা থাকে। কোনো পাগল অবশ্য এমন তুষারঝড়ের সময়ে ওখানে যায় কি না সন্দেহ। জন্মদিন যেহেতু আমার, কিছু পাগলামি দাবি করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে।

তোতাটার গায়ে উলেন কেপের মত একটা বস্তু ঝুলতেছে। শালারপুতের ডানায় অস্বস্তি আসে না না কি? হাহা! হালায় নাচের তালে পা চালাইতে যেয়ে কেপের কাপড়ে জড়ায়ে উষ্ঠা খেয়ে উপুত হয়ে চ্যাগায়ে ডানা ঝাপটাইতেছে। দেখার মত দৃশ্য। আবার লুনি টিউনে সম্রাটরে সাহায্য প্রার্থনা চায়। “এঞ সম্রাট ! এঞ সম্রাট! দূঁরে যেয়ে মঁরার আঁর টাঁইম পাইলা নাঁ। আঁমাকে বাঁচাও !”

“অনিম শুধু এইটার জন্য আজকে তোর এখানে আসা সার্থক।”

“খারাপ বলিস নাই।” সামিহা সেল বের করে রেকর্ড করতেছিল। কার্টুনটারে ওঠানো দরকার, নাইলে চিল্লাইতে চিল্লাইতে পাগল হয়ে যাবে।

অফিসে জয়েন করতে পারতেছি না, মরার এই শীতের জন্য। যত কিছুই হোক এই জবের কারণে আমার সব অস্থিরতা কেটে গেছে। সবারই ছুটি। তাই অন্যদের উৎকর্ষে ক্রমাগত ধেয়ে আশা ঈর্ষা উদ্বিগ্নতায় আজকাল ক্লান্ত হই না। আমার ভাইগুলো হেডনিস্টিক জীবনচলনে পক্ষপাতী। বোনগুলো ম্যাটেরিয়ালিস্টিক। এই দুই এর ভারসাম্য ধরে রাখতে প্রতিটা কথার ওয়েট ডিস্ট্রিবিউশনে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হইতেছে। এরা কত জীবন দেখে ফেলছে! আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।

হিমেল ভাই কিছুদিন আগে হালং বে থেকে ঘুরে আসল। স্টোন ডগে হাইকিং করতে যেয়ে শালার ব্যাটা ঝুলে থাকা অবস্থায় ঘুমায়ে পড়ছিল। বাতাসে দুলে দুলে সেই সুখের ঘুমের সাথে না কি পৃথিবীর অন্য কিছুর তুলনা দেয়া যাবে না। ওর জ্বালাময়ী সুখের বর্ণনা সবার ভালো লাগতে যাবে কেন? মীরা আপু পিৎজার টপিং-এর পর্তবেলো মাশরুমের টুকরা দেখায়ে খোঁচা মেরে বলে, “তা ছাতা খেয়ে এত দামি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেছিস কি কারণে ! একটা আইল্যান্ডের মাঝখানে ইয়ট নিয়ে যাইয়া সাদাকালো বাংলা সিনেমার জসীমের মত চিল্লায়া সারা পৃথিবীকে জাগায়ে দিয়ে জানাইতি, আমার মত সুখী আর কেউ হতে পারবেএএএ না…”

বেচারা হিমেল ভাই, সুন্দর অভিজ্ঞতা জানায়ে বিপদে পড়লো। পোংটার ছেলে আলিফ গিটারে আরও বাড়তি ঝামেলা তৈরি করে তার জন্য। তৎক্ষণাৎ সুর সৃষ্টিতে এমনিতেই ওর জুড়ি মেলা ভার। ভ্রমণযাত্রার লম্বা প্যারোডি বানাইতে বানাইতে এই যাত্রায় হয়তো ও মারাই যাইত। আমরা কেটে পরে সবাইকে সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করছি। হারামির কিছু কিছু লাইন ভোলার মতো না।

“চান্দের আলোয় ভাইস্যা যাব লুঙ্গি মেলিয়া,

  ঠাডা খাইয়া উপরে যামু পাছা পুড়াইয়া……”

“ভ্রমণ আমার তিনদিনের জয়গুণের খালা…

   বন্ধু দেখল না”

তিন মিনিট মাটিতে গড়াগড়ি করার পর আমি ফের হাসার শক্তি পাই নাই। নাহ! ওয়েব সিরিজে মিউজিক এরেঞ্জার হিসেবে শো-রানাররা ওরে খামাখা রিক্রুট করে নাই। ট্র্যাডিশনাল ফোক নোট থেকে লেযিলি সাইক্যালেডিকে চলে আসে। আজকে ইভেন্ট ভ্যালু ক্রিয়েট করে সবাইকে নিজের ট্যালেন্ট আবার বুঝাইল। 

সামিহার রুমে যেয়ে ওর সাথে মুভি দেখে মুড ডাইভার্ট করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেছি। মিয়াযাকির মুভি আধ্যাত্মিক লেভেলের সেন্সিটিভ হয়। পৃথিবীর কোন বাইনচ্যোদ ভাঁড়ের মত হেসে এই লেজেন্ডের ক্রিয়েটিভিটিতে ব্যাড বাজ দেয় কি না আমার জানা নাই। কিন্তু আমি দিতেছি। আর আমি কেয়ারও করতেছি না, কারণ আজকে জন্মদিন। আশা করা যায় মিয়াভাই এর গুড সউল আমারে মাফ করবেন।

তোতোরোরে দেখার জন্য তোতা আজকে রাতের ঘুম মারছে। শুধু ঘুম মারে নাই, ইমোশনাল সিনগুলোতে সামিহার গালের কাছে এসে মাথা ঘষে আদর নিছে। জন্মদিনে তোতাকান্না দেখা আমার জন্য একটা অভুতপূর্ব অভিজ্ঞতা। কিঞ্চিৎ সন্দেহ অবশ্য হচ্ছে সামিহা দুপুর কালে উঠে এই জিনিস  নিয়ে আজাইরা ভাবের গল্প ফাঁদবে। ‘তোতা তার পোষ মেনে গেছে’। শালার ব্যাটা সবাই যখন মজা নিতেছিল তখন তোরে বাঁচাইছিল কে? এই অনিম!

“এই অনিম !”

“কি?”

“রোদেলা তোর অর্গানাইজেশনে জয়েন করছে।  মাত্র প্রোফাইল আপডেট করলো।”

“ভালো তো। কিন্তু এই খবরে কান্নার কি আছে?” চোখের পাপড়ি বুজায়ে ভণিতা করা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকানোর মত কি বলছি বুঝলাম না। 

“স্পেশাল ফিলিং তুমি কেমনে বুঝবা? তোমারে তো কুত্তাও পুছে না। এত সুন্দর পাখির মত একটা ঘটনা ঘটলো। আমার চোখে এমনিতেই পানি এসে গেছে।”

“তা ঠিক বলেছ বটে। আমার মায়া-মহব্বত একটু কম।”

“তোরে বার্থডে গিফটটা দিছিলাম?”

“ তুই গিফট দিবি তো এতক্ষণ বসে ছিলি কিসের জন্য?” ব্লেসেড বোন আমার। র‍্যাপিং দেখেই বোঝা যায় ওয়াইনের বোতল ভেতরে।

র‍্যাপিং খুলে ছোট খাট একটা শক খাইলাম। এনগ্রেভ করা সিলভার প্লেটে রোদেলার তরফ থেকে মনের বরফ গলানোর আহ্বান।

“বোতলটা ওর সাথে বসে খুইলো, আজকে থাক। দুইজনের ফার্স্ট জব উইকেন্ডে হাইসা-কাইন্দা সেলেব্রেট করতে পারবা। তোমার তো ডিলাইটফুল গ্রাজশেপড জারে অজস্র কথা জমা আছে। আমি নেক্সট ডে তে রোদেলার কাছ থেকে সব শুনে নিবো।”

একটা মেয়ে চৌদ্দকোটি বার চিট করার পর আবার প্যাচ আপ করার সাহস পায় শুধু সামিহার মত ছোটবেলার বন্ধু থাকার কারণে। চাকরিটা আমার দরকার ছিল। এখন না চাইতেও রোদেলার সাথে কয়দিন পর উঠতে বসতে দেখা হবে। ওর মতলব আমি ইহকালে বুঝি নাই। আজকাল নতুন করে কি মতলব জোগাইতেছে তাও বলতে পারব না। সামিহা গুটুর গুটুর করে একগুচ্ছ ধুলোপড়া স্মৃতিমালা জীবন্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেছে। 

আমার সায় নাই, আবার অতীতে মন কেমন ছিল জানতেও আপত্তি নাই।
 

১১.

পানির ভেতর থেকে বাইরের জগতটা একধরনের পোশাকের মত। ফ্যাব্রিক অফ ফ্লুইডিটির ডুবন্ত পোশাক। বাথটাবটা খুবই ছোট। ফুপুর মাপে বানানো। সেকেলে এন্টিক বাথটাবগুলো তো আরও ছোট হইত। কেতাদুরস্ত পুরুষমানুষেরা সেসব তামার চৌবাচ্চায় পা বাইরে রেখে গা ডুবায়ে গোসল করত। আমিও তাই করতেছি। সেই সময় আর এই সময়ের একধরনের যোগাযোগ ঘটে গেল। জলীয় মস্তিষ্কে ভাবনাটার চাঞ্চল্যকর তাৎপর্য আছে বৈকি। আমার চোখ খোলা। যথেষ্ট পানি এসে এখনও চেতনা অবশ করে দেয় নাই। কিন্তু গুপ্ত উষ্ণ জলবাহে যা দেখতেছি তাতেও বড়মাছ হইতে পারতেছি না। বুকের উপর ভদ্র মেয়ের মত বসে থাকা ক্যাটফিশটাকে মুখের ভেতর নিতে মায়া লাগতেছে। বেচারি কি ধারণা করে নিছে আমি কোনো জলের দেবতা? যার আস্তা শ্যাওলা ছাড়া বুকের মাঝখান দেখে মনে হচ্ছে এর ভেতর কোনো পুণ্য মন্দির আছে? আর তিন মিনিট পর ওরে মুখের ভেতর পুরব। ঠিক যেই মুহূর্তে দুজনের নিশ্বাস নেবার প্রচণ্ড ইচ্ছা করবে তখন বেচারিকে আবার ছেড়ে দেব। প্রাণ পাওয়ার পর ছোট্ট টাবটাকে ওর মনে হবে জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। অন্য আগন্তুকের আকার দেখে এরপর নিশ্চয়ই দেবতা মনে করে রোজ পূজা করতে আসবে না। দুই ভিন্ন জীবনের মধ্যে কখনও বন্ধুত্ব হয় না। তাহলে হাঙ্গর আর কিলার হোয়েলদের বেঁচে থাকার কোনো কারণ ছিল না। 

ফার্স্ট কন্ট্যাক্ট ভীষণ দামি। আমার লোমকূপের কোনো টক্সিক হরমোনের উপস্থিতির খবর বেবি ক্যাটফিশটার কাছে পৌঁছায়ে গেছে। ঠিক চোখের সামনে চলাফেরা করে তলের সাদা রাবারের মত ত্বকটা দেখায়ে কি যাতাচ্ছে কে জানে? একদম চোখের কাছাকাছি চলে আসার পর শালীরে এক্কেবারে তিমি মাছের মত দেখা যায়। এত সুন্দর সব মাছ থাকতে রোদেলা এই মাছ কেন দিল এখনও মাথায় আসতেছে না। আঙুল সমান একটা প্রাণী যে আপাতত নিজেরে তিমি মাছ ভাবানোতে ব্যস্ত, কয়েক মিলিমিটার গোঁফ নাড়ায়ে পাপড়ির ফাঁক দিয়ে চুলের ভেতর ঢুকে পড়লে কতবার সহ্য হয়! ঠিক নয়বার মাছটা একই কাজ করছে। বামপাশের মিনি স্ট্যান্ডে ঘড়ি থাকার কথা। জ্যাক দা রিপারের হাতের মুঠো সমান একটা গলিত ডিম্বের মধ্যে একটা বিশাল ত্যরাব্যাকা নয় আমারে অবাক করে দিয়ে দেখাইল, ছোট্ট একটা কাঁটা আপাতত ওর ঘরে নিশ্বাস নিতেছে। সময়ের ধারণা ক্যাটফিশটার আসল কীভাবে? ঠিক নয়টা বাজতেই ঘড়িটা প্রতিদিন শব্দ করে দেখে? আসলেই তো! নয়টা বাজতেই আমি জলের বোধ শরীর থেকে তাড়াইয়া দেই। বুদ্ধিমত্তা প্রেডিক্ট করা এত সহজ কোনো কাজ না, তবে প্যাটার্ন প্রেডিক্ট করা সহজ ব্যাপার। 

আনন্দের ব্যাপার হইল, আমার ক্যাটফিশটার এই দুইটা ক্ষমতাই আছে। বিস্বাদের ব্যাপার হইল রোদেলার দেয়া মাছটাকে আমি বন্ধু ভাবতে চাচ্ছিলাম না। আমার রাগ এখনও বলবত। ন্যাকামি না, আমি মেয়েটার কোনো কিছুই সহ্য করতে পারি না। তলে তলে নিজের সহ্য করতে পারার দুর্দান্ত ক্ষমতা দেখে অবশ্য আমি আন্দোলিত হই। 

সম্রাটের তোতাটা বাসার যাবতীয় জিনিসপত্র ওলটপালট করে রাখে। সময়মত কিছু খুঁজে পাই না। একটা সকালেও যদি আমি সিগারেটের প্যাকেট খুঁজে পাইতাম! সিগারেট না নিয়ে বাথরুমে ঢুকছিলাম। ভাবছিলাম গোসল করে মাছের সাথে গড-গড খেলে ঘুম তাড়ায়ে ঠান্ডা মাথায় খুঁজবো। হইল না, সাতসকালে ‘লিঙ্গ-হন্তারক’ বরফের মধ্যে টং এ ধাওয়া দেওয়ার মত মানসিক শক্তি নাই। ডেইলি নতুন নতুন জায়গায় প্যাকেট লুকায়ে এরপরে ঘুমাই। তোতাটা ছাড়া এই ফিরতি লুকানোর বাইনচুদি আর কে করবে? মাতারি জন্মের ফাজিল। দুইদিন আগে দেখি বাসায় অচেনা মানুষজন এনে আড্ডা দিতেছে। পরে জানলাম তারা হইতেছেন খেলনার কারিগর। তার সাথে কাস্টমাইজড চাবির খেলনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে আসছে। কি কাণ্ডটা! সে এই বাসার একজন মহান সদস্য তাতে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু মানুষজন দাওয়াত দেয়া শিখছে কীভাবে এইটা আমার মাথায় ঢুকে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে বা প্যাকেট কোথায় জানতে চাইলে এত উপেক্ষামূলক দৃষ্টি দেয়... ইচ্ছা করে গায়ে পারমানেন্ট কালো রং ঢেলে কাউয়া বানায়ে দেই। 

“আমার সিগারেটের প্যাকেট গেল কই, শালারপুতেরা? আইজকা গাইল্লাইয়া সবগুলোর গুদ্দা হজম করমু কইলাম! প্যাকেট খুঁইজা না পাইলে সামা পাচায়া লাত্থি মাইরা সবগুলোরে বাসার থেইকা বাইর কইরা দিমু। তোতারামি করো তোমরা! মানুষ চিনো নাই দুইটার একটাও।”

“আশ্চর্য দুই মাতারি গেছে কোথায়?” আমারে ভয় পায় না তারা। খুব ভালো জানা আছে। ভয় পেয়ে বাসা থেকে দৌড় দিবে না। অন্যান্য দিন খুব মুড নিয়ে ওভারএচিভার কোনো ছাত্রের মত কিছু না বুঝে বসে থাকে। আজকে পলান টুকটুক খেলতে চায়! কোন জাউরা গাছের পয়দা এগুলো কেউ চিন্তা করছে! ফোন বন্ধ সম্রাটের। তোতাচোদার রিঙ্গার বাজে না। আমি মাকে কল দিয়ে সবার গুষ্টি উদ্ধার করবো আজকে।

“হ্যাঁ আব্বু, এত সকালে? নাশতা করছিস?”

“মা এইগুলো কী আমারে একটু বলবা?”

“কোনগুলো কী?”

“তুমি এক্ষণ দুইটারে কেমনে কোথা থেকে বাইর করবা আমি জানি না। আমি সামনে যাতে পাই…”

“নাশতা কর আগে, পরে সব পাবা।”

“ আমি উঠেই বিস্কিট আর জুস খেয়ে বাথরুমে গেছি।”

“আজকে কী নাশতা রেডি করলো সম্রাট? হোটেল থেকে কিনে আনল না কি রান্না করলো?”

“মা, এইরকম টর্চার করার কোনো মানে নাই। আমি ডেইলি মেজাজ খারাপ করে অফিস করতে পারবো না।”

“ওলেলে, আমার মহা দুষ্টু কর্মজীবিটা! সিগারেট ছাড়া দিন শুরু করতে পারেন না। চুপচাপ নাস্তা সেরে অফিসের রোটারি ধর, বেকুব কোথাকার। তোমার আলসার টানার মত আমার আর এনার্জি নাই। একবার দেখেই আমার শিক্ষা হয়ে গেছে।”

“ফোন কেটে দিল! মার কত্ত বড় সাহস!” আচ্ছা, খামাখা কমেডি কাজকারবার করতেছি ক্যান? সময় নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সিগারেট ছাড়া তো আবার হাগু আসে না।

নন স্মোকাররা সকাল বেলা কি প্রার্থনা ডেকে পায়খানা করে ভাই? সাড়ে এগারটা পর্যন্ত কার্ড পাঞ্চ করতে পারব। তিনদিনের ক্লেমেন্সি আছে যদিও। কিন্তু চারদিন হয়ে গেলেই ইভালুয়াশনের লাল কলামের গ্রাফ বাড়তে থাকবে। প্রোমোশন হবে, সবকিছু হবে মাগার স্যালারির অ্যানুয়াল কার্ডে যেয়ে একটা হবিগঞ্জের উন্নত বাঁশ ধরায়ে দিবে। বছর শেষ হইবে নিরানন্দ বসুর কৃষ্ণ পাছার আবির্ভাব হইবে জানিয়া। তাহাতে সামনের গোটা বৎসরটায় দিনে দিনে গাড় হইতে গাঢ়তর হইতে থাকা কৃষ্ণ পাছার আহাচিৎকারে অবিরাম ধূসর ধোঁয়া মালের নির্গমন ঘটিবে নির্ঘাত। কারণ কোম্পানি এঞ্জিনে তেল ঢালিবে না। ফাইজাও পরপর আমার সহিত টাংকি মারিবে না। কোন সেক্সি রমণীই বা জেব্রার সহিত ডেট করিতে চাইবে? পনের মিনিট বানরের মতো খিঁচিয়া-কোঁতাইয়াও হাগিতে পারিলাম না। নাহ! মোর চ-বর্গীয় কপালমালে রোদেলা মাসির কপটপ্রণয় ছাড়িয়া আর কোনো গতিক নাহি। 

অটোমেটার রাজধানী ঢাকা। ‘টাইম-লক’ দিয়ে রোটারিমোটরের টারবাইনে নির্দিষ্ট গন্তব্য ডাইরেক্ট করতে হয়। গন্তব্যে না আসা পর্যন্ত সবসময় টেনশনে থাকি। রাতেরবেলা সার্ভিস সেন্টারে টাইম-কি জমা দিয়ে ডেস্টিনেশনের কো-অরডিনেটস সংগ্রহ করে টাইম-লক এক্টিভেট না করতে পারলে বিশাল বিপদ। সকালে মোটরেই ওঠা সম্ভব না। এটা টাইম মেকানিজমের শহর আর সেই মেকানিজমের যন্ত্রের শহর, কিন্তু বড় সমস্যা ঘটে আরেক ক্ষেত্রে যেয়ে । কিছু মানুষ টাইম-লকের কো-অরডিনেটসের নাম্বার মনে রাখতে পারে না, টাইম-লকে গোলমাল বাঁধায় ফেলে। মেকানিজম উলটাপালটা নাম্বার দেখলেই বিদ্রোহ শুরু করে দেয় জ্যাম বাঁধায়ে । সারা রাস্তায় ডাম্পিং লেন না পাইলে সব শেষ। যত্রতত্র রোটারি ডাম্প করার সাথে সাথে পঞ্চাশ টাকা ফাইন। পরের রাস্তা হেঁটে যাও বাবা। এইটা সিস্টেমের তরফ থেকে তোমার বেখেয়ালের পুরষ্কার। 

ভাগ্য ভালো আমি তানজিকে তার পার্সোনাল রোটারকার সমেত একদিন এমন করুণ অবস্থায় আশীর্বাদের মত পেয়ে গেছিলাম। সারা রাস্তায় দুইজনের কোনো কথা হইল না। অন্যকিছু হইছিল অবশ্য। মেয়েটার ঘন রোদখেলানো চুল গলা জড়ায়ে খালি ফেরোমন বের করে। আমার নেশা উঠে যায়। ও তখন সাদা শর্ট এপ্রোনটা ডান পাশে রেখে ডিভাইস ঘাটতেছিল। আমার দিকে একবারও তাকায় নাই। আমিও অনেকক্ষণ কথা না বলে কি বলবো, কি কথা দিয়ে শুরু করব এসব চিন্তা করতেছিলাম। চোরের লাহান দেখার মত কোনো পাপ তো আর করি নাই। তাই প্রথমে সুন্দর করে তাকাইতে যেয়ে দেখি ওর গাল খালি গোলাপি হইতেই আছে। বললাম, “পরী”। চোখে কখনও লাইনার, ল্যাশ কিচ্ছু ইউজ করে না। গ্ল্যান্ডে রক্ত পানি ভেসে থাকে। মনে হয় মাত্রই পবিত্র হইল, কোনো আকামের উদ্দেশ্যে। আর কি! লাল পলকা চিকফ্রক থেকে উন্মুক্ত জিপ্সি ডান পা টা বাম পার জোড়া বন্ধনী থেকে ঢং করে সামনে প্রসারিত করে তরতাজা কোমরটা খানিকটা ভেংগে ও আমার একদম কাছে চলে আসে। কারও বাপের ধনের সাধ্য নাই ওর মূক বৃত্তের আস্তা খয়েরি ঠোঁট দেখে চুপ করে বসে থাকার। পেটে হাত চেপে ঘাড়-গলা-বুক-ঠোঁট খাবলাইতে খাবলাইতে কারও তুচ্ছ জীবন নাই হইয়া যায়। ইজেকশনের কালে মেয়েটা আমার চুলের পেছনে মুখ লুকায়ে শার্টের ইয়কে নখ খাবলায়ে জোর ডিসট্র্যাক্ট করে। প্রেগন্যান্ট হবার পরেও ওর ছোট্ট ঝুলঝুল নাভিতে  এত বারুদ ঠাসা কিভাবে আমি জানি না। বেশিক্ষণ লাস্ট করা গেল না, সারাদিনের ঝড়-ঝাপটা সামলাতে চাওয়া শরীর, সকালে শুরুতেই সাবমিসিভলি ক্ষণদেবীর ঘরে অকারণে আশ্রয় নিল। 

অটোমেটেড তিনকোণা বাক্সের মত রোটারকারে কখনও সেক্স করব আমি কল্পনা করতে পারি নাই। সকালবেলা অফিস-স্কুলগামী রাস্তার মানুষেরা তো ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করে না। ঐদিন মেরিগো সার্কেল থেকে তিনজন সাইকেলের হকার ‘কুইকি’ কীভাবে হয়-কেমনে করে তা ফলো করে আসতেছিল। অফিসের স্টপেজ আসার পর তানজি রিকোয়েস্ট করে বলছিল, “অফিস বাঙ্ক করো। তোমার নতুন বাসাটায় আমাকে সারাদিন আদর করো, প্লিজ অনিম। প্লিজ।” আমি হাইসা ফালতু একটা কথা বলে আগামীর সম্ভাবনা অহেতুক নষ্ট করি। চিন্তা করলেই হাসি আসে,  “কথাটা বলার আর সময় পাইলা না। দুই ঘণ্টা পরে বললেও কাজ হইত। বাট সুইট পি এখন যে অফিসে যেয়ে কফি খেয়ে ঘুম তাড়াইতে ইচ্ছা হইতেছে। সারাদিন একই কাজ করার চিন্তা করলে দেখবা তোমারও ঘুম আসতেছে।” অপমানিত কোনো সুন্দরী একটা ভয়ংকর ভিসুভিয়াস। লাভা গিরগির করলে তাড়াতাড়ি ফাটে। মিলিয়ন ডিগ্রির সেই লাভা গাড়ি ডাম্প করে পেছনে এসে কলার টেনে আমার উপর আচ্ছামত কিছুক্ষণ ফাটল। সমানে কিল-ঘুষি-লাথি খাওয়া শেষ হবার পর তিন হকারের একটা এসে আমারে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করে, “ভাই আপনি কি ভাড়া খাটাইন্যা বট? কামও দিলেন, মাইরও খাইলেন?” রিংয়ের আঘাতে ঠোঁট কেটে গেছিল। ঘটনা ভুলে যেতে আর লেট হচ্ছিল দেখে অফিসে তাড়াতাড়ি ছুট দিছিলাম। নাইলে বলতাম, “নাটকির ছেলেরা একবার শুনে সারাজীবন কথাটা মনে রাখবা, পোয়াতি মাইয়াদের জীবনেও খেপাইতে নাই।”

মুখ বুজে মাঝেমাঝে ঝড়ের তীব্রতা সহ্য করার কিছু পুরষ্কার আছে। মন থেকে জানতাম। নাহলে যেই লিফট সারা বাংলাদেশকে নিয়ে উঠা-নামা করে তাতে ‘চাহিবা মাত্রই’ চড়তে পারতাম না। প্রেগন্যান্ট হৃদি আপু দূর থেকে আমার তাড়াহুড়ো দেখে লিফট ধরছেন। ঘড়িতে দেখি এখনও সাড়ে এগারটা বাজে নাই। যাক বাবা! আপুকে তিনবার ধন্যবাদ দেওয়ার পরেও মন ভরতেছে না। মন চায় তারে চকলেট খাওয়াই। ঐদিন যা গেল আমার উপর দিয়ে। উফ! সেক্স করে, মাইর খেয়ে আট ঘণ্টা অফিস! এইটারে বলে লাইফ! রোদেলা আমার অবস্থা দেখে লাঞ্চের সময় বলছিল, “অনিম, বোতলটা খোলার আজকেই উপযুক্ত সময়। হোয়াট সে ?”

কাজে মন বসাইতে পারতেছি না। ডেস্কে তেমন টাস্ক নাই অবশ্য। তিনটায় প্রকিউর ডিপার্টমেন্টের ট্রেনিং আছে টানা চার ঘণ্টার। আমি ক্লান্ত না। ট্রেনিং এর সাবজেক্টস স্টাডি করতে হবে। “Hoard, Collect, File, Index, Catalog, Preserve, Amass, Index.” ওহ, মিস্টার স্টিভেন! তুমি ডিএনএ ইনভেইড করলা, খবর দিবা না। ডিজাইন ডিপার্টমেন্টের সজীব ভাই টেবিলে একটা সেলেনাইট হার্ট রেখে গেছিল আমার মনে নাই। আনপলিশড, রিমডিউলারে পাঠানোর আগে লাস্ট চেক দিতে বলছে। ডিপ মেজারমেন্ট শিট দেখে কীভাবে প্যাটার্ন ক্রসচেক করবো বুঝতেছি না। এইসব ছুটা কাজ দিয়ে মেবি আমারে ঝামেলায় ফালাইতে চায়। আমার কাছে প্রায় পাঁচশটা স্মিথশপের স্যাম্পল আছে। সব ফাইনাল প্রোডাক্ট। র স্যাম্পল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করি নাই। শুরুর দিন থেকে ডিজাইন এসথেটিকস নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত হয় নাই। আর এই রাফএজড ক্রিস্টালের কাহিনি কী? শুধু ঝামেলায় ফেলা ছাড়া অন্য ঘটনা নাই তো? একজনকে বেছে নিতে হবে শিক্ষাগ্রহণের জন্য।

“ভাই নিকি তোমার র কাটের মেজারমেন্টটা একটু দেখাও তো?”

“কাজ করতেছি ভাই, পরে দেখি প্লিজ?”

“বাহ! এমবসের ডিজাইনটা ফাটাফাটি হইছে। এইটা রেজিনে বসবে না?”

“হ্যাঁ।”

“মারাত্নক সৌন্দর্য! ম্যাটেরিয়াল কি লুমিনিসেন্ট?”

“ক্রোমিয়াম দিতে চাইছিলাম, অবশ্য লুমাতেও খারাপ দেখাবে না। খাড়ান দুইটারই মাস্কিং করতেছি। আপনি কী চাইছিলেন জানি?”

“সেলেনাইটের র কাটের স্পেক।”

“ক্যান?”

“এমনে আজিব মুখ বানানোর কি আছে ভাই!”

“আমার কাছে নাই, নিতু আপুর কাছে যাইয়া খোঁজেন।”

“এমন করো ক্যান ভাই আমার! তিনটা মিনিট সময় লাগবে খালি। আমি তো দেখতেছি তুমি বিজি...”

“এইটা একটা আকাজ। তিন মিনিট না তিনদিনও লাগতে পারে। ডেস্ক দেখছেন আমার? টেমপ্লেটের পাহাড়। ডিস্টার্ব না কইরা ম্যাগনেটের জঞ্জাল থেইকা খুঁইজা নিতে পারলে নিয়ে যান। আমার ভাই দিনে পঁচিশটা মডেল বানানো লাগে। কি বালের মাইয়া মাইনষের জিনিস কতগুলো নিয়া ডিস্টার্ব দেন হুদাই……”

এইডারে রোদেলা দিয়া চোদামু। ভাব কি তুইচ্যার ! বিপদে পড়ছি এখন, না খুঁজে উপায় নাই। আজকের ট্রেনিং-এ এসব ম্যাটেরিয়াল, আর ডিটেইলস নিয়ে ভাইভা হবে শিওর । সিমিন, আকিব, ম্যাক আরও বিশটা মেয়েছেলেসহ সব বাহারি ক্রিস্টালপ্লেট নিয়ে ছোটাছুটি করতেছে।  থ্রিডি ডিপার্টমেন্ট নামক মাছের বাজারে তাতে ত্রিশরঙা ক্রিস্টাল বিচ্ছুরণ। ডিজাইনার, এসোসিয়েট এমন এলাহি কাণ্ডে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মাথা নামায়ে একসাথে চেয়ার ছাড়তেছে দেখি। যায় কই ওরা? কমপ্লেইন করবে বোধহয়। করুক যায়া, আমি নিজের কাজ করি।

“স্ক্রিম অফ এ বাটারফ্লাই গানটা কোন ব্যান্ডের জানি?"

“When the music's over, গানের নাম। ব্যান্ডের নাম ডোরস।”

“অবভিয়াসলি! আমাদের জিম মরিসন এইদিকে আসো।”

বড় বোনটি অনিম নামে ডাকতে চায় না কেন? সুন্দর একটা নাম। পার্ট আছে।  “মেনি থ্যাংকস। স্পেকটা দিয়ে জীবন বাঁচাইলেন আজকে !”

আমি বালিকাটারে প্রায় ফলো করি । কথা বেশি বলে না। হুটহাট ‘আমারে কেউ কোপা’ বইলা মাঝে মধ্যে চিৎকার দিয়ে পাঁচ-দশ মিনিট কাজের জ্বালা থেকে ব্রেক নেয়। ঐ সময় সে অফিসের মিরর ক্লকের দিকে তাকায়ে থাকে। আমি ঘটনার এনাটমি করতে চেয়ে ঘড়ির সাথে গ্লুড হয়ে যাই। টাইম হুইল ঘুরে, আলোর কাঁটাগুলো নড়ে না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। মেকানিজমটা জানতে পারলে নিজের জন্য একটা টাইমপিস বানাইতাম। ক্লকের ক্রিস্টাল ডোরটা লজিস্টিকসের লোকজন ছাড়া আবার কেউ ধরতে পারবে না। তবে বেসিক ফিল্ড অফ থিওরি বলে ঐটা তিন লেয়ারের রিফ্লেকশন দিয়ে ম্যানুপুলেট করা। 

আমি অতি অদ্ভুত ফলস কনশাসনেস থেকে হাজার প্রসেসের পরেও বের হইতে পারি নাই। কোন সময় সেল হাতে নিয়ে ঝাপসা চোখে টেক্সট পড়তেছিলাম মনে আসতেছে না।

বেল চেপে লুতফর ভাইরে আসতে বলছিলাম। উনি এখনও কফি নিয়ে আসেন নাই। বুড়া একটা লোক। কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। আমি দেখছি নতুনদের সাথে লোকটা ভালো রকমের ফাইজলামি করে। কিন্তু আশ্চর্য! আমি কফির কথা বললাম কখন? আমি না ঘড়ির মধ্যে ডুবে ছিলাম। খাবি খাইলাম। বাসায় অচেনা মানুষের খেলা খেলতে যেয়ে একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা তাকায়ে প্রতিটা সেকেন্ডের নড়াচড়া দেখছি। খুব খেয়াল আছে মাথায় নিজের সমস্ত সংস্করণ ছুটে বের হয়ে অনেক কিছু করলো । নিতু আপুকে প্রতিটা দিন আমার মতন একই কাজ কিছুক্ষণ করতে দেখি। উনি কিছু ফিল করে কি না কে বলতে পারবে!

নাহ, কারও মাথায় ঢুকে যাওয়ার মত আনএথিকাল চিন্তা আমার আর পাত্তা দেয়া উচিত না। মানুষ যদি পাপেটও হয় তারপরেও না। নিজের চাবি নিজে ঘোরান যার যার জন্মগত অধিকার।

কাইনেটিক পেজার থেকে জানাইছে আমাকে রিসেপশনে যাইতে। কে জানি কল করে খুঁজতেছে।

রিসেপশনের মেয়েটার সাথে রোদেলার চেহারার কি অদ্ভুত মিল! আমার মনে হয় রোদেলাকে পাঁচ বছর পর ঠিক এই চেহারায় দেখা যাবে।

“হ্যালো অনিম ভাইয়া, আমি লিলি। নাও সম্রাটের সাথে কথা বলো।”

ফোঁপায় কে? কী হইছে?

“হ্যালো, হ্যালো…...  হ্যালো !”

“অনিম তোমার তোতা না কি আয়না দেখে স্টাক হয়ে গেছে! নারসিসাসের রিইনকারনেশন এই বাংলার বরফে ঘটে, খুবই আশ্চর্য ঘটনা!”

আমি ক্রিস্টাল সাপ্লিমেন্টরির কনটেন্ট প্ল্যান করতেছিলাম। মানুষের যত খাজুইরা বিষয় নিয়ে মাতামাতি। ডিজিটাল কারেন্সির কঠিন আইডিয়াটা পাবলিকরে কীভাবে খাওয়ানো যায়? থ্রিসিক্সটি অ্যাঙ্গেলের টোটাল এগ্রেসিভ এপ্লিকেশন না কি জেনেরিক সোশিও সাইকোগ্রাফিক সার্ভে? Which one will work better? সার্ভে করতে গেলে আবার হেডমিসের পারমিশন লাগে। আমার দুইটা ড্রাফট রেডি করা উচিত। সময় নাই, আটটা বেজে গেছে। আজকে রোদেলাকে দেখলাম না। ও কি আসে নাই অফিসে?

“অনিম, তোতাটার খোঁজ নিয়েছেন?”

“না জিয়া ভাই। সময় পাই নাই।”

“ও আচ্ছা।” আমি ক্লায়েন্টকে মাসকট প্রপোজ করে একটা স্টোরি পাঠাইলাম। ইউজুয়ালি দশ মিনিটের মধ্যে ফিডব্যাক দিয়ে স্টোরি লক করে ফেলে। বিশ মিনিট হয়ে গেছে। রাত বাজে দশটা। অফিস প্রায় ফাঁকা। কাইনেটিক্সে যেয়ে স্টোরিবোর্ড শেষবার চেক করে আসি। বোর্ডের ‘ক্রোমা’ কখন প্রেশাস মুভে রেন্ডারড হয়ে আমারে আজকের জন্য ছুটি দেয় জানা দরকার। ঝুলতে আর ভাল্লাগে না।

“আপনি অনিম না?”

“আরে ফাইজা! কি খবর?”

“আপনি ঠিক আছেন তো?”

“হ্যাঁ,কেন ঠিক থাকব না ?”

“আপনি আসলেই অনিম, যে আমাদের ইনগোরাল পার্টিতে গিটারে ‘The man who sold the world’  গেয়ে শুনাইছিল?”

“ফাইজা, তোমার কী হইছে?”

কিছু না বলে বোর্ড থেকে ‘ক্রোমা টেমপ্লেট’ রেডি করতেছে। বাইশটার মত টেমপ্লেট ফ্লুইডলি রেন্ডার হইতে দেখলাম। আর আমারগুলোর খবর নাই! আমার আসলে রিয়েলিটি রেন্ডার হচ্ছে, নাইলে এত্ত সময় লাগতেছে ক্যান বাল! 

“Can’t believe people these days. দুনিয়া থেকে এম্প্যাথি চলে গেল নাকি? পাখির মত কিউট আর কিছু আছে অনিম ! মায়া লাগে না তোমার?” 

“না, আমার তোতা পছন্দ না। কন্ট্রোল সিকিং প্রাণী।” মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। বিরক্ত লাগতেছে আজকে সবাইকে। লক-লিড তাহলে আজকে পাচ্ছি না। মেজাজে মাথা ভারি হয়ে গেল। কত কষ্ট করলাম সারাদিন।

চুলের লিফট পাঁচ তালা থেকে তেত্রিশতালায় উঠতেছে। বসদের ফ্লোর ঐটা। শালারা এত কি কাজ করে? ম্যানেজার স্যার আমারে পাইলে আবার ধুম করে কোনো টাস্ক দিয়ে বসতে পারেন। পেইন!

“ইভনিং স্যার।” যাক কিছু বলতেছেন না। আজকের মত বেঁচে গেলাম।

“অনিম।”

“স্যার।”

“শুনলাম আপনার না কি কি ইন্সিডেন্ট হয়েছে।”

“না তো স্যার। কিছু হয় নাই।”

“তাহলে কার তোতা মারা গেল?” 

গুজবের কারখানা দেখি অফিসটা। 

“স্যার, আমার সাথে থাকে তোতাটা। মারা যায় নাই। ভয় পাইছে কিছু একটা দেখে।”

“বাসায় যেয়ে একবার দেখে আসতেন। বেশি সমস্যা হলে মেটাফিজিশিয়ানদের কাছে নিয়ে যান। হাজার হোক পশুপাখিদের যত্ন করতে হবে। কাজ সারাজীবন করতে পারবেন, হিউম্যানিটি সবার আগে।”

“জি স্যার।” পার্সোনাল ঝামেলা নিয়ে অফিসের প্রতিটা মানুষ এত মাথা ঘামায় না।

তোতাটা মেবি আত্নাপোকা হয়ে মাথা খাওয়ার প্ল্যান করতেছে, করুক। ‘টপা’র মজা জানুক। নাজির স্যার তিনতালায় মেবি সাইমা মিসরে নিয়ে বের হবেন। অফিসে কানাঘুষা হয়, তাদের না কি ইয়ে চলে। 

ব্যাপার কি? আচ্ছা! রোদেলাকে আজকে তিনতালায় পিচিং সেন্টারে এসাইন করছিল তাইলে। বাপরে কি তাড়াহুড়া করে সিড়ি দিয়ে নামে। লিফটের দিকে তাকাইতে দেখলাম তখন। নাহ, তিনি এইদিকে আসলেন না। সম্ভবত সাবেরের ট্রেইল শুকে পিছপিছ যাইতেছে।

“ওকে রোদি। কালকে তো দেখা হচ্ছেই। বইটা পড়ে জানাও কেমন লিখলাম। যাই তাহলে…”

হাগাহাগিও শুরু হয়ে গেছে। আবার রোদি! ভালো তো।

“বেবি মরিসন কি খবর? এই তোমার নাম মরিসন কোন পাগলে দিল? কার্লি লম্বা চুল আর ভাল্লুকের মত বিয়ার্ড আছে দেখে?” বেটি তোর স্বভাবের গুষ্টির ক্ষেতায় আগুন।

“যার যেটা ভাল্লাগে ডাকে। আমার তোমার সাথে কাজ আছে।”

“কী?”

“দাঁড়াও, কল আসছে।” মা আজকে ছেষ্টট্টি বার কল করছে। পিক করি নাই। খুব উচিত শিক্ষা হইছে। নিকি ছেলেটারে টাইট দেয়ার প্ল্যান করছিলাম। রোদেলা পারে না এমন কোন কাজ নাই।

“রোদেলা !”

“তোমার বারবার কল আসতেছে। ধরে কথা শেষ করে কি কাজ জানাও।”

মাথা ধরে গেছে কলের চোদনে।

“বাসার জন্য একটা আয়না কেনা লাগবে। কালকে সময় দিতে পারবা।” আশ্চর্য ! এই কথা কেন বলতে গেলাম ?

“ও হ্যাঁ, তোমার তোতার না কি কি হইছে? আয়নাপড়া দিবা না কি?”

কি এক জগত! জোকের বিষয়বস্তু হচ্ছে জিন-পেত্নি, পানিপড়া আর আয়নাপড়া । মানে হাসিও আসে না। 

“অনিম, আয়না কিনে প্রথমে তোমার চুল কেটে দিব। জন স্নোর মত করে।”

মেয়েটা অনেকদিন পর আমার চুল ধরছে। কি যে আরামের হাত ওর! শালি ভালবাসাবেই সবকিছু। মনে পড়ে এগার বছর আগে ওকে প্রথম যেদিন দেখছিলাম… 
 

১২.

“সাইকিকের মিথ” 

সাইকেলের প্রহরী

লেগো দিয়ে বানানো হেড কনসোল হাতে নিয়ে দাঁড়ায়ে আছি। রোদেলার ‘পট’ নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আসার কথা। ইচ্ছা হচ্ছিল একসাথে হেঁটে বাসায় ফিরতে। বেচারিকে দোষ দেয়া যায় না। অফিসে আজ ঝড়ঝাপটা কম গেছে। তবুও দুই মাইল হেঁটে বাসায় ফেরার গল্প কারও পছন্দ নাই হতে পারে। একটা হাস্যকর ব্যাপার, দুইজন খুব দূরে বাসা নিয়ে কখনো থাকি নাই। আমি চড়ুই পাখির মত প্রেমিকার পাশের ব্লকের বৃত্তে থেকেই আস্তানা গড়ছি সারাটাজীবন। কিন্তু রোদেলা আজ পর্যন্ত আংকেল-আন্টির মায়া ছাড়তে পারে নাই। এলিফ্যান্ট রোডের একটা অখ্যাত পাড়ায় অর্ধেক জীবন কাটায়ে দিছে। হিসাব করে দেখছি এগার বছরে গড়ে দুইশ পয়ষট্টি দিন ধরে দুই হাজার নয়শত পনের দিন আমি ওর বাসার পথে বিনা কারণে ঘোরাফেরা করছি। তা সত্ত্বেও বাড়ির দেয়ালে ঝোলান ঝিনুকের চিঠির বাক্সে কোনোদিন নিজের উপলব্ধিতে ঠাসা কবিতা ছেড়ে আসতে পারি নাই। কিন্তু জানতাম মেয়েটা কবিতা পাগলের মতো ভালবাসে। লাইনগুলো একসাথে বলার সুযোগ কখনও রোদেলা দেয় নাই। কবিতাপ্রেমী ভাষাপণ্ডিত মেয়েটা বিশ্বাস করে আমার পংক্তিমালা না কি রকেটের উড্ডয়নের মত। ছোট্ট কাগজের প্লেনের মত কিছুক্ষণ ভেসে মাটিতে নিশ্বাস নেয় না, হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে হয়ে ছিঁড়ে যাওয়ার আয়োজন করে না।

কিন্তু কখনো কখনো আমি প্রেমিক হয়ে জন্মাই। প্রেমিকের রকেট আবেগীয় মাত্রার সূত্রে বাঁধা পড়ে থাকবে কেন? ওর ভ্রমণে কিছু সার্থকতা থাকা উচিত। অফিসের গ্রিন জোনের বার ফুট উঁচু বাউন্ডারির উপর চুপ করে বসে দুইটা সাইকেল পাহারা দিতে দিতে ও চিন্তা করবে, স্কুলের একদা কোনো ক্ষুদে বিজ্ঞানীর সাইন্স প্রজেক্ট জাতীয় এলইডি কনসোল, নামছাড়া সস্তা দামের ভ্রমণ-কবিতার রসটা ঠিকঠাকভাবে সামলাইতে পারবে তো? 

রোদেলার সাইকেলে রাইড শেয়ারের আইডিয়াটা একটু বেশিই পছন্দ হয়ে গেছে আমার। প্রতিদিন কাউকে না কাউকে  সঙ্গী করে বাড়ি যায়। ঈর্ষান্বিত কাপুরুষের অহং এর দেয়াল গড়ে তোলা অতীব জরুরি। ঘুমানোর আগে ছেলেমানুষি ভাবনায় গোপনে হাসলে জীবনটার মুল্য দিতে ইচ্ছা করে। রোদেলা গল্প জমানোর নিক্তিতে আমাকে বারবার হারাবে কেন? আমি অজস্র বিচিত্র চামড়ার রথে চেপে প্রেমিকা ও তার প্রেমমণ্ডলের ব্যবসা পাল্লায় ওজন করে মেপে হারাবো।

লম্বা আলখেল্লার মত নতুন জমানার হুডি পড়ে বানির মত খুশীতে ফাল পেড়ে আসতেছে। দুইদিন পর রোদেলার বয়স ত্রিশ হবে। এখনও কচি খুকির ভাবসাব ছাড়তে পারে নাই। কবে যে ছাড়বে! পাঁচ সাতের মোটামুটি লম্বা একটা মেয়ে, এতটুক হয়ে গেছে একটা কালো শ্যাবি আলখেল্লার কারণে। শিমারি স্টকিং এ দশ ইঞ্চি পেন্সিল পা সপে রাতের ঠান্ডা বাতাস মাখায়ে কোন জন্মের মজা আছে তা স্টাইলিস্টরা ভালো বলতে পারবেন। তবে বানিশেপের লাফানো সাদা স্নিকার দেখতে আমার খুবই মজা লাগতেছে।

“আররে, এই শালি দাঁড়া। সাইকেলের ইজারা না দিয়ে ভাগতেছে !”

“পিছে পিছে আস বাবা বান্দর খান।” 

এত জোরে বাইক ছুটাইতেছে কেন ? বার ফুট থেকে শেষ কবে লাফ দিছিলাম? আইলসা মেজাজে জালি বেয়ে নামার সময় নাই অনিম, লাফ দাও। তোমার রেসি এক্সরে তাড়াতাড়ি ধর, নাইলে খাজাবাবার দরবারের বাইরে আজ রাতে কান্না ভেজা হাতে ভিক্ষা করতে হবে।

যেভাবে চালাচ্ছে রোদেলা না জানি এক্‌সিডেন্ট করে!  রাত এগারটার ফাঁকা সময়। চার-পাঁচটা রোটারি মাঝে মাঝে দেখা যায়। দশ-পনের মিনিটের ভেতর বাংলা মোটর ক্রসিং এ একটা ট্রাম যাওয়ার কথা। কনসোলটা কি পেছনে রাখছিলাম? হ্যাঁ আছে। সার্কেলে মিনিট জ্যামে পড়লাম। কি ফ্যাকড়া! দুইটা স্কেটারের জন্য রাস্তা বন্ধ করার কি মানে? বাল! এড্রেনাল রাশে হার্টের অবস্থা কাহিল। রোদেলার কোনো ট্রেস নাই, হারায়ে ফেলছি পুরাপুরি। আর বিশ সেকেন্ড, জ্যাম ছাড়ল বলে। রোদেলা! এই ট্যুর ডি ঢাকায় আমি বরাবরই সেকেন্ড হইতাম। কি দরকার ছিল একটা অসুস্থ মানুষকে পেইন দেয়ার। আচ্ছা, কনসোলটা কি দূর থেকে কাজ করে ? ভয়েস রিসেপটরের ভোঁতা শব্দ শোনা যায়। খেলনা বস্তুর আর কাজটাই কি বা! আমি অবশ্য জানি ও কোন রাস্তা ধরবে। হাতিরঝিলের এপ্রিলের পুরনো বরফ গলা পিচ্ছিল রাস্তায় আমারে আছাড় খাওয়ানো তার ভীষণ পছন্দের কাজগুলোর একটা। মাথার কেমিক্যালস কোথাও পালায় যায় নাই বেব। পুরানা দিনের সহজ কেমিস্ট্রি টেস্ট এদের জন্য কোনো ঘটনাই না।

চুলের মগবাজার আন্ডারপাস! ইন্ডিয়া থেকে আগত একগাদা বন্য ছাগলের পালরে বিগত শীতকাল দিয়ে চোদাইতে ইচ্ছা করে। বসন্তের শুরুতে বাংলাদেশে জ্ঞাতিগুষ্টি নিয়ে আসবি ভালো কথা। আন্ডারপাসে কি আছে ভাই? কাঁঠালপাতা! থাকলে তাও খুশি হইতাম, এত কষ্ট করে ছয়মাস হেঁটে এত্ত বিশাল একটা বংশরে জাতিতে পরিণত করতে যেহেতু আসছো। এক-দুই ঘণ্টার কাঁঠালপাতা দিয়ে ডিনার ব্রেক তোমরা নিশ্চয়ই ডিজার্ভ করো।

আন্ডারপাসের শেষ সীমানায় তাপসি দাঁড়ায়ে হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছেন। বড় শিংওয়ালা পাঁঠার পাল থেকে বের হইছি, হাসি তো হাসবেই। যথেষ্ট মেজাজ খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আমার হাসি আসতেছে। পট আজকে না করলেও চলে।

“হইছে! বহুত হাসছো। এখন উঠ শালি। পাছা ঠান্ডা করে জ্বর বাঁধাবা। তারপর অফিস কামাই করবা। সাবের সাহেবকে কোমায় পাঠানোর কোনো দরকার নাই।”

“সিরিয়াসলি! হাহাহাহা।”

কি যন্ত্রণার মধ্যে পড়লাম! 

“অনিম ! ধরে উঠা মামা। আমার এনার্জি নাই। মাবুদ! কি চমৎকার দেখাইলা! মাই ব্যাড, কি চমৎকার পাঠাইলা!”

ছবি তোলার মত ভিজ্যুয়াল। হাফস্কয়ার এন্ডে দুইটা স্ট্যান্ডবাই সাইকেল, লেগো এলইডি হেলমেট অর হোয়াটএভার কনসোল পরা একটা ছেলে, কোনো হাসি নৃত্যেরত গাব্দা ‘আলোপতঙ্গ’-এর দুই হাত টেনে তাকে তিন মাত্রার মনোক্রম পৃথিবীর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। লাভের মধ্যে আরেক লাভ হইত, আমি ইতিহাস বদলাইতে পারতাম। বলতে পারতাম, এই দিনটায় আমি না, রোদেলা নামের সেই 'ভ্রম-রাণী' সাইকেল নিয়ে আছাড় খাইছিল। 

“অনিম তুমি আমার সৃষ্টির অপমান করতেছো। কনসোল খুলে রাখছো কেন?” 

সেই তখন থেকে চেষ্টা করতেছি নির্বচনে দুর্বোধ্য হাসিতে উত্তর দেবার। অতি ধীরে সাইকেল চালাইতে বেশ বেগ পাইতে হয়। গাছের রসকষ গলিত বক্রাকার রাস্তায় আমার পিছলে পড়ার দুর্বিষহ অতীতের পুনরাবৃত্তি চাচ্ছিলাম না। এই রাস্তায় হাঁটার অধিকার আজ অবধি পাই নাই। একবার না পড়ে ড্রাগন অপেরায় পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ জিততে পারলেই হয়। বিচ ওয়াকের ডেট তো জিততে পারবোই, সাথে আমার ইজ্জত সমেত হাঁটার অধিকারের দাসমুক্তি ঘটবে। 

“তুমি কি ভাবতেছো তোমার এই লেগো কনসোল আমার মাথা বাঁচাবে? মনে হয় না।”

“কনসোল না গাধা, হেলমেট । প্যাসেঞ্জার ট্র্যাক না করলে টাকা দিবে কে? তোমার আব্বু?”

“অযথা প্রাইভেট শেয়ারিং এর সিস্টেম বানায়ে রাখছো। ‘বেলা’ তে রেজিস্ট্রেশন করলে কি অসুবিধা ছিল?” 

“শুধু যাবার পথে পড়লে কাউকে নিয়ে নেই, কোনো ঝক্কি নাই। সবচেয়ে বড় সুবিধা হইল, কাউকে অপছন্দ হইলে রিসেপ্টরের মিউট বাটনে চাপ দিয়ে বোবা করে দেই। অতপর সেই গান্ডুরা বুঝে যায় আমি ইন্টারেস্টেড না।” 

“একলা মনে নিশ্চয়ই গালি গালাজ করে ভরায়ে ফেলে!”

“হাহা, ইভসড্রপার আছে কি করতে! একদিন এক নাবালক গালি দেয়ার জন্য এতই ডেস্পারেট ছিলেন যে, বাইক নিয়ে প্রায় দশ ফুটের কাছাকাছি চলে এসছিলেন। কো-রাইডারদের যেকোনো সিচুয়েশনে রিয়েক্ট করা নিষেধ। প্রাইভেট হোক বা যাই হোক লাইসেন্স নিয়ে সার্ভিস ট্রেইড করি। আমি সব সুন্দর মতো রেকর্ড করে ষ্টেশনে সাবমিট করে আসছি। সিস্টেম আমাকে নগদ হাজার টাকা ফাইন দিল।”

“এমনে চললে তো বড়লোক হয়ে যাবা দেখা যায়।”

“টানা তিনমাস যখন আজাইরা ছিলাম, তখন কী কী ফাতরামি করতাম জানো?”

“না।”

“আসলেই কি, অতি ক্ষমতাধর সাইকিক অনিম? তুমি মিডিয়াম সেজে স্পাইগিরি কর নাই এর মাঝে? আই মিন স্টক কর নাই আমাকে?”

“কোন তিনমাস তুমি বেকার ছিলা, জানি না তো !” রোদেলা বিশ্বাস করে নাই। বড়চোখের দীপ্তোজ্জ্বল হাসিতে মুখ পেছন থেকে আলতো করে সামনে ঘুরায়।  অনিম, ঐ ছদ্মবেশি এলিয়েন লেজের পার্পল গ্লোতে চোখ বেঁধে রাখলে বিবিধ ভাবনার জঞ্জালে পিছলে ফের রাস্তায় পড়ে যেয়ে হারতে হবে !

“ব্রা ভদ্র মেয়েদের ভাবের দোকানে রেখে রাইডে বের হইতাম। আর পোলাপানের আমার বিশাল দুইটা বস্তু দেখে মাথা যায় যায়! মোফুর মত এপ্রোচ করতে আসলে সাথে সাথে রিসেপ্টর মিউট করে দিয়ে ইভসড্রপার অন করে দিতাম, ব্যাস! বেচারা সিস্টেম, তিনমাসে প্রায় চার লাখ ফাইন দিল……”

এখনও পর্যন্ত উষ্ঠা খাই নাই। এইকথা শোনার পর উষ্ঠা খাইতে ব্যাপক ইচ্ছা করতেছে।

“ফেমিনিস্টরা পুরুষত্বের শেষ সীমা দেখতে এত আগ্রহী কেন আজকে বুঝলাম।”

“I’m not a feminist, Anim. ফেমিনিস্ট কেউ সোজা মামলা করবে। সিস্টেমের এম্পেথিটিক্যাল র‍্যাপর্টে তাহাদের কিসসু যায় আসে না।”

“আহা, এক্সট্রিম হয়ে গেলে সিস্টেমও তো কেইস ফাইল করে। তুমি কি রুলকিপার বটদের ফেমিনিস্ট বলতে চাও?”

“গান্ডুর সন্তান, ওরা ফেমিনিস্ট কোড এপ্লাই করে।”

“হ্যাঁ, সুইচ অন সুইচ অফ ফেমিনিস্ট বট !”

“মেট্রিয়ার্কিসাইন্স ছাড়া ক্রাইম কেমনে কমাবেন স্যার?”         

“পৃথিবীর সব মেয়েদের সুইচ অন, অফ করে ম্যাসকুলেনিস্ট হবার ক্ষমতা দিয়ে।”

“পৃথিবীর একটা বাচ্চাও ঠিকমত দুধ খেয়ে মানুষ হবে না, তুমি কি বললা?”

“দুধ খেয়ে যদি কেউ মানুষ হইত তাহলে দুইটা বিশ্বযুদ্ধ হবার কথা না।”

“তুমি মেয়েদের সব ক্ষমতা দিতে চাও কেন?”

“কারণ মেয়েদের সুন্দর ফুল দেখতে…” উফ ! হাঁপ উঠে গেছে। শক্ত করে হ্যান্ডেল ধরে রাখতে যেয়ে কব্জি ব্যথা করে। যাই হোক, কথাটা শেষ করি। রোদেলা সুন্দর আগ্রহে কিছু শোনার অপেক্ষায় আছে।  “...ফুল পাইতে ইচ্ছা করে। ছেলেদের করে না। যার ফুল দেখতে ইচ্ছা হয় তার পৃথিবীকে বিশাল সমুদ্রের মত একটা ফুলেল বাগানে দেখতে ইচ্ছা হবে, নেচার সব স্বাভাবিকে এমনটাই জানায়।”

“সেই পৃথিবীতে তোমার কাজ কী হবে তাহলে?”

“আপাতত সেক্স করা ছাড়া এই অবাঙালের আর কোনো কাজ খুঁজে পাই না। খারাপ না, বেশিরভাগ পুরুষমানুষের বৃদ্ধ নিশ্বাসে সেক্সের স্মৃতিচারণা অতি উপাদেয় জুস। আমাদের মন পাহাড়ের বাস্তব কল্পে বাহাত্তরজন নারী একশ একটা মেকাপে সেজে খেলাধুলা করবেন, আমি তাতে ক্ষতি দেখি না।”

“তুমি কাকে পচাইলা অনিম, বুঝাও একটু।”

“অদৃষ্টের নাম রুপী বেহেশতকে। আরেব্বাহ্‌! তুমি এই প্রথম বাইক থামায়ে চ্যালেঞ্জ ছেড়ে দিলা। আমার চোখে কিছু লেখা থাকে না। তুমি কি খুঁজতেছো?”

“লেখা থাকে, অনিম। তুমি শেডলাইটের সামনে এসে দাঁড়াও। ব্রিজের কমলা নিয়ন আলোতে তোমার চোখ দুইটা পানির মত পরিষ্কার পড়া যায়।”

বুঝলাম না, ওর মাথায় নিশ্চয়ই কোন রোম্যান্টিক ফ্যান্টাসি ঘুরতেছে । আমি উঠতি নায়কের মত লজ্জা পাইতেছি।

“হ্যালো, নিয়ন দ্যুতির কাফেলা । এই অসহ্য কালো চোখ জোড়ায় আমি বাহাত্তরটা মেয়ের পরিচয় জানতে চাই, তুমি কি এক এক করে ওদের নাম জানাবা?”

আমার চোখ সৌভাগ্যে চিকচিক করতেছে নিশ্চয়ই। রোদেলা সচরাচর খুব বিষণ্ণ চলনে চোখের এক্কেবারে সামনে এসে উঁকিঝুঁকি দেয় না।

“মামা, এই নাও তোমার বাহাত্তরতম আছাড়।”

“ফাক!” 

         

জায়গাটার বয়স বিশ বছর হতে চলল। ছোট থাকতে গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগতো। তিনটা বাজলে আড়াইশ মিটার উচ্চতার সুবিশাল গোল্ডেন ড্রাগন, অপেরার আলো অলংকারের পূজোতালে লেকের পানির নিচে ডুবে যায়। দীর্ঘশ্বাসে মনে পড়ল বাবা প্রথমবার ঢাকায় নিয়ে আসছিল শুধু এই বিশেষ কারণে, ড্রাগনের স্নানঘুম দেখাইতে। ঢাকায় শিকড় গড়বার পর প্রথম আসি প্রচণ্ড শীতে, সোনালি আস্তরটা তুষারে কেমন দেখা যায় জানতে। জেনে খারাপ লাগছিল শীতের পুরো পাঁচটা মাস আংকেল সাদা পাথরে মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। স্থানীয়রা বোধহয় এই কারণে জায়গাটাকে ড্রাগন স্ট্যাচু বলে। পুরাপুরি ডুবে যেতে ড্রাগন আঙ্কেলের প্রায় আধাঘণ্টা লাগে। আমরা শেষ পাঁচ মিনিটে মুরেজে দাবড়াদাবড়ি করে উঠার রিস্কে আজ যাচ্ছি না। দুজনের বয়স হয়ে গেছে। পঁচিশ মিনিটে অতি আরামে তিনবার পট করা যাবে। প্রথমটা প্রায় শেষের দিকে।

“অনিম, ঐ লোকটা কি মারা গেল?”

“কে? সেই মুদ্রাকবি?”

“বেচারা তোমার মত বাহাত্তরটা মেয়ের চিন্তা করলো না কেন? উচিত ছিল না বলো? আমি নিশ্চয়ই তাদের একজন হইতে পারতাম!”

রোদেলার জীবনে কড়া ছ্যাক দিছিল সেই কবি। স্ট্রাকচারটা ডুবে গেলেও শেষ মুহূর্তে ড্রাগন উইংয়ে কিছুক্ষণ বসে, ভেসে ভারি কবিতা খোদাই পয়সা জরিমানার জারে ঢালতেন। জরিমানার জার বলতে এই বিখ্যাত আংকেলের মাথাটা। কবির বই বের হইতো, কেউ পড়তো না। শেষে সব কবিতা পয়সায় খুদে ড্রাগনের মস্তকে ছুঁড়ে মুদ্রাকবি হিসেবে পরিচিতি পান।       

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহটায় বসন্ত আসি আসি করে। অনেকে ড্রাগনের মাথা থেকে পয়সা খোয়া সূর্য উদয় দেখতে আমাদের মত শেষরাত থেকে ভিড় করতো। এমনই এক আসন্ন ভোরে রোদেলা তার পাগলাটে কবিতা কাহিনির প্রেমে পড়ে যায়। গল্পের কাছে পাঠকের অভাব হয় না। রোদেলার মত আরও নিযুত ভারি পাঠক সেই গল্পের প্রেমে পড়ছিল।

“রোদেলা, শেষ রাতটায় আসলে কি হইছিল ?”

“ কবি সাহেব বরাবরের মত আমার দিকে পয়সা ছুঁড়ে নাংগু হয়ে পানিতে ঝাপ দিলেন। আমি রোজ সাধনাকামী তাকে দেখিয়ে জামা-কাপড় ছেড়ে কবিতা খোদাই পয়সা হাতে নিয়ে মুরেজের কিনারা নামের মন্দির বাজারে একটানা অপেক্ষা করছিলাম। তিন সপ্তাহের সাধনায় দেবী ভাগ্য ছোঁয়া অসম্ভব জানতাম, তারপরও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নগ্ন দাসমূর্তি হয়ে বসে বসে দেখলাম উনি তার কাঙ্ক্ষিত জলকন্যা আরেক দেহে খুঁজে নিয়েছেন। সেই ডুবে যাওয়ার পর তাকে আর কেউ দেখে নাই। আজ পর্যন্ত তাকে আর কেউ খুঁজেও পায় নাই। আর সেই সাথে সবার জীবনে অন্যভুবনের মুদ্রাস্নান দেখার নাশ ঘটে।”

“সেই কবি ছিলেন কারও বার্তা বহনকারী একটা অজ্ঞাতনামা লাশ। মৃতের কিংবদন্তি সাধারণ্যের জীবনে খুব কাজে আসে, তোমাকে দেখে বুঝছিলাম। আমি ফ্যান্টাসির পোকা হয়ে পড়ছিলাম, রোদেলা। সরি, অন্য কিছু ভাববার সুযোগ তুমি দাও নাই।”

রোদেলা জয়েন্ট পা দিয়ে নিভিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে ড্রাগনের মাথার উপরে উঠতে যায়। আমি হাত টেনে কোলপেঁচা করে একদা অন্নপিয়াসীকে থামাইতে উদ্যত হই। পিঠে যুগ যুগ বওয়া যত্নের ঝোলার স্মৃতিকষ্টে ডুবে থাকার আর কারণ নাই। ফিতার রাশ ছেড়ে দেই, আশ্চর্য! মনে হয় কারা জানি মুক্তির চিৎকার দিয়ে উঠল। খুব সম্ভবত সেই পয়সাওয়ালারা। যারা ভেতরে কবিতায় জমে অলমোস্ট শ্যাওলা ফুল হয়ে গেছে। ওদের জন্ম উদ্দেশ্য, জলাকাঙ্খি রোদেলাকে দিয়েই প্রাপ্যটা বুঝে নেয়া। 

“একদম শেষ মুহূর্তে টলবা। এ সব আজ থেকে শুধু তোমার কবিতা আর তোমার গল্প। আমি এখন ভারমুক্ত হইলাম।” 

হিমবাহে রোদেলার কাপড় চুল সব উড়ু উড়ু। আমাকে আড়াল করার সাধ্য আজকে তার নাই। আধ ডুবো শেখরের চূড়োয় দাঁড়ানো এই উপকথার কিশোরীর মুদ্রার পিঠে বোজা কবিতায় চোখ বোলান মন্থর তর্জমায় আমার সহস্রের জমানো অধিকার। অলৌকিক একেকটা রুপা ওর সুদৃশ্য আঙুলের নীল নালী থেকে অদৃশ্য রক্ত খসিয়ে জলের ভাষা নেবে, এমনটাই যেন পৃথিবীর জানা বাকি ছিল।       

সাতটার প্রথম আলোতে মুরেজের কিনারায় বসে আমরা দুইজন ড্রাগন মস্তকের এ বছরের সবচেয়ে বড় মুদ্রাস্নান দেখতেছি। ভিজিটররা আরও আলো ফুটলে সেইসব পয়সা কুড়ায়ে পূজার বাক্সে ভরবে, চুড়ান্ত শুভকামনায়। সবকিছু জেনে আমি রোদেলার হাতে সবচেয়ে দামি পয়সাটা দিলাম। মেয়েটা কান্না গলানো ঠোঁটে সে লেখার পুনরাবৃত্তি করে আমাকে বলে  “আমি প্রতারিত হইতে প্রচণ্ড ঘৃণা করি।”

বিছানার একপাশে রোদেলা হাঞ্চব্যাকের মত ঘাড় ফুলায়ে ঘুমাচ্ছে। ভাবতে ভয় লাগে প্রতিদিন একটা হাঞ্চব্যাকের মুখ দেখে সকাল দেখতে না জানি  কতটা ভয় করবে! এমন ভয়ের কেবল একটাই সুবিধা, কোনো রূপকথার চরিত্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন ভোরের সূর্য দেখতে পারার। আর সূর্য দেখবার আগে ফোলান ঘাড় বালিশে মাথা গুঁজে নতুন আশীর্বাদ গায়ে মাখার। তবে আমার ওর বুকের বামপাশের হার্টবিটের মঞ্চে হাত রেখে ঘুম চেতনায় রাতের উষ্ণতা মাপার কৌতূহলটা সবচাইতে বেশি। 
 

১৩.

দুইটা মাস কি অসাধারণ কেটে গেল!

একটা সাইকিকের সাথে ঘরকন্না করা কিছুটা ঝামেলার হবার কথা। রোদেলার কাছে বিষয়টা মোটেও পাত্তা পাইল না। আমি অবশ্য মনে প্রাণে সাধারণ জবহোল্ডারের ভাব আনার খুব চেষ্টা করতেছিলাম। মাঝে মাঝে পারি, বাকি সময় মধুপোকা হয়ে রোদেলার মাথায় আবাস গড়ি। জানতে ইচ্ছা হয় রোদেলার আমার সাধারণত্বে বিরক্তি ধরে গেছে কি না। এই বান্দা বর্তমানকে ভালবাসা নিমজ্জিত একজন কেউ, ‘বিরক্তিভাব’ তাই বিরক্ত হয়ে ভবিষ্যতের কবরের মাঝে হারায়ে গেছে। কেউ বিরক্ত হচ্ছে কি না জানতে চেয়ে নিজের প্রচণ্ড বিরক্তি ধরে না। গতকাল রোদেলা হট শাওয়ার নেবার কালে ‘লাভবাগ’ হয়ে মাথায় ঢুকে ওর জলে মোড়া শরীর ছুঁচ্ছিলাম। সাথে মেয়েটার গোপন স্পর্শের আলোড়নে নিজের অনুভূতি মিশায়ে দিচ্ছিলাম, সবকিছু বুঝে ও কিছু বলল না। শুধু শাওয়ার শেষ করে আয়নায় চেয়ে নিজের খুঁত দেখে রাগ করলো। আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। 

মা’র সাধের তোতাটা সেই ঘটনার পর একদম চিমসে গেছে। ভালো দিক হচ্ছে আমার সিগারেটের প্যাকেটে এখন আর হাত দেয় না। সিগারেট রোদেলাও খায়। সকালে ওর প্যাকেটের সিগারেট খেয়েই গুহ্যদ্বার ঢিল করে হাগতে যাই। বাথটাবের ক্যাটফিশটা দ্রুত বড় হচ্ছে। রোদেলা উইকেন্ডে টেরেসে বসে মাছটার জন্য টুম্যালিন কেটে ঘষে মিনিপন্ড বানাতে প্রচুর সময় দেয়। ইদানিং আমাদের বাসায় ক্রিস্টালের ছড়াছড়ি। ক্রিস্টাল রসায়ন রোদের অদ্ভুত সব রং দেখে আগে জানা ছিল না। মজাটা লাগে রাতে, শূন্য আঁধারে। যখন দুজন ইলেকট্রিক সিস্টেমকে নাকচ করে কফির মাগে চুমুক দিয়ে বাসায় জমানো একেকটা অজানা ক্রিস্টালে টিমটিমিয়ে জ্বলা পুঁচকে তারাগুলোর বিচ্ছুরণ দেখি। নিজেদের আলোর বেনিয়া মনে হয় তখন। দেয়ালে আলোর ভেতরে দুজনের ছায়া-রং হাঁটে ,নাচে। আর আমি নিমগ্ন চেতনায় রোদেলার জন্য এ সমস্ত গাঢ় স্বপ্ন গড়ি। শান্তিতে মেয়েটার চোখে ঘুম নেমে আসে। ঘুম নামানোর রাতের এ চাকরিতে আমার জাত ক্ষমতার কোনো ক্লান্তি নাই। সাধারণ ঘটিবাটি ভবিষ্যতে প্রচণ্ড মায়া আছে জেনে তিনিও ঘুমাতে যান। 

রোদেলা একটা আস্তা পিৎজা খোর। তার ব্রেকফাস্টে পিৎজা লাগে, লাঞ্চেও লাগে, ডিনারে তো লাগবেই লাগবে। পিৎজা ওর বসন, মার শাড়ির মত। বানানোর কারিকুরি দেখে এই ওভাররেটেড খাদ্যের প্রতি ঝুঁকছিল একসময়। এখন শাড়ি পরার মত অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি নতুন কয়েকটা কুইজিনের সন্ধান করতেছি। কোনোভাবে ওর ঝোঁক ধরায়ে দিতে পারলে পিৎজার শাস্তি থেকে নিশ্চিত মুক্তি মিলবে। 

“আমাদের কিন্তু কথা খুব কম হচ্ছে।”

“কথার অনেক মিডিয়াম আছে রোদেলা।” টপিং এ আজকে পাইনএ্যাপল আর হ্যাম। নাস্তা হিসাবে ভালোই। সারাজীবন ব্রেড এন্ড বাটার দিয়ে কাজ সারছি। ব্রেকফাস্ট হিসেবে আমি পিৎজা সহ্য করতে পারবো, সমস্যা নাই । সমস্যা নাই কি আবার, পুরা ইয়াম! সাওয়ারি চিজের সাথে পাইনএ্যাপল মিক্সটা চমৎকার গেছে। সামনে দুই রকমের সস। টম্যাটো সুইট আর রেড হট চিলি। লালা সাফ করার জন্য আবার যাওয়ার কালে বেসিনে দৌড়াইতে হবে। নাহ! জীবনটা একপেষে মধুর। 

“সকালে আমি বেক করে কথা বলি, দুপুরে?”

দুপুরে কীভাবে কথা হয় আমাদের? গতকাল রোদেলার পাশে বসতে সাবেরকে চিপ্ট্রিক করে লাঞ্চের টেবিল থেকে সরায়ে দিছিলাম। আসলে তো রোদেলার কাণ্ডের পাল্টা জবাব দিচ্ছিলাম। আগেরদিন ও ফাইজার সাথে একই কাজ করছিল। এছাড়া তো কিছু মাথায় আসতেছে না। দুইজন দুই ডিপার্টমেন্ট। আমি থাকি সারাদিন মার্কেটিং ফ্লোরে। ও লিখবে দেখে ডিপার্টমেন্ট চেঞ্জ করে পিচিং- এ চলে গেল। পাইছি!

“তিনগাদা কাজের বোঝা মাথায় দিয়ে যেয়ে।”

“ওরে বাব্বাহ্‌ ! একগাদাও না, পুরো তিনগাদা !”

“আমি বাচ্চা ছেলে না রোদেলা। এইভাবে কথা বইল না প্লিজ।” 

“ সসে ডিপ করে ডো টা মুখে ভরো।”

এই ভাষায় খালি সুখানুভূতির ছড়াছড়ি। হার্ট-মেল্টিং। বারবার এত ইংরেজি শব্দ আসে কেন? মন গলানো। বাংলাটা বেশি মধুর। 

“অনিম!”

“হুম।”

“আমি জানি এই বাড়ির প্রত্যেকটা ধুলায় ধুলায় তোমার মেমোরি। কিন্তু এটা আমাদের বাড়ি না। আমরা নিজেদের জন্য একটা বাড়ি দেখি না কেন?”

“না, না পাগল! তনিমা আপু মন খারাপ করবেন। তোমার না তার সাথে কথা হইছিল, কী বললো ভুলে গেলা?”

“আংকেলের সাথেও কথা হয়েছিল।”

“হুম, বাবা বলছেন আমাকে। বাবা কিন্তু আমাকে ফোন দিয়ে সাধারণত কথা বলেন না।”

“উনি কার সাথে কথা বলেন, বলবা? সারাদিন পোকামাকড়ের গবেষণা নিয়ে পড়ে থাকেন। আংকেল রিটায়ার করলে আন্টি খুব বিপদে পড়বেন বলে দিলাম। মহিলাকে আবার পোকা না বানিয়ে বসেন।”

“মাকে বিরক্ত করা এত সহজ না। কঠিন মহিলা, বাবার বাবা সে।”

“তুমি অনেকটা আংকেলের মতন হয়েছ। চুপচাপ, মানুষ নিয়ে বেশি মাথাব্যাথা নাই।”

যদি জানতা যে আমার মাথায় কত লক্ষ কথা ঘুরে! বিশেষ বাঁচাল মস্তিষ্ক একটা পাইছি, কি সূত্রে জানি না। 

“অনিম, আমি না নিজের টেবিল ছাড়া কিছু খাইতে পারি না।”

“ঠিক আছে, নিয়ে আসব।”

“অন্যের আয়নায় নিজেকে দেখতে প্রচণ্ড বিশ্রী লাগে।”

“ঠিক আছে, আয়নাও নিয়ে আসব।”

“নিজের বেড ছাড়া ঘুমাইলে সকালে মাথা ব্যথা করে।”

“এইটা একটা ডাহা মিছা কথা। বুকের উপর হাত রেখে প্রত্যেক রাতে আরামের পারদ মাপি আমি। খুব ভালো জানা আছে, কী স্বপ্ন দেখে ঘুমাও।”

“স্বপ্ন কি তুমি দেখাও?”

“না, আমি দেখি তুমি কী দেখ। মেইনলি ঘুমানোর ত্রিশ মিনিট পর তোমার মূল স্বপ্নের ফেস  শুরু হয়। ”

“ও, আমি আরও মনে করলাম এই তোতাটার আজগুবি স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছিলে।”

“কোন তোতার স্বপ্ন? কী স্বপ্ন?”

“নতুন আয়নাটার ভেতরে অবতারের সোনালি আলোয় নীল পালক ঝেড়ে ফেলছিল। স্বপ্নটা এত অদ্ভুত কি বলব! পালকগুলো আয়নার ভেতরে থাকার কথা। কিন্তু না, সব সামনে এলোমেলো কাগজের উপর অযত্নে পড়ে ছিল। It feels sad.”

তোতাটার উপর সবার এত মায়া জন্মায় কেন? একটা ভদ্র মেয়ের মত ঘরের এক কোণা থেকে আরেক কোণায় কথা ছাড়া ঘুরে বেড়ায় এখন। চশমা পড়া শিয়াল পণ্ডিতের মত পকপক করে না। আমি বেশ আছি। 

“হ্যাঁ, অদ্ভুত তো বটেই। এই স্বপ্নের কথা জানি না।”

“হতে পারে সাবকনশাসলি দেখেছি। কিন্তু আমি এভাবে ভাবছিলাম না, হোয়াট আই মিন পৃথিবীকে এভাবে দেখছিলাম না।”

রোদেলা কেমন স্থির বসে আছে। স্থির বা মূঢ় প্রতিকৃতির দিকে তাকায়ে থাকলে চারপাশটা আমার আপনাতেই স্থির হয়ে যায়। 

“অনিম!”

“তুমি ঘুমের মধ্যে ঐ পাখি হয়ে কি হিপনোটিক সাজেশন দিয়েছিলে মনে করে দেখ।” চোখের পলক একটুও পড়ল না। অন্ধ মেয়ের মত গ্লাসের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করতেছে কেন? আমি কি অজান্তে কিছু করছিলাম? চেতনাবৃত্তি আবার লুকোচুরি খেলা শুরু করল কবে থেকে? আমার প্রত্যেকটা সেকেন্ড মনে করে দেখতে হবে। অফিস আজকে চুলোয় যাক!

“রোদেলা?”

“কিছু হয় নাই আমার, তোমাকে ভয় দেখালাম। কেমন লাগল?”

“বিরক্তিকর !”

সম্রাটকে চাবি বুঝিয়ে দুইজন ঘর থেকে বেরুলাম। আচ্ছা উপন্যাসের ঢঙ্গে কথা সাজাচ্ছি কেন? আমি কি কারও জন্য গল্প বানাচ্ছি?

ট্রাম ফাঁকা। লম্বা সিটের কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলাম। রোদেলা চুল ধরে মাথা টেনে উঠিয়ে নিচে ঢাউস ঊরুখানি পেতে দেয়। সবসময় দামি কাপড় পড়ে অফিসে যেতেই হবে তার। সুগন্ধি ছড়া কাপড়ের নরম গন্ধে ঘুম আবারও মণির দরজায় আসি আসি করতেছে। সাইড ওয়েইস্ট স্লিটের ফাঁকে ওর হলুদ চামড়া অনেকখানি দেখা যায়। মারুন ভেলরে গোটা কামিজ জুড়ে অতি সূক্ষ মোটিফের কাজ। দেখে মনে হইতেছে মাইক্রোস্কোপিক নিডল দিয়ে এমব্রয়ডারি করা। আমার মাথাও তো নিডলের চেয়ে কম না। হলুদ চামড়ায় লাল বিস্ফোরণ ঘটানো কেবল তিন সেকেন্ডের মামলা। বাতাস বাবু আপনি কিছুক্ষণের জন্য সামনের সিটের মেয়েটার শরীরের ফাঁকে যেয়ে হাওয়া খেয়ে আসেন। আমি ডাস্ট পার্টিকেলের ফ্রিকোয়েন্সিগুলো একত্র করি।

“এই কুত্তার বাচ্চা !”

“হাহা !”

“সেলটা দাও, দেখাই কি করছি।”

“তোমার ট্যালেন্ট সম্পর্কে আমার আইডিয়া আছে। তারপরও নাও, ছবি তোলো।”

“হাওয়ার চিমটি দিয়ে প্রজাপতি আঁকছি কোমরে। দেখাই।” মেয়েদের ত্বক এত সময় নিয়ে লজ্জা ধরে রাখতে পারে কেমনে? ম্যাক্রমুডে লেন্স কাছে যাইতে পারে, শালার আমি পারি না! লোকজন আছে। থাক, দরকার নাই। কামড় দিলে আবার আর্ট নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। 

“প্রজাপতির ডিটেইল ভারি করতে হবে জনাব। বোরিং লাগতেছে দেখতে।”

সামনের মেয়েটা হা করে তাকায়ে আছে। কী ঘটতেছে বুঝতে চায়। ওর কি শরীর জুড়ানো আরাম পছন্দ হয় নাই ! 

জানালায় পেট কাটা উঁচু নিচু দালান। অক্লান্তে না ঘেমে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। উলটা ঘাড়ের ওপরের জানালাগুলো ঘেমে গেছে। সাইকেলে এই ফিলটা পাওয়া যাইতো না। বাতাসের ঘামের ঝাপসা দালানকোঠা। আলতো হাতের ছোঁয়ায় জাগা পরিষ্কার দালানকোঠা। রাতের চোখ ঝলসানো আলোতে এদেরকে অন্য গ্রহের সারি সারি সুন্দর দৈত্যের মত দেখা যাবে। যতই মাথায় হাত বুলায়ে ইয়ারফোনে অর্নব-মেঘদল গুলোয়ে দিক, রোদেলার নিজেকে কেন অসহায় লাগবে না?

“ অনিম !”

“ হুম।” 

সামিহা আর তার বয়ফ্রেন্ড শিশির সন্ধ্যায়  বাসায় এসে তিন ঘণ্টা থেকে ডিনার করে চলে গেছে। পুরোটা সময় আমি অতিরিক্ত নেগেটিভ ভাইব পাচ্ছিলাম। রোদেলা সাথে থাকলে এই একটা সমস্যা। শুধু রোদেলাই কি অতি প্রিয় আমার? যাই হোক, প্রেমিকার মতো কারও কাছে জিম্মি থাকা কেন্দ্রীভূত ইমোশনাল এনার্জির কারণে এমনটা ঘটে বারবার। হলুদ আলোর বাজে আভায় না-মানুষ আত্নাদের হাসির বাজনা সহ্য করতে থাকি। যা কুৎসিত ঘামের গন্ধ মাফিক নাকে ঢাক বাদ্যর মত বাজে। 

রোদেলা শাড়ি পড়ছে আজকে। ওকে দুর্দান্ত সুন্দর লাগতেছে এটা ওর সমস্যা না, আমার সমস্যা। আমি ভয় পাই এই মেয়ের অতিরিক্ত সৌন্দর্য। ওর মেয়েবেলার বিচ্ছিরি বন্ধুগুলোর চিন্তা মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খায়। নিজের বন্ধুরাই বা বাদ যাবে কেন? সব একেকটা পালিত অবদমিত জানোয়ার। সারাক্ষণ খালি তাদের ন্যাংটা পরনারী দেখার ইচ্ছা। মুখেতো লালা ঝরেই, মনে বালতিতে বালতিতে ঝরে। ঠিক এই মুহূর্তেই রোদেলার শাড়ি খোলা লাগবে কেন? আমি বারান্দায় যেয়ে সিগারেট খাই, কুশ্রী চিন্তা থামানো দরকার।

“অনিম, এত বড় ঘটনা তুমি বললে না কেন?” পরে যাই। কি বলতে চায় বুঝে নিই। 

“কোন ঘটনা?”

“অনিম, ফুপু তিনদিন এ বাড়িতে লাশ হয়ে পড়ে ছিলেন। সাথে তুমিও ছিলা অসুস্থের মত।”

“আর তুমি ব্রা খুলে বুব দেখায়ে জিজ্ঞেস করতেছো। বলো, কোনটা বেশি অ্যাবনরমাল ?”

“তুমি খালি গায়ে একই কথা জিজ্ঞেস করলে কেন নরমাল হইত?”

“সরি।”

“It’s okay। আমি এ বাসা থেকে কাল চলে যাবো। তুমি কি আমার সাথে ছাড়বা এই বাসা?”

“তোমার বাবা আমাকে কোন জন্মে পছন্দ করেন নাই।”

“হোটেলে থাকবে?”

“জানি না। এ্যাশ, তোতা, সম্রাট ওদের কে দেখবে?”

“কিছুদিন সময় নেই তাহলে। কাল বাসা খুঁজবো, ঠিক আছে?”

লাল ম্যাটে ছত্রিশ গজের গ্লেসি কালো সিল্ক পড়ে আছে। চোখ উপরে উঠায়ে ঘর বরাবর রাখলেই বিপদ। নগ্ন দেহের গরম ধোঁয়া দেখতে হবে। মন সায় দিতেছে না। ফুপুর প্রসঙ্গ অনেকদিন পর ফের এল এই বাড়িতে। কেমন হরর শো এর ভাইব পাইতেছি। পুরানো কাম পাগলা মরবিড চামড়া সমস্ত শক্তি জমায়ে লিঙ্গে ঝাঁপ দিতেছে। 

“অনিম, আমি শাওয়ারে গেলাম। দরজা খোলা রইল।”

“ফাক হার ! সিরিয়াসলি……আমার এইভাবে চুদতে ইচ্ছা করতেছে?”

দাঁড়াও বিচ! দরজা এদিকে বন্ধ করে মজা দেখাই।

“তুমিই মিস করলে, আমার কিছু যায় আসে না।”

“Just feel it babe.”

“বাল !”

“লিপস্টিক আজকে এভাবে মাখছো কেন? ব্লাশ টোনে? ঠোঁটে কিসের মার্ক? আচ্ছা বুঝছি। মেবি কাউকে লিপের জ্যুস খাওয়াইছো। ”

“অনিম, চিপ সাইকোগিরি অসহ্য লাগে।”

“রাস্তার কুত্তাদের মত তোমাকে জিভ লেলায়ে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করতেছিল তখন। নিজের স্কিনের মেজাজটা খুব ভালো বুঝতে পারো তুমি।”

“অনিম, কার থটস এগুলো? প্লিজ মাফ চাই, That was totally a harmless thing। উনি কিন্তু আমার ফুপু ছিলেন না। তোমার খারাপ লেগেছে আমি বুঝেছি।” 

“আজকে ঘুমের মধ্যে চোখ বোজা অবস্থায় তোমার অরগ্যজম এঞ্জয় করব। প্রথমে……” শিশিরের লালাঝরা কুত্তা আকাঙ্ক্ষা গুলো সব মুখে চলে আসতেছে। কাওয়ার্ডলি পেইন পোষার কোন দরকার নাই। সারাজীবনের ঠেকা পড়ে নাই আমার।

“আহ! উফ! আরেকটু…...বেবি আরেকটু।” কি করতে চায় ও?

“তোমার পেটের সাথে চার ঘণ্টা আটকায়ে থাকবো আজকে…”

“স্লোলি যাও বেব।”

মেজাজ চড়ে গেছে। এম্প্যাথি বলতে কোনো কিছু নাই মেয়েটার।

“রোদেলা, এগুলো সব শিশির চিন্তা করছে আজকে তোমাকে নিয়ে।”

“ফাক, রিয়েলি। He got balls। তোমার মতন না। সামিহার দিনকাল ভালই যায় তাহলে।”

“It’s not funny.”

“Ohh God! Fuck me harder! ”

“বাইরে থেকে ভূতের গলার মত শোনা যায়।”

“Deal with it. It was your choice.”

“ডোর ভেতর থেকে লক করার দরকার ছিল না, রোদেলা। আমি এমনিতেও ভেতরে আসতাম না।”

“অনিম!” রোদেলা এত্ত জোরে চিৎকার দিল অনেকদিন পর, আমি কন্ট্রোল ফিরে পাইছি! 

“কি হইছে?”

“ফাক! সাইকোর বাচ্চা আয়না থেকে ছেলেটার চেহারা সরাও। বাস্টার্ড ক্রিপদের মত বিহেইভ করবা না প্লিজ!”

“What a lovely mess! I can see your junk. তোমার সমস্ত শরীরী পাওনা যদি না মিটাইছি আমার নাম শিশির না …”

পানিতে জোরালো থপ থপ শব্দ শোনা যায়। হইল কি? আমি এক মিনিটের জন্য কনশাসনেস হারায়ে ফেলছিলাম?

“রোদেলা ! রোদেলা ! কী হইছে?”

“It’s really not funny, Anim !” শাওয়ারের জোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।

“তুমি কি কাঁদতেছ?”

“It’s not funny, Anim! It’s not funny! ”

“সরি, আমার খেয়াল নাই আমি কি করছি। আর হবে না, ডোর খুল।”

“না !”

সকাল হয়ে গেছে। রোদেলা এখনও ওয়াশরুমে। চার ঘণ্টা ধরে গল্প শুনাইলাম, গান গাইলাম। ওর ভয় কমে নাই। একই কথা বারবার বলতেছে। “It’s not funny। তুমি সারাজীবন এই জঘন্য কাজ করছো আমার সাথে। প্লিজ এই ক্রিপি জানোয়ারটাকে আয়না থেকে সরাও।” জিদ্দে আমার নিজের কান্না আসতেছে। কি করলাম তখন না বুঝে? আমি বালের ক্ষমতার কিছু অভিশাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি নাই। খুব সম্ভবত সারা জীবন চেষ্টা করলেও পারব না। নতুন আয়নাটা পরিষ্কার বুঝায়ে দিল। 

১৪.

তিনদিন একনাগাড়ে অফিস। এত কাজপাগলা হইতে পারি কবে জানতাম? সাপ্লিমেটেড কারেন্সি প্রজেক্টের ক্যাম্পেইন সামনের মাস থেকে শুরু। সবার কলিজা বের হয়ে যাবে তখন। রোটারি এত থেমে থেমে যাচ্ছে কেন? একদণ্ড শান্তি নাই। এতকিছুর পর আবার রোদেলার বাবা বাসায় ডাকছেন। জানি না তাকে কী বুঝাবো? আমি তো তার মেয়েকে কিছু করি নাই। জানি না কিসের চাপে ওর আবার এপিলেপ্সির ঢং শুরু হইছে। নিজের বাসায় যাবার আগে আমার বাসায় দুই সপ্তাহে কম করে হলেও চল্লিশ জন মানুষ আসছে গেছে। এত্তগুলো গিফট পাইছে! এ্যাশের ফিশপন্ডের জন্য হিমেল ভাই রেড সি থেকে কোরাল জোগাড় করে আনছেন, ভাবা যায়! এমন বাড়াবাড়ি রকমের খাতির যত্নে ওর বিরক্তিতে পাগল হয়ে যাবার কথা। হয় তো নাই, উলটা সেই তিন বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে কলিগ, কাজিন, বন্ধুবান্ধব সবার সামনে ইজ্জতের তেরটা বাজায়ে রাখছে। রোদেলা তুমি কখনই আমার হবার যোগ্যতা রাখো নাই। হইলে এত অল্পতে মুষড়ে পড়তা না, আস্থা রাখা জানতে পারতা। 

রিকশাফেরি পরপর তিনটা দাঁড়ানো। আচার, আইসক্রিম আর বই পাওয়া যাচ্ছে। অনেকদিন পর দেখতেছি এই তিন সন্তকে। বুড়া হন নাই কেউ। সন্তরা বুড়া হন না তাহলে। বড়রা কিংবদন্তী বলে আমাদের সাথে ছলনা করেন নাই, খুব সুন্দর। জাফর সাহেব এতক্ষণ যখন অপেক্ষা করছেন, দশ মিনিট আচারের পর আইসক্রিম আর বাকি দশ মিনিট অন্য পৃথিবীর গল্প নিশ্চয়ই সহ্য করতে পারবেন। 

“জিপসি নবি আর ভিঞ্চির একান্ত সাক্ষাৎকার।” বাই আর কে। মিস্টার জিপসি নবি, উনি বেঁচে আছেন তাইলে! না কি এই ব্যক্তি ফেইক জিপসি নবি সেজে লেখেন, অদ্ভুত সব গল্প। চৌদ্দ শতকে ভিঞ্চি নামের রহস্যময় চরিত্র কি কি অসাধ্য সাধন করছেন তার শ খানেক রোমাঞ্চকর বর্ণনা । ছোটবেলায় ভিঞ্চি হইতে চাইতাম। পারি নাই, পলিম্যাথ হওয়া চাট্টিখানি কথা না। 

“বিজ্ঞান কাব্য- আইন্সটাইনের চশমা”, কবি আর্কিমিডিস। থাক, জিপসি নবির ভিঞ্চির গল্প পড়ি। একটা গল্পের বেশি পড়া যাবে না। ফ্ল্যাপে লেখা “দ্যা ভিঞ্চি ভার্জিনস অফ দ্যা রকে ইজি চেয়ারে বসে চায়ের কাঁপে চুমুক দিচ্ছিলেন। গুল্ম লতার ফাঁকে তিনি একটি পরিত্যক্ত বই খুঁজে পান। প্রকাশের বছর মুদ্রণ লিপি সবকিছু ভিনগ্রহের মত ঠেকে তার কাছে। মানুষের জ্ঞান মস্তিষ্ক মারফত বইটি ছাপা হয়েছে তা পরিষ্কার। কিন্তু কীভাবে তিনশ বছর পরবর্তী ভবিষ্যতের এই বই এখানে এভাবে তার কাছে আসল? পৃথিবী কি বদলে যাবে না কি বদলের ষড়যন্ত্র এতদিন চলছিল?”

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে আমার। আমার কাছে লেখবার জন্য আঁকবার জন্য ছোটবেলা থেকেই চরিত্ররা আসতো, ভর করতো । বিছানায় আবছা ভয়ার্ত চোখে দেখতাম ওরা আঁকতেছে, লিখতেছে। যদিওবা জানি ওরা চাইলেও আমাকে দেখতে পারবে না। পরদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হইত, পৃথিবীটা সেসবের অতি ক্ষুদ্র ডিটেইলের আলোকে সাজতেছে, গড়ে উঠতেছে। বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমার জন্য। কারণ তাবৎ সাইকোসোশ্যাল থিওরিস্টরা না কি এভাবেই সৎ স্বপ্ন-মানুষ দেখে মহৎ সব কাজে হাত দিতেন। বাবা থোড়াই জানতেন, এই পৃথিবীটা একসময় মেটাফিজিসিস্টদের দখলে যাবে, আর আমি ওদের দুর্বোধ্যতার আড়ালে ক্ষণজন্মা অতি ক্ষুদ্র একজন সাইকিক হয়ে উঠবো। লেখার সত্য বাস্তব হয় সিনেমাতে অথবা বইতে। আমার ক্ষেত্রে জীবনে। গাঢ় প্রকোষ্ঠ অন্ধকারে জিইয়ে থাকা একটা সত্তা পুরোপুরি জানে পুরা জগতটা অসংখ্য ক্ষুদ্র বড় মাল্টিথ্রেডেড বৃত্তের কোডে বাস্তব হয়ে উঠতেছে আমাদের কাছে। আসলে কি তাই? যথেষ্ট সময় নষ্ট করলাম। রোদেলার অবস্থা কি, জানার সময় হয়ে গেছে।

ওদের বাসায় আসলে প্রতিটাবার একই কথা মনে হয়। সবকিছু যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকবে। পুরো বাসায় কোন অনিয়মের স্বাভাবিকতা নাই। যেন পুরো বাসাটা সিনেমার একটা বিশাল সেট। আর ফার্নিচার সমূহ একেকটা চরিত্র। মার্ক করা জায়গার বাইরে এদের পা পড়বে না। 

“অনিম, চেয়ারটা আর দুই ইঞ্চি পেছনে নিয়ে বসো।” জানা কথা। হাসি আসলেও হাসার সময় না এখন।

“কেমন আছো? কফি ঠিক আছে?” পরনে আয়রন করা সাবমিসিভ কালো রঙের পাঞ্জাবি। শান্ত ভঙ্গীতে বড় সোফাটায় বসলেন। চোখেমুখে টেনশান ধরে রাখছেন, তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা ফেইক।

“জি ঠিক আছে সবকিছু।”

“ভালো, তুমি সবসময় স্বাভাবিক থাকতে পারো।”

কারণ আমি জানি সবকিছু মিথ্যা, আর আপনার মেয়ে একটা পুওর সউল।

“আমি জানি না তোমাকে কীভাবে কি বলব। তোমার চেহারাটা আমার দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে না। মেয়েটা আমার ঘৃণা করতে পারে না তোমাকে, পারবেও না। পারলে খুব ভালো হতো।”

“আমি চাই নাই কখনও ঘৃণা করুক। চাইলে হয়ত সম্ভব হইত।”

“তুমি এত ম্যানুপুলেটিভ কেন?” চুপ করে শুনে থাকা ছাড়া কোন উপায় নাই। আমার নিজেতে আর ঘেন্না ধরে না। 

“আমার মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই এক্সট্রিমলি সেনসিটিভ। কোনো খারাপ খবর শুনলেই ও ভেঙে পড়ে।”

ও এই পৃথিবীর মেয়ে না। এই পৃথিবীর মেয়েদের কষ্ট ফেরত দেওয়ার ক্ষমতা থাকা লাগে। ওর তা নাই।

“এই গ্রহটাই একটা গণ্ডগোল, আংকেল। কেউ খুঁত দেখে মন খারাপ করে না, বোবা হয়ে যায় না। রোদেলা হয়। মানুষ হইতে না পারার বড় একটা খুঁত নিয়ে আমি জন্মাইছি। রোদেলা জানে না, বুঝতেও চায় না। ওর সুন্দর ভাবনাতে সবার জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমার জন্য থাকা উচিত না আমি জানি, আপনিও জানেন।”

“হাহা, তুমি পার পেতে চাও এসব বলে? ফানি ম্যান!”

“না।” 

“তুমি বলো, ওর এপিলেপ্টিক সিজারের সমস্যা আগে থেকেই ছিল তা মানলাম। দিনদিন হাইট কমছে কীভাবে? তুমি দেখতে চাও ও কতটুকু হয়ে গিয়েছে? যাও দেখে আসো। আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই যে তুমি কিছু একটা করছো, থাকলে তোমাকে ট্রায়ালে চড়াতাম।” 

“আপনি কি ট্রায়ালের ইনফরমেশন জোগাড় করবার জন্য ডাকেন নাই?”

“তোমার চেহারা দেখে রুচি হচ্ছে না। আমি মেটাফিজিক্যাল ল’র উপর কেসটা ছেড়ে দেব।”

“রোদেলা কি মারা যাবে? ফিজিশিয়ানরা কি বলল?” গলা কাঁপে আমার। আমি ভুল পৃথিবীতে চলে আসছি। 

“কেউ জানে না। পাঁচ সাত থেকে পাঁচ একে যার হাইট এক মাসে নেমে আসে সে কীভাবে বাঁচবে, কীভাবে কিছু খাবে, কীভাবে হাঁটবে আমার কোনো আইডিয়া নাই। মেটাফিজিশিয়ানরা এক্সামিন করে বলল…”

“ওর পিটুইটারি গ্ল্যান্ড ক্ষয় হচ্ছে সাথে কানেক্টিভ টিস্যু খুব দ্রুত বোন লাইনিং সেল থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সিভিয়ার অস্টিওপোরোসিস এর সবচাইতে ইউনিক আর অ্যাবনরমাল কেস। ওদের চোখ নিশ্চয়ই চকচক করছিল রোদেলাকে দেখে?” 

হ্যাঁ না কিছু বলতেছেন না। এ কি? হাউ মাউ করে কাঁদা শুরু করছেন। চোখ তো আমারও কাঁপে। দশ পারসেন্ট কোনো একটা সত্য মানুষের কান্নায়। বাকি নব্বই পারসেন্ট মিথ্যা মানুষটা আমাকে মুভ অন করতে বলতেছে। তাতে প্র্যাক্টিক্যালিটি নামক কোনো অদ্ভুত নিষ্ক্রিয় বিশেষণ আমাকে হাতে ধরে রাখা কফির মগ ভাঙতে নিষেধ করে।

“আপনার কি মনে হয় না মেটাসায়েন্টিস্টরা নিকৃষ্ট পর্যায়ের খারাপ কিছু? একেকটা সোশিওপ্যাথ! ওরা কেন সবকিছু জেনে আমাদের থেকে আড়ালে থাকে? চারপাশে

অসহ্য রকমের উলটা আয়নার দেয়াল কেন? বামদিকে কেউ হার্ট নিয়ে জন্ম নিলে ওদের আমরা একসময় হারায়ে ফেলি কেন? এসব মানুষ কোথায় যায়?”

“তুমি আমাদের মাফ কর। আমার মেয়েটা... 

"মিথ্যা বলছেন। সারাজীবন তার কাছ থেকে বিপদ লুকাইছেন আর নিজেরাও অতি ধনবান হওয়া সত্ত্বেও গরিবের মত লুকায়ে থাকছেন। আমি সত্য বলছিলাম, কারও সহ্য হয় নাই। জেনেশুনে ম্যানুপুলেট করে নিজের কাছাকাছি রাখছি। দূরে যাইতে দেই নাই।”

“তুমি এখান থেকে যাও।”

“ওকে মেটাফিজিশিয়ানদের কাছে নিয়ে গেলেন কেন? আপনি যা জানাতে চান নাই, তা না জানায়ে থাকতেন।”

“তোমার মা আমাকে কল দিয়ে নিয়ে যেতে বলছেন। এখন চুপ করে এখান থেকে বিদায় হও। নিজের মাকে যেয়ে জিজ্ঞেস করো এসব কথা।” 

বাহ্‌! মাও মিথ্যা ! জানতাম না। “ আমি রোদেলাকে নিয়ে যাব।”

“না।”

“আপনারা সব পাগল। আমি কিছু না কিছু করতে পারবো। আপনারা মিথ্যা বিশ্বাস করে বসে আছেন।”

“তুমি পাগল। তোমার কারণেই সবকিছু ঘটছে। তোমার মা বলেছেন তুমি পাগল হয়ে গিয়েছিলে লাশের সাথে তিনদিন পড়ে থাকার কারণে। তোমাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নাই।”

“আপনারা সবাই মিথ্যা। এসব কোনকিছুই ঘটতেছে না। আবার ঘুম থেকে উঠে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“ কিছুই ঠিক হবে না।”

আমার কিচ্ছু বিশ্বাস হইতেছে না। কেউ কি আমার হয়ে বলতেছে এসব কথা না কি কেউ নিজ থেকে জানতে চাচ্ছিল, কোনোকিছু ঠিক করবার ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয় নাই। আমি হইতেছি রোদেলার মত একটা দশ শতাংশ মানুষ। যার ট্রমাতে কুৎসিত এলার্জি। তার অনুভূতি থাকতেই হবে দেখে থাকবে। প্রতিক্রিয়া দেখানোর দরকার দেখে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। সে কেবলই নকল অনুভূতিতে কাঁদতে পারা একজন অক্ষম মানুষ।

নব্বই শতাংশ মানুষটা নিজ থেকে দরজা খুলে চলে যাবে। আর দশ শতাংশ মানুষটা শেষ আকুতি নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে জানবে “আমার রোদেলার সুন্দর মিথ্যায় হাত রেখে ঘুমাইতে অভ্যাস হয়ে গেছে। সকাল সকাল ওর মায়া না পাইলে আমি বাঁচব না।”

দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, চিরদিনের জন্য। আমার লেখা-আঁকা দুঃস্বপ্নগুলো সবসময় সত্যি হয় কেন? আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাই নাই। মনে হচ্ছিল রোদেলার কিছু হবে না। কম্বলের আরাম পাইতাম ভেবে, এখন সত্যটা জেনে প্রচণ্ড শীত লাগতেছে। 

১৫.

কি হোল্ডার চেক, প্যান্টের জিপ চেক, ডিটক্স পিল চেক। ক্রিম কালারের টাইটা গতকাল কিনে এনে কোথায় রাখলাম? “এই সম্রাট! আমাকে টাইটা খুঁজে দাও।”

“ভাইয়া, লণ্ড্রির পোলাটা নি গ্যাছে যে।”

“নাস্তা লাগাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।” 

প্রতিদিন আয়নায় একটা রুক্ষসূক্ষ্ম মানুষকে দেখা যায়। কালো শার্ট, ব্লু জিন্স। গোটা পৃথিবীর অলিতে গলিতে চক্কর কাটতে চাওয়া ধাড়ি কোঁকড়া চুল। টেনে হাই পনিটেইল করতে হবে। দাঁড়ি কামানো উচিত হয় নাই। চেহারা ভাঙা ভাঙা দেখা যায়। চোখা লম্বা নাকের মানুষদের ক্লিন শেভ লুকে দেখতে বেশ ভালো লাগে। আমার খাড়া বোঁচা নাক। অর্ধচন্দ্র খাওয়া পলাতক প্রবণ চেহারা, ঈষৎ বেগুনি ঠোঁটে ভান ধরা আত্নবিশ্বাস জমায়ে যে কি না রুঢ় বিচারকের মতন আচরণ করতে করতে চূড়ান্ত ক্লান্ত। দুই বছরের ছেলেটা সেদিন তানজির সাথে এসে ব্লু লেন্স পড়ার আবদার রেখে গেছে। বাবা জ্যোতিষীর কথা ফলে গেছিল। সাহানের চোখ দেখতে অপূর্ব পিস্টল তারার লাভা সমুদ্রের মত ঘন নীল। বাবা-ছেলের চোখে সাদৃশ্য থাকা উচিত। আমি কি লেন্সটা পড়বো? হাতে টাইট মাসল থাকলে ক্রিপ্টোনিয়ান গডের রোলে অভিনয় করতে পারতাম। সাহান সেই বাবাকে নিয়ে নিশ্চিত সবার কাছে গর্ব করতে পারতো। প্যান্টটা মানাচ্ছে না। নতুন গ্রে চেক ট্রাউজারটা এই লেন্সের সাথে ভালো যাবে। 

রাব্বানি ছেলেটা ফুপুকে ঘরে বেঁধে রেখে রেইপ করে আমার আধোয়া প্যান্ট- শার্ট পড়ে নিচে ডিউটি দিত। খুব স্বাভাবিক আচরণে সবার সাথে চা-সিগারেট খেয়ে গল্প করছে, কাজ করছে। কোনো সমস্যা হয় নাই ওর। কেউ ওকে জিজ্ঞেস করে নাই হঠাৎ এসব দামি চেক শার্টগুলো কোথায়, কীভাবে পাইছে। যেভাবে আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করবার পর আফসোস করে না, এমন হন্টেড হাউজে দুইটা বাজে ঘটনার পর সেজেগুজে অর্থের তাড়নায় অফিস করে কী লাভ? আমি কার কাছে পালাবো? নিয়তি আমাকে ছেড়ে কথা বলে নাই কখনও। আমি সবচাইতে বিচ্ছিরি অবস্থায় মরতে চাই। অবশ্য পরম আরাধ্য ঘোচানোর আর বেশিদিন নাই। যাই হোক, নাস্তার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রোদেলা তোমাকে বরাবরের মত মিস করতেছি। 

কথাটা আয়না কর্ণপাত করে কি? সবসময় হেঁটেই চলে আসি। অপেক্ষা করবার সময় থাকে না। আমার চলে যাবার পর শূন্যস্থানে আয়না কাকে বসায়? কাকে বলে সেসব উত্তর? এত্ত বড় ফাঁকা ঘরটা তো ওর চারকোণাতে কবজা। বন্দী শিবিরের অবাক আত্নারা অনেক সুন্দর। এদের নিয়ে খেলতে আয়নার সম্ভবত ভালো লাগবার কথা। 

আমি জানি আমি কি করতেছি। একটা নামকরা ক্রিস্টাল এজেন্সিতে সিনিয়র মার্কেট আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ করতেছি তিন বছর। কচু থেকে ডিম হইতে পারে সাধারণ মানুষের জানবার কোনো দরকার নাই। আমরা মনে করি, মানুষের কী প্রয়োজন তা মানুষ কখনও ভেবে ঠিক করতে পারবে না। আমরা নতুন প্রয়োজনের উদ্ভাবনে মেধাত্না বিনিয়োগ করি। কোম্পানির লাটসাহেবেরা কোমল গদিতে ঘুমিয়ে আমাদের গড়া এই পুরো ব্যবস্থাটাকে মাঝে মাঝে গালাগালি করেন। কচুর ডিম দিতে প্রায় সময় এত দেরি হয় কেন তারা জানতে চান। কোম্পানির এমপ্লয়িদের অফুরন্ত সময় পড়ে থাকে তাদের অসহিষ্ণু উৎসাহের খাতার কজ এন্ড ইফেক্ট মেপে ওজন করানোতে। আমি সবাইকেই সাহায্য করি। নিজের উপার্জন জমাই না, চেষ্টা করি অন্যদের স্ট্রাগলে অর্থের উৎসাহ দেখাইতে। মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যস্ত থাকতে। বাসায় পূর্ণবয়স্ক একটা ধামড়ার চার সদস্যের পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিতে। দেখতে জঘন্য লাগবে এমন সব জিনিস কিনে ভরায়ে ফেলতে। যেমন গতকাল টাই কিনলাম। ইচ্ছাকে জোর করতেছি। সুন্দরভাবে বেঁচে থাক্‌বার স্পৃহা তাতে নষ্ট হচ্ছে। আমি তৃপ্ত। কি অদ্ভুত! ভোর সকালে অফিসে বমি বমি ভাব নিয়ে ঢুকে আমি তৃপ্ত হই।

কিউবিক ছয় তালার একটা কর্নারের বিশাল ফালি-টুকরা বারান্দায় বসে আমি ছুটির কফিতে চুমুক দেই। সামনে দু-সপ্তাহ আমরিকা ট্যুরের টিকিট। অফিস আমার কন্ডিশন নিয়ে যারপরনাই দুশ্চিন্তায় । মাথা ড্রিল করে হাড়ের ফুটোতে ক্রিস্টাল প্লেস করছিলাম কি না। বেচারা নেছার! আমার করুণ চাওয়ায় হাসতে হাসতে নিজের চাকরি হারাইল। ওর মত মেনিয়াক ক্র্যাফটসম্যান কোম্পানি চায় না। কারণ রত্ন, দামি দামি সব পাথর কাটার পেছনের মানুষদের নেছারের বড় তুচ্ছ মনে হয়, ঘৃণা ধরে। তবে কোম্পানি আমার কপালে ওদের আনুগত্য কিংবা দাসত্বের সিল দেখে ভীষণ আমোদিত। তাতে নেক্সট জেন বিজনেস ফোরকাস্টের সম্ভাবনা একেবারে উড়ায়ে দেয়া যাচ্ছে না। অচিরেই হয়ত মেয়েরা কপালে টিপ দেয়ার প্রাসঙ্গিকতা হারায়ে ফেলবে। সবাই জানবে মানুষের রক্ত মাংসের শরীর, চামড়া এতদিন রত্নশূন্য ছিল। পচা হাড়ের বদলে বিনাশযোগ্য রত্ন নিয়ে মাটিতে চিরতরে ঘুমিয়ে থাকা নিশ্চিত লোভনীয় কিছুই হবে। দু সপ্তাহের ট্রিপ কফির সাথে উপহার দিয়ে কোম্পানি হেডরা বোধহয় সেভাবেই কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। এরা যে কবে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিবে!

“অনিম, আজকেও কিউবটা মেলাতে পারলাম না। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।” 

“নিতু আপুর চিটশিটটা আমার কাছে আছে, লাগবে লিয়া?”

“আরে নাহ! তাহলে ফান থাকলো কোথায়?”

“রিক্রিয়েশন টাস্কে বিহেভিয়ার এডজাস্টমেন্টে সবাই উঠে পড়ে লাগছে। কাজটাজ বাদ দিয়ে খামাখা যত্তসব পেইন!”   

“হাহাহা, ঘোস্ট কিউব মেলানো কি এতই সহজ! সবাই ভেবেছিলাম তুমি পারবা, কিন্তু ক্রিস্টালে হাত-টাত কেটে যা করলা সেদিন।”

“নাইন বাই নাইনের মেগামিক্স কিউব ওটা। কোনো শেপ শিফটার না।”

“নিতু আপুর চিটশিট দেখে বলছো?”

“অবশ্যই না।”

“জানলে পারছো না কেন?”

“তিনটা কেস নাড়াইলে এক ঘেয়ে গান বাজাবে। ভুল হইলে চুপ করে থাকবে। খুব বুদ্ধিমান মানুষের ভাব ধরে টিজ করে, অসহ্যকর!”

“এই সেমিমেটা সাবজেক্টটা মিস নিতু কিভাবে সলভ করলেন?”

“সম্পূর্ণরূপে গায়েব হয়ে যেয়ে।”

“অনিম, হাসিতে দুঃখ ধরে রাখা ফরবিডেন। আমাকে দেখ, দুইবার ডিভোর্স হয়েছে। তারপরও কিউট বটগুলোর মত নতুন মুহূর্ত থাকবেই জেনে হাসি।”

“আমরিকায় যাবা আমার সাথে?”

“তোমার না বাচ্চা আছে, সেই বাচ্চার হট মা আছে। আমাকে কেন নিয়ে যেতে চাও?”

“তুমি জানো কেন।”

“ওয়ান সেক, ফলো মি।”

আমি টেবিলে বসে থাকবো। হাত ধরে উঠায়ে না নিয়ে গেলে আমার জ্যুস জমে না।

“আররে আজিব! হাসছো কেন? উঠে আসো না।”

“এসে নিয়ে যাও।”

যাক, ভালো হইল। রেস্টরুমে লিয়ার বালিশ বুকের মাঝখানে মাথা ঠেসে চেপে আরাম করে ঘুমাইতে পারবো কিছুক্ষণ। মেয়েটা ইন্টারকোর্সের সময় অযথা কথা কম বলে। শরীরের থিওরি বোঝানোতে ওর জুড়ি মেলা ভার।

“তুমি কেমন আছো, অনিম?”

“আহা, আজকে এত কথা বলতেছো কেন? ঠোঁট নাড়াইতে ইচ্ছা করতেছে না আমার।”

“তোমার ঠোঁটের উপর একটু পর আরো প্রেশার পড়বে!”

আনবিলিভেবল। জিহ্বা দিয়ে কিছু টেস্ট করবার শক্তি আজকে আর পাবো না। মেয়েটার হরমোনে এত্ত জোর!

“Do you love the smell?”

“কিছুটা।”

“কিছুটা? আমি আজকে অনেক প্রেপ নিয়ে আসছিলাম। তোমার এক্সপ্রেশন দেখে স্যাড হয়ে গেলাম।”

“লিয়া, আই স্টিল মিস হার।”

“তুমি কি জানো আমি কত ডিপ্রেসড?”

“জানি, সবার ডিপ্রেশনের কারণ আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।”

“অনিম সমস্যাটা কী তোমার?”

“কোনো সমস্যা ছিল না, ইদানিং হচ্ছে। সবাই সারাক্ষণ ডিপ্রেশনের কজ জানায়ে জানায়ে মাথা শূন্য করে ফেলতেছে। সারাক্ষণ মানুষকে রিচ করার এত কি দরকার? কেউ নিজের ভেতরে থাকতে চায় না কেন? যাকেই দেখি সে নির্দ্বিধায় জানায় আমি জঘন্য অবস্থায় আছি। ভালো থাকবার জন্য তুমি কী কর, ব্লা ব্লা…। মন ব্যাপারটা এত যান্ত্রিক হয়ে গেছে যে চুপ করে থাকাটা আশীর্বাদ মনে হয়। ”

“ঠিক আছে আমি কিছু বলবো না। Wanna do it again?”

“হ্যাঁ, কিন্তু ওপাশের রুমে একটু পর সাইদ স্যার আসবেন।”

“জোরে মোন করতে দেখলে তুমি ঠেসে কিস করবা।”

“ঠোঁট এরপর খসে পড়ে যাবে।”

“যাক, আমার কি? আহ!”

হায়রে যৌনতা! তোমার আসলকে বিস্মৃত করে নকলের ছদ্মবেশে থাকার চাহিদা কখনও ফুরাবে না। 

“লিয়া, চল্লিশ মিনিট শেষ হয়ে গেছে। চল উঠি এবার।”

“হুম, একটা কফি বানিয়ে আনবে?”

“তুমি কাঁদতেছো কেন?”

“তোমার সাথে কোথাও যাব না অনিম !”

জানি না খুব রাফলি ট্রিট করছি কি না ওর শরীরকে। রাগ আর অরগ্যাজম একসাথে মিলে গেলে কী হয় আমি আসলেই জানি না। আচ্ছা অন্য কিছু কি হইতে পারে না? ওর কি অন্য কোনোভাবে পুরান ক্ষতগুলোর স্মৃতি মাথায় ভর করতে পারে না? আমি সবক্ষেত্রে মানুষকে মেট্রোপলিটনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে মিশিয়ে ফেলতে চাই কেন? মানুষ ফানুশ হবারও দাবি রাখে। লিয়ার মত অভাগাদেরও অন্য আলো গাঢ় রহস্যের ভেতর থেকে বের করে আনতে ইচ্ছা করে হয়তবা।

“লিয়া, আমি আজকে তোমার চুলের প্রেমে পড়ে গেছি।” লিয়া হাসে। বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না এমনভাবে হাসছে। 

“ অনিম, আমি ভালো আছি।”

দিন এভাবে যায়। ইচ্ছা করলে আমি বাসায় যেয়ে ভালো মুভি দেখতে পারতাম। ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেশ কিছু সুন্দর ছবি তুলতে পারতাম। আজকাল আঁকতে ইচ্ছা করে না। আঁকতে গেলে কড়া মৃত্যুর ঘ্রাণ নাকের ভেতরে ক্রমাগত লাফঝাঁপ দেয়। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে। আমার অজানা গল্পের রথে চাপতে ইচ্ছা করে। সেই মানুষগুলোকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা হয় যারা আমার মত একটা মৃত গহ্বর থেকে দুম করে চলে আসছিল। আমি তার কিছুই না করে রেস্টরুমে শুয়ে আছি। মুখে একটু পরপর ফালি করা আপেল পুরে ভাবতেছি, এই অন্তের সীমানা কোথায়?

ছেলেবেলার স্মৃতি বারবার সাজানো গল্পের মত চোখের কোণে ঝাপসা সেজে মৃত পুকুর হয়ে ভাসে । আমার বিশ্বাসে, অবিশ্বাসের চোয়াল লোহার শিক বেঁধে জানায়, তোমার প্রাণ নামের জরা পাখি প্রথমে মৃত্যুতে আছর করে ডুকরে কাঁদছিল। পাখির জীবন নামের আরেকটা অবশিষ্ট পোর্টালে আমার স্থিতির কারণ ভয়ংকর কিন্তু উপকারি। মরতে যাওয়া মানুষদের কামেল ঈশ্বরদের গ্রেটার আউটকামের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করা অনন্ত নিশীথের ঠিক করে দেয়া দায়িত্ব। নিজেকে ভালোবাসতে চাওয়া তাই ভীষণ বোকামি। কেউ এসে বলে না কিন্তু আমি জানি, ভালোলাগা অবজেক্টে রূপান্তরিত হওয়াতে আমার বিশেষ বারণ আছে। সব জানার পর আমি শুধু মরে যেতে চাই। দড়িতে ঝুলে নিঃশ্বাসকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর বেঁধে ফেলতে আমার অরুচি আসে না। সবকিছু শেষ হবে। দাদাজানের বায়োস্কোপে সুপ্রাচীন ডিনএ আরএনএর কারখানা ফাঁসের দড়িতে শ্বাসনালীর নাচানাচিতে আটকে যাবে। পৈত্রিক কষ্টগুলো রাজামুক্ত হয়ে মিছিল করবে। ওরা আঁচ করতে পারে নিজেদের আনন্দ। তাই আমার ঘুমন্ত লোমগুলো জেগে যায়।

কে জানি কল করছে। “ হ্যালো ফাইজা।”

“অনিম, তুমি কোথায়? একটু এসে দেখা কর।”

“কেন?”

“আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। সবকিছু এত পানসে কেন?”

“আমি জানি, কিন্তু তুমি কারণটা পাত্তা দিবা না।”

“আমার মনে হচ্ছে, পুরো পৃথিবীটাতে কেউ মন খারাপের সুপার পাওয়ারফুল বম্ব রেখে চলে গেছে। কোথায় ফাটছে আমরা কেউ জানি না। জানলে নিশ্চয়ই ফিউজ করতে পারতাম।”

“ফাইজা, তুমি চাইলে রেস্টরুমে আসতে পার। আমি ফোরটিফোরথে আছি।”

“স্যাপি ফিলিং হচ্ছে, Now I feel more like getting laid and have some good wine.Yeah....I’m coming.” 

ডিস্টোপিয়ান কারকাস। তোমার চিরস্থায়ী বিচিত্র সেলুকাস। লও ঠ্যালা,  নাওয়ে বোন্দা ভইরা। 

“অনিম, আমি চাই তোমার ভালো লাগুক। প্রটেকশন আছে না কি সাথে নিয়ে আসবো?”

রাতের খাবার খেয়ে ফাঁসিতে ঝুলবো। আশা করছি আজ আমার মৃত্যু হবে। চোখ খুলে পাগলের কারাগারে আর বন্দীদশায় থাকতে হবে না। সম্রাট আজকে বাঁচাইতে আসিস না ভাই। সুন্দর করে মরতে দিস ভাই, শেষ অনুরোধ।

De-construction Phase -3

১৬.

“তুমি কে?”

“রোদেলা।”

“হাহা, ভুল বলেছো। আবার বলো তুমি কে?”

“রোদেলা।”

“তাহলে অবনী কে?”

 আমি জানি না।”

“অবশ্যই জানো, সবাই জানে তুমি অবনী। ভুল বলছো কেন? নিজেকে কেউ অন্য মানুষ ভাবতে পারে?”

“না।”

“তাহলে?”

“সে জন্যই বলছি আমি রোদেলা। ভুল মানুষ হিসাবে নিজেকে ভাবছি না।”

“তুমি কোথায় আটকে আছো তুমি জানো?”

“আমি যা দেখছি সেখানেই আটকে আছি।”

“তুমি কি দেখছো?”

“ওপালের ঘর, মহাবিশ্বের আদিম গুহা। গুহার মাঝে তুলোর মত বরফ জমিয়ে বানানো হিম বিছানা।”

“আর?”

“হুবহু আমার স্বরে কথা বলে এমন একটা মেয়ে, যাকে আমি চিনি না। তবে সে খুবই সুন্দর। সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর দেবী। দেবী বলছি কারণ মেয়েরা এত সুন্দর হয় না।”

“তুমি কি কিছু সাথে করে নিয়ে এসেছ?”

“না, সময় পাই নাই।”

“এখানে আসতে চেয়েছিলে?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার কি ধারণা তুমি বেঁচে আছো?”

“হ্যাঁ, আচ্ছা, মরে গেলে কি কারও পরিচয় বদলে যায়?”

“আমি বলতে পারবো না। কারণ আমার মৃত্যু হবে না।”

“আমি দেবীদের ঘরে কি করছি?”

“কী করবে ঠিক করতে পারো। তোমাকে অনেকেই দেখতে এসেছে।” 

“কেন?”

“ কারণ তুমি মানুষ।”

“বাহ! আমি এত দামি, জানতাম না। তোমাদের ঘরে আয়না নাই কেন? বাতি আছে, জোনাকি আছে। আঁকবার জন্য বড় কাগজ আছে, আচ্ছা তোমরা কি আঁকো?”

“কেবল গুছিয়ে উঠছি। এই ঘরটা তোমার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আমাদের কাগজের দরকার হয় না। তুমি কিছু লেখার বা আঁকার প্রয়োজন মনে করলে ব্যবহার করতে পারো।”

“তোমাকে দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে, তুমি আমার মত দেখতে কিন্তু আরও অসহ্য সুন্দর !”

“তুমি যে কি বলো না! আমার উলটা তোমাকে দেখে ঈর্ষা হয়েছিল। সরাসরি আসতে চাইতে না, তাই গোপনে নিয়ে আসতে হল।”

“এটা কি মেটাফিজিসিস্টদের চেম্বার? তোমরা কি আমাকে পরীক্ষা করছো? আমি জানতাম ওদেরকে না কি কেউ চোখে দেখে নাই।”

“নাহ, এটা কারও চেম্বার না। তোমার কি আয়না প্রয়োজন?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা রেখে যাবো। কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলতে হবে। নতুন পরিচয়ে নিজেকে জানতে হবে।”

“তার মানে? আয়না আমাকে অন্য কিছু দেখাবে? আর আমি ভুল মানুষকে দেখবো?”

“ভুলই শুদ্ধ, তবে তোমাকে আমরা বিকল্প দেবো। তুমি নিজে শুদ্ধ কিন্তু চারপাশ অশুদ্ধ দেখতে চাও? না কি নিজে অশুদ্ধ চারপাশ শুদ্ধ দেখতে চাও?”

“নিজে শুদ্ধ কিন্তু চারপাশ অশুদ্ধ।”

“তুমি কি অনিম নামে কাউকে চেন?”

“না, সে কে?”

“একটা ছেলে। তোমার মতো বিকল্প খুঁজে মরতে বসেছিল।”

“আমি কি মরে যাব?”

“হ্যাঁ, যদি না তুমি যা দেখছ তাই লিখে রাখ বা এঁকে রাখ।”

“তার প্রয়োজন কি?”

“সেসব ঘটনা তোমাকে কারও না কারও কাছে বাঁচিয়ে রাখবে।”

“আমার কিছু কথা জমা হয়েছে। ঠিক করেছি, ঐ ছেলেটার জন্য কিছু একটা আঁকবো।”

“কি আশ্চর্য একটা মেয়ে তুমি! কি আশ্চর্য দুজন মানুষ তোমরা!”

“কেন?”

“কিছু না। তুমি ঘুমুবে? ঘুম পাড়িয়ে দেই?”

“না, আমার কান্না পাচ্ছে। আমি কিছু মনে করতে পারছি না। খালি ঐ ছেলেটার কথা মনে হচ্ছে।”

“ঘুম থেকে উঠে আর কান্না পাবে না। আমি আছি এখানে।”

“তুমি মিথ্যা বলেছিলে। এটা মেটাফিজিসিস্টদের সেশন, নিশ্চয়ই আমার মাথায় কিছু হচ্ছে।”

“তুমি কষ্ট পাচ্ছো, ঘুমিয়ে পড়ো। কালকে ছবি আঁকবে। আমরা সবাই তোমার সুন্দর কল্পনার জন্য অপেক্ষা করবো। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“তোমার নামটা আবার বলবে?”

“অবনী।”

“খুব সুন্দর একটা মেয়ে তুমি। ঘুমাও এবার।”

“ধন্যবাদ অবনী।”

“আমরা দুজন একই দেবী।”

ঘুম থেকে উঠবার পর কাউকে দেখছি না। তবে আশপাশে অজস্র মিহি কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। আমি ছবি আঁকছি। সুন্দর কিন্তু অদ্ভুত সব অবয়ব মাথায় ঘুরছিল, এঁকে ফেলছি। খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। সাথে অজস্র বিস্ময় ভরা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। আমার ছবিতে তেমন কিছু কী আছে? থাকতে পারে। ফুলের মতো মহা বিস্ময়কর দেবযানে চড়ছে এমন কিছু মানুষ। প্রচণ্ড কালো শূন্য থেকে আলোতে চড়ে সেই মহারথের দিকে এগোচ্ছে একটা শিশু দেবতা আর তার ডানার লক্ষ লক্ষ পালক। শিশুটা বোধহয় এসব পালক দিয়ে দেবযান ঢেকে দিতে চায়। নিজের ডানাযোগে সামনের দৃশ্যপট পাল্টে ফেলতে চায়। অন্তত আমার ছবি দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে। আড়ালের কণ্ঠস্বরগুলো কি ভীষণ খুশি। অনেকগুলো বাঁশির সুর একসাথে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেসে আসলে যেমনটা শুনতে পাওয়ার কথা ওদের স্বর থেকে ঠিক তেমনই কিছু ভেসে আসছিল। এটা নতুন কিছু তৈরি হবার সুর। আমার বেশ লাগছে।

আমি গুহা থেকে বের হতে চাই। ছবিটা গুহার বাইরের সত্তাদের জন্য। বাহ! পথ বাড়ানোর পর কী দেখলাম। চুনিপাথর ডোবা পানির রাস্তা, এই ছোট চুনিগুলোর ফাঁকের ভেতর নিশ্চয়ই ফড়িং এর মত ছোট মাছেরা প্রার্থনা করছে। না হলে ফাঁকে ফাঁকে আলো জ্বলে থাকবে কেন? ঐ তো, কি অদ্ভুত সুন্দর! ঝাঁকে ঝাঁকে মাছগুলো ছুটে যাচ্ছে। ওরা বোধহয় শরীরে আলো জমিয়ে রাখতে পারে। আমার ভাগ্য ভালো তোমরা ছিলে। নাহলে গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেতাম না। আচ্ছা, এদের শরীরের এই আলোর রংটা কী? উজ্জ্বল হলুদ না কি কটকটে সবুজ, হবে কিছু একটা। সামনে মঞ্চের মত উঁচু কিছু একটা দৃশ্যমান, নিচে নিশ্চয়ই অনেকেই রয়েছে। বলা হয়েছিল আমাকে সবাই দেখতে আসবে। এতক্ষণ ওদের গলা আর বাদ্যযন্ত্রই শুনছিলাম তাহলে। ইশ! এত পাতলা একটা কাপড় গায়ে। সবকিছু দেখা যাচ্ছে। অবনীকে বললে নিশ্চয়ই সুন্দর করে সাজিয়ে পাঠাতো আমাকে।

“দুর্দান্ত!”

“অপরূপ!”

“কি সুন্দর সৃষ্টি!”

“তুমি কোন গ্রহের হে মানবী !”

“তোমাকে কে কল্পনা করেছে?”

“যেন ‘ডি’ তে স্বাগতম হে মাননীয়া। আমরা আপনার কল্পনাদাসী। বলুন কী করতে পারি?”

এত এত প্রশ্ন, এত এত সম্ভাষণ, এত এত জিজ্ঞাসু, এত এত পিপাসা! আমি কীভাবে সামলাবো? এমন সৌজন্যে আমি মোটেও অভ্যস্ত না। সবাই চেয়ে আছে। ওদেরকে আমার কিছু বলতেই হবে? হ্যাঁ, ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কী বলবো? আশ্চর্য লাগছে ওদের রূপ দেখে। ক্ষণে ক্ষণে আলোর রং ধরে পাল্টে যাচ্ছে। না কি আমার মাথায় কোনো গণ্ডগোল হল? এটা কি সম্ভব, যে আমি লিম্বোতে বাঁধা পড়ে গেছি। তাই সবকিছু বিক্ষিপ্ত লাগছে? মনে হচ্ছে, সবকিছু একসাথে ঘটতে যেয়ে কোনো অদৃশ্য তারে কেটে কেটে যাচ্ছে। ঝুলে যাচ্ছে। ভাবতে বিদঘুটে লাগলেও  চোখে বিস্ময়কর লাগছে। কাউকে আসল মনে হচ্ছে না। আমি কোথায় আছি?

“শিশুটা কে অবনী?”

“আমি চিনি না, তোমরা কি আমার জন্য খুঁজে বের করতে পারবে? ও কোথায় আছে জানতে পারবে?” 

“অবনী, এভাবে কথা বলে না। অবনী এভাবে কথা বলে না। অবনী এভাবে কথা বলে না। অবনী এভাবে কথা বলে না। অবনী এভাবে কথা বলে না। অবনী এভাবে কথা বলে না।”

মাথা ফেটে যাচ্ছে। ওরা এমন করছে কেন? “তোমরা কি আমার কথা শুনবে দয়া করে? আমার এই ছেলেটার পরিচয় জানা খুব দরকার। আমার ধারণা ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্লিজ, একটু শুনবে।”

“আমাদের নিষেধ আছে। আমাদের নিষেধ আছে। আমাদের নিষেধ আছে। আমাদের নিষেধ আছে।” 

“অবনী, তুমি কোথায়? তুমি কি এখানে আছো?”

“তুমিই অবনী। তুমিই অবনী। তুমিই অবনী। তুমিই অবনী।”

“হ্যাঁ আমি অবনী। উফ! তোমরা চলে যাও। কি বিকৃত স্বরে কথা বলছো? আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে!”

আমি জলপ্রপাতের গুহায় বসে আছি, নক্ষত্রস্নান করছি। জলফোটা ছিটে এসে গুহার পথটা ভাসিয়ে ফেলছে। মাঝে মাঝে কিছু চুনিপাথর আর ফড়িং এর মত মাছ এসে ভেতরে পড়ছে। কতকাল ধরে ঝর্ণার ফাঁকে উঁকি দিয়ে আমি তারার খসে পড়া দেখছি হিসাব নেই। মাঝে মাঝে অবনী এসে পাশে আমার মত তারা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?”

আমি জানি না ওর স্মৃতিতে কোনো ঝামেলা আছে কি না, তারপরও হয়ত ওকে খুশি করবার জন্যই বলি, “আমি অবনী।”

“তোমার ট্রায়াল শেষ হয়েছে, অনিম। এখন সিম্যুলেটর খুলে রাখতে পারো। তুমি চাইলে আমি সাহায্য করবো।”

“না, আমি পারবো সমস্যা নাই।”

“তোমার কি মৃত্যু দেখতে ইচ্ছে হয়?”

“না, আমি জলপ্রপাতের গুহায় বসে তারা দেখতে চাই।”

এতদিন অন্ধকারের ভেতরে থেকে এখন আলো সহ্য করতে পারতেছি না। এত তীব্র সাদা আলো! ফ্লোরোসেন্টের চোখ ধরানো চাকচিক্য। 

“আমি কতদিন এভাবে ছিলাম?”

“জানতে চেও না এখন। আমার বলতে ইচ্ছা করছে না। তোমার জন্য আমাকেও আটকে থাকতে হয়েছে। তোমার বয়স বাড়েনি, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। মেটাফিজিসিস্টরা এর চেয়ে ভালো কিছু আমাদের জন্য করতে পারতেন না। তারা ভেবেছিল তুমি লিম্বো নিতে পারবে না, বহাল তবিয়তে আছো। বসরা তোমাকে দেখে চমকাতে পারেন। ” 

“আমার ট্রায়াল কি শেষ?”

“দুর্ভাগ্যজনক কারণে ‘না’। তোমার রেজাল্টটা তদের কাছে পাঠানোর পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।” 

“হাহাহা !”

“হাসছ কেন?”

“কিছু না এমনিতেই। আসলে ভাবতেছিলাম মানুষের নিজের কেন কোনো অধিকার নাই। বোধহয় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

“কিছু হয়নি তোমার, তুমি ঠিক আছো। তবে শাস্তি থেকে পার পাবে কি না জানি না।”

“শেষ শাস্তি কি আবার লিম্বোতে একটা দেবীর সাথে সময়ের ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত আটকে থাকা?”

“তোমার কষ্টের স্মৃতির কারণ ভালো উদ্দেশ্যে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। আমরা মনে করছি এটা তোমার জন্য ভালো। সুইসাইড করে অন্যদের জীবন নষ্ট করার চাইতে এই ব্যবস্থা উপকারী। মস্তিষ্ক শীতল থাকে, আইসোলেটেড থাকে। বাইরের পৃথিবীর সাথে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সদিচ্ছা যোগ হয়। ধীরে ধীরে তুমি ভুলে যাওয়াটাকে স্বাভাবিক মনে করবে। আমাদের সব ব্যবস্থা নেয়া শেষ।”

“যদি ইচ্ছা না হয়, তাহলে?”

“আমি তোমার প্রতিটা কথা লিখে রাখছি। কি থেকে কি হবে, তুমি অবশ্যই জানতে পারবে।”

“ও।”

“এখন বিদায় বন্ধু। ঝুড়িতে খাবার রাখা আছে।”

“ধন্যবাদ, যদিও জানি না আমার রুচি ফেরত আসছে কি না !”

“চেষ্টা করতে হবে। আমি উঠছি অনিম।”

১৭.

সাদা একটা ঘরে তিনদিন যাবত বন্দী। আমাকে কেউ দেখতে আসে নাই। আমি অবশ্য রোগী না, অপরাধী। তাই জ্ঞান ফিরে প্রিয়জনদের দেখতে চাইবার আকুলতায় সার্থকতা নাই। এইখানে ক্ষমতা দেখাতে পারতেছি না। পারলে জানতে পারতাম আমাকে নিয়ে এই মেটাভিলেনদের প্ল্যান কী। কোনো এক ধরনের ফোর্স ফিল্ডের কারণে মনোযোগ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফাঁকা রুম, কোন সঙ্গী নাই। একসময় একলা থাকতে চাইতাম। এখন যা পারতেছি। কিন্তু আমার একলা অবস্থানে কারও সিদ্ধান্ত নির্ভর করতেছে। পা নাচায়ে সবকিছু চিন্তা করে রক্তের চাপ বাড়াচ্ছি। কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ বেঁচে থাকা কী জানতে হবে আগে। মুশকিল ব্যাপার হলো কোনো খাতা কলম নাই, কোনো ডিভাইস নাই। সময় পুরোপুরি থমকে গেছে। নিদেনপক্ষে অস্তিত্ব অনুধাবনের জন্য অনুভূতি জড় করে সংরক্ষণ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা ছিল। আমি কি মানুষ না অন্যকিছু তা বোধ করি এখানে জানানোর কেউ নাই। এই কয়েকদিন এভাবে থেকে ভেতরে পরিবর্তন জন্ম নিল। একলা থাকবার কারণেই হয়তোবা। আপাতত এসব সংশয়ের ডালপালায় অন্য কিছু জানার অবকাশ নাই।

কোনো বস্তু কেন্দ্র করে ঘুরতেছি না। সূর্যের আলো এখানে পৌছায় না। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিভে যায় না। কেবল সাদা আলোর চোখ রাঙানি। সময় বুঝছি শরীরের মেকানিজম থেকে। দুপুরের আগে আমার কখনো বাথরুম পায় না। গোসলের সময় থেকে শুরু করে আমি নিজের জন্য সময় নির্ধারণ করে নিচ্ছি। একটা বাজে ব্যাপার হইল, প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম পায় না। সময় পিছায়ে তারপর ঘুমাচ্ছি। আবার আচমকা ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে না। স্বপ্নের কথা কিচ্ছু মনে থাকে না। জানিই না আসলে স্বপ্ন দেখি কি না। নিজের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য জানতে আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মাচ্ছে। জেনে অযথা খারাপ লাগতেছে কেউ আমার জন্য জীবনের তাৎপর্য তৈরির চেষ্টায় নিবেদিত, যা আমি বেমালুম ভুলে গেছিলাম। শুরু থেকে সবকিছু ভেবে দেখতে হচ্ছে। জীবনের এত মোড় ঘুরে আসার পর, আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা হয় জানতে এখন কটা বাজে! ভাবলে অবাক হতে হয়। অবাক মানুষ নিছক কোনো ধারণার কাছে অসহায় একজন। আর অসহায় বোধ করলে মানুষের খিদে পায়। ঘরে একটা সুন্দর ঝুড়ি আছে। তিনদিনে বিশটা আপেল শেষ করলাম, এই অবাক অসহায়ত্বে আর সাদা আলোর চোখ রাঙানিতে। ওরা অবশ্য আমার ঘুমানোর কালে রান্না করা খাবার প্যাকেটে পুরে রেখে যাচ্ছে। অবাক হবার প্যারামিটার বেড়ে গেলে ধন্যবাদান্তে মুখে তুলে দেখা যায় কি না ভেবে দেখব। খাবার গুলো পচে যাচ্ছে প্রায়। এই ঘরের প্রিজারভেশনের সিস্টেম ভালো না। ঘুম উপযোগী কিন্তু মানুষ উপযোগী না।

ঘরে একটা লুকানো দরজা আছে। জানি সেটা কোন দিকে। নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে ইচ্ছা হয় না। আমি চাই কেউ আমার জন্য অন্তত আসুক। বাইরের পৃথিবীটা এখন কেমন আমি জানি না। মুখোমুখি হতে আমার ভয় কাজ করে। হাত ধরে কেউ বাইরে নিয়ে গেলে আমি জানতাম, আমি গুরুত্বপূর্ণ কেউ। কিছুটা হলেও আনন্দ কাজ করতো। অথচ কেউ প্রস্তুত করতে আসতেছে না দেখে, আমি তিনদিন মন খারাপ করে বসে আছি। অতীতের বিদেহী আত্নার বিবিধ শিকড়ের মারপ্যাঁচে বিছানার উপর বসে মাথা কাত করে ঝুলায়ে বসে ভাবতেছি। অদৃশ্য ফাঁস এখনও দণ্ডিত মস্তকে বিঁধে আছে। সুনিশ্চিত ভবিষ্যত আজকাল আমার সাথে কথা বলে না। শুধু বদ্ধমূল আকাঙ্ক্ষা থেকে মনে হচ্ছে মহা গুরুত্বপূর্ণ কোনো একজনের সাথে আজ সাক্ষাৎ ঘটবে। আপেক্ষিক অর্থে আমি একজন টাইম ট্র্যাভেলার কি না সে ছদ্মবেশি ভাবলেশহীন ভাষায় জানাতে আসবে।

আসে না, কেউ আসে না। বাইরে হচ্ছেটা কী? আমি জেনে আসব? আচ্ছা ভালো কথা, ওরা কি তাই চাচ্ছিল যে আমি কৌতূহলী হই। নিজ থেকে যোগাযোগের ক্ষেত্রফল বের করি? আর সবাই আমাকে হারাতে চায় কেন? আর আমিই বা জীবনের সাথে জিততে চাই কেন? সিম্যুলেটর থাকলে ভালো হইত। অবনী ঈশ্বরীদের পাশে বসে ঝর্নাস্নাত হয়ে আকাশে সেলাই করা নক্ষত্রের আলো দেখে সুন্দর সময় কাটাইতে পারতাম। আমি যাই, নতুন পৃথিবীটার ব্যাপারে একটু খোঁজ নিয়ে আসি, আর পারলে সিম্যুলেটর চেয়ে নিবো।

এতদিন বেজমেন্টে ছিলাম। পার্কিং লটের মত উঁচু নিচু ফ্লোরে চেক পোস্ট আকৃতির ঘরে একটা উদ্ভিদ প্রায় মানুষের মতন। পুরো জায়গাটার আবহই এমন। মনে হবে কেউ এসব বড় বড় সাদা চারকোণা টবে বীজের মতন মানুষ পুঁতে রাখছে। কাউকে এখনো পর্যন্ত দেখলাম না। উপরে যাবার সিঁড়ি খুঁজতে হবে কিংবা এলেভেটর পাইলেও চলে। বিশ মিটার দূরে সম্ভবত ওটা এলেভেটর, ক্যাপসুল আকৃতির যেহেতু। এদিকে খালি পায়ে হেঁটে জমে যাচ্ছি। ফ্লোরটা প্রচণ্ড ঠান্ডা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। পুরো জায়গাটায় কাঁচের কোনো আলামত নাই। নিজের চেহারা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল। দাঁড়ি বড় হয়ে মাঝ বুকের কাছাকাছি প্রায়। চেহারায় জোয়ান ঋষি ভাব আসবার কথা। কোনো অদ্ভুত কারণে চামড়া কুঁচকে যেয়ে মৃত্যুর আগাম প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে নাই। তাই নিজেকে তরতাজা মনে না হলেও এতটুকু জানি আমি বুড়া হই নাই। এখানে যারা থাকে তারা সবাই বোধহয় গন কেস। কারণ কাউকে পাহারা দেবার প্রয়োজনীয়তাটুকু কেউ ভেবে দেখে নাই।

সাদামাটা কিছু শব্দ কিংবা জীবনের গান শুনতে চেয়ে মনটা তৃষিত। মাটিতে জুতা ঘষা শব্দ, মেয়েদের রিনরিন হাসির শব্দ, গায়ের সুন্দর গন্ধ যা অনেক সময় স্বর্গের নির্মেঘ জঙ্গলের সুপ্ত নদীর কথা মনে করায়ে দেয়। ছোট বাচ্চাদের হুটোপুটি, কুকুরের কারও জন্য অপেক্ষায় ক্লান্ত শ্রান্ত ডাক। এই সুন্দর ঘটনাগুলো সাজানো জীবনের নিয়ামক। আমি কেন এসবে অসহ্য বোধ করতাম জানি না। এখন আমার জিজ্ঞাসা ওদের সাধারণ নিমিত্তে আটকায়ে গেছে। কৌতূহলে নিজের নিষ্করুণ প্রাণের স্থায়ী সূত্রের অংক কষা নাই। লে বাবা, বিশ মিটার দূরে মনে হচ্ছিল নতুন পৃথিবীর আগমনী এলেভেটরটা। আসলে কয়েক ক্রোশ দূরে। আমি কি ভুল মাপলাম? না কি অনেকদিন পর খোলা পরিবেশ দেখে চোখে গড়বড় লেগে গেল! হাঁটতেছি তো হাঁটতেছিই…

আমার কি হাঁটা শেষ হবে না? কতকাল হাঁটবো? “এই ভাই, কেউ আছেন? কোনো বোন আমায় শুনবেন দয়া করে!” এইতো আর একটু, কিন্তু ঠান্ডায় পা পিচের সাথে লেগে যাচ্ছে। দৌড়াতে হবে, ভয়ংকর জোরে দৌড়াতে হবে……

আহ! পারছি, ওউফ! খোদা। পায়ের আঙুল ফুলে সুদর্শন বোলতার আকার ধারণ করছে। এত নিষ্ঠুর কেন এলেভেটরটা? তিনবার চাপার পরও কাজ করতেছে না। ধ্যাত !

যাক, খুলছে লিফটটা শেষমেশ। আর যথাস্থানে কেউ থাকে না কেন? বাটনগুলোয় এমন আজগুবি ব্যবস্থার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এগুলো কী? অড শিফট সিকোয়েন্স? মানে অনেকটা ভেহিকেল চালানোর মত নিজে চালিয়ে পথ বের করতে হবে! এমন শিশুসুলভ নাটক করবার কী দরকার? ০ ০ ১ ০ ১ ১ ১ ০, গিয়ারটা যথেষ্ট ভারি, প্রথমঘরে ধরে মনে হইছিল পারবো না। কোনোরকমে পারলাম। এবার নতুন পৃথিবী দেখার পালা! অনেকদিন পর একটু আনন্দ হচ্ছে।

ভোর হবে হবে ভাব। এজন্যই বোধহয় কাউকে খুঁজে পাই নাই। অন্যদের চিন্তা করে লাভ কি! আমি নিজে কতদিন পর সূর্যোদয় দেখতেছি! লাউঞ্জে বসে দুই ঘণ্টা কাঁচের দেয়ালের সোনালি বিচ্ছুরণ মুখে মাখবো। অনিম তোমার শুভ মুক্তি ঘটলো। মাথায় এক রাজ্যের গান এসে জড় হচ্ছে। কোন গানটা গেয়ে সবার ঘুম ভাঙাবো? আগে নিজের মনকে তুষ্ট করি। পরে লা লা লা করে গেয়ে হেঁটে সবার ঘুম ভাঙানো যাবে।

“লা লা লালা, লা লা লা। সবাই উঠে পড়ুন, পাগল চলে আসছে আপনাদের জাগাতে। লা লা লা।” 

“ভাই আপনি কে? ওয়ার্ডের ড্রেস পড়ে আছেন?”

“বুড়ো বাবা, আমি অনিম। জান মুখ ধুয়ে আমার জন্য কড়া করে এক কাপ চা নিয়ে আসেন।”

“এ্যাঁ।”

বুড়োর অমুল্য হাসি। সুখের আসামি দেখে না বোধহয়। আশি বচ্ছরের মত ঠোঁটে কোমল স্নেহ আর খুশির হাসি লেপ্টে আছে। সকালটা এর চাইতে গভীরভাবে শুরু হইতে পারত না।

“আপনি আমাকে আগে দেখেন নাই? আমি পনেরো বছর আগে এখানে প্রথম আসি।” 

“সেদিনের ঘটনা মনে থাকে না বাবা! পনের বছর তো মেলা সময় !”

“আপনার ভিলেন বসরা কখন আসেন?”

“হা হা । বাবা, তারা না থাকলে তুমি সুস্থ হতে পারতে না।”

“আপনাকে আরেকটু হাসাই। এবার হাসলেই নিচের পাটির দাঁতটা খুলে টেবিলে পড়বে।”

“হাহাহা, অনেকদিন পর এভাবে হাসছি। আসলে তো কেউ আমার সাথে কথাই বলে না।”

“আপনি কি ওদের কেইস হয়ে এসছিলেন?”

“হ্যাঁ, মেয়ের জামাইকে খুন করে এখানে আসছি। একসময় সবাইকে মেরে ফেলতে চাইতাম। সবাই এত ন্যাকা, ভাঁড়ের মত ভান ধরে… আমি নকল মানুষ সহ্য করতে পারতাম না। এই মেটাফিজিসিস্টরা আমাকে পুরোপুরি ঠিক করে দিলো।” 

“আপনার এখানে আসবার কারণের সাথে আমার পুরোপুরি না হলেও কিছুটা মিল আছে।”

“মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি, মিল তো থাকবেই, হাহা।”

“পিওনের চাকরি করতেছেন কত বছর?”

“এই তো সামনের মাসে চব্বিশ বছর হবে।”

“আরে দুই যুগপুর্তি তো বিশাল ব্যাপার। কেক কাটবেন না?”

“হাহা !”

“কাক্কু দাঁত কিন্তু পড়লো বলে!” 

সাধারণত উইস্টেরিয়া গাছ বাউন্ডারি দেয়ালে দেখা যায়। এই লোক না মহিলা জানি না, এর চেম্বারের দেয়াল জুড়ে এই গাছ। অসম্ভব সুন্দর আইডিয়া।

“আপনি এখানে কীভাবে এসেছেন মনে আছে?”

“অজ্ঞান অবস্থায়।”

“অজ্ঞান হবার কারণ কি যুক্তিযুক্ত মনে হয় এখন?”

“বলতে পারি না, বের হলে বুঝতে পারবো। ভালো অর্থে বা ভাবুক অর্থে বললাম। দয়া করে অন্য অর্থ দাঁড় করাবেন না।”

“হুম।”

“আপনার অপরাধ কী আপনি জানেন?”

“হ্যাঁ।” ভদ্রলোক বা মহিলা কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেছেন। তার চোখ হালকা নীল। চোখ ছাড়া পরিষ্কার ভাবে অন্য কিছু বুঝবার উপায় নাই। সমগ্র মুখে মেকআপ। গায়ে ফিটেড ওয়েস্ট কোট আর ফুল হাতা শার্ট। আমার তার বুকের দিকে তাকাইতে কেন জানি প্রচণ্ড ইচ্ছা হইতেছে। ঢাউস বুক না তাকাইলেও চোখে ধরা পরে। কিন্তু সাজসজ্জা দেখে ধারণা করছিলাম বুকের পাশটা একটু উঁচু হয়ে থাকবে। নিতান্তই অভদ্রতা হবে দেখে চোখ দিচ্ছি না।

“আপনার ফুপুর মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?”

“ধর্ষণের পর মৃত্যু।”

“আপনার অবস্থান কী সেখানে?’

“আপনার জানেন যা তা জিজ্ঞেস করতেছেন কেন?”

“আমাদের মনে হয় আপনি কাজটা করেছেন। আপনার নিজের স্মৃতি আপনার বিপক্ষে। আপনার আত্নীয়রা কেউ বিশ্বাস করবে না দেখে মামলা করেন নাই। এখানে এসেছেন, সবাই কেঁচো খুঁড়তে যেয়ে সাপ পেয়ে গেল। ”

“আপনারা ফুপুর স্মৃতি দেখছেন বা আমার ট্রমা থেকে ইমপ্ল্যান্ট হওয়া ফেইক মেমোরিস। আমি একজন সাইকিক। আমার কিছু ক্ষমতা আছে। আসলে আপনাদের জঘন্য নকল দুনিয়াতে আমি এইভাবেই জন্মাইছিলাম। আবার ফুপুর ঘটনাটা নিয়ে কিছু বলতে এখন আমার ঘেন্না লাগতেছে।”

“ভালো কথা, আপনি সাইকিক। কিন্তু সেরকম কোনো স্টেটমেন্ট কাউকে কখনও দেন নাই। আমাদের কাছে আরও কিছু স্মৃতির প্রমাণ আছে, আপনি ডিলিউশনাল, ম্যানুপুলেটিভ। নেক্রফিলিয়ার অবৈধ প্র্যাকটিসের প্রতি ইন্টারেস্টেড ছিলেন। আমাদের কাছ থেকে কেউ কিছু লুকাতে পারে না মিস্টার।”

“এই গ্রহে সুইসাইড নিষিদ্ধ কেন? বাম পাশে হৃৎপিন্ড নিয়ে জন্মালে আপনাদের সমস্যা কী?”

“কে বলেছে কি সমস্যা! কোনো সমস্যা নেই তো। এসব আজগুবি তত্ত্ব কোথায় পেলেন?”

“আপনার সময় আছে? সময় থাকলে যারা খুব অদ্ভুত ভাবে বাম দিকে হৃৎপিন্ড থাকবার কারণে গুম হয়ে গেল তাদের নাম একে একে জানাতাম।”

“হতে পারে, কিছু মানুষ হারিয়ে গেছে। কাকতালের সহজ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মেলাতে যান দেখবেন মিলে যাচ্ছে। আর আমরা সবার খবর তো রাখতে পারবো না।”

“প্রতিটা কথা মিথ্যা।”

“আপনার মাথা বড় বড় ধাঁধার জন্য তৈরি হয় নাই অনিম। আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন ভালো থাকবেন।”

“আমি জানি আমি কে। কোথা থেকে আসছি। জানেন বোধহয় তারপরও বলি আরেকটা মৃত বাস্তবতা থেকে আমার জন্ম। হাহা! আপনাদের কাছ থেকে না কি কিছু লুকায়ে লাভ নাই। পনের বছর আমাকে লিম্বোর ধাঁধাঁয় আটকায়ে অসুস্থ মাথার ধাঁধারুপী একেকটা ইনফরমেশন একস্ট্র্যাক্ট করে ফেলছেন। আমার বিশ্বাসও করতে হবে আপনাদের কথা! আপনারা এসব সো কলড স্মৃতির প্রমাণ বের করলেন কী করে? আন্দাজে ঢিল ছুড়তেছিলেন, তাই না? শুনেন, এই গ্রহে আমি মানুষের মত জীবিত মৃত দেখতে সবাইকে পোজেস করতে পারি। চাইলে আপনাকে পোজেস করে দেখাতে পারব।”

“আমি এখানে নাই। আমার এই রূপ আসল রূপ না। কথাগুলো একটা এ্যালগরিদমে সেজে আপনার কাছে পৌঁছাচ্ছে। আপনি শুধুই একটা প্রজেকশন দেখছেন। তারপর আপনার গল্প ধরুন, ভালই লাগছে আপনার গল্প।”

“আর কিছু বলার নাই।”

“তবে হ্যাঁ, কিছু কথা আপনি সত্যি বলেছেন। যেমন আপনার সাইকিক এবিলিটি আছে। কিন্তু পরবর্তী ধাপে অর্থাৎ মেটাফিজিসিস্ট কেন হতে চান নাই আমরা জানতে চাই। যাই হোক, একটা শেষ ট্রায়ালের ব্যবস্থা আমরা আপনার জন্য রেখেছি। সেই কথায় পরে আসবো। তার আগে আমাদের আপনার নেক্রফিলিয়ার স্ট্যান্ড সম্পর্কে পরিষ্কার করবেন? জানার খুব কৌতূহল ছিল।” 

“শেষ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে মৃতের আত্না শরীর ছেড়ে আলাদা হয়ে যায় কিন্তু মরে যায় না। বেঁচে থাকে। তাই ওদের স্বাদ আহ্লাদ থাকে, পুনর্জীবনের বাসনা থাকে। আমি শুধু তাদের কথা শুনতাম, আর কিছু না। আর প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে আমি মেটাফিজিসিস্ট হইতে চাই নাই কারণ এরা কন্সপিরেটর। এই বিচ্ছিরিমত সাইকিক সায়েন্টিস্ট গুলো জীবিত মৃত সবার জন্য নিজেদের গ্র্যান্ড স্কিম ঠিক করে রাখে। আমার কৌতূহল হতে পারে জঘন্য মানুষের মতো। কিন্তু একজন ভালো অথবা সাধারণ মানুষের মন নিয়ে মরতে চাইছিলাম। আপনাদের কেন যেন সবখানেই আপত্তি। এই জীবন আমার প্রাপ্য না। আমি ভুল পৃথিবীতে চলে আসছি।”

“ভুল পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার সুন্দর কারণ থাকতে পারে।”

“হাহা।”

“রোদেলা কে জানেন?”

“না। কে?”

আমি রোদেলার ফাউন্টেন ট্রির সামনে দাঁড়ায়ে আছি। সাইকিক ক্ষমতা ভুলভাবে খাটাইছি দেখে শেষ ট্রায়াল দিতে হচ্ছে। এরা 'উল্টো-মানুষদের' কানেক্টোমের সাথে গাছের মাইসেলিয়াম জুড়ে দেয়। ওরা না কি কখনও মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারতো না। তাই এই মেজাজ খারাপ করা ব্যবস্থায় বেঁচে আছে, গাছের আকড় ধরে। মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা বিন্দু থেকে শক্তি জড় হয়ে হাতের তরঙ্গ বেয়ে এই গাছটার শিকড়ে চলে যাচ্ছে। মৃত্যু হতে পারে আমার, কিন্তু তাতে গাছটা আরও অনেক বছরের প্রাণ পেয়ে যাবে। সম্ভবত লক্ষ বছরের। মানুষ একসময় উদ্ভিদের সাথে মিশে যায় দেখে ব্যাপারটা একেবারে খারাপ লাগতেছে না। কিন্তু যার প্রাণ আছেই তার অতিরিক্ত প্রাণের কিবা দরকার! জানি না, তবে এই মেয়েটাকে আমি প্রেমিকা ভেবে নিবো। কোনো ক্ষতি হবে না। আমার নিঃশেষিত পজিটিভ অরা সমস্তটুকু এই গাছটার প্রতিটা কোষে বেগুনি ক্রিস্টালের মত আলো নিয়ে জ্বলবে। হ্যাঁ, কিছুটা তো এখনই জ্বলতেছে। জল্লাদেরা পিছনে উদাস দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে, আমার দুই পায়ে লোহার শেকল ধরে। ওরা কি আলাদা কিছু জানে? এসব বাদ দেই, এত সুন্দর একটা ঘটনা দেখে ওদের মন ভালো হয় না কেন?

     


 

“The First Man Who Rejects His Prophecy”

১৮.

আমি অমর, বায়োলজিক্যালি। টেলোমেয়াজ এনজাইম আমার শরীরের সব স্থান-উপস্থানে একটিভ। মেটাফিজিসিস্টরা এসবের সবই জানতো। ওরা বলল আমার আত্না চিরস্থায়ী, তা কারটা না? আমি বুঝি না একটা গ্রহ সারাজীবন ধরে একটা মানুষকে পালবে কেন? হাজার-কোটি বছর ধরে একটা সৃষ্টি কি এমন  কাজে আসবে? মহাশূন্যের কাজ অন্ধকারের আকর্ষণ ধরে রাখা। নক্ষত্রের কাজ কী? আলো দিতে দিতে একদিন ধ্বংস হয়ে অমরদের জন্য নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা। একদিন সূর্যের ও আমার মতো মানুষদের প্রতি ঘেন্না ধরে যাবে। এইদিকে আমি ও বুড়ো শয়তান হয়ে স্পেসশিপে রাজনীতি করে মহাকাশে ঘুরতে চাই না। আসলে অন্তিম ঘুমের জন্য কেইবা অপেক্ষা করে না? সামনে যে পুঁচকে মেয়েটা বসে আছে ও আমার জেনোমের স্যাম্পল এনকোড করে অনেকের মত নিজে সারাজীবন বাঁচতে চায় কেন?

“তুমি সারাজীবন বাঁচতে চাও কেন?” মেয়েটা হাসতেছে।

“সমস্ত পৃথিবীর প্রতিটা ইঞ্চিতে পায়ের ছাপ, নিঃশ্বাসের ঘ্রাণ রাখতে পারবো, তাই।”

“তুমি কি হাজার বছর কুমারী থাকতে পারবা?”

“এই প্রশ্ন কেন?” আমি বোধহয় তাকে রাগায়ে দিলাম।

“মনের কৌতূহল, কোনো পুরুষতান্ত্রিক বাসনা থেকে আসে নাই প্রশ্নটা। কোনো ছেলেকে পাইলেও আমি এই প্রশ্নটা করতাম।”

“আপনি অদ্ভুত মানুষ। উত্তর হচ্ছে না। এই জাতীয় খেয়াল আমি পাত্তা দেই না। আচ্ছা, আমাদের যথেষ্ট স্যাম্পল যোগাড় করা হয়ে গেছে। আপনি চাইলে আমি চলে যেতে পারি। ”

“আমি চাই তুমি আমার সাথে কদিন থাক। পৃথিবীর প্রথম অমর মানুষের সাথে কিছুদিন কাটানোর ইতিহাস চিরস্নেহে স্মরণ করতে পারবা। তোমার কি মনে হয় না আমি সঙ্গী হিসেবে আকর্ষণীয়?”

“আমি সাথে করে জামা কাপড় আনিনি।”

“এটা মহাকালের জন্য অতি তুচ্ছ একটা ঘটনা। আমরা কাপড় ছাড়াই থাকব, আদিম মানুষের মত। আমার গুহাটা তোমার পছন্দ হয়ে যাবে।”

“তা অবশ্য সত্য। মনে হচ্ছে আলিবাবার গুহায় বসে আছি। চারপাশে রত্ন আর পাথরের স্তূপ। আপনি যেন কী করতেন?”

ছয়মাস অবিরত হাঁটতে থাকলে মানুষ পূর্বজন্মের স্মৃতি ভুলে যায়। আমিও ভুলে গেছি। জন্ম কোন মায়ের কোলে হইছিল খেয়াল নাই। পথের আশপাশ আর জীবন দেখতে দেখতে আগের জনম মরে গেছে। আজকে হাঁটছি অনেকক্ষণ, প্রায় আট ঘণ্টা। জলপ্রপাত আরও তিন ক্রোশ দূরে। কাল্টের অন্য সদস্যদের আমার মতো আরও কয়েকজনের জন্য পূর্বনির্ধারিত একটা গুহায় অপেক্ষা করবার কথা। অন্যভুবন জানবার উত্তেজনায় সব বোধ অনুভূতি লোপ পেয়ে গেছে। পেটে একেবারে ক্ষিদা নাই। অথচ শেষ খাবার পেটে পড়ছিল দুই সপ্তাহ আগে।

প্রায় সাত মাস আগে সেন্ট পিটার্সবার্গের এক পার্টিতে একদল জাংকিদের খপ্পরে পড়ে জানছিলাম ‘মেটানয়ান কাল্ট’ এর কথা। প্রতিটা রিলেজিয়াস কাল্ট মানুষকে ভিন্ন ডাইমেনশনে পৌঁছে দেবার কথা বলে। জাংকিদের কথায় আরও থাকে না সত্যতার ‘স’। শুনে আর কিছুটা বুঝে মনে হইছে এই কাল্টের রিচুয়াল হয়তোবা আরেকটা কোনো মাস সুইসাইডের রিসাইকেলড রূপ। ছয় মাস কষ্ট করে পায়ে হেঁটে নিজের বলি চড়াইতে যাচ্ছি না। আমি আসলে এখন কোনো কিছু অবিশ্বাস করি না। নিছক পৃথিবী ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যটাও অবশ্য কিছুটা কাজ করে। আবার মন্দভাগ্যের সুপার ডিটারমিনেস্টিক নেচারে আমার বাঁধহারা কৌতূহল। আর কিছু না হোক, লুনার রেইনবোর মিথটা দুই চোখ দিয়ে স্পর্শ করা যাবে।

এখন অগাস্ট চলে। সামার শেষ হবে হবে ভাব। সেজন্য বোধহয় শীত কম। চারপাশে লার্চ গাছের সারি। আমি লেকের তীর ধরে উত্তর দিকে তালনিকোভি ফলস-এ যাব। সাইবেরিয়ার পুতোরানা প্ল্যাটোর সর্বোচ্চ ফলস। খুব কাছাকাছি চলে আসছি। আর ঘণ্টা তিনেক ট্রেক করলেই পৌঁছে যাবার কথা। ক্লান্তি এই মুহূর্ত পর্যন্ত গেঁড়ে বসতে পারে নাই। এত বিশাল পর্বতরাজির মাঝে আমি নগণ্য বায়োলজিকাল অমর তীব্র গতি রেখে পথ চলতেছি, ভাবতে অদ্ভুত লাগে। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করতেছি। মাইলকে মাইল ধরে হেঁটে-ট্রেক করে আসা পথে দ্বিতীয় কোনো পায়ের ছাপ দেখলাম না। যদি সবসময়ই এই কাল্টের রিচুয়াল চলতে থাকে, তাহলে কারও না কারও তো পায়ের ছাপ থাকবার কথা। ব্যাপার কি, বাকিরা কোন পথ ধরে আসে? চপার এ চড়ে উড়ে আসে নাকি সরাসরি? চাকার ছাপ ও দেখতেছি না। অথচ এই সময়টায় এইখানে ট্যুরিস্ট এমনিতেই থাকবার কথা। ক্যাম্পিং এর জন্য জায়গাটা সুন্দর। কিছুটা রহস্য কি তৈরি হইতেছে না? আবার এমনও হইতে পারে পুরা মিথটাই ভুয়া। আমি আগবাড়ায়ে হেঁটে হেঁটে পর্বত চষে বেড়াবার কথা বলছি দেখেই তখন সেই হারামজাদারা মজা করে একটা গল্প ফাঁদলো। কেউ না থাকলে কোন ক্ষতিও নাই অবশ্য। একটা মহাসময় বেঁচে থেকে কি আর বাল ছিঁড়ব! ঝর্না-স্রোত আর পাখির ধ্যানে কিছু বছর ভালোও তো কাটতে পারে। 

সন্ধ্যা নামল বলে। দূরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। পাথরের স্তূপ সম্ভবত। ভুল ভাবলাম, রক ব্যালান্সিং জাতীয় কিছু একটা। এটা কি কোনো নির্দেশনা? সামনে আগাই। কাউন্টারব্যালান্সে স্তুপাক্রিত প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুটের গৌরবদীপ্ত খাঁড়া শিল্পকর্ম। আশপাশে বেশ কয়েক আকারের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। তার মানে নির্দিষ্ট কোনো একজন এই কাজটা করে নাই। আবার হতে পারে কেউ কাছ থেকে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করছিল, তাতে পায়ের ছাপ পড়ে গেছে। যারা কাজটা করছে আপাতত তারা অনুপস্থিত। কেন জানি মনে হচ্ছে কোন আগন্তুককে দেখাবার উদ্দেশ্যেই শিল্পকর্মটা করা। আচ্ছা, আমি এখানে থেমে দেখি না কেন? কেউ না কেউ হয়ত আশেপাশে থাকতে পারে। ফলসটা বিশাল। ঠিক এইখান থেকে দেখতে জাদুকল্পের মত লাগতেছে। ঝর্নার রেণু, বাতাসে মিষ্টি স্বাদ তৈরি করছে। আফসোস আমি উড়তে পারি না। উড়তে পারলে মিষ্টি ছিটে আসা বাতাসে দেবতা স্বাদ গায়ে মাখতে পারতাম। মানুষ হয়ে জন্মানোর আফসোস কবে শেষ হবে? 

আমার কুৎসিত লাগে নিজের ভাগ্যকে চিনতে। অনন্তকাল বেঁচে থাকা মানে, অনন্তকাল ধরে আফসোস মাথার মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার মত বেঁচে থাকবে। সুখের কোন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নাই। থাকলে সেটাও বিরক্তিকর হইত। কি আর করা! এই গ্রহের নিজস্ব নিকেলের সুবৃহৎ ভাগাড়ে মানুষের গন্ধের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোন কাজ নাই। কেউ আসল না। মেজাজ খারাপ লাগতেছে। সামনের পানির চ্যানেল ধরে আগানো উচিত। প্রায় ১৬০০ ফিট উপরে উঠতে হবে। এখান থেকে কোনো গুহার আলামত দেখা যাচ্ছে না। অমাবস্যার রাত। আকাশে তারা কিলবিল করতেছে । হেলমেটে টর্চ বাঁধতে হবে। রাতে হাইকিং করাটা মহাবৈশ্বিক পাগলের কাজ। আমি পাগল পুরানা। নিচে পরে মাথা ফেটে মরে গেলে কিচ্ছু আসবে যাবে না।

আরে,ব্যাপার কী? একটা ছোট বাচ্চাকে আমার দিকে আগাইতে দেখা যাচ্ছে। সাদা একবস্ত্র জড়ায়ে নগ্ন পায়ে ধীরলয়ে  হেঁটে আসতেছে। হাতে ওর শরীরের তুলনায় মোটামুটি বড় একখণ্ড পাথর। ছেলেটার চোখ অস্বাভাবিক। সাহানের কথা মনে পড়ে গেল। সাহানকে শেষ দেখছিলাম ওর দুই বছর বয়সে। এই ছেলের বয়স কত, নয়-দশ হবে। আমার দিকে সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকায়ে আছে। আমি কি আটকায়ে গেলাম? ওকে রাশান কোনো পিচ্চি বলে মনে হইতেছে না। ঠিক মর্ত্যের বাসিন্দাই, কিন্তু কোন মাটির বলা যাচ্ছে না। কথা বলার চেষ্টা করে লাভ নাই। এই ছেলে পাথর দিয়ে গায়েব হয়ে যাবে, আমি নিশ্চিত। কিন্তু…...কাল্ট আছে তাহলে!

ঠিক তাই হইল। পাথর ব্যালান্স করতে যেয়ে কোন এক ফাঁকে সেই বিশ্রী রকমের সুন্দর পিচ্চিটা গায়েব হয়ে গেছে। এবার বোধহয় আগানো উচিত। চোখে ধান্দা লেগে আছে না কি! এতক্ষণ ছেলেটা প্রপাত বেয়ে উপরে উঠতেছিল? ঐদিকটায় আমার চোখ যায় নাই। ছেলেটা মাথা কাঁত করে ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করতেছে। ওর দেখানো পথ ধরে আগাইতে হবে। কানের পাশ দিয়ে বাতাসের মতন কিছু একটা ছুটে গেছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। চূড়ার খানিকটা নিচে, খানিকটা নিচেও না তাও প্রায় বিশ মিটার হবে, একটা চ্যাইতে দাঁড়ায়ে আছে কেউ একজন। ঝর্ণার মিহি-সাদা দ্যুতিতে লোকটাকে অদ্ভুত দেখা যাচ্ছে। সেই ব্যক্তি নীচে আমার দিকে তাকায়ে আছে। 

অনেকদিন পাহাড়ে উঠি নাই। আমার হাত ছিলে যাচ্ছে প্রায়। পায়ে শক্তি পাচ্ছি না। এসব কিছুই পাত্তা দেয়া ঠিক হবে না। শুধু জানতে হবে একাগ্রতার অভাব আছে। বুকে দম জমাতে হবে কিছুক্ষণ পরপর। এর চাইতে খাঁড়া পাহাড়ে আমি উঠছি। তখনও সাথে হাইকিং এর কিছু ছিল না, এখনও নাই। আর উঠবার আগে বিশ্রাম নিছি, প্রচুর পানি গিলছি। একটা জংলি বেরি গাছ পাইছিলাম গতকাল। সেই গাছের কয়েকটা বেরী চাবাইছি দুই ঘণ্টাও হয় নাই। উফ! হাস্যকর মন্ত্রণা। প্রথম জীবনের করুণ স্বভাব এখনও পিছ ছাড়ে নাই। চিন্তাকে সাহসের ফুয়েল যোগায়ে যাইতেই হয়। আমার কিছুরই দরকার নাই। একটু একটু করে দূরত্ব কমতেছে। আমার সব আগ্রহ চ্যাইতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার প্রতি। এই ধরনের মানুষদের কোনো একটা ব্যাপার আছে, আগ্রহ ধরায়। আর কি আশ্চর্য, এত কিছু দেখার পরেও কেন আমার মনে হয় না, তারা আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে না! তারা! কারা তারা? অন্য সময়ের কেউ? সবাই বলছিল, এরা মেটানয়ান। এরা প্যারালাল জগতের চক্রধারী! 

আর আমি সত্যি সত্যি নতুন জন্ম চাই। এই মেটানয়ানরা আমাকে সাহায্য করবে। আমি সত্যিটা জানতে চাই। ওরা সিম্যুলেটেড জ্বালা ধরা সত্য থেকে আমাকে নিশ্চয়ই মুক্তি দেবে। 

না, ওরা এলিয়েন। একটা মিথ্যায় সাজানো সত্য ওরাই তৈরি করে। সবাই তাই বলল, তারাই না কি বিগার রিয়েলিটি। আমার অনেক প্রশ্ন। এই মেটানয়ানরা অন্তত এতটুকু সাহায্য করবে। কয়েক দশকের পুরনো ঘোর আবার আসছে ডুবাইতে। আমি ওদেরকে দেখতে একটু অদ্ভুতভাবে তৈরি হচ্ছি। রগে রগে রাগের উত্তাপ। চিলতে কৌতূহল ভাব জমাইতে পারতেছে না। স্মৃতি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া জীবনের জন্য আমার রাগ হচ্ছে। নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ ঘটবে। ম্যানুপুলেটিভ কোনো দূর সম্পর্কের ঈশ্বর। যাদের কথা অনেকেই জেনে গেছে। আচ্ছা জেনে গেলে কেউ ঈশ্বর থাকে কেমনে? তাহলে সবাই এদের ঈশ্বর বলে কেন? না কি তারা ঈশ্বর-পরিবর্তিত-প্রেরিত এজেন্ট। এঞ্জেলস, শেপশিফটারস, নারসিসিস্ট সেলফ প্রক্লেইমড গডস ! 

আমার ব্লেইজার, কোয়েজার চোখে ভাসে। সেইখান থেকে ওমিনাস পার্টিকেলের রেডিয়েশান চোখে ভাসে। এর বাইরে আমি ঈশ্বরের চিন্তা করতে পারি নাই। বেশি ভিতরে চিন্তা করতে গেলে সবকিছু ভঙ্গুর মনে হয়। সাইকেড্যালিকের কাব্যিক ব্যাকরণ। ফ্র্যাকটালস, ভরটেক্স, ইনফিনিটি মিরর যার সবগুলো ভাঙা। ইভেন্ট হরাইজনের অনন্তকালের লুপ। দশ মহাবিশ্বের সমান দেয়াল। এর বাইরে আমি কিছুই কল্পনা করতে পারি না। আসলে এখন পারি না। কোনো একসময় পারতাম।  আমার কিছু লুকানো ব্যাপার ছিল। ভুলচুকে ক্ষমতা পেয়ে গেছিলাম। আমার মাথায় সেসব যাত্রা ভুলে যাবার রহস্য আছে। আমি যেটাকে বলি নিজের জন্য বেদরকারি আর অন্যের জন্য দরকারি ডি-কন্সট্রাকশন। কোনো একটা শয়তানি প্রয়োজনের জন্য আমার অমর হওয়া।

আমার রাগকে শান্ত করার জন্য এই ফেইক প্রকৃতি একটা ব্যবস্থা করে রাখছে। ঝর্নার স্রোতের শব্দ ব্যবস্থা। পৃথিবীর কি মহাবিশ্বের কোন বাইনচোদের কখনই এই ব্যবস্থার উপরে মেজাজ খারাপ হবার কথা না। শব্দটা সবকিছুই অন্যরকম ভাবায়। চাপা রাগ আর কৌতূহলে একাকার অবস্থা আমার। এসবের চাইতে মানে আমার গল্পের চাইতে কি কোনো কিছু অদ্ভুত না? আরে আছে তো! স্রোতের ফাঁকে ফাঁকে মাছ গড়ায়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। একটু ভিন্ন জীবনের সাথে পরিচয় করায়ে দিয়ে প্রকৃতির মন ভুলানোর কত সুন্দর ব্যবস্থা! আমার ভালোবাসার কেউ থাকলে বলত, “এত সুন্দর কিছু দেখার মাঝে তুমি রাগ পুষতে পার কেমনে? ঠিকই আছে। তোমার ভুল কারণে সারাজীবন বেঁচে থাকাই উচিত।” বালের রোমান্টিকতা। আচ্ছা, কৌতূহলের শাস্তি আর কদ্দুর! আঙুল সব ফুলে অবশ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা প্রায় উঠে গেল। পিচ্চির স্পিড দুর্দান্ত। কিন্তু কাল্টমানবকে তো দেখা যাচ্ছে না। চোখে ঘামের কারণে অবশ্য কিছু দেখতেই কষ্ট হচ্ছে। রাতের বেলা দেখে গ্লাস পড়লাম না। তবে পড়া উচিত ছিল। আমি ওঠার পর কাল্টজনকের সাথে কি মশকরা করবো? নাহ, আমি অতি সিরিয়াস মানুষের ভান করবো। আর তার উপর তো আমি অমর। হ্যাশট্যাগ বায়লোজিক্যালি। আহা, সেই পুরানো দিনগুলো! কত কিছু বলতাম!

আজকে সারারাত লেগে যাইতে পারে। যুধিষ্ঠির এর সাথে দেখা হবে ভোরের প্রথম সূর্যে। এমনটাই হওয়া উচিত। নাইলে তাকে পবিত্র লাগবে কি কারণে? এদের তো পবিত্রতা দেখানোর বিশেষ কারণ থাকে। বাতাস সাইডওয়ে থেকে প্রবলবেগে আসা শুরু করছে। মহা সমস্যা, আমার তাড়াহুড়ো করেই উঠতে হবে। মস্তিষ্কের কয়েকশ মিলিয়ন কোরের উপর সমস্ত প্রেশার দিয়ে সময় আর দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে বাঁচায়ে যত তাড়াতাড়ি ওঠা যায়। আমি বোধহয় ভুল দেখতেছি না। একটা মেয়েকে এখন দেখা যাচ্ছে ঠিক সেই কাল্টমানবের জায়গাটায়। আকাশপানে তাকায়ে আছে। পুরা ব্যাপারটায় কেমন একটা সুররিয়েল ভাব। সব অতিপ্রাকৃত সুন্দর অবয়বী মানুষের আয়োজন। এটা কি রেসিস্ট কাল্ট অর্গানাইজেশন? কালো অথবা স্টেরিওটিপিক্যাল অসুন্দরদের এখানে জায়গা নাই? ক্রিটান ল্যাব্রিন্থের মেনোটররা দুঃস্বপ্ন আর দুর্বোধ্য পেইন্টিং ছাড়া কোথাও যাইতে মনে হয় লজ্জা পান। কেউ চাইলেও বাস্তবে তাদের খুঁজে পাবেন না। থুক্কু পরাবাস্তব। এই মুহূর্তকে বাস্তব বলতে যাই কোন দুঃখে। কিন্তু পরাবাস্তবই বা কেন? কোথায় মেটাফিজিক্সের কোন সূত্রের বেইজ্জতি হইছে! মেটাফিজিক্সের দুনিয়ায় কি কি সম্ভব না তা কে বলতে পারে?

“স্বাগত আপনাকে। আমরা আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

মোটামুটি বড় একটা গুহা কেটে কেটে বানানো হইছে। এই স্পেসটা চওড়া, খোলা। ঠিক কোন নচ বলা যাবে না। মাউন্টেইন পিকে মাঝে মাঝে এমন অবস্থান দেখা যায়। তবে এই ফলস, মাউন্টেন এর ক্লাসিফিকেশনে পড়ে না। বাইরে থেকে বুঝবার কোনো উপায় নাই, ভেতরে এমন কিছু থাকতে পারে।

“কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুন। পরিশ্রম হয়েছে আপনার।”

টেলিপ্যাথি না কি? মুখে তো শব্দ করতেছে না কেউ। সেই বাচ্চাটা কোথায় গেল? দেখা যাচ্ছে না। আমি কি কথা বলব না চিন্তা করলেই হবে? এরা পাতলা রেশমের সাদা একটা চাদর পড়ে আছে সবাই। আমি এতটাই ক্লান্ত কারও সাথে যেয়ে বসে পরিচিত হইতে ইচ্ছা করতেছে না। আর ঘুমসিক্ত চেতনায় এদেরকে দেখতে বিদঘুটে লাগতেছে। মনে হচ্ছে মানুষ ছাড়াও আত্নাদের আঁতাত এই গুহাটা। হঠাত কিছু আলো, রং খেলার মত জ্বলে নিভে যাচ্ছে। পাথুরে দেয়াল খুব চেনা। নিচে এই জমাট পাথরেরই শরীরের একটা অংশ রেখে আসছিলাম। হ্যাঁ, ঠিক এই পাথরটাই।

“নিশ্চিন্ত মনে ঘুমান। রাতে কথা হচ্ছে।”

“আচ্ছা।”

ঝর্ণার শব্দে ভেসে আসতেছে গাঢ় ঘুম। মন্দ লাগতেছে না।       

১৯.

সূর্য ডুবতেছে, গুহাটা উন্মুক্ত। অনেকেই এই জায়গাটার কথা জানে। মানুষ আর অন্যেরা আসতেছে, যাচ্ছে। কেউ স্টে করতেছে না। এখন স্বর্গের এই ছোট বিচরণক্ষেত্র আপাতত আমার। খুব সুন্দর একগুচ্ছ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গছিল। একেবারেই ইচ্ছা হয় নাই উঠতে। এত সুন্দর একেকটা সব স্বপ্ন দেখছি! প্রথমবার কোনো স্বপ্নে প্রত্যেকেটা ব্যাপার ভালো লাগছে। মনে হইল শাশ্বত সুখের স্বপ্নে হারাইছি জীবনে প্রথমবার। সুখে অবশ হয়ে গেছি প্রায়। বসে বসে অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখে চোখের পানি খরচ করতেছি। এই নিরাকার তরলে মিশে নিস্তব্ধতা আর ঝর্ণার স্রোত চিরে আসা পানির ঝাপটা সংশয় জাগায়। আমি কোন কূলে যেয়ে ঠেকবো? সংশয় সবচাইতে করুণ প্রশ্নটা তৈরি করলো। সবকিছু যদি এতই সুন্দর হয় তাহলে এত কষ্ট কেন সহ্য করলাম? পায়ের কাছে মাথা ঠেকা সুখ আমার কাছে কেন মেকি লাগতো? শতাব্দী প্রাচীন একঘেয়ে পঙক্তি “সুখে থাকতে ভুতে কিলায়” আমার জন্য প্যারালাল বাস্তবতা তৈরি করল না কেন? এই আপেক্ষিক সত্য গ্রহণ করবার ক্ষমতা আমার জন্যে না। আমি পাত্তা দিছি অন্য কিছু। এই অন্য কিছু ও আবার আমি খুঁজি নাই। এরপরও দিশা হারায়ে, যুঝে কান্না কান্না অবস্থা। তার মানে আমি দুই সত্যের মাঝামাঝি তার বাজায়ে ট্র্যাজেডির গান গাইছি। আশ্চর্যের বিষয় এই ট্র্যাজেডি আমার ভালো লাগত, এখনও লাগে।

নীল চোখ আমার অসাধারণ লাগে। গুহার মালিকের চোখজোড়াও নীল। আমার একমাত্র ছেলে সাহানের মতো। ছেলেটা এদিকে আসতেছে। এক হাত দূরত্ব রেখে পাশে বসছে। অদ্ভুত ফিলিং কাজ করতেছে। সাহানের বড় হয়ে এতদিনে এই ছেলেটার মতন হবার কথা। দেখতেও অনেকটা এমন হবার কথা। 

“ঘুম ভালো হল?”

“অসাধারণ।” মাথা আপনাতেই উত্তর সাজাচ্ছে। আমি কিছু জানতে চাচ্ছিলাম না। শব্দ যদি নিষ্প্রয়োজন হয় এক্ষেত্রে তাহলে কৌতূহল কেন হবে না? টেলিপ্যাথি আমাকে কীভাবে আলাদা করে? আসলে আমি বুড়া হয়ে গেছি। যেকোনো ধরণের সঙ্গ আমাতে বিরক্তি উৎপাদন করে। 

“অনেকেই আছে এখানে। তাদের খোঁজ জানতে কি ইচ্ছা হচ্ছে?”

“আমি জানি না তারা কারা।”

ঠোঁটে মৃদু হাসি। কোন ইগনোরেন্ট পাইলে মানুষ যেই হাসিটা দেয় সেই হাসি। অসুবিধা না, কৃত্রিম মনে হইতেছে না। প্রকৃত অস্তিত্বের হাসি, বোঝা যাচ্ছে।

“এরা আত্না না, বিভিন্ন সত্তা। কারও মৃত্যু নাই। কাজ ছুটে বেড়ানো।”

“কীভাবে?”

“আলোর মত ডুবে, সাঁতার কেটে।”

“এই জায়গাটা থেকে?”

“হ্যাঁ, ঠিক পনের চাঁদ ধরে এইখানে ধনু দেখা যায়। দৃশ্যমান ধনুতে দৃষ্টি দেয়া যাবে না।”

“ইন্টারেস্টিং, তারপর?”

“আলোর রশ্মি শরীরে জমবে। স্মৃতিতে থাকবে। ক্ষুধা লাগবে না, ঘুম আসবে না। জাগিয়ে রাখবে অপর চেতনায়। সেই চেতনাটা জরুরি। নিজেদের দেখা যায় নামধারী জগতমালায়। তবে তা দেখা দেবে পনের দিন পর অমাবশ্যায়। তখন একটা একটা আকাঙ্ক্ষার তারা আর তাদের প্রণালী এই খাদের নিচে নেমে আসে। আর আমরা ঝাঁপ দেই নিচে, তিমির অন্ধকারে, সেই প্রণালীতে। অসমর্পিত সত্তারা আমাদের দেখতে পায় না, কখনও পাবে না। কিছু সময় পর প্রয়োজনের চক্রে আমাদের এইখানটায় আবার আসতে হবে। যাদের ছুটে বেড়ানোর নিমিত্ত শেষ হয় না তারা অনন্তকাল যাওয়া-আসার ভেতর থাকে।”

“এই তাহলে এই সৃষ্ট জগতের কসমিক রেল্ম? কোনো মহাসৃষ্টি বা মহাপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু?”

মানুষটা মাথা নাড়ল। পেছনে কিছু অবয়ব জড় হচ্ছে। আমি রি রি ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। তারা একত্র হয়ে বসল। অবয়বগুলো পরিচিত। আমার মাথার দেবীরা, অবনী যাদের একনাম। আসলেই কি? এই দেবীদের পরিচয় নিয়ে আমি নিশ্চিত না।

“কিছু সময় আগে একটা মেয়ে এসছিল আপনার খোঁজ করতে। তিনি আমাদের মহান যজ্ঞের আরেকজন বিশেষ পার্টিসিপেন্ট।”

“কে সে?”

“রোদেলা।”

“সে কোথায়?’

“কোনো এক জগতে অবশ্যই আছে।”

“মেয়েটা কি রূপে এসছিল?”

“সেসব সত্তার মত। যাদের আপনি গতকাল থেকে দেখছেন।”

“বিশ্বাস হচ্ছে না। মেয়েটার কানেক্টোম উদ্ভিদের মাইসেলিয়ামের সাথে জুড়ে দেয়া।”

“গতরাতের স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল কীভাবে?”

“একটা ফাউন্টেন ট্রির গোঁড়ায় শুয়ে ছিলাম…...”

বিশ্বাস হচ্ছে, কিন্তু মানতে পারতেছি না। মেয়েটার সত্তা আসলেই এখানে পৌঁছাইছিল! এই মহাবিশ্বের মানুষকে পরিবর্তন করবার কী প্রয়োজন? তবে সবকিছু পরিষ্কার। একটা রিয়েলিটিকে ডি-কন্সট্রাক্ট করা হচ্ছে। আমাদের ভেতর আসলে কারা বাস করে?

“সবকিছু ষড়যন্ত্র মনে হয়?”

“হ্যাঁ, আমি সাধারণ একজন হয়ে জন্মাইছিলাম। কিন্তু কিছু একটার প্রয়োজনে আমি এমন বা সেই মেয়েটার অমন অবস্থা হইছিল। কেন?”

“আমি জানি না, তবে নিজের কারণটা বলতে পারি। সব শুরুর আর শেষের অস্তিত্বের কিছু যাত্রীদের আমার মতো অনেকেই বিভিন্ন জগত থেকে খুঁজছে। এটাই আমার বা আমাদের নিয়তি। তিনি যার নাম রোদেলা এই জগতে আলোর শিকড় বাড়িয়ে খুঁজছেন।”

“কাদের খুজতেছে?”

“মেটানয়ান।”

“কী হইছে তাদের?”

“এদের একাংশ সুবিশাল কিছু ভয়েডে হারিয়ে গেছে। তারা কোন না কোনভাবে এই সুবিশাল জগতমণ্ডলতে আঁটকে গেছে। তবে তাদের আস্তে আস্তে পাওয়া যাচ্ছে। পরিবর্তিত সত্তারা আমাদেরকে সেই মেটানয়ানদের খুঁজতে সাহায্য করছে। আপনিও করবেন।”

“আমার তাদের প্রতি কোনো মোহ মায়া কাজ করতেছে না। তারা আমার কেউ না।”

“এই জগতটা আপনার জন্যই তাদের একাংশের তৈরি করা।”

“তারা কোন মেটানয়ান? যারা বিচরণ করতেছে?”

“হ্যাঁ, পনের চাঁদের পরিক্রমার মাঝে আপনি তাদের দেখবেন। শুনতে পাবেন।”

“আপনার জন্ম কীভাবে হইছিল? আপনি কি মানুষ না অন্য কিছু?”

“কোন অসুখী মায়ের কোলে জন্মেছিলাম। তিনি আপনাকে প্রবল ভাবে চাইতেন।”

সাহান! 

“মেটাফিজিসিস্টরা তাহলে কী করে? সব চক্রের পাহারাদারি?”

“আপনি আমাকে কখনও ভালবাসতে চান নাই। আমি সারাজীবন আপনাকে ঘৃণা করেছি। কিন্তু আমাকে আপনার জন্যই অপেক্ষা করতে হয়েছে………... কয়েক কাল ধরে। এতকিছুর পর আপনার সামনে আমার সত্য কিছুই মনে হচ্ছে না। কেন বাবা? আপনি এই পৃথিবী কেন এত ঘৃণা করেন?”

“এই পৃথিবী আমার না।”

“আমি জানি আপনি তাই বিশ্বাস করবেন। ঘুমের ভেতর ঘটতে থাকা কোনো ঘৃণায় ভরা মিথ্যা কল্পনা বলে উড়িয়ে দেবেন। আপনার আর কিছু করারও নাই, আমরা জানি।”

“ঘৃণার কারণ ধরে ছুটে বেড়াচ্ছ সাহান? কিছু বাজে প্রজাতির স্পিসিস খুঁজতে? তুমিও কি অমর?”

“হ্যাঁ, আর আমার প্রতিশোধের স্পৃহা নাই বাবা।”

ছেলেটার চোখে জল জমতেছে। অনুভূতি থাকে তাহলে ওদের?

“আমি প্রথমত একজন মেটানয়ান তারপর একজন মানুষ, হয়তোবা। পরিবর্তিত সত্তাদের জন্য মেটাফিজিসিস্ট- বায়োলজিস্টরা নাম খুঁজছে। পরিচয় নির্ধারিত হয়ে যাবার পর আমার সেই অস্তিত্বের দেখা অবশ্যই পাবেন কোনো একদিন।”

“আমি অন্যজীবন চাই। তুমি এখান থেকে এখন চাইলে যেতে পারো।”

পেছনের সত্তারা এক এক করে সাহানের সাথে গুহার ভেতরে অদৃশ্য হচ্ছে। কারও পরলৌকিক অহেতুক কারণের জন্য এত বছরের সাজানো, এত জীবনের ক্ষত সৃষ্টি করা ষড়যন্ত্র আমি মেনে নিতে পারতেছি না। আমার নিশ্চয়ই কিছু করার আছে। হয়ত ভিন্ন কোন জগতে। আমি সেই জগতটাই খুঁজবো।

রাত নেমে আসছে। খুব সুন্দর চাঁদ উঠছে। মাথা পাগল করে দেয়ার মত লুনার রেইনবো দৃশ্যমান হচ্ছে। আমার চোখ বন্ধ করবার সময় চলে এল। আসলে চোখ খুলবার সময় হইল। এই পৃথিবীর বাকিদের জন্য, যারা সাধারণ, তাদের জন্য মায়া হচ্ছে। আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মিথ্যা সত্তা হইলেও তাদের কষ্ট পাইতে হয়, অথবা অসহায় নির্বোধের মত একটা বিশাল জীবন কারও তৈরি করা কুৎসিত সিম্যুলেশনে নষ্ট করতে হয়। আমি কি কোনো যুদ্ধ বাঁধায় দিতে পারি না? 

হাহাহা! খারাপ ঈশ্বরদের সাথে যুদ্ধ! নিজেকে এই প্রথমবার বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছে।

“আমার গ্রহ”

“ ‘কারা’ এদের নিজেদের রি-কন্সট্রাকশনের হিস্ট্রি নাই? এভ্যুলুশনের সংজ্ঞায় প্রতিটা সুপেরিয়র প্রাণীই তো তাই করে।” 

“টিপিক্যাল বডির বিলুপ্তি আছে। এলিয়েন মিউটেশনের কমপ্লেক্স জেনোমে ইউনিভার্সে টিকে থাকবে। এভাবে এক্সিসটেন্স মেটানয়ান সেল রিজেক্ট করেছে, তুমি ভালো করেই জানো। ডি-কন্সট্রাক্ট করা ছাড়া কোনো উপায় নাই।” 

“ ‘কারা’, আমার বুদ্ধি হচ্ছে এদের মিউটেশনের জন্য অপেক্ষা করা। যেহেতু আমরা অরগ্যানিক এভ্যুলুশনকে ডিস্টার্ব করি না তাই নিজেদের সেলগুলো কমপ্যাক্ট রেখে সুদূরে ইনফরমেশনের জন্য চাইলেই অপেক্ষা করতে পারি।”

“ যেন, তুমি ততদিন বসে থাকবে এই ছেলের অস্তিত্বে? আমি তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না। তুমি এই নগণ্য ছেলেটার মত আচরণ করছো। তার ফলাফল হবে খুব খারাপ।”

“যুদ্ধের প্রয়োজন আছে কারা।”

“আমার উচিত তোমাকে নাই করে দেয়া। কিন্তু তা পারবো না।”

“কারণ মৃত্যু বলে কোনো কিছুতে আমরা বিশ্বাস করি না হা হা……”

ভয়েডের অপর চেতনায় আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্র রদবদল করা যায়। এই কথোপোকথনের ইন্ট্যুশনাল সত্য আরেকটা সত্যে পাল্টে গেছে। অনিম নামের মানুষটার আরেক জগত চেতনার বাস্তবে। বিজ্ঞান বা দর্শনের হাইপোথিসিস জুড়ে দিলে সেটা দেখাতে পারে কোন ম্যানিফেস্টশনাল রিয়েলিটির মতো, একটা নাম না জানা পার্টিকেল, আইডিয়ার একটা ডিটারমিনেস্টিক কোর্সে কোয়ান্টাম মহাকাল থেকে মহাকালে যা ছুটে চলছে। সেই পার্টিকেলের দায়িত্ব নিজের পৃথিবীটা খুঁজে বের করবার। 

নিজের শরীরে পূর্ণ অস্তিত্ব গেঁড়ে বসা কোনো ডিটারমিনেস্টিক কণার চেতনা পরিবর্তন করতে অনিমকে কনশাস রেল্মে কত অজস্রবার জন্মাতে হয়েছে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই যাত্রায়, (অনিমের কাছে বিভিন্ন সময়ে আগন্তুকদের আসা)। ওর সম্ভাবনার ছোট একটা ভগ্নাংশ সমীকরণের গ্রহতে আমরা নতুন গল্প পাই। সেই গল্পে পরিবর্তিত মানুষ আর মেটানয়ানদের যুদ্ধ চলছে। বা বলা যেতে পারে ফেইটের ইকুয়েশন ভাঙার যুদ্ধ চলছে। 

সেই গ্রহে মহাসমুদ্রগুলোর ভূগর্ভস্থে থাকতে হচ্ছে পরিবর্তিত মানব প্রজাতির। সেই ‘কোর’ বা চেতনার স্তরে মহাবিশ্বের আলো পৌঁছায় না। মেটানয়ানরা পৌঁছায় না, তাদের এসোটেরিক ষড়যন্ত্রের ইন্ট্যুশন পৌঁছায় না। তবে স্থলের মেটানয়ানরা মানুষের এই পরিবর্তিত প্রজাতির নাম দিয়েছে ‘নিউ মেটানয়ান’। সেই গ্রহের মেটাফিজিক্যাল(!) স্তর ভেদের রাজনীতি আর অসংখ্য ছোটবড় জীবনের গল্প আপাতত আর করছি না। পরে কোনো একসময় হয়ত হবে…... 

Comments

    Please login to post comment. Login