অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ও এনসিপির অন্যতম মেন্টর মাহফুজ আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে ‘দুটি কথা’ শিরোনামে রাজনৈতিক ও আদর্শিক একটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। লেখাটির দুই অংশ -প্রথমটি যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের উদ্দেশে, দ্বিতীয়টি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধপন্থী বাম রাজনৈতিক শক্তির প্রতি -দুই ভিন্ন রকম বার্তা বহন করে। ফলে এটি রাজনৈতিক পরিসরে আলোচনার পাশাপাশি বিতর্কও তৈরি করছে।
প্রথম অংশে তিনি ১৯৭১ সালের পাকিস্তানপন্থী অবস্থান বর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, যারা একাত্তরে পাকিস্তানের সহযোগিতা করেছে, তারা যদি রাজনীতিতে ফিরতে চায়, তবে তাদের ‘সাফ দিলে’ ফিরে আসতে হবে -অর্থাৎ নির্দ্বিধায় স্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পুনর্বাসনের আগে প্রয়োজন নৈতিক জবাবদিহি ও আদর্শিক অবস্থান পরিবর্তনের স্বীকৃতি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোট্যাজ করা বন্ধেরও দাবি জানান তিনি।
তাঁর এইসব বক্তব্যে একধরনের নৈতিক উচ্চতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
তবে লেখাটির দ্বিতীয় অংশে ভিন্ন সুর লক্ষ্য করা যায়। এখানে তিনি 'মুজিববাদী বাম'দের ‘কালচারালি ও ইন্টেলেকচুয়ালি গাদ্দার’ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তাদের ‘পরাজিত’ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এই শ্রেণির রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষার ধরণ ও রেটোরিক থেকে বোঝা যায়, এই অংশটি একধরণের প্রতিশোধপরায়ণ অবস্থান প্রকাশ করে।
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে -এই দ্বৈত বার্তা কীভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত? একটি অংশে যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের প্রতি সংশোধনের আহ্বান, অন্য অংশে মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ধারকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ -এ দুটি বার্তা কি একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
আমরা মনে করি, এটি একধরণের কৌশলগত দ্বৈততা। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সেই মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারকে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এর ফলে যে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ইঙ্গিত মেলে, সেটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির নতুন রূপে পুনরাবির্ভাব বলে অনেকেই মনে করছেন।
মাহফুজ আলমের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত-ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বিশ্লেষক দাবি করেছেন, ১৯৭১ সালের পাকিস্তান জামায়াত এবং বর্তমান বাংলাদেশ জামায়াত এক নয়। তাঁদের মতে, ১৯৭২ সালে পাকিস্তান জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পর বর্তমানে যে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, তা একটি আলাদা সত্তা। ফলে একাত্তরের দায় বর্তমান সংগঠনের ওপর বর্তায় না।
এই যুক্তি ইতিহাসবিদ ও মানবাধিকার বিশ্লেষকদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের মতে, একটি সংগঠন যদি তার নাম, আদর্শ ও নেতৃত্বে পূর্বসূরি ধারাবাহিকতা বহাল রাখে, তবে তার অতীত কর্মকাণ্ডের দায় এড়ানো ন্যায্য নয়।
অন্যদিকে, বাম ও সেক্যুলার রাজনৈতিক পরিসরেও মাহফুজ আলমের লেখার দ্বিতীয় অংশ নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। কারণ, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক পুনঃপ্রবেশ নিয়ে আলোচনা থাকতেই পারে, তবে সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধপন্থী অংশের প্রতি আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার যেমন: ‘গাদ্দার’ অভিধা -বহুজনের মতে অযাচিত এবং নৈতিকভাবে দুর্বল। বিশেষ করে, যারা জুলাই আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছেন, তাদের প্রতি প্রতিশোধমূলক মনোভাব এড়িয়ে যাওয়া যেত।
রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা মনে করছেন, এটি একধরণের দ্বৈত রেটোরিক -যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকার দাবি তুলে ধরা হলেও কার্যত মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এর ফলে স্বাধীনতার চেতনা একটি মুখোশে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় -যেখানে উচ্চারিত হয় মুক্তিযুদ্ধের নাম, কিন্তু উপেক্ষিত থাকে তার আদর্শ ও নৈতিক ভিত্তি।
মাহফুজ আলম কেবল একজন তরুণ রাজনীতিক নন, বরং একটি বিশেষ প্রবণতার প্রতিনিধিত্বকারী কণ্ঠ। তাঁর বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, একাত্তরের রাজাকার-আলবদর ধারা কেবল অস্ত্রধারী ছিল না, তাদের ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পও। আজ সেই প্রকল্প নতুন রূপে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে -মুক্তিযুদ্ধের নাম উচ্চারণ করে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে নির্মূল করে দিয়ে।
এই রূপান্তরের কৌশলটি সরল নয়। কারণ, মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সেই যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিত্ব ও চেতনার প্রতি থাকছে চরম বিদ্বেষ। টার্গেট করা হচ্ছে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব, বামপন্থী বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি এবং সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে। তাহলে উদ্দেশ্য কি এটাই যে, মুক্তিযুদ্ধকে এমন এক কংকালে রূপ দেওয়া -যেখানে নাম থাকবে, প্রাণ থাকবে না?
ক্ষমা চাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে আদর্শিক আত্মসমালোচনা, নৈতিক দায় স্বীকার ও জবাবদিহির প্রশ্নটি এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক পুনর্বাসনের আগে এসব প্রশ্নে পরিস্কার ও আন্তরিক অবস্থান না থাকলে, তা এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপন বলেই বিবেচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে, মাহফুজ আলমের লেখাটি কেবল একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির মতামত নয় -বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার একটি ইঙ্গিত হিসেবেও পড়া যেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
১১ মে ২০২৫
112
View