কোথায় লড়াই হয় রাজায় রাজায়,
ঘরের সারাই মোর খালী হয়ে যায়।"
বাংলা কাব্যধারায় মানবিক ব্যথাকে গভীর ও প্রতীকধর্মী ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আহসান হাবীব ছিলেন অনন্য। তাঁর ছায়া হরিণ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাষায় যুদ্ধ ও তার অভিঘাত তুলে ধরেছেন। যদিও কবিতাটি রচিত হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রেক্ষিতে, আজকের বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এটি যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক ও বিস্ময়করভাবে প্রগতিশীল।
যুদ্ধ প্রায়শই রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রনেতারা, সামরিক জোট ও বিশ্বশক্তিগুলি ভূখণ্ড, আধিপত্য ও আধুনিক কূটনীতি নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হয়। কিন্তু এ যুদ্ধের প্রকৃত শিকার হয় সাধারণ মানুষ—গ্রামীন কৃষক, শহুরে গৃহবধূ, শ্রমজীবী, উদ্বাস্তু ও শিশু।
"ঘরের সারাই মোর খালী হয়ে যায়" পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে কবি বোঝাতে চেয়েছেন—যে যুদ্ধ হয় সীমান্তে, তার প্রভাব এসে পড়ে একজন মানুষের ব্যক্তিগত সংসার ও জীবনে। যুদ্ধ ভাঙে ঘর, খালি করে থলে, নিঃস্ব করে হৃদয়।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ ও উত্তেজনার যে ছায়া ঘনিয়ে এসেছে, তা যুদ্ধ-পরবর্তী মানবিক সংকটের নতুন অধ্যায় রচনা করছে:
: ২০২৪ সালের শেষদিকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সহিংসতা থেকে ইরানের সরাসরি জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বিশ্বকে উদ্বেগে ফেলেছে। এই যুদ্ধ শুধুই ভূখণ্ডের নয়; এটি মানুষের নিরাপত্তা, মানবিক অধিকার ও অস্তিত্বের প্রশ্নে দাঁড়িয়েছে।
: ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়ার আগ্রাসনে ইউক্রেন আজও পীড়িত। ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সংকট, খাদ্য সরবরাহের ব্যাঘাত, এবং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এ যুদ্ধকে বিশ্বমানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে এক জ্বলন্ত সংকট করে তুলেছে।
: এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘর্ষ সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। আধিপত্যের এই প্রতিযোগিতা মানবিক শান্তিকে ছিন্ন করে দিচ্ছে।
এইসব যুদ্ধক্ষেত্র যেন নতুন করে কবিতার পঙ্ক্তিকে বাস্তব করে তোলে—
"যুদ্ধের ধ্বনি শুনি দূর সমুদ্রে,
কিন্তু তার ঢেউ লাগে বুকে আমার।"
কবিতার শেষ দুই পঙ্ক্তি—
"বাজারের থলে ফাঁকা পড়ে থাকে,
পিঁপড়ে এসে দেখে, ফিরে যায় হাহাকার।"
—যেন যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। যুদ্ধ মানেই খাদ্যসংকট, মুদ্রাস্ফীতি, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, লেবানন কিংবা আফগানিস্তানের মতো দেশগুলি এই ঢেউয়ের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠছে। পিঁপড়ে এখানে মানুষের প্রতীক, যা শ্রম করে, খোঁজে, সংগ্রহ করে; অথচ যুদ্ধ তা ব্যর্থ করে দেয়।
আহসান হাবীবের এই কবিতা শুধু একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভাষ্য নয়—এটি বিশ্বের যে কোনও যুদ্ধ-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আত্মপ্রকাশ। এটি কবিতার গঠনগত সৌন্দর্য নয়, বরং তার অন্তর্নিহিত বার্তা, মানবিক আবেদন ও সত্যের সামনে দাঁড়ানোর সাহস যা একে চিরন্তন করে তোলে।
আজকের দিনে, যখন যুদ্ধের ভয়াবহতা আবার নতুন করে দিগন্তে জমাট বাঁধছে, আহসান হাবীবের মতো কণ্ঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
রাজাদের যুদ্ধ ইতিহাসে লেখা হয়, কিন্তু প্রজার কান্না লেখা হয় অস্তিত্বের শূন্যতায়।
যুদ্ধ থামাতে কবিতা হয়ত যথেষ্ট নয়, কিন্তু কবিতাই আমাদের শেখায়—কেন যুদ্ধ থামানো প্রয়োজন।
০৮/০৫/২৫ ইং।