রাত তখন দুটো। চারদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু মাঝে মাঝে পুকুরপাড়ের ঝোপ থেকে এক-আধটা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে উঠছে। শহরের ব্যস্ততা থেকে অনেক দূরে, একেবারে গ্রামবাংলার নিঃশব্দ এক কোণে বসে আছে মানাফ। তার সামনে খোলা একটি চিঠি—পুরনো, মলিন কাগজ, হাতে লেখা। চোখে একটানা তাকিয়ে আছে সে চিঠিটার দিকে। যেন প্রতিটি অক্ষরে মিশে আছে তার জীবনের রক্তক্ষরণ।
মানাফ ছিল এই গ্রামেরই ছেলে। খুব সাধারণ, গরিব ঘরের সন্তান। মা ছিলেন না, বাবা এক কাঠমিস্ত্রি। সকাল থেকে রাত অবধি খেটে খেটে সংসার চালাতেন। ছোটবেলা থেকেই মানাফ পড়াশোনায় ভালো ছিল। শিক্ষকরা বলতেন, “এই ছেলেটার চোখে একটা আলাদা আলো আছে।” কিন্তু আলো থাকা আর আলোয় হাঁটা—এটা এক না।
স্কুলে থাকতেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইক্রির। ইক্রি ছিল মধুর মতো—নরম, হাসিমুখের, আর নিঃশব্দ ভালোবাসায় ভরা। ওরা প্রথমে বন্ধু হয়েছিল, তারপর কবে যে ভালোবাসা এসে বাসা বাঁধল—তা তারা নিজেরাও টের পায়নি।
ইক্রির বাবা ছিলেন গ্রামের চেয়ারম্যান। সম্ভ্রান্ত পরিবার। তাদের সঙ্গে মানাফের কোনো তুলনা চলে না। কিন্তু ভালোবাসা তো তুলনার হিসাব রাখে না।
এক বিকেলে, গ্রামের মেলার শেষে, নদীর পাড়ে বসে ইক্রি বলেছিল, “মানাফ, তুমি যদি একদিন চলে যাও, আমি কোথায় থাকব?”
মানাফ হেসে বলেছিল, “তুমি আমার বুকের ডানদিকে থাকবে। ঠিক হার্টের পাশে। কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু আমি প্রতিবার নিশ্বাস নিলে তুমি টের পাবে।”
সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল হাজারটা ভয়। কারণ মানাফ জানত—এই সম্পর্ক টিকবে না। সমাজ, অর্থ, অবস্থান—সব কিছুর দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে তাদের মাঝে। কিন্তু তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে, তাই না?
একদিন ইক্রির বাবা জানতে পারলেন সব। গ্রামের মধ্যে মানাফ আর ইক্রির নাম ছড়িয়ে পড়ল। লোকজন ফিসফাস করতে লাগল। আর তখনই নেমে এল ঝড়। ইক্রিকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হলো না। মানাফের বাবাকে ডেকে হুমকি দেওয়া হলো—ছেলেকে যেন বোঝায়, নইলে ফল ভালো হবে না।
কিন্তু ভালোবাসা কখনো ভয় মানে না। মানাফ ঠিক করল—সবকিছু ফেলে ঢাকায় চলে যাবে, লেখাপড়া শেষ করবে, একটা ভালো চাকরি পাবে, তারপর ইক্রিকে নিয়ে ফিরবে। সে বিশ্বাস করত, “যদি মন থেকে চাও, সবকিছু সম্ভব।”
চলে যাওয়ার আগের রাতে, মানাফ একটা চিঠি লিখল ইক্রিকে। সেখানে সে প্রতিশ্রুতি দিল—সে ফিরে আসবে। “ইক্রি, আমি কষ্ট করব, রাতদিন এক করে কাজ করব, শুধু তোমার হাত ধরার জন্য। তুমি শুধু অপেক্ষা করো।”
চিঠিটা সে একটা পুরনো কুড়েঘরের জানালায় রেখে আসল—যেখানে ওরা সবসময় দেখা করত।
ঢাকায় গিয়ে মানাফ শুরু করল এক নতুন যুদ্ধ। হোস্টেলে থাকত, দিনভর ক্লাস করত, রাতে টিউশনি করে টাকা জোগাড় করত। দিনের শেষে শরীর ক্লান্ত হলেও চোখে ছিল স্বপ্ন। প্রতিবার পকেটে হাত দিয়ে চিঠির কপিটা বের করে দেখত—ইক্রির নাম লেখা চিঠি।
এভাবে কেটে গেল পাঁচ বছর। মানাফ এখন একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, মেসে না থেকে ছোট্ট একটা বাসায় থাকে। বুকের মধ্যে প্রতিদিন সেই প্রতিশ্রুতির আগুন জ্বলে—সে ফিরে যাবে।
ফিরলও।
কিন্তু যেদিন সে ফিরল, গ্রামের দৃশ্য বদলে গেছে। নতুন পাকা রাস্তা হয়েছে, মোবাইল টাওয়ার উঠেছে। কিন্তু মানুষের মন বদলায় না—এখনও তাকে কেউ পছন্দ করে না। সে সরাসরি গেল ইক্রিদের বাড়ির সামনে। বাকি কথাবার্তা পরে, আগে ওকে একবার দেখতে চায়।
কিন্তু বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল, এক বুড়ো দারোয়ান দরজা খুলে বলল, “ইক্রি আপা? আপনি তো জানেন না?”
“জানি না মানে?” মানাফের গলা কাঁপে।
“আপা তো তিন বছর আগে মারা গেছেন।”
পৃথিবী থেমে গেল।
“কী বলছেন আপনি? কেন?” মানাফ বুঝে উঠতে পারে না।
“ওই যে... ওনার বিয়ে ঠিক করেছিল ওর বাবা। আপা মানতে পারেননি। কিছুদিন পরেই একদিন জ্ঞান হারিয়ে পড়েন। হসপিটালে নেওয়া হলে জানা যায়—হার্টের প্রবলেম। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি।”
মানাফ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। পায়ের নিচে যেন মাটি নেই। হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে।
পরে জানতে পারল—ইক্রি মৃত্যুর আগে প্রতিদিন জানালায় চিঠি খুঁজত। অপেক্ষা করত মানাফের। কেউ জানত না—সে ঠিক কতটা বিশ্বাস করেছিল মানাফ ফিরবে।
চিঠি... মানাফের সেই চিঠিটা তখনও সেই কুড়েঘরের জানালায় ছিল। বাতাসে হলুদ হয়ে গেছে, অক্ষরগুলো ফ্যাকাসে। কিন্তু ভালোবাসা ফ্যাকাসে হয় না।
মানাফ সেই কুড়েঘরের জানালায় বসে আছেই। চিঠি হাতে। রাত দুটো বাজে। চোখে জল নেই, কিন্তু মনটা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে।
সে চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলে না। বুকের বাম পাশে রাখে। কারণ ওখানেই তো ইক্রির জায়গা।
শেষে শুধু একটা লাইন লিখে—“তুমি আমার নিশ্বাসে আছো, আজীবন।”