এরপর ঘরজোড়া নিস্তব্ধতা কাটিয়ে হেনা নিচু গলায় বললো,
"সাহেব… আমার বয়স এখন ২৩ হবে। তুমি ভাবছো আমি কী করে এমন জায়গায় এলাম?"
আরিয়ান কিছু বললো না। চুপ করে শুনতে লাগলো।
হেনা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"আমার বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক। আমাদের বাড়ি ছিল ধানমন্ডিতে। ভালো স্কুলে পড়তাম, ইংলিশ মিডিয়ামে এরপর কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। আমি ছোটবেলা থেকেই খুব প্রাণবন্ত ছিলাম।"
তারপর হঠাৎ একটু থেমে গেলো সে। গলার স্বর একটু শক্ত করে বললো,
"I was twenty when Ratan kidnapped me. He locked me in this world of darkness. I screamed, I cried… but no one came. He changed everything. My name. My clothes. My life."
আরেকটু চুপ থেকে কাঁপা গলায় বললো,
"সব পথ বন্ধ… আমি পালাতে গিয়েও পারি নাই। কেউ বিশ্বাস করে না। বাবাও খুঁজে পায়নি আমাকে। হয়তো ধরে নিয়েছে আমি পালিয়ে গেছি… বা মরেই গেছি…"
হেনার চোখে জল টলমল করছিল, কিন্তু সে কাঁদলো না।
"এইখানে মানুষ বাঁচে না সাহেব। শুধু টিকে থাকে। আমি টিকে আছি। কিন্তু তুমি… তুমি আলাদা। তুমি এখনো চোখে আগুন নিয়ে কথা বলো। তাই বলছিলাম, তোমার পালানো দরকার… আমার না।"
আরিয়ান অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো হেনার দিকে। এত কষ্টের গল্পের পেছনে একটা নিস্তব্ধ অথচ অসম্ভব সাহসী মেয়েকে সে দেখতে পেলো।
আরিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে, চোখে একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বলল,
"তুই… তুই কয়জনের সাথে রাত কাটিয়েছিস এই প্রযন্ত?"
হেনা মাথা নিচু করে শান্ত গলায় বলল,
"সাহেব… এই পর্যন্ত আমার ভাগে পড়েছে ৩০ জন কাস্টমার। কিন্তু সত্যি বলতে… এই তিন বছরে ৫ বার শুধু এমন হয়েছে, যখন আমি সত্যি নিজেকে বাঁচাতে পারিনি। আর আজ… তুমিই হলে ৫ তম।"
তার গলাটা কেঁপে উঠল। কথা শেষ করে সে চুপ করে গেল।
আরিয়ান বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
"চুপ কেন? বল না… কথা থেমে গেল কেন?"
হেনা চোখ তুলে তাকাল না, কিন্তু তার ভেতরের ভাঙন যেন পুরো ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।
আরিয়ান ধমক দিয়ে বলল,
"চুপ করে থাকিস না হেনা! আমি জানতে চাই… কীভাবে ৩০ জনের মাঝে ৫ জনের সাথেই শুধু এটা ঘটলো? বাকিদের সময় তুই কী করছিস?"
চোখের পাতা কাঁপছিল। শেষে আর বাধা রাখতে না পেরে ধীরে ধীরে বলল,
"সাহেব… আমি বুদ্ধি করতাম। আমি সবসময় কাছে ঘুমের ওষুধ রাখতাম… আর একটা করে মদের বোতল। যখন বুঝতাম কেউ আসছে, তখন সুযোগ বুঝে ওষুধ মিশিয়ে দিতাম মদের মধ্যে। তারা ঘুমিয়ে পড়ত… আর আমি রেহাই পেতাম।"
সে গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলল।
"এই জায়গায় কেউ কাউকে কিছু বলে না সাহেব। কেউ কিছু জানে না… জানতেও চায় না।"
আরিয়ান স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখে যেন ধীরে ধীরে কিছু বদলাতে লাগল—ঘৃণার জায়গায় জন্ম নিতে লাগল করুণা… আর এক অদ্ভুত বেদনা।
আরিয়ান চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল,
"তাহলে বলো হেনা… ওই ৪ জনের বেলায় কি হয়েছিল?"
হেনা একবার চোখ বন্ধ করল। ঠোঁট কাঁপছিল। তারপর ফিসফিস করে বলল,
"ওই ৪জন… ওরা ছিল ভয়ঙ্কর কামিনা। আমি কিছু করার আগেই… ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ত আমার উপর। আমার হাত-পা শক্তি কিছুই থাকত না সাহেব… শুধু চোখের পানি পড়ত। আমি চিৎকার করতে পারতাম না, কারণ এই দেয়ালও এখানে বোবা… কিছু শোনে না…"
তার গলা ধরে এলো।
"আমি তো বাঁচতে চাইনি সাহেব… কিন্তু মরে গিয়েও মরিনি। বেঁচে থেকে শুধু শরীরটা দিয়েছি, মনটা আমি কারও হাতে দিইনি কোনোদিন… কাউকে না…"
আরিয়ানের চোখ ভিজে এলো। সে বুঝতে পারছিল, এই মেয়েটির শরীরের ওপর যতটা অত্যাচার হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মনটা। সে কিছু বলতে পারল না—শুধু হেনার দিকে তাকিয়ে রইল নীরবে।
চলবে......