Posts

চিন্তা

নারীবিদ্বেষী রাজনীতি: ঘৃণার মুখোশে কাম

May 5, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

112
View

নারীকে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দেওয়া আজ আর লজ্জার নয় —ধর্মীয় মঞ্চে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ যেন একে বানিয়ে তুলেছে ঈমানের চূড়ান্ত পরিচয়, রুচির অভাবকে প্রতিষ্ঠা করেছে সত্যের ঘোষণা হিসেবে!

সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন’ যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, তা যেন হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটির অন্তরে দাবানল জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে নারীর সম্পত্তিতে সমানাধিকার এবং বহুবিবাহ নিরুৎসাহের প্রস্তাব আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে নারীবিরোধী বিষোদ্গার। সম্মানিত নারী পেশাজীবীদের ছবি মঞ্চে ঝুলিয়ে, জুতার মালা পরিয়ে তাঁদের উদ্দেশে সমাবেশে গালাগালির যে পরিণতিহীন পর্ব—তা কি ধর্মের নামে গৃহীত কোনো চারিত্রিক চর্চা, নাকি বর্বর পুরুষতন্ত্রের ঘৃণ্য উৎসব?

ইসলামের পবিত্র বয়ানে নারী পেয়েছে মর্যাদা ও সমীহ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে -"তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য পোশাকস্বরূপ, আর তোমরা তাদের পোশাকস্বরূপ।"
(সূরা আল বাকারাহ্, আয়াতঃ ১৮৭)।

“আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে... এবং তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে সবচেয়ে পরহেজগার।” -(সূরা হুজরাত, আয়াত ১৩)। নারীর অধিকার রক্ষায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন অগ্রগামী। তিনি বলেছেন -“তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম, যে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে।” (তিরমিজি শরিফ)
তবু কেন হেফাজত নেতাদের জিহ্বায় এমনতর নারীবিদ্বেষের ঝাঁঝ?

Psychoanalysis তথা মনোসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড বহু আগেই বলে গেছেন -যে সমাজ যৌনতা নিয়ে অবদমন সৃষ্টি করে, সে সমাজে জন্ম নেয় মানসিক বিকার। মুখে স্রষ্টার জিকির, অন্তরে লুকানো লালসা -এই দ্বৈতসত্তার নগ্ন প্রকাশ আমরা দেখি ধর্মীয় জলসা, মাঠের বয়ান কিংবা ফেসবুক-ইউটিউব লাইভে। বক্তারা নারীকে কৌতুক ও কটাক্ষে পরিণত করেন লোভ ও লজ্জার কাঁটায় বিধুর আবেগ, অনুভূতি ও স্বাধীনসত্তাবিহীন এক শরীরমাত্রে।

চাণক্য নীতিতে বলা হয়েছে—
“গুপ্ত কামনা কখনো গুপ্ত থাকে না; তা মুখে, চোখে ও আচরণে ফাঁস হয়ে যায়।”
হেফাজতের সমাবেশে যারা ঘাড় ফুলিয়ে নারীদের 'বেশ্যা' বলে গালি দেন, তাদের মুখাবয়বে চাণক্যের সেই কথার বাস্তব প্রতিফলনই দেখা যায়।

এই ‘গালিময় ঈমান’ আসলে কীসের ইঙ্গিত করে? বক্তাদের অঙ্গভঙ্গি, শব্দচয়ন আর অন্ধ অনুসারীদের করতালিই তার উত্তর হয়ে ওঠে।

হেফাজত যে নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তার মূল দর্শন অত্যন্ত প্রাচীন এবং পশ্চাৎমুখী -নারী থাকবে ঘরে, সন্তান প্রসব করবে, স্বামী সেবা করবে। সে চাকরি করতে পারবে না, রাজনীতি তো দূর, সম্পত্তিতে অধিকার চাওয়া তো রীতিমতো পাপ! সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই পারবে না! নারীর আত্মপ্রকাশ নয়, তার দমনের মধ্যেই তারা খোঁজে ধর্মীয় নৈতিকতা।

এই নারীবিদ্বেষ বিচ্ছিন্ন কোনো প্রবণতা নয়; এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্প। হেফাজত একটি সংগঠনই শুধু নয়, বরং একটি মতবাদ -যার শিকড়ে রয়েছে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর নারীর দাস্যতা। নারী যখন নিজের কথা বলে, রাজনীতিতে পা রাখে, সম্পত্তির ভাগ চায়, তখনই তারা হয়ে ওঠে অস্থির।

সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাসে আমরা পাই সেই অনন্ত বাক্য -“নারীর শরীর নিয়ে যারা ধর্মের ব্যাখ্যা দেয়, তারা আসলে নিজের কামনা আড়াল করতে চায়।”
এই কথাগুলো যেন আজ হুবহু সত্য হয়ে ফুটে উঠছে -ধর্মের নামে যারা নারীকে গালি দেয়, তারা কেবল নারীকেই অপমান করছে না; তারা অবমাননা করছে কোরআনের বাণী, কলঙ্কিত করছে রাসুল (সা.)-এর উদার আদর্শকেও।

নারী অবমাননা আজ আর ব্যক্তিগত বিকার নয় -এটি রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রতিহত করার একটি সাংগঠনিক প্রচেষ্টা। এবং এই প্রচেষ্টার মূলে রয়েছে ধর্মের মুখোশে লুকানো পুরুষতান্ত্রিক লালসা।

তাই প্রয়োজন একটি প্রগতিশীল অবস্থান, যেখানে নারী পাবে সম্মান, অধিকার আর স্বাধীনতা -ধর্মের সেই ব্যাখ্যায়, যার কেন্দ্রে থাকবে ঔদার্য, সুবিবেচনা আর মানবতা।

লেখক: সাংবাদিক 
৪ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login