অধ্যায় ২৮: আয়নার ওপাশে
ঢাকার রাত। হাসপাতালের জানালা দিয়ে নীলচে চাঁদের আলো পড়ে এলিজার মুখে। শিশুটির কান্না থেমে গেছে। নার্সেরা বলেছে, এমন চোখ আগে দেখেনি—গভীর নীল, যেন সমুদ্রের গহ্বর থেকে উঠে এসেছে।
এলিজা শিশুকে বুকে টেনে নেয়। শিশুটির মুঠোয় শক্ত করে ধরা এক টুকরো কালো লিলির পাপড়ি। কে দিল? কেউ দেখতে পায়নি। বাতাস ভারি হয়ে ওঠে, দেয়ালের আয়নাটা দুলতে থাকে নিজে নিজে।
হঠাৎ আয়নায় ভেসে ওঠে আরিয়ানের মুখ। এইবার সে শুধু তাকিয়ে নেই—তার ঠোঁট নড়ে: "প্রতিটি জোয়ার ফিরে আসে… শুধু ফেনা চলে যায়।"
এলিজা নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। আয়নার ভেতর সমুদ্রের ঢেউ দেখা যাচ্ছে, আর ঢেউয়ের ফাঁকে এক শিশু—তার নিজের সন্তান—ডুবছে আবার ভেসে উঠছে। শিশুটির মুখে এলিজার ছায়া, কিন্তু চোখ ঠিক আরিয়ানের মতো নীল।
পেছনে নার্স চিৎকার করে ওঠে: "আয়নাটা… ফাটছে!"
এক ফাটল দেখা দেয় আয়নার মাঝ বরাবর। জল গড়িয়ে পড়ে আয়নার নিচ থেকে। এলিজা তাকিয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। শিশুটি হঠাৎ কেঁদে ওঠে, সেই কান্নার শব্দে ঘরের সব আলো নিভে যায়। কেবল আয়নার ফাটল দিয়ে জোয়ারের মতো জল ঢুকতে থাকে ঘরে।
এলিজা আয়নার দিকে হাত বাড়ায়… আয়নার ওপাশ থেকে শিশুটির হাতও বাড়ে।
দুটো হাত যখন মিলবে ঠিক তখনই—
ক্র্যাশ!
আয়না চুরমার হয়ে যায়। জল থেমে যায়। ঘর আবার নিঃশব্দ। নার্সরা ফিরে আসে, কিছুই দেখে না। আয়নার টুকরোগুলোতে এলিজা নিজেকে খুঁজে পায় না। শুধু সমুদ্রের ঢেউ আর দূরে জাহাজের ছায়া।
শিশুটি শান্ত হয়ে গেছে। তার ছোট আঙুলের মাথায় নীলচে আলোর ঝলকানি।
অধ্যায় ২৯: ঢেউয়ের ফেনায় লেখা নাম
রাত বাড়ে। এলিজা আয়নার ভাঙা টুকরোগুলো কুড়িয়ে নেয়। হঠাৎ দেখে, প্রতিটি কাচের টুকরোয় ভেসে উঠছে একেকটা নাম—পুরনো, ভিনদেশি নাবিকদের নাম।
এক টুকরোয় স্পষ্ট লেখা: Jonas Hale।
আরেকটায়: Clara।
শেষ টুকরোয় সে দেখে নিজের নাম: Eliza। তারপর… শিশুটির নাম, যেটা সে এখনও রাখেনি।
কাচে লেখা ভেসে ওঠে: "Lior"।
এলিজা চমকে ওঠে। এই নাম তার মায়ের ডায়েরিতে ছিল—যার মানে হলো "আলো"।
শিশুটি তখন ঘুমিয়ে, কিন্তু ঠোঁট নড়ে: "মা… জোয়ার আসছে…"
অধ্যায় ৩০: শেষ ঢেউ (উপসংহার)
সকালে হাসপাতালের করিডরে হঠাৎ ঝড় শুরু হয়। জানালার বাইরে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়, অথচ তারা তো ঢাকায়—সমুদ্র থেকে দূরে!
ডাক্তার রিপোর্ট নিয়ে আসে। শিশুটির রক্তে আবার সেই অজানা নীল রঞ্জক পাওয়া গেছে। রিপোর্টের কোণায় ডাক্তার হাতের লেখা: "শিশুর জিনোমে ১৮০২ সালের নাবিকদের সাথে মিল 98%। এইটা সম্ভব না।"
এলিজা জানে, সম্ভব। কারণ তার সন্তান শুধু মানুষ নয়। সে সমুদ্রের উত্তরাধিকারী।
শেষ দৃশ্য:
এলিজা আয়নার ভাঙা কাচের দিকে তাকায়… আর দেখে, ঢেউয়ের ফেনার মধ্যে ভেসে আছে আরও অনেক মুখ। তাদের চোখও নীল। আর সবাই তাকিয়ে আছে শুধু তার শিশুটার দিকে।
হঠাৎ শিশুটি হাসে। সেই হাসির সঙ্গে দূরে কোথাও এক লাইটহাউসের আলো ঝলকে ওঠে।
আর আয়নার ফাটল থেকে ভেসে আসে ফিসফিসানি:
"প্রতিটি ফেনা ফিরে আসে… এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।"
গল্প শেষ। না শুরু?