Posts

ফিকশন

মৌসুমি আম নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রাণভরে খান কৃষিবিদ মো.বশিরুল ইসলাম

May 16, 2025

Bashirul Islam

84
View

জৈষ্ঠ্য মাস । এ মাসে শহর কিংবা গ্রামের বাজারগুলোতে দেখা যায় নানা রকম ফলের সমারোহ। চারিদিকে নানা রকম ফলের সুবাস। গ্রামবাংলার এসব ফলে ছেয়ে গেছে শহরের অলিগলি ও বাজার। বছরের আর কোনো মাসে এত ফলের আগমন ঘটে না। তাই তো ভুল করে অনেকে জ্যৈষ্ঠ মাসকেই ‘মধুমাস’ বলে ফেলেন। আমরাও অপেক্ষা থাকি কখন জৈষ্ঠ্য মাস আসবে। কারণ এসময়েই আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুলসহ নানা জাতের ফল পাকতে শুরু করে। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা তাজা ফলের পরশ অসাধারণ এক অনুভূতির জন্ম দেয়। এই ফলের কথা ভেবে নস্টালজিক হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। 

ফলের রাজা আম। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। বর্তমান সরকার আমগাছকে দিয়েছে জাতীয় গাছের মর্যাদা। যদিও কাঁঠাল জাতীয় ফল, জনপ্রিয়তায় আম সবার ওপরে। মধ্য মে থেকে উন্নত জাতের আমের মৌসুম শুরু হয়। চলে সেই প্রায় আগস্ট মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মাস আমের বাজার থাকে রমরমা। এ সময় ধনী থেকে গরিব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে দেখা যায় ফল কেনার উৎসব। দামও থাকে সাধ্যের মধ্যে। ফলের পসরা সাজিয়ে বসে ক্ষুদ্র থেকে বড় ফল ব্যবসায়ীরা। 

বছর কয়েক আগেও ফল খাওয়া নিয়ে মানুষের এত নেতিবাচক ধারণা ছিল না। গ্রাম ও শহরের মানুষ সবাই মিলে দেশীয় ফল, বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে আম-কাঁঠালের স্বাদ নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত।৷ আর এখন পাকা আম বাজারে আসলেই নানা প্রশ্ন চলে আসে। অনেকের মধ্যেই ভয় বা বিভ্রান্তি কাজ করে। ভয়ের কারণ এগুলো খাঁটি আম তো? মানে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড রাসায়নিক দিয়ে আম পাকানো হয়েছে কি না? এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কোথাও যেন স্বস্তি নেই। 

একবার ভাবুন তো সারা বছর বিদেশ থেকে এত আপেল, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, প্যাসন ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট, আংগুর, খেজুর আসে যেগুলো মাসের পর মাস পচে না। তারা কি কোনো কিছুই দেয় না? আর আমাদের দেশের চাষিদের আম কিনতে গেলে সব বিষে ভরা! আসলে, এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল আমে কেমিক্যাল ও ফরমালিন রয়েছে এমন অপপ্রচার করে  আমকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করে চলছে । এতে দেশীয় আমচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

রমজান মাসের আমাদের দেশি ফল কম থাকার বিদেশি ফলের দাম অস্বাভাবিক ছিল। ওই সময় আপেল, কমলা ও মাল্টার মতো আমদানি করা ফলের দাম কেজিতে বেড়েছিল ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। দাম বাড়ার জন্য বাড়তি দরে শুল্কায়ন ও ডলার সংকটকে দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। এখন রমজানের চেয়েও

ডলারের দাম বেশি। শুল্ক-করও এর মধ্যে কমানো হয়নি। কিন্তু  ফলে ভরপুর এই মৌসুমে বাজারে আধিপত্য কমেছে বিদেশি ফলের। চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ফলের দামও কমেছে বাজারে। এর থেকেই অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। আর, অভিযোগ রয়েছে-আম পাকার পর তা যেন পচে না যায়, এজন্য নিয়মিত স্প্রে করা হয় ফরমালিন। আমাদের যে ধারণা দেশি ফলমূল এবং বিদেশ থেকে আনা ফলে ফরমালিন দেওয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

আমের ফরমালিন ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা জানান, প্রাকৃতিকভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। মনে আছে, ২০১৪ সালে আমে ফরমালিনের কথা বলে হাজার হাজার মন আম বিনষ্ট করা হয়েছিল। শুধু আম নয় অন্যান্য মৌসুমি ফলও করা হয় ধ্বংস। অথচ গবেষণায় জানা গেল শুধু আম নয়, ফলমূল শাক সবজিতেও ফরমালিনের কোন ক্ষতিকর ভূমিকা নেই। যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হতো সেটাও কার্যকর ছিল না। 

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এরপর ফরমালিন বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়- ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার, যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ যা মূলত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনও ভূমিকা নেই। কেউ যদি না বুঝে দেয়ও, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না। সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ এখানে কোনো প্রোটিন নেই। 

আবার কয়েক বছর আগে যখন  কার্বাইড,

ইথোফেনের নামে আম ধ্বংস করা শুরু হল তখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন- ইথোফেন অথবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম নিরাপদ। তখন অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। আসলে, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ও ইথোফেন ব্যবহার করা হয়, যা সারা বিশ্বে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা ২৪ ঘণ্টা কম সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। তবে যে কোন ফল খাওয়ার  আগে বেসিনের পানিতে কয়েক মিনিট ছেড়ে রাখলে ক্যামিকাল ধুয়ে চলে যায়, ফলে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। 

এবার আসুন, যুক্তি দিয়ে দেখি- আম চাষিরা ভরা মৌসুমে আসলে কেমিক্যাল ব্যবহার করে কি না? আর দিলেও কেন দেবে? আমার ধারণা, আম চাষিরা এই ধরনের কেমিক্যাল অন্তত ভরা মৌসুমে দেয় না। কারণ হচ্ছে ভরা মৌসুমে আম এমনিতেই পরিপক্ব থাকে এবং আম আধা পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়া হয়। এ সময় আম রেখে দিলে বা আমগাছ থেকে পাড়ার পর ট্রান্সপোর্টের সময়টুকুতে আম এমনিতেই পেকে যায়। তাই ভরা মৌসুমে টাকা খরচ করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর কোনো প্রয়োজনই দেখি না।

 আর ভরা মৌসুমে প্রচুর আম বিক্রি হয়, দোকানে স্টক থাকে না। প্রচুর আম আসে, তেমনি প্রচুর আম বিক্রিও হয়ে যায়। এ সময় টাকা খরচ করে কেন কেউ ফরমালিন দেবে? তবে কথা হচ্ছে, মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকাতে পারে। কারণ তখন অপরিপক্ব আম তাড়াতাড়ি পাকিয়ে বাজারে ছাড়লে বেশি দাম পাওয়া যায়।

অতিমুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে এ সময় আম পাকানোর সুযোগ নিতে পারে। আর মৌসুমের শেষে যখন বাজারে আম খুব কম পাওয়া যায়। কিছুদিন আমকে ধরে রাখতে পারলে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে তা বিক্রি করতে পারে। ঠিক সেসময় ব্যবসায়ীরা আমে ফরমালিন দিতে পারে। তাই, পুষ্টিকর ভালো আম খেতে হলে ফলের মৌসুমেই খেতে হবে।

পরিপক্ব আম বাজারজাতে সূচি ঘোষণা করে আসছে স্থানীয় প্রশাসন। সূচি অনুযায়ী আম কিনলে কোন ভয়ে কারণ নেই। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ, গোপালভোগ, বোম্বাই, গোলাপখাস, বৈশাখীসহ স্থানীয় জাতের আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। ২০ মে থেকে শুরু হবে হিমসাগর বাজারজাত। ২৭ মে থেকে পাওয়া যাবে ল্যাংড়া। ৫ জুন থেকে বাজারে উঠবে আম্রপালি জাতের আম। আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চলের গুটি আম বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ২২ মে থেকে গোপালভোগ, ২৫ মে থেকে রানিপসন্দ ও লক্ষ্মণভোগ, ৩০ মে থেকে হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি, ১০ জুন থেকে ব্যানানা ম্যাংগো ও ল্যাংড়া, ১৫ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি, ৫ জুলাই থেকে বারি আম-৪, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা, ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতি সংগ্রহ করা যাবে। এ ছাড়া কাটিমন ও বারি আম-১১ সারা বছরই পাকা সাপেক্ষ পাড়া যাবে। তবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলতি মৌসুমে থাকছে না ম্যাংগো ক্যালেন্ডার বা আম পাড়ার সময়সীমা। আম পরিপক্ব হলেই গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করতে পারবেন আমচাষিরা। আর একমাত্র আশ বিহীন রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম পাওয়া যাবে জুন মাস থেকে।

তাই আসুন ইথেফন, ইথিলিন ও ফরমালিনের বিষয়টি ভালোভাবে জানি এবং আম না কেনা বা ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকি। তবে আমচাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। 

তবে কার্বাইড শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার কারণে নানারকম রোগ হতে পারে। যেমন- ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে  এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারের ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণার আর

ভেজালবিরোধী নানান অভিযানের ফলে কার্বাইডের ব্যবহার অনেক কমে গেছে।  এছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে।  তারপরও কিছু কাজ আমরা করতে পারি। যেমন- স্থানীয় এলাকায় মাইকিং করা, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা, আম চাষি এবং আড়তদার নিয়ে সচেতনতামূলক মিটিং করে এ ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। 

আম এখন সারা দেশের ফল, যা বাণিজ্যিক কৃষির কাতারে পৌঁছে গেছে। এখন উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে। পার্বত্য জেলার জুমচাষ এলাকায়ও উন্নত জাতের আম ফলছে। বাংলাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বে। বিশ্ববাজারে আম রফতানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে, তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের

আম আসে না। আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। প্রতিবছর বাংলাদেশে ১.৫ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়। সম্প্রতি ডেটা স্ট্যাটিস্টিকা এ তথ্য জানিয়েছে। দেশে প্রতি বছরই আমের উৎপাদন বাড়ছে। তাই দেশের মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আম।

এ দেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর,  হাড়িভাঙ্গা এবং আশ্বিনা জাতের আম যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। 

তাই আসুন আমরা সবাই একটু সচেতন হই, ভালোভাবে বুঝে, সঠিকভাবে শুনে মন্তব্য করি। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে আমাদের এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

কৃষিবিদ মো.  বশিরুল ইসলাম 

উপ-পরিচালক 

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় 

ই-মেইল -mbashirpro1986@gmail.com

মোবাইল - ০১৭১৬-৫৮১০৮৬

Comments

    Please login to post comment. Login