পোস্টস

প্রবন্ধ

সবুজ স্থাপত্য – স্থাপত্যে সবুজ

২৩ মে ২০২৪

তাসলিহা মওলা



দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা
পূর্ব দুয়ারী তাহার প্রজা,
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই
উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই।
 
বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ বচনটি নিছক কোনো প্রবাদ নয়। উপরের চরণটির অন্তর্নিহিত অর্থের সাথে মিশে আছে আমাদের এ অঞ্চলের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। বস্তুতঃ গ্রীষ্মপ্রধাণ এ অঞ্চলের বাসস্থান নির্মাণের মূলমন্ত্র ছিল এটি। দক্ষিণ দিকে সারা বছর আলো হাওয়ার যে প্রাচুর্য থাকে তাতে দক্ষিণমুখী বাড়ি বা ঘরের পরিবেশ অনেকটাই আরামদায়ক হয়। আর প্রাকৃতিক ভাবে আরামদায়ক পরিবেশ অনেকটাই কমিয়ে ফেলে যান্ত্রিক সমাধানের ওপর নির্ভরতা। আর তেমনটা হলে, অর্থাৎ যদি ঘরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা সেভাবে না থাকে, দিনের বেলা বৈদ্যুতিক আলোর প্রয়োজন না হয়, তবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে নিঃসন্দেহে। এসি কম চললে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাবও অনেকাংশেই কম পড়ে। আর আপনার বাড়ির ছাদে যদি একটি সোলার প্যানেল থাকে তবে কিছুটা বিদ্যুৎ উৎপাদনও হয়। আপনার কিছু বাতি পাখা চলতে পারে সে বিদ্যুৎ থেকে। বিদ্যুৎ চলে গেলে সোলার প্যানেল  পুরণ করতে পারে সে চাহিদা। ফলে জেনারেটরের ব্যবহার হয় কম যাতে করে ডিজেলের খরচও কমে যায়। আবার ধরুন আপনার গোসলখানায় ব্যবহৃত পানি যদি বিশেষ ভাবে রিসাইক্লিং করে গাড়ি ধোয়া, বাগানে জলসেচন, সিঁড়ি গর ধোওয়া বা কমোডের ফ্লাশের মত জায়গায় ব্যবহার করা যায় তবে পানির পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই পরিষ্কার পানির মত অতি মূল্যবান এ সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। আবার আপনার বাড়ির অন্দরসজ্জাও এমনভাবে করা যেতে পারে যাতে করে গৃহাভ্যন্তরের পরিবেশ হবে টেকসই ও স্বাস্থ্যকর। “সবুজ স্থাপত্য” এর সহজ উদাহরণ হিসেবে আমরা উপরোক্ত আলোচনাকে বিবাচনা করতে পারি।
“সবুজ স্থাপত্য” বা “গ্রীণ আর্কিটেকচার” বর্তমানকালে বিশ্বব্যাপী একটি বহুল আলোচিত বিষয়। “সবুজ স্থাপত্য” নামটি প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে এর সাথে শুধুই গাছপালা আর সবুজের সম্পর্ক। মূলতঃ “সবুজ” এখানে একটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি ভবন বা স্থাপনায় গাছের আধিক্য মানেই সবুজ স্থাপত্য – এ ধারণাও অনেকে পোষন করে থাকেন। আদতে তা একেবারেই নয়। “গ্রীণ আর্কিটেকচার” বা “সবুজ স্থাপত্য” এর সাথে “টেকসই” বা “সাস্টেইনেবল” এবং “পরিবেশবান্ধব” শব্দ দুটি বেশী সম্পর্কিত। শুধুমাত্র গাছ লাগিয়ে একটি ভবনের ভেতর বাহির ভরিয়ে তুললেই তা “টেকসই” বা “পরিবেশবান্ধব” হবেনা। ভবনের নকশায় একজন স্থপতিকে, প্রকৌশলীকে মনে রাখতে হবে কিছু অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়। তার মধ্যে অন্যতম হল, উপযুক্ত নকশার মাধ্যমে ভবনের এনার্জি কনজাম্পশান কমিয়ে আনা, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রপভাব কমানো ইত্যাদি। উপরন্ত স্থাপনাটি যেন নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, পানির পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে সেভাবে নকশা করাই সবুজ স্থাপত্যের অন্যতম মূল স্থিতিমাপক। 
 
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা, এগিয়ে চলেছে আমাদের নগরগুলোও। নগরায়নের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ভবন নির্মাণ। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও “টেকসই” নগর নির্মাণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নগরের ক্ষেত্রে “টেকসই” পরিকল্পনা থাকলে তার স্থাপনা সমুহও টেকসই হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে “সবুজ নগর পরিকলনা” বা “সবুজ স্থাপত্য” দুটো বিষয়ই নির্ভর করে একটি এলাকার ভৌগলিক কাঠামো, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নৃ-ত্বত্ত্ব ইত্যাদির ওপর। দেশ ও সমাজ ভেদে স্থাপত্যের মতই সবুজ স্থাপত্যের ধরণও হয় ভিন্ন। সে কারণেই সবার প্রথমে খনার বচনটি বললাম। 
আমাদের দেশ গ্রীষ্মপ্রধাণ। বছরের একটা বড় সময় তীব্র রোধ ও ঝড় বৃষ্টির সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। আজকাল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও ভবনে কাঁচের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। যার ফলে বাইরের তাপকে আমরা অনেকটাই ঘরের ভেতরে টেনে আনছি।  এতে করে যান্ত্রিক সমাধানের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবেই। চতুর্দিকে ঢালাওভাবে কাঁচের ব্যাবহার ভবনের তাপমাত্রাকে এমন ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে যে এয়ার কন্ডিশনারের ওপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে নগরাঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত এক দশকে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা অত্যন্ত আশংকাজনক। অথচ অতীতে আমাদের অফিস ভবনগুলোতে এসির ব্যবহার ছিল নিয়্যন্ত্রিত। কারণ সেখানে প্রাকৃতিক আলো হাওয়ার চলাচলের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করা হত। আমাদের আবহাও্যার যা ধরণ তাতে বাতাসের নির্বিঘ্ন চলাচলই আমাদের আরামদায়ক ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে যেসব ঘরবাড়ি তৈরী করা হয় তা একেক অঞ্চলের আবহাওয়াভেদে একেকরকম। সেসব ঘরের কোনোটিতেই অসহ্য গরম বা শীত অনুভূত হয়না, এর মূল কারণ হল প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য যা আমাদের নগরাঞ্চলের বর্তমার ভবনগুলোতে অনুপস্থিত। উত্তর-দক্কিণ-পূর্ব-পশ্চিমের এ বিষয়টি মেনে চললে খুব সহজেই এসির ব্যবহার কমিয়ে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারি তেমনি অন্যদিকে পরিবেশকে এসির ক্ষতিকর প্রভাব থেকেও রক্ষা করতে পারি। এ কথা ভুলে গেলে চলবেনা যে, জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে আমরা তাপমাত্রাকে যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব, বায়ুমন্ডলে কার্বন – ডাই- অক্সাইড নিঃসরন যত বেশী হ্রাস করতে পারব ততই আমাদের জন্য  সর্বোপরি এ পৃথিবীর জন্যে মঙ্গল। 
আবার বছরের একটা বড় সময় আমরা বৃষ্টির পানি পাই। ভরা বর্ষার মৌসুমে এ পানি দুষণমুক্ত থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশীরভাগ পানিই পয়ঃনিস্কাশন ব্যাবস্থার মাধ্যমে নোংরা ও দুষিত পানির সাথে মিশে নদীতে গিয়ে পড়ে। অথচ খুব সহজেই প্রতিটি বাড়ির ছাদে বা গ্যরেজে আমরা রেইন ও্যাটার হারভেস্টিং এর ব্যাবস্থা রাখতে পারি। এতে করে পরবর্তীতে এ পানি ব্যাবহার করে নগর অবকাঠামোর ওপর চাপ কমিয়ে আনা যায়। পয়ঃনিস্কাশন ব্যাবস্থাও এমনভাবে তৈরী করা উচিত যাতে করে দুষিত পানি নদী নালায় সরাসরি না গিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশে “ফিকাল স্লাজ ম্যানেজমেনট” বা “পয়ঃ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা” নীতি গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশেও ওয়ি চর্চা শুরু হচ্ছে ধীরে ধীরে। 
পুরনো ভবনের নির্মানসামগ্রীর পুনঃব্যবহারও সবুজ স্থাপত্যের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য এতে করে আবর্জনার পরিমাণ কমে যায় অনেকটাই। আবার উন্নত বিশ্বে অনেক ভবনেই রান্নাঘরের আবর্জনা থেকে প্রাকৃতিক সার তৈরীর ব্যবস্থা থাকে। আবর্জনা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও রিসাইল্কলিং বা পুনর্ব্যবহারের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়।
সবুজ স্থাপত্য সম্পর্কে আমাদের মাঝে একটি ভুল ধারণা প্রায়শই দেখা যায় যে, ভবনে গাছ লাগিয়ে দিলেই তা সবুজ স্থাপত্য। মূলতঃ তা নয়। একটি ভবন কতটা টেকসই ও স্বয়ংসম্পুর্ন তার ওপর নির্ভর করে তা কতটা “সবুজ স্থাপত্য” এর শর্তসমূহ পুরণ করে।  যেমন একটি ভবনের বিদ্যুৎ খরচ কম রাখা, ভবনের আপৎকালীন বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাবস্থা রাখা, পানির পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করা, ভবনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যাবস্থা করা, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা, আসবাবপত্র তৈরীর ক্ষেত্রে কাঠের ব্যবহার হ্রাস করা, স্থাপত্য নির্মাণে মাধ্যমে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে না দেয়া ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলোই নির্দেশ করে একটি স্থাপত্য কতটা “সবুজ” বা “টেকসই” হবে। 
বাংলাদেশে “সবুজ স্থাপত্য” চর্চার শুরু খুব সাম্প্রতিকই বলা চলে। বছর দশেক হল এদেশের মানুষ স্থাপত্যের এ নুতন ধারা সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। আজকাল স্থপতিদের সাথে সাথে আজকাল সকলেই সবুজ স্থাপত্যের প্রতি মনযোগী হয়ে উঠছে। “লিডারশিপ ইন এনার্জি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন সার্টিফিকেট বা লিড সার্টিফিকেটের মাধ্যমে গ্রিণ বিল্ডিং বা সবুজ স্থাপনার সনদ প্রদাণ করা হচ্ছে। আবাসিক ভবন, প্রাতিষ্ঠানিক ভবন, অফিস বা কারখানা ইত্যাদি অনেক স্থাপনার ক্ষেত্রেই সবুজ স্থাপত্যের নিয়ম নীতি মেনে চলা হচ্ছে। বাংলাদেহে বর্তমানে ১৭৮টি গ্রিণ ফ্যাক্টরি বিল্ডিং আছে যেগুলো লিড সনদ প্রাপ্ত। এসব ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব দুষিত জল শোধনাগার আছে যাতে করে প্রাকৃতিক জলাধার সমূহে কারখানার দুষিত পানি না মেশে। 
জলবায়ু পরিবর্তনের এ যুগে বাংলাদেশ অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে। এক্ষেত্রে স্থাপনা ও নগর পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় নীতিমালা এমন ভাবে গ্রহণ করা উচিত যেন এর ব্যাপ্তি ও বিস্তার বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি দুষনমুক্ত নগর, দেশ সর্বোপরি পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। প্রকৃতিই সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক। সে প্রকৃতিকেই আমরা রক্ষা করতে পারছিনা শুধুমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা, নীতিমালার ও সদিচ্ছার অভাবে। “সবুজ স্থাপত্য” চর্চার প্রসার বৃদ্ধির মাধ্যমে খুব সহজেই আমরা নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।