যেন 'ফেইরি টেলসে'র কোনো শুভ্র চরিত্র। যেন মিথলজিক্যাল অ্যাঞ্জেল। সফেদ গাউনে সজ্জিত দুই সারী নারী, লম্বা ঘন চুল বাতাসে ছুঁড়ে ছুঁড়ে এক ছন্দোবদ্ধ অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধানকে। পেছনে ঢাক-ঢোল আর পুরুষদের সঙ্গীতগীতি, যেন উপসাগরের মরুপ্রান্তরে ফুটে ওঠা এক বহুকালীন সংস্কৃতির শব্দ-নৃত্যরস।
এই চিত্রপটটি কোনো ইউরোপীয় শিল্পনগরীর নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের কড়া রক্ষণশীল দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ প্যালেস অব দ্য নেশন তথা কাসর আল ওয়াতানের। অতিথি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নৃত্যটির নাম খালিজি -যা আরব উপসাগরীয় নারীদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
‘খালিজি’ নামে পরিচিত নৃত্যগীত -নারীর বিশুদ্ধ অভিব্যক্তির প্রতীক। এটি ধর্মীয় নয়, পেগান বা পৌত্তলিক তো নয়ই; বরং একটি জাতিগত সাংস্কৃতিক চর্চা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গালফ অঞ্চলে লালিত হচ্ছে। সৌদি আরব, কাতার কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাত -এদের সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম, কিন্তু তারা নিজেদের চিরায়ত সংস্কৃতি, জাতিগত ঐতিহ্য কিংবা লোকজ নান্দনিকতাকে কখনোই ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করায়নি। বরং রাষ্ট্রীয় আয়োজনে সেই সংস্কৃতিকেই গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরে। বিশ্বকে চেনায়।
'খালিজি’ শব্দের অর্থই উপসাগরীয়, যা সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নারীদের একটি অভিব্যক্তিমূলক নৃত্যরূপ। এই নৃত্য নারীর আনন্দ, অহংকার, সৌন্দর্য ও নারীস্বাধীনতার এক ঐতিহাসিক ভাষ্য।
এটির সূত্ৰপাত ইসলামী স্বর্ণযুগের গোড়ার দিকেই -বিশেষ করে উমাইয়া খিলাফত (৬৬১–৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) এর আমলে, যখন আরবে সঙ্গীত ও কাব্য চর্চা বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছিল। খালিজি নৃত্য ও সুর সেই কালের সঙ্গীত ঐতিহ্যেরই উত্তরাধিকার। ধর্মীয় নয়, বরং এটি আরব নারীর নিজস্ব জাতিগত সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ, যা রাষ্ট্রীয় উৎসব ও অভ্যর্থনাতেও গৌরবের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়।
অথচ বাংলাদেশে চিত্রটা উল্টো। এখানে নারীর খোলা চুল শুধু ‘অসুবিধাজনক’ নয়, অনেকক্ষেত্রে ‘পাপ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বহুবর্ণিল ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় প্রতিনিয়ত। কখনো রবীন্দ্রসংগীতে আপত্তি, কখনো ধ্রুপদী নাটকে বাধা, আবার কখনো সিনেমার প্রদর্শনীতে হামলা। আজকাল জনপরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলোকে অপরাধপ্রবণতার সাথে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বাদ্যযন্ত্রের সুরকে নিষেধাজ্ঞায় ফেলে দেয়া হয়েছে। মন খারাপ হয় এজন্য যে, এই দেশেই একদিন গান-নাটক-চলচ্চিত্র ছিল গণমানুষের প্রতিবাদের ভাষা, প্রগতির হাতিয়ার।
জাতীয়সংগীত একসময় ছিল আমাদের মুক্তির চেতনার প্রতীক, আজ তা গাইতেও ঝুঁকি থাকছে। কবিতা, চিত্রকলা, লোকনৃত্য -এসবের মাঝে যে মনন লুকিয়ে আছে, তা আজ সংকুচিত হয়ে পড়ছে নিষেধের ছায়ায়।
প্রশ্ন হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সৌদি আরব যেখানে তাদের ধর্মীয় গাম্ভীর্য বজায় রেখেও সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করেনি, সেখানে আমরা কেন বারবার নিজেদের শিকড় কেটে ফেলছি? আমাদের কি নিজেদের বাঙালিয়ানা, চিরায়ত সুর, কৃষ্টি ও রুচির প্রতি কোনো আস্থা নেই? আমরা কি আমাদের হাজার বছরে বাঙালি পরিচয় অবলুপ্ত করে ফেলব?
খালিজি নৃত্যের নারীরা যখন চুল ছুঁড়ে নাচেন, সেটি হয়ে ওঠে তাদের স্বকীয়তার অভিব্যক্তি; রাষ্ট্র তা প্রশ্রয় দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে। আর আমরা? আমরা নারীর মাথা ঢাকতে ঢাকতে তার কণ্ঠও রুদ্ধ করে দিচ্ছি।
প্রশ্ন হলো -যেখানে আরবের রক্ষণশীল দেশগুলো তাদের ধর্মীয় গাম্ভীর্য বজায় রেখেও সংস্কৃতি বর্জন করছে না, সেখানে আমরা কেন নিজেদের সাংস্কৃতিক শিকড় বারবার কেটে ফেলছি?
সংস্কৃতি যদি মননের আয়না হয়, তবে আমরা কি নিজেদের আয়নাকে ভেঙে ফেলছি?
এই প্রশ্নগুলো আজ বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উত্তর আমাদেরই দিতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির বন্ধ দুয়ার আমাদেরকেই খুলতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক
১৬ মে ২০২৫