বাংলা সুর, সংগীত ও গবেষণার জগতে দীপ্ত এক নাম মুস্তাফা জামান আব্বাসী। আজ সকালেই বনানীর একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। রেখে গেলেন দুই কন্যা, অসংখ্য অনুরাগী ও সংগীতভক্ত, এবং বাংলা লোকসংগীতের বিপুল ঐতিহ্য।
অসংখ্য পরিচয়ের ভিড়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় -তিনি ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমেদের সন্তান। পল্লিগীতির সেই মহীরুহের উত্তরসূরি হয়েও তিনি নিজের পথ নিজেই গড়ে নিয়েছিলেন। সংগীত ছিল তাঁর সাধনা, গবেষণা ছিল তাঁর ব্রত। গান শুধু গাইতেন না, সংগীতের শিকড় সন্ধান করতেন তিনি। লোকজ গান সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে কাটিয়েছেন পাঁচ দশকের বেশি সময়। ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন আজীবন। সংগ্রহ করেছেন কয়েক হাজার লোকগান। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মারফতি কিংবা ধর্মীয় সংগীত -বাংলার সব ধারার গানেই ছিল তাঁর সমান বিচরণ।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী ছিলেন ইউনেস্কোর বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতি। নজরুল ও আব্বাসউদ্দীনের জীবনী ইংরেজিতে লেখার দায়িত্বও পান তিনি। তাঁর লেখায়, বক্তব্যে, গানে উঠে এসেছে বাংলা মাটির গন্ধ। দেশে–বিদেশে শতাধিক মঞ্চে গান গেয়েছেন, গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছেন। সংগীতকে তিনি কেবল বিনোদন নয়, ইতিহাসচর্চা ও আত্মানুসন্ধানের মাধ্যম হিসেবে দেখতেন।
সংগীত একটি জাতির আত্মার ভাষ্য। সেই ভাষার দোভাষী হতে চেয়েছিলেন মোস্তাফা জামান আব্বাসী। তাঁর উপস্থাপনায় বিটিভির ‘ভরা নদীর বাঁকে’, ‘আমার ঠিকানা’, ‘আপন ভুবন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংগীত ও সংস্কৃতি পৌঁছে গেছে দেশের ঘরে ঘরে। তাঁর গাওয়া গানগুলো কণ্ঠের চেয়ে মন ছুঁয়ে যেত বেশি।
নজরুলের লেখা ইসলামী গান নিয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ। বলতেন, ‘নজরুল কেবল সুরের কবি নন, তিনি ছিলেন আত্মমুক্তির দার্শনিক।’ তাঁর স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, একদিন আব্বাস উদ্দীন নজরুলের বাড়িতে গেলেন। নজরুল তখন কী একটা লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আব্বাস উদ্দীনকে হাতের ইশারায় বসতে বলে আবার লেখা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে জোহরের আজান মসজিদ থেকে ভেসে আসল। আব্বাস উদ্দীন বললেন, ‘আমি নামাজ পড়ব। আর শুনুন কাজীদা, আপনার কাছে একটা গজলের আবদার নিয়ে এসেছি।’
কবি শিল্পীকে একটা পরিস্কার জায়নামাজ দিয়েৎবললেন, ‘আগে নামাজটা পড়ে নিন।' আব্বাস উদ্দীন নামাজ পড়তে লাগলেন আর নজরুল খাতার মধ্যে কলম চালাতে শুরু করলেন।
আব্বাস উদ্দীনের নামাজ শেষ হলে নজরুল তাঁর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন, বললেন, ‘এই নিন আপনার গজল!’ হাতে কাগজটি নিয়ে তো আব্বাস উদ্দীনের চক্ষু চড়কগাছ। এই অল্পসময়ের মধ্যে নজরুল গজল লিখে ফেলছেন! তাও আবার তাঁর নামাজ পড়বার দৃশ্যপট নিয়ে!
আব্বাস উদ্দীন পড়তে শুরু করলেন, ‘হে নামাজী! আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ /দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর পরিবারটি ছিল সংগীত ও সৃজনের নিখাদ পরিমণ্ডল। পিতা আব্বাসউদ্দীন আহমেদ, চাচা আবদুল করিম, বোন ফেরদৌসী রহমান, ভাতিজি নাশিদ কামাল -সবাই সংগীতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্ত্রী আসমা আব্বাসী ছিলেন প্রথিতযশা শিক্ষিকা ও লেখিকা; তিনি গত বছর ইহলোক ত্যাগ করেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী কেবল সংগীত-গবেষণার মানুষ ছিলেন না, সমাজসেবাতেও ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। রোটারি ক্লাবের গভর্নর হিসেবে নানা জনকল্যাণমূলক উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর সংগীতচর্চা, গবেষণাকর্ম ও সামাজিক দায়িত্ববোধ মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বহুমাত্রিক মানবসত্তা।
আজ তাঁর প্রয়াণে বাঙালির সংগীতজগতে শূন্যতা তৈরি হলো, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তবে তাঁর কণ্ঠে রেকর্ড হয়ে থাকা গান, লেখা বই, বক্তৃতা, টেলিভিশন উপস্থাপনা ও গবেষণাকর্ম রয়ে যাবে আগামী প্রজন্মের জন্য অমূল্য ঐতিহ্য হিসেবে।
আত্মার ভাষায় গান গাইতেন মোস্তাফা জামান আব্বাসী। আজ সেই আত্মার সুর ফিরে গেল চিরায়ত শিকড়ে। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মোস্তাফা জামান আব্বাসীর শিল্প দর্শন আমাদের মনোজগতকে সজাগ রাখুক।
লেখক: সাংবাদিক
১০ মে ২০২৫
252
View