অধ্যায় ১: অপেক্ষার ছায়া
ছোট্ট একটি কাঁচা ঘর। খড়ের ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখা ছাদের উপর তখন টুপটাপ করে বৃষ্টির শব্দ পড়ছিল। ঘরের এক কোণে একটা কাঠের খাটে বসে ছিলেন রওশন আরা। মুখটা শুকনো, চোখে গভীর শূন্যতা। তবুও প্রতিনিয়ত সেখানে জমে উঠছে একরাশ জল—কান্নার জল। তবে সে কান্না কোনো আহাজারির নয়, সে এক নিঃশব্দ বেদনার জ্বলন্ত প্রমাণ।
রওশন আরা একজন মা। যিনি ছেলে রাকিবকে মানুষ করতে জীবনের সবটুকু সময় আর ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। তখন রাকিব মাত্র দশ বছরের। সেই থেকে একা হাতে সন্তানকে বড় করেছেন। নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা, জীবনের রঙিন চাওয়াগুলো একে একে বিসর্জন দিয়ে শুধু ছেলেটার ভবিষ্যতের পেছনে ছুটেছেন।
কিন্তু বছরখানেক হলো রাকিব শহরে চলে গেছে। পড়ালেখার কথা বলে গিয়েছিল, কিন্তু এখন সে আর ফোনও করে না। খরচের জন্য টাকাও পাঠায় না। মায়ের মন বারবার প্রশ্ন করে—এই ছেলে কি বদলে গেছে? নাকি কারো ভুল প্ররোচনায় পড়ে গেছে?
প্রতিদিন বিকেলে গেটের দিকে চেয়ে থাকেন রওশন আরা। হয়তো আজ রাকিব ফিরে আসবে। হয়তো আজ সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলবে—“আম্মু, আমি ফিরে এসেছি!” কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার আগে তার চোখে জমে ওঠে জল, আর বুকের গভীরে জন্ম নেয় এক নতুন অপেক্ষা।
এইভাবেই এক মায়ের কান্না রূপ নেয় জীবনের গল্পে। আর সেই গল্পেই শুরু হয় এক যন্ত্রণার যাত্রা, যার নাম—মাতৃত্ব।
অধ্যায় ২: শহরের দূরত্ব
ঢাকা শহরের কোলাহল, যানজট আর হাজারো মুখের মাঝে কোথাও একজন রাকিব হাঁটছে নিঃশব্দে। তার চোখে ক্লান্তি, কপালে চিন্তার ভাঁজ। হোস্টেলের ছোট্ট রুমে বসে একা একা বারবার ফোনটা হাতে নিচ্ছে, আবার রেখে দিচ্ছে। মায়ের নম্বর স্ক্রিনে ভেসে উঠছে, কিন্তু সে ফোন করছে না।
“আমি কীভাবে বলব আম্মুকে? ওনাকে তো বলেছিলাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু আমি তো চাকরির খোঁজে এসেছি, এখনো কোথাও কাজ জোটেনি।” — নিজের মনেই কথা বলছিল রাকিব।
একটি বেসরকারি অফিসে কনস্ট্রাকশনের কাজের চেষ্টা করছে সে, কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় ফিরিয়ে দিচ্ছে সবাই। দিন চলে যাচ্ছে, পকেটে টাকাও কমছে। হোস্টেল ভাড়া বাকি, খাওয়ার অভাবে মাঝে মাঝে শুধু পানি খেয়ে দিন পার করে।
মায়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা হুহু করে ওঠে রাকিবের। সেই হাসিমুখ, সেই হাতে রান্না করা গরম ভাতের গন্ধ, সেই কষ্টের ভিতরও চোখে রাখা মমতার দীপ্তি—সবই তার সামনে ভেসে ওঠে।
কিন্তু অপরাধবোধের পাহাড় তাকে বোবা করে দিয়েছে। সে ভাবে, “আম্মুকে এখন ফোন দিলে প্রশ্ন করবে—'বাবা, কেমন আছো?' আমি কি বলতে পারব, আম্মু, আমি ভালো নেই?”
এদিকে গ্রামে রওশন আরার প্রতিটি দিন এখন শুধু একটাই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে—“রাকিব কেন আর ফোন করে না?”
অধ্যায় ৩: না বলা কথার ভার
রওশন আরার চোখ এখন আগের চেয়ে আরও বেশি অশ্রুভেজা। গ্রামের মানুষজন জিজ্ঞেস করে,
— “আপার ছেলে কি ঢাকাতেই আছে?”
— “হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে,” — ছোট্ট করে উত্তর দেন তিনি। মুখে হাসি রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখ তাকে বিশ্বাসঘাতক করে দেয়।
প্রতিদিন নামাজ শেষে মোনাজাতে একটাই কথা বলেন, “হে আল্লাহ, আমার রাকিবকে ভালো রাখিস। ওর মুখটা যেন আর একবার দেখি…”
একদিন দুপুরে পাশের বাড়ির রাশেদা বেগম এসে বললেন,
— “আপা, শুনলাম শহরে আপনার রাকিবকে নাকি কেউ রিকশা চালাতে দেখেছে?”
রওশন আরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন। গলা শুকিয়ে এলো। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
— “নাহ, ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে… কই, ও তো আমাকে এসব কিছু বলেনি।”
কিন্তু মনে মনে একটা শব্দ বাজতে লাগলো— রিকশা?
ছেলেটা কি তবে সত্যিই কষ্টে আছে?
দুপুরে খাওয়ার থালা সামনে রেখেও খেতে পারলেন না রওশন আরা। বুকের ভেতর কেমন এক চাপা যন্ত্রণা। সন্তান যে মাকে বোঝায়নি তার কষ্ট, সেটাই তাঁর হৃদয়ের সবচেয়ে বড় আঘাত।