Posts

চিন্তা

নীল রাত্রির গর্ভে দাঁড়িয়ে সূর্য খোঁজে বাংলাদেশ

May 9, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

113
View



রাজনীতির হেঁশেলে যখন প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে, তখন আইনও কখনো কখনো তার পোশাক পাল্টে ফেলে। একদা যারা ছিলো মুক্তির প্রতীক, কালের স্রোতে তারাই হয়ে ওঠে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের অবস্থান যেন ঠিক তেমনি -ঐতিহাসিক মর্যাদা ও আধুনিক বিতর্কের দ্বিধান্বিত ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বিরাট বৃক্ষ, যার শিকড় যেমন গভীরে, তেমনি ডালে-পাতায় এখন বিরাট ঝড়ের অশুভ আবহ। 

‘জুলাই আন্দোলন’ নামে যে গণ-প্রতিরোধ উঠে এসেছিল, তার বুকে রক্ত ঝরেছে। দাবি উঠেছে -আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ মদদে ও ছায়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে ১৪০০ মানুষ। এই অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তা নিছক রাজনৈতিক বিপর্যয় নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের তালিকায় স্থান পায়। প্রশ্ন উঠে -এই দায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায় কি না, এবং তার পরিণতিতে দলটি কি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যায়? 

আইন বলে, যে দল গণতন্ত্রবিরোধী, সংবিধানবিরোধী বা সহিংসতা ছড়ানোর কাজে লিপ্ত, তাকে নিষিদ্ধ করার পথ রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯(১) ধারায় নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তবে এর প্রয়োগ হতে হবে যথাযথ তথ্য, নিরপেক্ষ তদন্ত ও আদালতের রায়ের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক আবেগ, বিপক্ষের ইচ্ছা বা জনরোষ এখানে প্রমাণের বিকল্প নয়। 

আমরা যদি মানবিক চেতনার চোখে বিচার করি, তাহলে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের মাধ্যমে ১৪০০ প্রাণহানির দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। রাজনৈতিক মতের কারণে যদি এত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তাহলে সেটি এক ধরনের গণহত্যার ক্ষেত্রেও পড়তে পারে। আর যদি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বা দায়ী হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধান -দু’টির আলোতেই তা নিষিদ্ধযোগ্য অপরাধ। 

তবে আইন শুধু আবেগের প্রতিক্রিয়া নয়। বিচার মানে প্রক্রিয়া। দল নিষিদ্ধ করতে হলে চাই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন, আদালতের রায় এবং সংবিধানসম্মত পথ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সমাবেশে “নিষিদ্ধ করো” ধ্বনি আইন নয়, গণতন্ত্রও নয়। নইলে আগামীতে যে কোনো ক্ষমতাসীন দল এই একই তরবারি ব্যবহার করবে তাদের পূর্বসূরি বা পরবর্তী শত্রুর বিরুদ্ধে। এটি হবে এক আত্মঘাতী চক্র। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু প্রশ্ন সময়ের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ের এমন এক প্রশ্ন -আওয়ামী লীগ কি দল হিসেবে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে? একটানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এবং রাজনৈতিক কর্মকৌশল, প্রশাসনিক আচরণ ও মানবাধিকার নিয়ে বিতর্কিত ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন নতুন নয়, তবে এর পুনরুচ্চারণ এখন যেন আরও ধারালো ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একে সরাসরি রাজনৈতিক রায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের ভাষায়, “গত ৫ আগস্ট জনগণই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছে।” এমন বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বর্তমান ক্ষমতার ধারা একটি প্রতিশোধপ্রবণ ব্যাখ্যা নির্মাণে সচেষ্ট। বিএনপি এই দাবিতে সরাসরি সায় না দিলেও দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আওয়ামী লীগের বিচার দাবি করছেন। তবে তারা নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধকরণে আপত্তি জানিয়ে আইনানুগ প্রক্রিয়ার পক্ষে কথা বলছেন। জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্যে দলটি স্বীকার না করলেও আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব অস্বীকারের প্রবণতা রয়েছে। সব মিলিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক ভাষ্য যেন একটি অদৃশ্য ঐক্যে পৌঁছেছে -আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়া দরকার, তবে পথ ও পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। 

এই পরিস্থিতিতে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসে -রাজনৈতিক দল কি একা কোনো আদেশ বা চাহিদায় নিষিদ্ধ করা সম্ভব? না কি এর পেছনে চাই বিচার, সংবিধান ও সর্বোপরি জনস্বার্থের এক সর্বসম্মত সংজ্ঞা? 

বাংলাদেশের সংবিধানে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সরাসরি ধারা নেই। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৯(১) ধারার এই আইনটির প্রয়োগ বরাবর বিতর্কের খোরাক জুগিয়েছে। এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো বহুবার নিষিদ্ধের হুমকির মুখে পড়েছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থেকেছে নানা রূপে ও জোটে। 

Compilation of Venice Commission Opinions and Reports concerning Political Parties (revised in October 2021) এর 'Control and Sanctions' শীর্ষক ৮ এর D ধারায় বলা হয়েছে, "রাজনৈতিক দলসমূহ যদি প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত এবং এই নিষেধাজ্ঞাগুলো যেন নিরুৎসাহমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তদুপরি, নিষেধাজ্ঞাগুলো অবশ্যই প্রয়োগযোগ্য হওয়ার পাশাপাশি সর্বদা নিরপেক্ষ, কার্যকর এবং নির্দিষ্ট লঙ্ঘনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। রাজনৈতিক দলসমূহকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনতে নিষেধাজ্ঞার ব্যবহারের বিষয়টি দলটির সহিংসতা বা নাগরিক শান্তি ও মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি হুমকির কারণে নিষিদ্ধকরণ বা বিলুপ্তির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।" 

এটা পরিষ্কার যে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন হয় সংবিধানবদ্ধ চরম লঙ্ঘন, সহিংসতা বা রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর ওপর হুমকি। এই মাপকাঠিতে আওয়ামী লীগ যা কিছু করেছে, সেসব কর্মকাণ্ড দল হিসেবে তাকে কি নিষিদ্ধ করার যৌক্তিকতা তৈরি করে? এমন প্রশ্ন একদিকে যেমন রাজনৈতিক, তেমনি নৈতিক ও আইনি। 

আওয়ামী লীগের ইতিহাস যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব, তেমনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধী কণ্ঠ দমনের অভিযোগও রয়েছে। তাই সমালোচনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু দল নিষিদ্ধ করাই কি তার উপযুক্ত প্রতিকার? 

আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরায় এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, “আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা অনেকটাই তাদের সিদ্ধান্ত ও নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে।” বক্তব্যটি যতটা কৌশলী, ততটাই তাৎপর্যপূর্ণ। নিষিদ্ধ ঘোষণা না করেও কার্যত এক ধরনের রাজনৈতিক কোণঠাসা করে রাখার কৌশল কি এতে স্পষ্ট? 

যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হয়, তাহলে রাষ্ট্র কি আরও স্থিতিশীল হবে, না রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা বাড়বে? ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক শক্তিকে চাপা দিলে তা গোপনে আরও সংঘবদ্ধ হয়ে ফিরে আসে। অতীতে মুসলিম লীগ বা জামায়াতের নিষিদ্ধ সময়েও দেখা গেছে, তারা নতুন নামে, ছদ্মব্যবস্থায় ফিরে এসেছে। তাই নিষিদ্ধকরণ কখনো সমাধান নয়, বরং নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে। 

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ক্ষমতা বদলের পর যদি নতুন শাসক দল পুরোনো শাসককে নিষিদ্ধ করার নীতি গ্রহণ করে, তবে সেটি এক প্রকার রাজনীতির প্রতিশোধপরায়ণতার দিকে মোড় নিতে পারে। গণতন্ত্র মানে কেবল জনপ্রিয়তা নয়, ভিন্নমতের সহাবস্থান নিশ্চিত করাই তার মূল সৌন্দর্য। 

সুতরাং, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নের আগে যা জরুরি, তা হলো বিচার, তদন্ত ও স্বচ্ছ জবাবদিহির একটি কাঠামো গড়ে তোলা। অপরাধ করলে বিচার হোক। দল যদি অপরাধী হয়, তা প্রমাণিত হোক আদালতে, রাজনৈতিক সমাবেশে নয়। নইলে নিষিদ্ধকরণের এই ধারাটি একদিন ঘুরে এসে বর্তমানের উপরেই পড়বে। 

রাজনীতির চরিত্র যদি নদীর মত হয়, তবে দলগুলোর অস্তিত্ব যেন তার দুই তীর -যে তীর ভেঙে গেলে স্রোতের গতিপথই হয়ে পড়ে বিপজ্জনক। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিকে তাই কেবল একটি দলকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল ভাবলে চলবে না; বরং এটি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নাড়া দিতে পারে। দলটির প্রান্তিক সমর্থকদের অনুভূতি নিষেধাজ্ঞার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হয়ত যাবে না। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি, অন্যদিকে ক্ষমতা-কেন্দ্রিক অতিবৃদ্ধির উদাহরণ। এই দ্বৈত বাস্তবতা না মেনে কোনো রাজনৈতিক সমাধানই স্থায়ী হতে পারে না। নিষিদ্ধের তাড়নায় যদি গণতন্ত্র নিজেই সংকুচিত হয়ে পড়ে, তবে জয় হবে না কোনো আদর্শের, হার হবে সংবিধান, রিকনসিলিয়েশন ও সংলাপের। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার আগে এইপব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকা চাই; নইলে গণতন্ত্র হবে একতরফা মঞ্চ, যেখানে প্রতিপক্ষ নেই, কেবল আপনা শব্দেরই মনোটনাস প্রতিধ্বনি। 

যে রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে জোরেশোরে হত্যার অভিযোগ ওঠেছে, তাহলে তাদেরকে অনতিবিলম্বে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তারা পাক, এবং প্রমাণিত হলে রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত নিক। তবেই এই দেশ, এই জাতি বুঝবে -এই জন্মভূমি এখনো প্রতিশোধে নয়, ন্যায়ের পথটাকেই সঠিক বিশ্বাসে রেখেছে। 

রেফারেন্স:
• গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ – ধারা ৯(১)।
• ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, “দল নিষিদ্ধ করতে হলে আদালতের রায় দরকার”, প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০২৫।
• অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, সাক্ষাৎকার, আল–জাজিরা ইংলিশ, ২৯ এপ্রিল ২০২৫।
• ডা. শফিকুর রহমান, বিবৃতি: সোশ্যাল হ্যান্ডেল, ২১ মার্চ, ২০২৫।
• Bans on Political Parties: International Standards and Comparative Practice, Venice Commission Report, 2021, Council of Europe. 

লেখক: সাংবাদিক 
৯ মে ২০২৫
 

Comments

    Please login to post comment. Login