Posts

চিন্তা

মাস্টারস অব ওয়ার: কারা খেলেন রক্তের খেলা?

May 7, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

128
View



‘অপারেশন সিঁদুর’ কিংবা ‘অপারেশন নারায়ে তাকবির’ -এই নাম নামান্তরে যখন যুদ্ধের দামামা বাজে, তখনও মোদি বা শাহবাজ শরিফের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে না। তাদের কেশাগ্রও ছেঁড়া যায় না। কারণ যুদ্ধ কখনও ক্ষমতাধরদের কাছে ব্যক্তিগত ক্ষতির বার্তা হয়ে ওঠে না; বরং তা হয়ে ওঠে মুনাফার ফর্মুলা, আধিপত্যের গাণিতিক হিসাব। যে আগুনে ঘর পুড়ে ছাই হয়, সেই আগুনেই তাঁরা রাঁধেন হীন রাজনীতি। 

গণতন্ত্রের মুখোশ পরে কিংবা ধর্মের চাদর গায়ে জড়িয়ে এই ‘যুদ্ধপ্রেমীরা’ বস্তুত নিছক একেকজন অস্ত্রবণিক। তাদের হাতে রক্ত আছে, ঘামে ভেজা মাঠ নেই। সেই অনন্ত চক্রান্ত আর বেদনাবিদ্ধ বাস্তবতা নিয়েই আজও অনুরণিত বব ডিলানের কণ্ঠস্বর— 

“You fasten the triggers
For the others to fire,
Then you sit back and watch
When the death count gets higher…” 

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ আসলে এক সুপরিকল্পিত ব্যবসা। প্রতিটি বুলেট, প্রতিটি মিসাইল, প্রতিটি বিধ্বস্ত গ্রাম -কেবল একেকটি হিসাবের খাতা, যেখান থেকে মুনাফা তোলে করপোরেট রাষ্ট্রযন্ত্র। এই কারণেই যুদ্ধ বন্ধ হয় না, বরং পরিকল্পিতভাবে জিইয়ে রাখা হয়। 

শিল্পী নচিকেতা যখন বলেন, ‘সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ—আপনি, আমি, আমরা,’ তখন আসলে আমাদের আত্মপ্রতিচ্ছবি উঠে আসে। কারণ রাজনীতির মঞ্চে যখন রণবাজি শুরু হয়, তখন সে যুদ্ধের ট্যাক্স, রক্ত ও প্রতীক্ষা বহন করে জনগণই। 

আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ আর উগ্রবাদ যেন একে অন্যের পরিপূরক। ধর্মীয় উগ্রতা ও সন্ত্রাসবাদ দমন করার বুলি যারা দেয়, সেই একই শক্তি আবার তা উসকে দিতেও পারঙ্গম। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ‘কেপটাগন’ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে গোটা মুসলিম বিশ্বের ওপর। ফলে ধর্মীয় উন্মাদনার নামে বিস্ফোরণ ঘটছে, আর সেই বিস্ফোরণ ঠেকাতে আবার বিক্রি হচ্ছে অস্ত্র, নজরদারি প্রযুক্তি, অপরাজনীতি। 

এই মৃত্যু-চক্রের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক -আমেরিকা, ইজরায়েল এবং রাশিয়ার মতো সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। 

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস অনুসারে, বর্তমানে পৃথিবীর ৫৬টি স্থানে সশস্ত্র সংঘাত চলছে। অথচ এই ভয়ংকর পরিসংখ্যানের তুলনায় আরও ভয়াবহ বাস্তবতা হচ্ছে -দারিদ্র্য, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও ঘনবসতির যাঁতাকলে পিষ্ট দক্ষিণ এশিয়া আজ আর কোনও যুদ্ধের চাপ নিতে প্রস্তুত নয়। 

কিন্তু তবু অস্ত্র আসছে, যুদ্ধজিগির তোলা হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাক-ভারত উত্তেজনা নিয়ে বলেছেন, ‘এটি লজ্জাজনক। আমি আশা করি, এটি বন্ধ হবে।’ এই ‘আশা’র জায়গায় তিনি চাইলে বলতে পারতেন, ‘এই যুদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না।’ কিন্তু তিনি বললেন না। কারণ যুদ্ধের ভেতরই যে মোড়লতন্ত্রের স্বার্থ নিহিত। 

শিল্পী নচিকেতা ভুল বলেননি। গণমানুষের মুখপাত্রের ভুল বকবার সুযোগও নেই, কারণ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে -যুদ্ধ কখনও শাসকের দরজায় দাঁড়ায় না, তা কেবল দরিদ্রের দরজায় ধ্বংস হয়ে নামে। 

ডিলানের ভাষায়,
“You hide in your mansion
While the young people's blood
Flows out of their bodies
And is buried in the mud"... 

জয়-পরাজয়ের উৎসবের আড়ালে থেকে যায় সাধারণ মানুষের ছিন্নভিন্ন জীবনের গল্প, কফিনবন্দি সম্ভাবনা, আর বোবা আর্তনাদ। যুদ্ধ আসলে তাদের জন্য নয়, যারা যুদ্ধ ঘোষণা করে; যুদ্ধ আসলে তাদের জন্য, যাদের রুটি ও রুহ ছিনিয়ে নেয় দুর্মর যুদ্ধ। 

লেখক: সাংবাদিক 
৭ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login