সমুদ্রের গর্জনটা দূর থেকে নয়, যেন একদম কানের পাশে—ধীরে, গম্ভীর আর গভীর।
ফাহিম শহরের কোলাহল থেকে ছুটি নিয়ে এসেছে সমুদ্রের ধারে, একটা অব্যবহৃত উপকূলীয় এলাকায়। মে মাসের মাঝামাঝি, ট্যুরিস্ট নেই বললেই চলে।
এ যেন একটা অনামা দুনিয়া।
বাতাসে লবণ আর ভেজা বালির গন্ধ।
সবকিছু এতটাই নীরব যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও অচেনা মনে হয়।
সামনে একটা পুরনো, ধূসর হোটেল—Sea Breeze Inn। তিনতলা, দেয়ালে স্যাঁতসেঁতে দাগ, কর্নিশে বসে থাকা কাক টা যেন কাউকে নজরে রাখছে।
ফাহিম হালকা নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে পা রাখে।
রিসেপশনে বসে থাকা মাঝবয়সী লোকটা যেন রোবটের মতো। কথাবার্তায় কেমন এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা।
–“আপনার জন্য ৩১৪ নম্বর ঘর ঠিক করা হয়েছে"।
ফাহিম একটু অবাক হয়।"সে তো এখনো কিছুই বলেনি ।"
–যদি নিচ তলায় কোনো একটা ঘর....
লোকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফাহিমের দিকে। সেই নিস্তব্ধতা যেন ফাহিমকে এক প্রকার থামিয়েই দেয়।
হঠাৎ লোকটি বলতে শুরু করে–
“আমরা যারা একা আসে, তাদের জন্য উপরের কোণার ঘরটাই দেই। সেটা পরিষ্কার করা আছে।"
ফাহিম আর কিছু না বলে চাবিটা নেয়।রাত ১:১২
ঘরটা অদ্ভুত নিরব।
জানালার ভারী পর্দা হাওয়াহীন বাতাসেও একটু কেঁপে ওঠে। ঘরের একটা দেয়ালে পুরনো জলরঙে আঁকা ছবি, ত্রিভুজাকৃতি মুখাবয়ব বিশিষ্ট মেয়ে, নাম লেখা নেই।
ঘাড়ের ব্যাগটা এক কোনে ফেলে রেখে সে বিছানায় আছড়ে পরে। যেন ঘরটা তাকে গিলে ফেলছে ধীরে ধীরে।
ঘরির কাঁটা এক রকম অলস ভাবে চলছে। সময় যেন তাকে জোর করে টেনে নিচ্ছে।
বাথরুম থেকে পানির টুপটাপ শব্দ।
সামনে এগোলেই দেখে কল বন্ধ।
আয়নার সামনে দাড়িয়ে হঠাৎ মনে হয়– চেহারাটা তার হলেও মুখে ক্লান্তির রেখা যেন অনেকদিনের।
ফাহিম পিছিয়ে আসে।
টিভি চালায়।
চ্যানেল আসে না—
শুধু সাদা-কালো স্ক্রিনে ঝিঁঝিঁ শব্দ... আর তার মাঝখানে এক পলক…
একটা মুখ!
মেয়ের মুখ।
চোখে ভয়, দৃষ্টিতে আকুতি।
ফাহিম চমকে উঠে টিভি বন্ধ করে দেয়। চোখ পড়ে দেয়ালে টাঙানো বিবর্ণ ছবিটির উপর। এ যেন অবিকল সেই মুখ!
নিঃস্তব্ধতা ঘন হয়। শুধু ঘরির টিক টিক টিক...রাত ৩:০৫
ঘরের এক কোণে পুরনো কাঠের ড্রয়ার।
মলিন, ধুলোমলিন।
ড্রয়ার খুলতেই বহুদিনের পূরানো ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া একটা পাতা। ফাহিম কাঁপা হাতে তুলে নেয়।
কালচে কালিতে অগোছালো অক্ষরে লেখা–
"ঘরটা আসলে আমাদের নয়, আমরা ঘরের"
ফাহিম তড়িঘড়ি করে দরজার সামনে যায়। দরজা বন্ধ। জানালা খুলে দেখে বাইরে সমুদ্র নেই, অন্ধকার, শুধুই অন্ধকার। ফাহিম পেছনে তাকায়। ঘরির কাঁটা থমকে আছে ৩.১৪ মিনিটে। আয়নায় তার প্রতিবিম্বটাও নেই। গলা শুকিয়ে আসে। সে ধীরে ধীরে আয়নার কাছে এগোয়। আয়নার কাঁচ ঘোলাটে। যেন কেউ ভেতর থেকে নিঃশ্বাস ফেলছে।
আঙ্গুল দিয়ে আয়নার কুয়াশা সরাতেই লেখা ফুটে ওঠে—
“তুমিও এখন এই ঘরেরই একটা চরিত্রমাত্র ”
ঘরের বাতি হঠাৎ নিভে যায়।
ফাহিম চিৎকার করতে চায়— but no sound!পরদিন সকাল ৮টা
রিসেপশনের ডেস্কে দাড়িয়ে নতুন এক অতিথি, আরিবা তাসনীম। ঘুরাঘুরি করতে এসেছে, একাই।
"একটা সিঙ্গেল রুম, যদি একটু নিরিবিলি হয় তো ভালো"
রিসেপশনিস্ট বলে
রুম নং ৩১৪! ঠিক আপনি যেমনটি চাচ্ছেন।
আরিবা প্রথমে একটু দ্বিধা করলেও পরক্ষণেই হাত বাড়িয়ে চাবিটা নেয়। সে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোয়।
লোকটি তাকিয়ে আছে সিরিঘরের দিকে, চোখে তার রহস্যময় তীক্ষ্ণতা । ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি।
“আমরা যারা একা আসে, তাদের জন্য উপরের কোণার ঘরটাই দেই।”
86
View