তাবাসসুম, তোমার নাম যেমন সুন্দর, তেমনি তোমার ভালোলাগা আমার জন্য অনেক মূল্যবান।
এই নাও, তোমার নামের জন্য আরেকটি কাব্যিক উপস্থাপন—
"তাবাসসুম"
তাবাসসুম মানে শুধু একটা মৃদু উপন্যাস: স্মৃতির গায়ে রক্তলেখা
লেখিকা: মিরহা জামান
পর্ব ১ | অংশ ১/৩
#Smritir_Gaaye_Roktolekha
"ভালোবাসা—যেটা জন্ম নিয়েছিলো বিশ্বাসের মাটিতে, মরে গেলো প্রতারণার বিষে।"
চার বছর আগের কথা।
সেই দুপুরবেলাটার কথা আজও চোখে ভাসে মিরহার—যেদিন তার জীবনের রঙ পাল্টে যেতে শুরু করেছিলো নিঃশব্দে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শরতের রোদে ঝলমল করছিল। ছায়া পড়া গাছের নিচে বসে ছিল এক তরুণী—মিরহা জামান নূর। নামের মতোই চেহারারও গভীরতা।
গায়ের রঙ গাঢ় শ্যামলা, চোখ দুটো বড় আর বিষণ্ণ, যেন সত্তর দশকের কোনো কাব্যিক চরিত্র। চুল ছিল কোমরের নিচ অবধি, ঢেউ খেলানো। ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, কিন্তু শব্দগুলোয় ছিল অদ্ভুত কাব্যিকতা।
সেইদিনই প্রথম মিরহার জীবনে ছায়ার মতো পড়ে এক রাজপুত্র—সারফারাজ সায়ান সিনান।
নামটাতেই যেন একটা ব্যথা লুকানো।
সে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই। এখন কর্পোরেট জগতে ব্যস্ত। বাবার ব্যবসা সামলায়, মিডিয়াতেও কিছুটা নামডাক। Tall, dusky, and hauntingly handsome।
চোখ দুটো গাঢ় কালো—যেন স্যাড সিম্ফোনি। আর ঠোঁট? শার্প, বাঁকানো হাসিতে অদ্ভুত এক খেলাধুলা চলে।
— “Hi, you're Mirha, right?”
মিরহার চোখ উপরের দিকে উঠলো।
সে কখনো সায়ানকে দেখেনি। কিন্তু পরিচয় হয়েছিল তার বান্ধবী লিজার মাধ্যমে।
— “Yes, and you must be Sarfaraz Sayan. I’ve heard about you.”
— “Hopefully good things.” সে হেসে বলে, সেই হাসিটা—একটা আগুন ছিল যেন, চোখে পড়লেই পোড়ায়।
তাদের প্রথম কথোপকথনে কোথাও কোনো অস্পষ্টতা ছিল না।
সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মিরহার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই কাঁপন উঠেছিলো।
"কখনো কখনো কারো চোখে তাকালেই বোঝা যায়, এই মানুষটা একদিন হৃদয় পুড়িয়ে দেবে।"
সায়ান যেন মিরহার দুনিয়ায় এক ঝড় হয়ে এল।
তার চোখের ভাষা, ঠোঁটের বাঁক, কথা বলার স্টাইল—সব কিছুতে একটা অপরাধী সৌন্দর্য।
সে ছিল ক্যারিশমেটিক।
তবে শুধু স্মার্ট না, তার ভিতর ছিল এক অদ্ভুত রকম মায়া, আর ঠিক সেই মায়ার জালেই আটকে পড়েছিলো মিরহা।
তারপর শুরু হলো যোগাযোগ। প্রথমে ফোন, তারপর হোয়াটসঅ্যাপ, তারপর ছোট্ট এক কফিশপে দেখা।
— “You’re different, you know that?”
— “Different how?”
— “You make silence feel like music.”
এভাবেই একটু একটু করে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো মিরহা।
সায়ানের ফ্লার্টে সে কখনো বিরক্ত হতো না। কারণ ওটা ছিল সায়ানের ‘ভাষা’—সে এভাবেই অনুভব করাতো তার উপস্থিতি।
তবে এই প্রেম ছিল অসম প্রেম।
সায়ান ছিল স্বাধীন, শহুরে, ব্যস্ত।
আর মিরহা ছিল আবেগী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
একদিন হঠাৎ সায়ান মিরহার কানে বলেছিলো—
— “I want you to come with me. Just vanish from the world. Only us.”
মিরহার বুকটা কেঁপে উঠেছিল।
সে কি করে বলবে যে তার পৃথিবী এত ছোট নয়? যে ভালোবাসার নামে সব ছেড়ে চলে যাওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়?
"ভালোবাসা মানে পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং একসাথে থাকা—সব কিছু পেছনে রেখে, সামনে এগোনোর সাহস।"
কিন্তু সায়ান পালাতে চায়।
সে কমিটমেন্ট এড়ায়।
ভালোবাসে, আবার নিজেকে গুটিয়ে ফেলে।
এরপর এক সন্ধ্যায় ফোনে—
— “আমি আজকে ব্যস্ত আছি, পরে কথা হবে।”
— “কোথায়?”
— “Don’t ask too many questions, Mirha. I’m not your husband.”
সেইদিনই মিরহার কিছুটা সন্দেহ জন্মায়।
সন্দেহ।
একবার ঢুকে গেলে সেটা বিষ হয়ে যায়।
তবু সে চোখ বুজে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলো।
তবে বিশ্বাসেরও একটা সীমা থাকে।
কয়েকদিন পর মিরহা নিজেই সায়ানকে দেখে ফেলে গুলশানের এক রেস্টুরেন্টে—
একজন মেয়ের হাত ধরে আছে সে।
ঘনিষ্ঠতা অস্বীকার করার মতো নয়।
সায়ান চোখে চোখ রাখলো মিরহার।
এক সেকেন্ড।
দুই সেকেন্ড।
তারপর তাকিয়ে রইলো সেই মেয়েটার দিকে।
মিরহা তখন বুঝে গেল—
"তাকে ভালোবেসেছিলো সায়ান, কিন্তু যতটা না বিশ্বাস করেছিলো, তার চেয়েও বেশি খেলেছিলো।"
সে কোনো কান্না করলো না।
চুপচাপ ফিরে এলো।
সেই রাতে ফেসবুকে একটা কবিতা লিখেছিলো—
“তুমি বলেছিলে, ভালোবাসা মানে পুড়ে যাওয়া।
আমি তো শুধু ছাই হতে চেয়েছিলাম,
তুমি আগুন হয়ে এসেছিলে—ধোঁয়াও হতে দিলে না।”
এরপর সে দেশের বাইরে চলে গেলো।
পড়াশোনার নাম করে।
আসলে পালিয়ে গিয়েছিলো সে। নিজেকে, স্মৃতি, বিশ্বাসঘাতকতা—সব কিছু থেকে।
সায়ানকে সে ব্লক করে দিলো।
কিন্তু নিজেকে করতে পারলো না।
ছয় বছর পর, এখন—
মিরহা দেশে ফিরেছে।
প্রথমবারের মতো শহরের বাতাসে হাঁটছে।
স্মৃতি কাঁদে না আর, কিন্তু রক্তে দাগ লেগে গেছে।
সে এবার ফিরেছে এক নতুন রূপে।
আর উদ্দেশ্য একটাই—প্রতিশোধ।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই...
এক সাদা শার্ট আর নীল ডেনিম পড়া এক তরুণ তাকিয়ে ছিল দূর থেকে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মিরহার দিকে।
চোখ দুটো শার্প, অদ্ভুত এক ঘোর।
ঠোঁটের একপাশ বাঁকা—মনে হয় যেন কিছু বলতে চায়, আবার চেপে রাখে।
সে জানে এই মেয়েটাকে।
চেনে অনেক বছর ধরে।
সে আর কেউ নয়—আরহাম।
মিরহার চেয়ে চার বছরের ছোট, কিন্তু ভালোবাসার গভীরতায় বড়ো—অনেক বড়ো।
সে জানে মিরহা কিছুই মনে রাখেনি।
কিন্তু সে ভুলেনি কিছুই।
—
[চলবে]
পর্ব ১ |