Posts

চিন্তা

দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক সমীকরণ: বাংলাদেশই কী পরবর্তী টার্গেট?

May 7, 2025

কামরুজ্জামান সাদ

78
View

উপর্যুপরি পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা, দেশের ভেতরে পলিটিক্যালি ও ইকোনমিক্যালি কোণঠাসা বিজেপির রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বার্থে পাকিস্তানে হামলা করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। বিজেপির একমাত্র রাজনৈতিক এজেন্ড  মুসলিম আর পাকিস্তান বিদ্বেষ। সর্বশেষ নির্বাচনে কোনঠাসা বিজেপি, শ্রীলংকা-মালদ্বীপ-বাংলাদেশ-চায়না-আমেরিকাতে একের পর এক ব্যর্থ কূটনীতি আর মুখ থুবড়ে পড়া পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিজেপি নিজ দেশে তুলোধুনো হচ্ছিল।

বিজেপি সরকারকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে এবং নিজেদের জাতীয়তাবাদী অবস্থান জোরদার করতে এমন এক “বাহ্যিক শত্রু” দরকার ছিল, যা তাদের ঘরোয়া ব্যর্থতা আড়াল করবে। পাকিস্তান সর্বদাই সেই সুবিধাজনক প্রতিপক্ষ, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কার তুললে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সমর্থন বাড়ানো সম্ভব।

ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপি, যার রাজনৈতিক ভিত্তি মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিমবিরোধী বক্তব্যের উপর দাঁড়ানো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক চাপে নাকাল। সর্বশেষ নির্বাচনগুলোয় তারা কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছে, আর্থিক খাতে উচ্চ বেকারত্ব, আয় বৈষম্যের বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলো জনমনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিদেশনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ময়দানেও তারা বেশ কিছু ব্যর্থতার মুখ দেখেছে — চীন, বাংলাদেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কেও নানা টানাপোড়েন।

ভারত ও পাকিস্তান, দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র, আবারো এক উত্তপ্ত সীমান্ত সংঘাতের মুখোমুখি। এই যুদ্ধ কোনো হঠাৎ স্ফুরণ নয়, বরং এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি মূলত একটি রাজনৈতিক হিসাবের ফলাফল।

আমার ভয়টা যেখানে, সেটা হলো পাকিস্তান ইস্যুটাতে যদি ভারত সুবিধা না করতে পারে তাহলে পরের টার্গেট কে হয়! ভারত খাগড়াছড়ি ও কুড়িগ্রাম জেলাতে যেভাবে পুশ ইন শুরু করেছে তাতে বাংলাদেশ পরের টার্গেট না হলেই ভালো। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গে ইন করতে হলে বাংলাদেশ নিয়ে ভয়ংকর কোনো গেম খেলতে হবে। সেটা কী নাগরিকত্ব ইস্যু, নাকি আরেকটা পেহেলগাম! যেটাতে বাংলাদেশের ইন্ধন খুঁজে বের করার একটা চেষ্টা অন্তত বিজেপি করবে।

আরেকটা বিষয় হলো, ভারতের জনগণ বলিউড দেখে দেখে একটা যুদ্ধ ফ্যান্টাসিতে ভোগে। যেমন বাংলাদেশের মুসলমানদের আছে গাজওয়াতুল হিন্দ‌ ফ্যান্টাসি। মনে হয় যুদ্ধ হলেই কিছু একটা করে ফেলবে তাদের বাহিনী; সব টেররিস্ট মেরে সাফ করে ফেলবে। কিংবা কেউ ভাবে কওমের সন্তানেরা নেমে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে। কতল করবে সব বিধর্মীদের‌। এতে হয়তো সাময়িক উত্তেজনা কাজ করে তবে এর খেসারত দিতে হয় মনুষ্য রক্তের মাধ্যমে আর কিছু অর্থের ঝনঝনানি। সামরিক বাহিনীর কেনা সরঞ্জামগুলো কেনা হয় মধ্যবিত্ত কেরানির টাকায় আর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা আধপেটা গরীব শ্রমিকদের টাকায়।

ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির শাসনকাল, এক বিপজ্জনক রূপ নিচ্ছে। দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, মুসলিমবিরোধী আইন, কাশ্মীর সংকট, চীন সীমান্তে ব্যর্থতা এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপে সরকার ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের সাথে “অপারেশন সিন্দুর” নামের সামরিক অভিযান শুরু করা হয়, যা আপাতদৃষ্টিতে সন্ত্রাসী ঘাঁটির ওপর আঘাত হিসেবে উপস্থাপিত হলেও, বাস্তবে এটি পাকিস্তানের সাথে এক সরাসরি সংঘাতের সূচনা। ভারতের প্রভাবশালী মিডিয়া এবং কূটনৈতিক মহল এই আক্রমণকে একটি “প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ” হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পাকিস্তান একে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবেই নিচ্ছে। বিশেষ করে এই হামলায় মসজিদে আঘাত হানা এবং এর ফলে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি, দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন ধরনের উত্তেজনার সূচনা করেছে, যা শুধু সামরিক নয়, বরং ধর্মীয় এবং প্রতীকী মাত্রা নিয়ে এসেছে। মোদীর “অপারেশন সিন্দুর” মূলত পাকিস্তানকে “রক্তের সিন্দুর” পরিয়ে দেওয়ার এক প্রতীকী প্রচেষ্টা, যা ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষায় মুসলমানদের দমনের একটি ‘পবিত্র’ মিশন হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

এই যুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যকার সামরিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর কূটনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলনও। বিগত এক দশকে ভারতের দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতি একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে। মালদ্বীপের নতুন সরকার প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, ভুটান ক্রমশ চীনের দিকে ঝুঁকছে, শ্রীলঙ্কা চীনা ঋণনির্ভরতার কারণে ভারতের প্রভাব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, শেখ হাসিনার ভারতঘেঁষা সরকার আগস্ট ২০২৪-এ গণঅভ্যুত্থানে মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং হাসিনা বর্তমানে ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন, যা নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। এক সময় ভারত যে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক অধিপতি ছিল, আজ তার সেই প্রভাব ধসে পড়ছে, আর মোদী সরকার এটিকে সামরিক ‘মাকআপ’ দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে।

সাউথ এশিয়া নিয়ে যাদের কনসার্ন বিশেষ করে যখন আমেরিকা ও চায়না কেউই দক্ষিণ এশিয়ায় বড় মাপের যুদ্ধ দেখতে চায় না। তারপরও এই সংঘাত চেষ্টা কার জন্য!

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধ এক মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা আজও সীমিত। ভারতের আগ্রাসন যদি কোনো এক ইলেকশনের সময় ‘শুভেচ্ছা মিসাইল’ আকারে এসে পড়ে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা বঙ্গোপসাগরীয় পোর্টগুলো রক্ষা করার কোনো বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা আজও আমাদের হাতে নেই। এর পেছনে দায়ী আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং ৫৪ বছরের রাজনীতিহীনতা।

অভিযোগ শোনা যায়, পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসে জড়িত, অথচ কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দেওয়া হয় না। পাকিস্তান আজ ভেঙে পড়া অর্থনীতির বোঝা টানছে, তাদের কি সত্যিই যুদ্ধ করার ক্ষমতা আছে? আর ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিবারই সমস্যার মূল হিসেবে মুসলিমদের, পাকিস্তানকে, বাংলাদেশকেও টেনে আনা হয়। সাম্প্রতিক কিছু বিষয়ে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ডিসইনফরমেশন ছড়িয়েছে। সব মিলিয়ে এটা এক ধরনের আত্মঘাতী জাতীয়তাবাদ, যা নিজেদের ভেতরের সমস্যাগুলো ঢেকে রাখে।

বাংলাদেশের মুসলমানদের একটা ফ্যান্টাসি হল, তারা মনে করে উপমহাদেশে একটি ধর্মযুদ্ধ হবে। যার নাম গাজওয়াতুল হিন্দ‌। ভারত যদি বাংলাদেশকে নিয়ে কোন চিন্তা করে সেই চিন্তাতে ঘি ঢালতে বাঙালি মুসলিম সমাজের গাজওয়াতুল হিন্দ ফ্যান্টাসিই যথেষ্ট। যা হয়তো ভারতের দিক থেকে কোনো ছোট উশকানিও রূপান্তরিত হতে পারে ভয়ংকর কোন যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায়। 

যুদ্ধের উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে শান্তি, সংলাপ আর যৌথ অগ্রগতির দিকে নজর দেওয়াই হবে দুই দেশের জন্য শ্রেয়। যুদ্ধের নয়, মানুষ বাঁচানোর ফ্যান্টাসি তৈরি হোক। আমরা যারা যুদ্ধ চাই না, তাদের জন্যই সময়টা আসলেই খুবই কঠিন।

Comments

    Please login to post comment. Login