Posts

নন ফিকশন

হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম): মানবতার মহান আদর্শ ভূমিকা

May 5, 2025

Nafis Jsjs

102
View

হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানবজাতির ইতিহাসে এক অসাধারণ ও অনন্য ব্যক্তিত্ব।

 

তিনি কেবল ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক নন, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ, যাঁর জীবন ও শিক্ষা আজও পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবনের দিকনির্দেশনা হয়ে আছে। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মানবতা, ন্যায়বিচার, সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যে ভরা।

 

জন্ম ও বংশ:

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরাইশ বংশের সম্মানিত পরিবারে জন্ম নেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি জন্মের আগেই পিতাকে হারান এবং মাত্র ছয় বছর বয়সে মাতাও ইন্তেকাল করেন। এরপর তাঁকে লালন-পালন করেন প্রথমে দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব।

 

শৈশব ও চরিত্র:

শৈশবকাল থেকেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন অত্যন্ত সত্‍‌ চরিত্রের অধিকারী। তিনি কখনও মিথ্যা বলতেন না, কখনও কারও ক্ষতি করতেন না। মক্কার মানুষ তাঁকে “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত) ও “আস-সাদিক” (সত্যবাদী) উপাধি দেয়। তিনি মানুষের প্রতি দয়ালু, দানশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন।

 

বিবাহ ও পারিবারিক জীবন:

২৫ বছর বয়সে তিনি বিবাহ করেন খাদিজা (রাঃ)-কে, যিনি একজন ধনী ও সম্মানিত ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সততা ও চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিজে প্রস্তাব দেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও প্রেমময়। তাঁদের ঘরে জন্ম হয় ফাতিমা (রাঃ) সহ আরও কয়েকজন সন্তান।

 

নবুওয়াতের শুরু:

৪০ বছর বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রথম ওহি লাভ করেন। ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ) এসে তাঁকে আল্লাহর বাণী শোনান:

“ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক।”
(তোমার প্রভুর নামে পড়, যিনি সৃষ্টি করেছেন।) – (সূরা আল-আলাক, আয়াত ১)

এই থেকেই শুরু হয় তাঁর নবুওয়াত এবং ইসলাম প্রচারের কার্যক্রম।

 

ইসলাম প্রচার এবং প্রতিক্রিয়া:

নবুওয়াত লাভের পর তিনি ধীরে ধীরে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। প্রথমে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বন্ধুদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ), চাচাতো ভাই আলী (রাঃ), মুক্ত হাবশী দাস হযরত বিলাল (রাঃ), বন্ধু আবু বকর (রাঃ) প্রথম দিককার মুসলিমদের অন্যতম।

কিন্তু মক্কার কুরাইশ নেতারা তাঁর প্রচারে বিরক্ত হয়ে উঠে। তারা ইসলাম প্রচার বন্ধ করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে— অপবাদ, নির্যাতন, অর্থনৈতিক অবরোধ এমনকি হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ধৈর্যের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।

 

তায়েফের ঘটনা:

মক্কায় প্রচণ্ড বিরোধিতা ও নির্যাতনের কারণে তিনি তায়েফ শহরে ইসলাম প্রচারে যান। কিন্তু সেখানেও তিনি অবজ্ঞা ও পাথর নিক্ষেপের সম্মুখীন হন। পায়ে রক্ত ঝরলেও তিনি তাদের জন্য দোয়া করেন:

“হে আল্লাহ! এদেরকে হেদায়েত দাও, এরা জানে না আমি কে।”

এই ঘটনা তাঁর দয়া ও সহনশীলতার নিদর্শন হয়ে আছে।

 

মেরাজ:

এক রাতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সাত আসমান অতিক্রম করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ঘটনাকে “ইসরা ও মেরাজ” বলা হয়। এই সফরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়।

 

হিজরত (মদিনায় গমন):

৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছালে তিনি আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান সবাই একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করত। এখানে তিনি শুধু নবী নন, রাষ্ট্রনায়ক, বিচারক ও সেনাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

 

যুদ্ধ ও আত্মরক্ষা:

ইসলাম প্রচারে বাধা ও হামলার কারণে তিনি ও মুসলিমরা আত্মরক্ষার্থে কয়েকটি যুদ্ধ করতে বাধ্য হন — যেমন বদর, ওহুদ, খন্দক প্রভৃতি। এসব যুদ্ধে তাঁর সাহস, কৌশল এবং দয়া দেখা যায়। যুদ্ধের সময়ও তিনি নারীদের, শিশুদের ও সাধারণ নিরস্ত্র লোকদের ক্ষতি করতে নিষেধ করতেন।

 

মক্কা বিজয়:

৮ হিজরিতে তিনি বিশাল এক বাহিনী নিয়ে মক্কা নগরী শান্তিপূর্ণভাবে বিজয় করেন। মক্কার মানুষরা আশঙ্কা করছিল প্রতিশোধ হবে, কিন্তু তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন। বলেন:

"আজ তোমাদের উপর কোন দোষারোপ নেই, তোমরা মুক্ত।"

এই উদারতা ইতিহাসে বিরল উদাহরণ হয়ে আছে।

 

বিদায় হজ ও শেষ ভাষণ:

১০ হিজরিতে তিনি বিদায় হজ পালন করেন এবং আরাফার ময়দানে লাখো সাহাবীর সামনে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন, যা “বিদায় হজের ভাষণ” নামে পরিচিত। সেখানে তিনি মানবাধিকার, নারী অধিকার, বর্ণবাদ বিরোধিতা, এবং ইসলামের মূলনীতি তুলে ধরেন।

“সকল মানুষ আদমের সন্তান, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। কোনো আরবের উপর অনারবের, কিংবা অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠতা নেই — শুধুমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে।”

 

ইন্তেকাল:

১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে), তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর আগে তিনি শুধু একটাই বার্তা দিয়ে যান:

“আমার পরে যদি তোমরা কুরআন ও আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।”

 

উপসংহার:

হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন এক পরিপূর্ণ মানুষ — একাধারে নবী, নেতা, শিক্ষক, বিচারক ও স্বামী। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করলেই পৃথিবীতে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তিনি সত্যিই ছিলেন:

"রহমাতুল লিল-আলামিন"সমগ্র জাহানের জন্য রহমত।

Comments

    Please login to post comment. Login