ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটা ঠিক যেন এক টুকরো সবুজ স্বপ্ন। লাল ইটের বিল্ডিং, পুরোনো আম গাছ, ব্যস্ত ছাত্রছাত্রীর ভিড়, আর সেই চিরচেনা টিএসসি—চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কাশফুলের মতো স্বপ্নগুলো যেন বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে , টিএসসির দেয়ালে আঁকা ছবি যেন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর কিছু নিঃশব্দ স্মৃতির। সবকিছু মিলে যেন একটা জীবন্ত কবিতা।
রোদেলা এক সকাল। হেমন্তের নরম রোদ গায়ে মেখে হাঁটছিল তন্ময় । প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে ইংরেজি বিভাগে। বুকের ভেতর একটু উত্তেজনা, একটু ভয়, আর অনেক অনেক আশা। নতুন জীবন, নতুন পথচলা।
তন্ময়ের প্রথম দিনের ক্লাসটা বেশ ভালোই কাটল। অধ্যাপকের কণ্ঠে সাহিত্যের ব্যাখ্যা শুনে তার মনে হলো—এ যেন শুধু পাঠ নয়, একেকটা কবিতার ভিতর ঢুকে পড়ার সুযোগ। সহপাঠীদের মুখে ছিল কৌতূহল আর চোখে স্বপ্নের ছায়া।ক্লাস শেষে নরম রোদ আর হালকা বাতাস মেখে সে হেঁটে গেল শহিদুল্লাহ হলে। লাল ইটের পুরোনো সেই হল, যেখানে ইতিহাস নিঃশ্বাস ফেলে।
বারান্দায় পুরনো খেয়ালের গন্ধ, দেয়ালে দেয়ালে সময়ের ছাপ—সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা।হলে ঢুকেই মনে হলো, এটাই হতে যাচ্ছে তার জীবনের নতুন ঠিকানা।শহিদুল্লাহ হলে ঢুকেই তন্ময়ের মনে হলো—এ যেন অন্য এক জগৎ।
প্রাচীন দরজা, মেঝেতে সিমেন্টের ধূসর ছাপ, আর দেয়ালে রয়ে যাওয়া কত শত ব্যাচের লেখা।
“২১০ নম্বর রুম” — দরজার গায়ে রঙচটা কালি, তবুও যেন কত শত স্মৃতির সাক্ষী।
রুমে ঢুকতেই পরিচয় হলো রুমমেটদের সঙ্গে।
রহমান, সমাজবিজ্ঞানে পড়ে—খুব হাসিখুশি। আরেকজন, মাহিন—গম্ভীর, সবসময় বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে থাকে, মাঝেমধ্যে দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে।
তন্ময়ের জন্য বরাদ্দ খাটটা জানালার ঠিক পাশে। সে ব্যাগটা নামিয়ে জানালার ধারে বসে পড়ল।
বাইরে চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে শহরের ছাদে ছাদে, দূরের গাছগুলোর ছায়া নেমে এসেছে হলের উঠানে।
সে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।রাত বাড়ে, কথা হয় রুমমেটদের সঙ্গে—কে কোথা থেকে এসেছে, কার বাড়ি কেমন, কে কী খেতে পছন্দ করে।
তন্ময় বুঝতে পারে—এখানে কেউই একা নয়, কারণ প্রত্যেকেই কারো না কারো মতো নতুন।
একদিন ক্যাম্পাসজুড়ে সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি।
আকাশটা ছিল ধূসর মেঘে ঢাকা, মাঝে মাঝে বিজলির রেখা যেন আকাশে আঁকা অজানা কবিতা।
তন্ময় শহিদুল্লাহ হল থেকে বের হলো ছাতা হাতে—চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজে, ভার্সিটির লাইব্রেরিতে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে।
সাহিত্যের গন্ধে ভেজা লাইব্রেরির সেই পরিচিত কোণায় গিয়ে বসল জানালার পাশে।
বাইরে তখন বৃষ্টির ছন্দ, পাতার ফাঁকে ফাঁকে জলবিন্দুর নৃত্য।
হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের ভেজা পথে এক মেয়ের দিকে।
নীল শাড়ি, ভেজা কালো লম্বা চুল, কপালে ছোট্ট টিপ।হাতভরা নীল চুড়ি, প্রতিটা দোলায় যেন একেকটা শব্দ বাজে—বৃষ্টির সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তার হাসিতে লেগে ছিল বৃষ্টির মতই স্বচ্ছ এক সরলতা, আর চোখে ছিল এমন এক ঝলক, যা তন্ময়ের দৃষ্টি আটকে দিল মুহূর্তে। সে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুদের মাঝে, কিন্তু তন্ময়ের চোখে যেন বাকি পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে গেছে।
মেয়েটির চোখে মুখে একরাশ চঞ্চলতা, ঠোঁটের কোণে দুরন্ত এক হাসি, যেন বৃষ্টি তার প্রিয় খেলার সাথী, আর এই ক্যাম্পাসটা তার নির্ভার পৃথিবী।সে কখনো চুল ঠিক করছে, কখনো জল ছিটিয়ে দিচ্ছে বন্ধুর দিকে।কখনো ছাতা ছুঁড়ে দিচ্ছে ওপরে, কখনো হাত বাড়িয়ে ধরছে আকাশের ফোঁটা—যেন জীবনকে ছুঁয়ে দেখছে প্রতিটি শিশিরবিন্দুর ছোঁয়ায়।তন্ময়ের মনে হলো—এ দৃশ্যটা কোনো গল্পের পাতায় আঁকা ছবি নয়,
এটা জীবন্ত, স্পন্দিত, রঙিন এক অনুভব—
তার নিজের জীবনের এক অনুচ্চারিত অধ্যায়,
যার শুরু হলো আজ, জানালার কাচের ওপারে
তন্ময় ঠিক তখনই শুনতে পেল—পেছন থেকে বন্ধুরা তাকে ডাকছে।
সে হেসে ইশারা করল, "এক মিনিট", বলে ফের একবার মেয়েটির দিকে ফিরে তাকাল।
কিন্তু তখন সে নেই।
বৃষ্টির ধোঁয়াটে পর্দার আড়ালে যেন মিলিয়ে গেছে মেয়েটি—
নীল শাড়ি, ভেজা চুল, আর রিনঝিন চুড়ির শব্দ...
সব মিলিয়ে যেন এক স্বপ্নের মতো হঠাৎ ক্ষয়ে গেল চোখের সামনে।
তন্ময় উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাঁচ ছুঁয়ে তাকাল চারদিকে—
ক্যাম্পাসজুড়ে ছিল শুধু বৃষ্টির শব্দ আর ছায়ার মতো মানুষ চলাফেরা।
সে খুঁজল, অনেক খুঁজল—
কিন্তু সেই মেয়েটি যেন শহরের হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে,……..