"আমি কথা বলবই, তুমি যতই গালি দাও" -এই উচ্চারণটি যেন আজকের নারীর প্রতিজ্ঞা ও প্রতীতি। নারী যখন নিজের শরীর, মন, চিন্তা ও যৌনতার ওপর অধিকার দাবি করে, তখনই পুরুষতন্ত্র আঁতকে ওঠে। তাদের রচিত ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক সংজ্ঞাগুলো ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় নারীর দিকে ছোড়া হয় ঘৃণার বিষ, শব্দের বিষ। কারণ একজন নারী যখন নিজের জীবনের ব্যাকরণ নিজেই রচনা করতে চায়, তখন তা কেবল ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত থাকে না -তা হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক ঘোষণাও।
ভাষা, যা সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম অর্জন, সেটাই হয়ে ওঠে নারীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কদর্য অস্ত্র। আমাদের বহুল ব্যবহৃত গালিগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় -নারীকে অপমান করতেই কেমন নিষ্ঠুর কৌশলে ভাষা সাজানো হয়েছে। "মাদারচোদ", "নটিরপোলা", "মাগিরপোলা", "খানকিরপোলা" -এসব গালির কেন্দ্রে রয়েছে নারী ও মাতৃত্বকে অপমানের অপপ্রয়াস। পুরুষ তার রাগ বা অপমান প্রকাশ করে নারীর শরীরের মাধ্যমেই। যেন নারীকে হেয় করলেই তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। অথচ এই অপমানই উল্টো তাদের আত্মঘৃণার পরিচয় -কারণ তারা জানে, নারীর শরীরেই নিহিত রয়েছে এমন এক ক্ষমতা, যা তারা কখনো ধারণ করতে পারবে না।
নারীর কণ্ঠস্বর যখন নিজের হয়ে ওঠে -যখন তা আর পুরুষতন্ত্রের অনুবাদে উচ্চারিত হয় না -তখন সমাজের একাংশ অস্থির হয়ে পড়ে। তারা চায় নারী যেন ‘ভালো মেয়ে’ হয়ে থাকে -যে বিনীত, বাধ্য, পুরুষের আধিপত্যে নীরবে সায় দেয়। কিন্তু আজকের নারী আর সেই সংজ্ঞায় বাঁধা পড়ে না। সে নিজের মতো করে কথা বলে, নিজের মতো করে জীবন গড়ে তোলে। চুল এলিয়ে, চোখে কাজল মেখে, ঠোঁটে প্রতিবাদের লাল রঙ লাগিয়ে সে নিজের নামটি উচ্চারণ করে -গর্বের সঙ্গে।
এই দৃশ্যই সমাজের ভিত কাঁপিয়ে তোলে।
ইতিহাসও তার সাক্ষ্য দেয়। সালেমের ডাইনীবিদ্রোহ, ফরাসি বিপ্লবের ওলাঁপ দ্য গুজ -যিনি ‘Declaration of the Rights of Woman’ লেখার অপরাধে প্রাণ হারান, কিংবা খনা -যার বাকশক্তিকে ভয় পেয়ে সমাজ চেয়েছিল তার জিভ কেটে নিতে -সবখানেই নারীর কণ্ঠ ছিল আলো ও প্রতিরোধের প্রতীক। সাহিত্যে ভার্জিনিয়া উলফ যখন বলেছিলেন, “A woman must have money and a room of her own if she is to write fiction,” -তখন তিনি আসলে বলেছিলেন নারীর সত্তার স্বাধীনতার কথা।
নারীর প্রতি পুরুষতন্ত্রের ভয়ই প্রমাণ করে, নারী সঠিক পথেই রয়েছে। কারণ প্রতিটি বিপ্লবই শুরু হয় একা, নিঃসঙ্গ অবস্থান থেকে। তাকে হেনস্তা করা হয়, লাঞ্ছিত করা হয়, মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলে। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরই হয়ে ওঠে ভয়ংকর -যতবার তাকে দমাতে চাওয়া হয়, সে ততবার আরও প্রবল হয়ে ওঠে।
প্রতিরোধের শুরুটা হয় আত্মিক। নারী নিজেকে প্রশ্ন করে -‘আমি কি নিজের শরীরের ওপর অধিকার রাখি না?’, ‘আমি কি নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারি না?’ এই প্রশ্নগুলোই নারীর ভেতরে জাগিয়ে তোলে এক বিদ্রোহী সত্তা। এরপর আসে সামাজিক স্তরে প্রতিরোধ -যেখানে নারী নিজের অবস্থান দৃশ্যমান করে তোলে। কিন্তু তখনই তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় গুজব, গালি, ট্রোল। নারীকে যৌনায়িত করে তাকে খাটো করার কৌশল, আসলে এক ধরনের মানসিক প্রতিরক্ষা-পদ্ধতি। সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, একে বলা হয় reaction formation -যে জিনিস ভয় জাগায়, তার বিরুদ্ধেই ঘৃণার মুখোশ পরে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়।
নারীর প্রতিরোধের চূড়ান্ত রূপ -ঐক্য ও সৃজনশীলতা। যেদিন নারীরা একে অপরের সঙ্গে সংহতি গড়ে তোলে, যেদিন তারা সাহিত্যে, সিনেমায়, রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় নিজের কণ্ঠে নিজেদের গল্প বলতে শুরু করেন, সেদিন সমাজের মুখোশ খসে পড়ে। তাই তো ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, “For most of history, Anonymous was a woman.” সেই অজ্ঞাতনামা নারীর পরিচয় খুঁজে ফেরাই আজকের নারীবিপ্লবের লক্ষ্য।
বাংলা সাহিত্যে এই নারীবোধ উঠে এসেছে বারবার -বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সেলিনা হোসেন কিংবা সাম্প্রতিক প্রজন্মের লেখিকাদের কলমে। সাহিত্যের নারীরা মুখ বুজে থাকেনি। তারা প্রশ্ন তুলেছে, অশ্রু ঝরিয়েছে, আবার প্রতিবাদের আগুনও জ্বালিয়েছে। তারা একেকজন হয়ে উঠেছে খনা, মীরাবাঈ, বা মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী -যার উলঙ্গ শরীর রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
সুতরাং, আজকের নারী যদি ‘না’ বলে, যদি নিজের শরীর, মন ও ভবিষ্যতের ওপর দাবি জানায় -তবে তা পাপ নয়, বরং তা বিপ্লব। আর বিপ্লবের শুরুতে যে একা থাকে, তাকে হেয় করা হয় -সেই বিপ্লবই একদিন হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ, সমাজের বিবেক, ভবিষ্যতের পাথেয়।
গালিগালাজ, ট্রোল, অপবাদ -সবই আসলে নারীর শক্তিকে স্বীকার করার পরোক্ষ প্রমাণ। নারী যত বেশি গালি খায়, ততই বুঝে -সে ভয় জাগাতে পেরেছে। আর সেই ভয়ই জানিয়ে দেয় -সে সঠিক পথেই হাঁটছে। ইতিহাস তার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে, এবং তারই অপেক্ষায় মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ মে ২০২৫
129
View