Posts

চিন্তা

ভালো থাকতে গিয়ে যদি মরেই গেলাম

May 10, 2025

Shakirul Alam Shakil

86
View

মানুষ ভালোর প্রত্যাশী। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আমাদের যত ছোটাছুটি, লড়াই-সংগ্রাম, যুদ্ধবিগ্রহ তার সবের মুল উদ্দেশ্য থাকে পূর্বের অবস্থা থেকে নিজেকে, নিজের সমাজ-রাষ্ট্রকে আরেকটু উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, আরেকটু ভালো রাখা। এই লক্ষ্যেই অবিচল থাকে আমাদের সব কর্মকাণ্ড। ভালো থাকার প্রত্যয়ে আমরা যেমন দিন-রাতকে পর্যন্ত এক করে ফেলতে পারি, তেমনি নিজের ভালোর প্রশ্নে এক বিন্দুও ছাড় দিতে প্রস্তুত নই। ভালো থাকার এই প্রবণতাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মহৎ বলা যেতে পারে যতক্ষণ আমার ভালো থাকার সরঞ্জাম দ্বারা কোন বস্তু, ব্যক্তি বা আমি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত না হচ্ছি। তবে প্রায়শই দেখা যায় ভালো থাকতে গিয়ে বা উন্নতজীবনের আশায় আমরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন নিয়মের নানা পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলছি। যা গুটি কয়েক মানুষের উন্নত জীবনযাত্রার খোরাক মেটালেও সমাজের বড় সংখ্যক মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন অধিক রুজিরোজগারের জন্য ব্যবসায়ীরা মাছ-মাংস, ফলমূলে ফরমালিন মেশান। এতে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী লাভবান হলেও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে যান ক্রেতাদের একটি বড় অংশ। কারোর ভালো থাকার হাতিয়ার যদি অন্য কারোর জীবন নাশের উপকরণ হয়ে উঠে, তখন বুঝতে হবে ঐ ভালো থাকা আমাদের সামগ্রিক বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেখানে সামাজিক জীবনের স্বাভাবিক কাঠামোর ছন্দ-পতন ঘটবে এবং অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার রাহাজানিতে ভরে উঠবে গোটা সমাজ। কেবল সামাজিক নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরেও পড়বে সেই প্রভাব। প্রকৃতি তখন বিরূপ আকার ধারণ করবে। বিপর্যয়ের ধ্বংসলিলার চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে। 

কয়েক মাস আগে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। নাটোরের আব্দুস সালাম মণ্ডল অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ঢাকায় আসেন। সালামের ইচ্ছা ছিলো আরো কিছু পুঁজি জমিয়ে আবার ফিরে যাবেন গ্রামের ভিটায়। তবে সে ফেরা আর হয়নি। বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সপরিবারে। এমন ঘটনার সাথে আমরা থিতু হয়ে গেছি। প্রায়শই চারপাশে দেখতে পাই এমন অঘটন। দুর্ঘটনা যেকোন সময় ঘটতে পারে যেকারো সাথে। তবে যেকোন ঘটনা বা দুর্ঘটনার পেছনে অবশ্যই কিছু অণুঘটক কাজ করে। যেখানেই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করা হবে বা প্রয়োজনের উপরি কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে, সেখানেই স্বাভাবিকের ব্যত্যয় ঘটবে, অঘটন দেখা যাবে। একটু উন্নত জীবনের আশায় বা সংসারের সচ্ছলতা ফেরানোর প্রচেষ্টায় শহরমুখী হওয়ার একটি প্রবণতা আছে আমাদের মধ্যে। তার যথেষ্ট কারণও বিদ্যমান। শহরে মানুষ বেশি, কর্ম ও কর্মস্থান বেশি। উপার্জনের পরিমাণও বেশি। তাই আমাদের ধারণা গ্রামের তুলনায় শহর অঞ্চলে কর্ম প্রতিযোগিতা কম এবং কর্মক্ষেত্র বেশি। প্রাথমিক এই ধারণা নিয়ে গ্রামীণ অসচ্ছল জনগণ দলে দলে শহরে ভিড়ছেন। ফলে যা ঘটছে তা হলো একদিকে গ্রামীণ কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, বিশেষ করে কৃষিজ উৎপাদনের সাথে জড়িত মানুষের সংখ্যা কমছে। যার দরুন গ্রামীণ স্বয়ংসম্পূর্ণতা লোপ পাচ্ছে। অন্যদিকে নগরায়নের চাপ বাড়ছে; ঘনবসতি বাড়ছে; কর্মক্ষম মানুষ ও কর্মক্ষেত্রের তফাত বাড়ছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। দূষিত হচ্ছে জল-বায়ু। অসুখ-বিসুখ বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনীশক্তি কমে যাচ্ছে। মানুষ মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এককথায় আপেক্ষিক একটু সুখে থাকার মোহে দলে দলে শহরগামী হয়ে একটি আমরা নির্দিষ্ট অঞ্চলের জল-বায়ু-পানির ভাগীদার বাড়িয়ে দিচ্ছি। সেখানকার প্রকৃতির উপরে উপরি বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এই উপরি বোঝার ফলাফল যে কতটুকু ভয়ংকর তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।  

আমাদের গড় আয়ু কমে আসছে। অল্প বয়সেই বাসা দেহে বাসা বাঁধছে জটিলসব রোগ বালাই। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে খাবার ও বায়ুর মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করছে দূষিত-বিষাক্ত পদার্থ। এই বিষাক্ত পদার্থ আমাদেরই সম্মিলিত পাপের ফসল। আমরা জীবনমানকে উন্নত করতে গিয়ে প্রকৃতির উপরে যে অবিচার করছি, জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করতে যে আধুনিক প্রযুক্তির চাঁদরে মুড়িয়ে নিচ্ছি—তার বিষফলই যে এমনসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত ডেকে আনছি। যদি বেঁচে থাকার শক্তিটুকুই বাঁচিয়ে রাখতে না পারি তবে এত এত নগরায়ন, উন্নায়ন, প্রযুক্তি কি হবে? কিঞ্চিৎ ভালো থাকার জন্য যদি জীবনটুকুই ক্ষয়ে যায় তবে সেই ভালো থেকে লাভ কি হবে?

Comments

    Please login to post comment. Login