১.
তৃতীয় দিনের মত হাসপাতালের করিডোরে ওয়েটিং সিটে বসে আছি। রোগীর স্বজনরা সাধারণত এখানেই বসে থাকে।গত দুইদিনের মত আজকের দিনটা আমার এখানেই কাটবে।জানিনা,আর কতদিন এভাবে কাটাতে হবে!
কখনোই ভাবিনি, এমন দিন আসবে।আসলে কেউই ভাবেনা, আগামীদিন কি হতে যাচ্ছে!আমিও ভাবিনি।অথচ আমাকে এখানে বসে থাকতে হচ্ছে।
আজকে অনেক ভীড় এখানে। গত দু'দিন ধরেও এমন ছিল। অনেক মানুষ। কত মানুষ যে অসুস্থ সেটা হাসপাতালে না আসলে বোঝার উপায় নেই।প্রাইভেট হাসপাতালের অবস্থা এই,না জানি সরকারি হাসপাতালে কি অবস্থা।
এই মূহুর্তে আমার কিছু করার নেই;বসে থাকা ছাড়া।অনেকেই আমার মত বসে আছেন৷কেউবা দৌড়াদৌড়ি করছেন। কাউন্টার, চেম্বার, বেড, ক্যান্টিন। অনেকের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। অথচ কি দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে।
আহারে জীবন।
২.
আমার পাশে যে ভদ্রলোক বসে আছেন তিনি এসেছেন রিপোর্ট নিতে। গতকালকেও দেখেছিলাম। গতকাল অবশ্য কথা হয়নি। আজকে কথা হলো। বিকেল চারটায় ডাক্তার বসবেন।তিনি বসে আছেন,একেবারে ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে তারপর যাবেন।
একটু আগে ক্যান্টিনে গিয়েছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এসেছেন।এখানে খাবারের দাম বেশি। এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,'ভাই, এই দেশে সবাই ডাকাত।'
আমি একটু হাসলাম।
বললাম, 'আপনার কি সমস্যা ভাই?'
তিনি বললেন, 'সমস্যা তো ভাই আমার একার না।'
আমি বললাম,'রোগের কথা জানতে চাইছিলাম।'
তিনি একটু কাশি দিলেন। বুঝলাম, গোপন কোন সমস্যা কিংবা আমায় বলতে চাইছেন না। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
অনেক্ষণ বসে আছি৷ তাই একটু উঠলাম। ক্যান্টিনের দিকে যাব না৷ কারণ,এখানে খাবারের অনেক দাম।
আমি কেবিন যেদিকে সেদিকে যাব সিদ্ধান্ত নিলাম।তিনতলার যে পাশে কেবিনগুলো সেদিকে তুলনামূলক ভীড় কম।সেদিকে অবশ্য বসার তেমন সুযোগ নেই।
হুট করে মনে পড়লো সকালে নাশতা করেছি সামান্য। কেবিনের দিকে যাওয়ার আগে খেয়ে যাই।আমি বাইরে বের হলাম। সূর্য তার সমস্ত তেজ ঢেলে দিচ্ছে কয়েকদিন ধরে। শুনলাম, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেও দেশে তাপমাত্রা বেশি। গরমে মানুষের অবস্থা খুব কাহিল।
পিচ গলা রোদে আমি বের হলাম খেতে। হাসপাতালের আশেপাশে খাবারের দোকানগুলোতেও গলাকাটা দাম।
আমি গেলাম হাসপাতাল থেকে দুই গলি পর একটা দোকানে। দোকানের নাম 'বিসমিল্লাহ হোটেল'। এখানে দাম তূলনামূলক কম।
৩.
বিকেলের সময়টায় একটু ঘুম আসে। আমারও ঘুম ঘুম ভাব চোখে। ঘুমানোর সুযোগ নেই। তাই ঘুম তাড়ানোর জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। আমার পাশের সিটের সেই ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছেনা। ওয়েটিং সিটগুলোয় এখন তেমন লোকজন নেই। দূরের এক কোনায় একটা ছেলেকে একটা বই পড়তে দেখা যাচ্ছে। হয়ত সামনে পরীক্ষা কিন্তু আবার রোগী নিয়ে এখানে থাকতে হচ্ছে।
দুই সিট পরের এক ছেলের সাথে চোখাচোখি হতেই আন্তরিক হাসি দিলাম।কথা বলার জন্যই মূলত হাসি দিলাম। কথা বলে জেগে থাকা। এক কাপ চা খাওয়া যেত। কিন্তু সেটা সন্ধ্যার নাশতা হিসেবে বরাদ্দ করেছি। এতে দুর্মূল্যের বাজারে একটু টাকা বাঁচে।
ছেলেটার বাড়ি পটিয়া। বাসা শহরেই। এসেছে আত্মীয়কে নিয়ে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, 'আপনি?'
আমিই তার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেললাম। এতেই সে যা বুঝার বুঝলো। পিঠে হাত রাখলো।
৪.
রাত ১১ টায় হাসপাতাল থেকে বের হলাম। দিনের তীব্র উত্তাপ নেই। চারদিক একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ঠান্ডা হচ্ছে। আমি বসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বাসায় গিয়ে গোসল করতে হবে৷ তারপর ঘুম। আগামীকাল আবার ৯ টায় এখানে আসতে হবে।
যে গরম দিনের বেলায়, একমাত্র প্রাইভেট হাসপাতালেই এসিতে বসে থাকার সুব্যবস্থা আছে।
যে ক'দিন গরম পড়বে এভাবেই কাটাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি!
আগামীকাল আসার সময় একটা বই হাতে নিয়ে আসব। এতে একটু পড়াশোনাও হবে। এই আইডিয়া এসেছে দুপুরের দিকে যে ছেলেটাকে বই নিয়ে পড়তে দেখেছি তার থেকে!পরে কথা হয়েছিল- সেও মূলত গরম থেকে বাঁচতে এখানে এসেছে।
তার কাছেই আরও জানলাম, আমার পাশের যে ভদ্রলোক ছিলেন,তিনিও নাকি এসিতে বসে থাকতে আসেন এখানে।
আমি এর আগে ব্যাংকে যেতাম। ব্যাংকে বেশিক্ষণ বসে থাকার উপায় নেই৷আর প্রতিদিন গেলে দৃষ্টিকটু দেখায়। কিছুদিন শপিংমলে ঘুরে কাটিয়েছিলাম।কিন্তু সেখানে বসার সুযোগ নাই।তারচেয়ে হাসপাতাল ভালো। কেউ সন্দেহ করেনা।সিট ছাড়ার তাড়া দেয়না........