Posts

গল্প

চন্দ্রবিলার সেই শেষ রাত

May 7, 2025

alfraj

73
View

চন্দ্রবিলার সেই শেষ রাত

গ্রামের নাম শিমুলপুর। চারদিকে ধানক্ষেত, মাঝখানে একটা পুরোনো বন। বনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রবিলা — এক বিশাল, ভাঙাচোরা বাংলো। কেউ সেখানে যায় না। বাচ্চারা সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফেরে। বুড়োরা চুপচাপ হুঁকো টানে, যেন চন্দ্রবিলার নাম নিলেও সর্বনাশ হবে।

তবু, শহরের ছেলে আরমান এসব কথায় বিশ্বাসী নয়। সে পেশায় এক আরবান এক্সপ্লোরার। পুরোনো বাড়ি-দালান ঘুরে ঘুরে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে দেয়। এইবার সে ঠিক করল — চন্দ্রবিলার রহস্য ফাঁস করবে।

গাঁয়ের লোকজন বারবার সাবধান করল,

“বাবা, ওই বাড়িতে রাইতে মানুষ যায় না। শেষবার যে গেছিলো, তার ছায়াও আর ফেরেনি।”

কিন্তু আরমান হাসল। আধুনিক ক্যামেরা, শক্তিশালী হেডল্যাম্প আর পাওয়ার ব্যাঙ্ক নিয়ে সে রওনা দিল। রাত তখন ১০টা বাজে

বাংলোর প্রথম প্রহর

চন্দ্রবিলার ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই আরমান বুঝল — বাতাসটা অন্যরকম। ঠাণ্ডা, কেমন ঘাম ধরিয়ে দেয়া ঠাণ্ডা। বাড়ির দরজা ঠেলতেই ক্যাঁচ করে আওয়াজ হলো। সাদা সিমেন্টের দেয়ালে ফাটল, ছাদের কোনায় বাদুড় ঝুলে আছে।

ঘরঘর শব্দে ফ্লোরবোর্ড কাঁপছিল। আরমান ক্যামেরা অন করল।

প্রথমেই সে দেখতে পেল পুরোনো সব ছবি — দেওয়ালে এক দাপুটে জমিদার প্রভীর রায়ের ছবি। পাশে স্ত্রী ও মেয়ের ছবি। কিন্তু মেয়ের মুখখানি ঝাপসা, যেন কেউ আঁচড়ে মুছে দিয়েছে।

রাত ১১টা পর্যন্ত আর কিছুই ঘটেনি। সে হাসতে হাসতে ক্যামেরায় বলল,

“সব গুজব! এই দেখুন দর্শক, আমি চন্দ্রবিলার ভেতরে একেবারে ঠিকঠাক…”

তখনই ঠক ঠক ঠক — উপরের ঘর থেকে শব্দ। আরমান থমকে গেল।

মধ্যরাতের বিভীষিকা

রাত ১২টা। হঠাৎ তার ক্যামেরা নিভে গেল — স্ক্রিনে ব্যাটারি লো দেখাচ্ছে, অথচ বেরোনোর সময় চার্জ ছিল শতভাগ। হেডল্যাম্পের আলো দুলে উঠল।

আলোর রেখা গিয়ে পড়ল ডান পাশের একটা দরজার উপর ঝোলানো পুরোনো আয়নায়। আরমান সেখানে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে চাইল। কিন্তু দেখে — নিজের বদলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে। তার চুল ভেজা, চোখদুটো ফাঁকা সাদা, ঠোঁটের কোণে রক্ত।

আরমান ঘুরে তাকালো — কেউ নেই।

তখনই আবার সেই শব্দ: ঠক ঠক ঠক। এবার নিচের মেঝে থেকে। আর সাথে সাথে একটা শিশুর হালকা হাসি ভেসে এল।

“তুমি এলেই বা কেন…?”
ফিসফিস করা আওয়াজ যেন দেয়াল ঘেঁষে ওকে ছুঁয়ে গেল।

গোপন সুড়ঙ্গের রহস্য

আরমান সাহস করে এগিয়ে গেল। বাংলোর ভেতরে খুঁজতে খুঁজতে সে পায় একটা কাঠের trapdoor — মেঝের নিচে একটা সুড়ঙ্গ। সে দরজা খুলল। ভেতর থেকে উঠে এলো পচা গন্ধ। বাতাস ভারী।

সুড়ঙ্গের নিচে গিয়ে দেখে — একটা পুরোনো বলির মণ্ডপ। দেয়ালে লেখা পুরাতন মন্ত্র, আর মাঝখানে এক ভাঙা কষ্টিপাথরের মূর্তি। তার চারপাশে কালো দাগ, যেন কেউ বহু বছর আগে এখানে রক্ত ছিটিয়েছে।

ক্যামেরা অন করতে গিয়েও পারল না। সামনে পড়ে ছিল একটা পুরোনো ডায়েরি। খুলতেই পড়ল:

"আমার মেয়েকে আমি উৎসর্গ করেছি… কিন্তু দেবতা চেয়েছে আরও। এখন চাঁদ উঠলেই নতুন বলি চাই…"

আরমান বুঝল — এই বাংলো আসলে একটা অন্ধকার শক্তির দরজা। জমিদার প্রভীর রায় নাকি এখানেই তার শয়তানের সাথে চুক্তি করেছিল। গ্রামের নিখোঁজ মানুষগুলো — তারাই বলির পাঁঠা।

শেষ মুহূর্তের বিভীষিকা

ঠিক তখনি সুড়ঙ্গের দেয়াল থেকে গুটিয়ে উঠল ছায়া। সেই মেয়েটি, যাকে আয়নায় দেখেছিল — এবার সামনে। ঠোঁটের কোণে রক্ত, সে ফিসফিস করল,

“তুমি আমার জায়গায় আসবে… চাঁদ উঠেছে... এবার তুমিই...”

আরমান দৌড়ে পালাতে চাইলো, কিন্তু সুড়ঙ্গের দরজা বন্ধ। চারপাশের দেয়াল থেকে বেরোতে থাকল মানুষের হাত — ঠান্ডা, শক্ত, মৃত হাত।

তার চিৎকারে বাংলো কেঁপে উঠল।

পরদিন সকাল

গ্রামের লোকজন বাংলোতে গিয়ে কিছুই পেল না। শুধু সুড়ঙ্গের মাঝখানে পড়ে ছিল আরমানের ক্যামেরার মেমোরি কার্ড।
তারা সেটি খুলে দেখে — প্রতিটা ভিডিওতে আরমানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেই সাদা চোখের মেয়ে। শেষ ক্লিপে আরমান চিৎকার করছে,

“আমাকে ছাড়ো! আমিও মানুষ... আমার ভিডিও…আমার দর্শকরা…!”

তারপর নিস্তব্ধতা।

উপসংহার

আজও চন্দ্রবিলার ফাঁকা জানালা থেকে কেউ কেউ রাতে আওয়াজ শোনে —
একজন ছেলের গলা, যে চেঁচিয়ে বলে,

“দর্শকবন্ধুগণ, স্বাগতম আমার নতুন ভিডিওতে… আজকের রাত আমার শেষ…”

🩸

চন্দ্রবিলা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মানুষ আর সাহস করে রাত্রি বেলা ঢুকে না। কারণ তারা জানে, যে ঢুকেছে, সে আর ফিরে আসেনি…

Comments

    Please login to post comment. Login