বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মানুষ মানত করে, মোমবাতি জ্বালায়, সুতা বাঁধে। বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় ও লোকজ সংস্কৃতিতে এই ধরনের বিশ্বাস ও প্রথার অনুশীলন যুগ যুগ ধরে চলমান। একে ‘শিরক’ আখ্যা দিয়ে সম্প্রতি মাদারীপুরে স্থানীয় কিছু ধর্মান্ধ মুসল্লি ২০০ বছরের পুরোনো একটি বটগাছ কেটে ফেলেছেন। এটি নিছক গাছ কাটার ঘটনা নয়, এটি আমাদের সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা, ঐতিহ্যচেতনা ও ইতিহাস-সচেতনতার বেদনাদায়ক অপমৃত্যু।
অন্যদিকে কুড়িগ্রামের কচাকাটা কলেজের ফাইনান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক লাকী খাতুন সামাজিক মাধ্যমে নারীর পর্দা প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে একটি মতামতভিত্তিক পোস্ট দিয়েছিলেন। সেই পোস্টকে কেন্দ্র করে উসকে ওঠে স্থানীয় উত্তেজনা। বাধ্য হয়ে তিনি পোস্টটি মুছে ফেলার পাশাপাশি ফেসবুক লাইভে এসে দুঃখ প্রকাশ করেন। তবু রেহাই মেলেনি। রাতে গ্রাম্য সালিস বসে। সেখানেও তাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয় তার ‘অপরাধবোধ’, ‘ভবিষ্যৎ আচরণ’ ও ‘মনোভাব’ নিয়ে। মোরাল পুলিশিং নামের এই তথাকথিত সালিশ সভা আদতে এক নারীর বিরুদ্ধে শাসন ও সামাজিক নিপীড়নের অশুভ অনুশীলন ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রভাষক লাকী খাতুন আরও একটি পোস্টে কবি শেখ ফজলুল করিমের কালজয়ী কবিতা স্বর্গ-নরক থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন। সেই কবিতাও ‘ধর্মবিরোধী’ আখ্যা পেয়ে সালিশে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হন তিনি। কবিতার মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ওই কবিতাকে সমাজে শিরক, নৈতিক অবক্ষয় ও ব্যভিচার ছড়ানোর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করতে তৎপর হয়ে ওঠেন মুসুল্লিরা।
আমরা যারা স্কুলজীবনে ‘ভাবসম্প্রসারণ’ করে এই কবিতার অন্তর্নিহিত মানবতাবাদী সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে শিখেছি, তারা জানি -এই কবিতা মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, প্রীতি ও মিলনের পক্ষে এক অনন্য বয়ান। সে কবিতাটি আজকের প্রজন্মের পাঠ্যপুস্তকে আছে কিনা, এখনকার ছেলেমেয়েরা মন দিয়ে পাঠ করে কিনা জানি না।
মূল প্রশ্ন হলো -শতবর্ষ প্রাচীন গাছ কাটার মতো বোধহীন আচরণ কিংবা উচ্চশিক্ষিত এক নারীর চিন্তাধারার স্বাধীনতা দমনকারী যারা, সেই অন্ধকারাচ্ছন্নদের দায় কে নেবে? তাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতা, কূপমণ্ডূকতা ও অসহিষ্ণুতা এই সময়ের দর্পণে কবে প্রতিফলিত হবে? কবে রাষ্ট্র কিংবা সমাজ আধুনিকতা, মানবিকতা ও যুক্তিবাদের পথে চলার সাহস দেখাবে?
শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব কিংবা সংস্কার দিয়ে রাষ্ট্র রক্ষা হয় না। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা না গেলে, নৈতিক ও মানবিক বিকাশ না ঘটলে, বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার ব্যর্থ গন্তব্যেই আটকে থাকবে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বসভায় আমরা থাকবো একেবারেই তলানিতে। আমাদের স্বপ্নবিহীন কুঁড়েঘরে বেহেশত আর কখনো এসে দাঁড়াবে না।
এই দেশের কোনো কবি হয়তো
আর কোনোদিন লিখবেন না:
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।”
লেখক: সাংবাদিক
৬ মে ২০২৫