‘হুজুরাত’ -পবিত্র কোরআনের ৪৯তম সূরা, যার অর্থ ‘অন্দরমহল’। মদিনায় অবতীর্ণ এই সূরাটি যেন মুসলমানদের শিষ্টাচার, সামাজিক ভারসাম্য এবং হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতার বিধান হিসেবে নেমে এসেছে ঐশ্বরিক আসমান থেকে। মাত্র ১৮ আয়াতের এই সূরার প্রতিটি বাক্য যেন আমাদের আজকের অস্থির সমাজে এক একটি স্থিতধী আয়না -যেখানে আমরা নিজেদের বিকৃত প্রতিবিম্ব দেখে শঙ্কিত হতে পারি, যদি অন্তরে সামান্য তাকওয়ার রেখাপাতও থেকে থাকে।
এই সূরার মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ আমাদের শিখিয়েছেন—
এক. “ফাসিক তথা ইসলামিক আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তির সংবাদ যাচাই ছাড়া বিশ্বাস করো না।” (আয়াত: ৬)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভাইরাল অসুখের যুগে যখন মিথ্যা গুজব বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই আয়াত যেন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।
দুই. “বিবদমান দুটি পক্ষের ঝামেলা ন্যায়পন্থায় মীমাংসা করবে। সর্বাবস্থায় ইনসাফ করবে।” (আয়াত: ৯)। সত্য ও ন্যায়ের অনুপস্থিতিই জাতিকে বিভক্ত করে দেয়। দ্বন্দ্ব নয়, সংলাপই ইসলামের পথ।
তিন. “উপহাস করো না। দোষারোপ করো না। কারো নাম বিকৃত করো না, মন্দ নামে ডেকো না।” (আয়াত: ১১)। আজকাল একে অপরকে হেয় করার প্রতিযোগিতায় সমাজ যেন নৈরাজ্যের পাকে ঘুরছে। অথচ কোরআনের নির্দেশনা একেবারে স্পষ্ট -শালীনতাই মুমিনের আসল পরিচয়। মন চাইল আর কাউকে কাফের, মুরতাদ, বেশ্যা -ঘোষণা করে দিলাম; এমনটি ইসলামের শিক্ষা নয়।
চার. “কারও পেছনে নিন্দা করো না। মন্দ ধারণা থেকে বিরত থাকো। ছিদ্রান্বেষণ করো না।” (আয়াত: ১২)। কারো ব্যক্তিগত জীবনে অনুপ্রবেশের অভ্যাস আমাদের হৃদয়ের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়। যারা গীবত করে, তারা যেন নিজের মৃত ভাইয়ের মাংস খায় -এতটাই ভয়াবহ এই অপরাধের তুলনা।
পাঁচ. “মর্যাদার মূল মাপকাঠি তাকওয়া তথা মহান আল্লাহর ভয়।” (আয়াত: ১৩)। জন্ম, বংশ, পদমর্যাদা নয় -আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ সেই, যার হৃদয় তাকওয়া তথা আল্লাহ্'র ভয় বা সংযমে ভরপুর।
আজকের বাংলাদেশে যখন এক শ্রেণির ধর্মগুরু নারীদের সম্মানহানিকর ভাষায় আক্রমণ করে চলেছে, বিরুদ্ধ মতকে ‘কাফের’ বলে ঘৃণার সঞ্চার করছে -তখন হুজুরাত সূরা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়: ইসলাম কেবল নামাজ-রোজা নয়, ইসলাম মানে সুন্দর চরিত্র, ইসলাম মানে আত্মশুদ্ধি, ইসলাম মানে মানবিক শুদ্ধাচার।
আসুন, আমরা ঘৃণাব্যঞ্জক শব্দে নয় -নৈতিকতায় বড় হই। বিদ্বেষ নয় -ভালবাসা ছড়াই। হুজুরাত সূরার আয়নায় মুখোমুখি করি বিপথগামী নিজের অস্তিত্বকে। আমার সদাচারে ফুটে উঠুক ব্যক্তির শান্তির স্বধর্ম।
লেখক: সাংবাদিক
৫ মে ২০২৫