কথিত আছে, আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ যখন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন, তখন জনগণ তীব্রভাবে তার প্রতিবাদ করে। তিনি সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে জনগণের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে অন্তত তাঁর ছেলেকে যেনো প্রধানমন্ত্রী করা হয়। কিন্তু মাহাথির সেই প্রস্তাবও বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে গণতান্ত্রিক রীতিতে গঠিত নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেন। আজকের পৃথিবীতে যেখানে একেকটি রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত, সেখানে একজন নেতা কীভাবে এতটা সম্মান ও আস্থা অর্জন করতে পারেন?
প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ: একটি সরকার জনগণের ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ সমর্থন পায় ঠিক কোন পরিস্থিতিতে? এমন যদি হয়, কোনো সরকার তার জনগণের মৌলিক চাহিদা—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা—সব কিছুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তাহলে কি সেই সরকারকে খারাপ বলা চলে? অথচ এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে, যেখানে সবকিছু নিশ্চিত করেও একটি সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থা পতনের পথে গিয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, কেন?
এই জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচনা করেন তাঁর অনন্যসাধারণ গ্রন্থ "ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ"। লেখক নিজে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল হলেও এই গ্রন্থে তিনি এক নির্মোহ অনুসন্ধানীর ভূমিকা পালন করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রেক্ষিতে রচিত এই গ্রন্থে তিনি শুধু মতাদর্শগত চেতনার ভাঙন নয়, বরং মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতার প্রতি চিরন্তন আকুলতার গল্প বলেছেন।
বার্লিন প্রাচীর পতনের পর লেখক ঘুরে বেড়িয়েছেন দুই জার্মানির শহর ও গ্রামে। কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে—সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা জনগণকে ন্যূনতম জীবনের নিশ্চয়তা দিলেও তারা উপেক্ষা করেছে দুটি মৌলিক বিষয়: ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ইচ্ছার মূল্যায়ন।
ধরা যাক, কাউকে প্রতিদিন তিনবেলা বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শর্ত থাকছে, তাঁকে প্রতিদিন একরকম খাবারই খেতে হবে, পছন্দ-অপছন্দের কোনো জায়গা নেই। একইভাবে বিনা মূল্যে পোশাক দেওয়া হলেও রঙ, নকশা কিংবা পরার স্বাধীনতা থাকছে না। মানুষ কী কেবল নিরাপত্তা আর প্রয়োজনেই তুষ্ট থাকে? নাকি সে স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার অধিকার চায়?
সুনীলের চোখে এই চিত্রগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাতিস্লাভা শহরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে আলাপচারিতায় লেখক যখন জানতে পারেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ওই বৃদ্ধ নিজেকে ‘খাঁচার পাখি’ মনে করেন, তখন বিষয়টি তার দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি রচনা করে। সেই পাখি যার জন্য খাবার-পানির নিশ্চয়তা আছে, কিন্তু মুক্ত আকাশে ওড়ার অধিকার নেই।
এই অভিজ্ঞতার সত্যতা লেখক উপলব্ধি করেন প্রাগ শহরে, কাফকার বই কিনতে গিয়ে। জানা যায়, বইগুলো নিষিদ্ধ; শুধু কাফকা নয়, বহু সাহিত্যিক ও দার্শনিকের রচনা মানুষের নাগালের বাইরে। শুধু চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নয়, বাজারেও একই অবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য জনগণকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
এই বাস্তবতাকে ব্যঙ্গ করে একটি মজার গল্প প্রচলিত ছিল পশ্চিম জার্মানিতে। পূর্ব জার্মানির এক শিশু তার পশ্চিমের বন্ধুকে একটি খেলনা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে—তারও কি আছে? পশ্চিমের শিশু কলা বের করে বলে, তার খেলনা নেই, তবে কলা আছে। কলা দেখে অবাক হয়ে পূর্বের শিশুটি মাকে জিজ্ঞেস করে কেন তাদের বাড়িতে কলা নেই। মা জবাব দেন, ‘আমাদের আছে সমাজতন্ত্র।’ এই জবাবে পশ্চিমের শিশু বলে, সে তার বাবাকে বলবে যেন সমাজতন্ত্র কিনে আনে! তখন পূর্বের মা বলে—'তুমি সমাজতন্ত্র চাইলে কলা খেতে পারবে না।’
লেখক কেবল দুই জার্মানির অভিজ্ঞতাতেই থেমে থাকেননি, বরং তিনি ভ্রমণ করেছেন মস্কোতেও। মস্কো বিমানবন্দরে তিনি দেখেছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ট্যাক্সিচালকরা অলস বসে আছেন। যাত্রী নেই, কাজ নেই—তবুও মাস শেষে তারা বেতন পাবে। কাজের প্রতি অনীহা, দায়িত্বহীনতা, রাষ্ট্রনির্ভরতা—সব মিলিয়ে সমাজ এক নিষ্ক্রিয় ঘূর্ণিতে ঘুরছে।
সবশেষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপলব্ধি এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ের নামান্তর। মানুষ অতীতের ত্যাগকে বেশি দিন মনে রাখে না। তারা চায় বর্তমানের স্বস্তি, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। পাশের কারও জীবন একটু বেশি সুখকর মনে হলেই তারা হিংস্র নয়, বরং আকুল হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্রের দেওয়া সমতা তখন আর মূল্যবান মনে হয় না, যদি সেই সমতা চুপ করে সহ্য করার, কিংবা চোখ বন্ধ করে থাকার আদেশ দেয়।
একদিকে যখন পূর্ব জার্মানিকে ১০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ঋণ হিসেবে, অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল পরিকল্পনার অধীনে বিপুল অর্থ সহায়তা পায়। সেই বিনিয়োগের সুফল তাদের ভোগ্যপণ্য, প্রযুক্তি ও জীবনের মানে প্রতিফলিত হয়। আর তারই আলোচক হয়ে ওঠে পূর্বের মানুষদের কণ্ঠ।
শেষ পর্যন্ত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বা বার্লিন প্রাচীর ধ্বংস কেবল ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক ঘটনা নয়। এটা এক স্বপ্নের ভাঙন, আবার ভাঙনের মধ্য দিয়েই নতুন এক ইতিহাসের সূচনা।