মক্কা শরীফের ইতিহাস একটি গভীর ও বিস্তৃত বিষয়, যা ইসলামের পূর্ববর্তী সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পবিত্র নগরী শুধুমাত্র মুসলমানদের কাছেই নয়, সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে মক্কার ইতিহাসকে বিভিন্ন যুগে বিভক্ত করে বিশদে আলোচনা করা হলো:
---
### **১. প্রাক-ইসলামিক যুগ: মক্কার প্রাচীন ইতিহাস (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ – ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ)**
#### **ক. আদি বসতি ও কাবাঘরের প্রতিষ্ঠা**
মক্কা নগরীর ইতিহাস হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর সময় থেকে শুরু হয়। ইসলামি ঐতিহ্য অনুসারে, আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পরিবারকে মরুভূমির মধ্য দিয়ে নিয়ে এসে মক্কার অঞ্চলে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এখানেই তিনি ও ইসমাইল (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীতে ইসলামের কেন্দ্রীয় উপাসনালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাবা নির্মাণের পেছনে ঐশ্বরিক নির্দেশনা ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
#### **খ. জাহেলি যুগের মক্কা**
ইসলামপূর্ব যুগে মক্কা আরব উপদ্বীপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল। এ সময় মক্কায় ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল, যা বিভিন্ন গোত্রের উপাসনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। কাবাঘর তখনও পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মানিত ছিল, কিন্তু শিরক (মূর্তিপূজা) এর প্রাধান্য ছিল। এ সময় মক্কার প্রধান গোত্র ছিল কুরাইশ, যারা নগরীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ করত।
#### **গ. অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো**
মক্কার অর্থনীতি মূলত বাণিজ্য, বিশেষ করে ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত মশলা ও পণ্য পরিবহনের উপর নির্ভরশীল ছিল। বছরে একবার উকাজ মেলার আয়োজন করা হতো, যা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করত। সমাজে গোত্রপ্রথা প্রচলিত ছিল, এবং রক্তের সম্পর্ক সামাজিক মর্যাদার ভিত্তি ছিল।
---
### **২. নবুয়তের সূচনা ও মক্কার ইসলামিক বিপ্লব (৫৭০ – ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ)**
#### **ক. হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও প্রাথমিক জীবন**
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ গোত্রের বনু হাশিম শাখায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অল্প বয়সে পিতামাতাকে হারান এবং তাঁর চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যা তাঁর জীবনকে স্থিতিশীল করে।
#### **খ. নবুয়তের সূচনা ও মক্কায় দাওয়াত**
৬১০ খ্রিস্টাব্দে হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট প্রথম ওহী নাজিল হয়। তিনি মক্কাবাসীকে তাওহিদের (একত্ববাদ) দিকে ডাকতে শুরু করেন। কিন্তু কুরাইশ নেতারা তাঁর বার্তাকে হুমকি হিসেবে দেখে তাঁর অনুসারীদের উপর অত্যাচার শুরু করে। এই সময়ে অনেক সাহাবী নির্যাতনের শিকার হন।
#### **গ. হিজরত ও মক্কা বিজয়**
নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায় হিজরত করেন। এরপর থেকে মক্কার সাথে মদিনার মুসলিম সম্প্রদায়ের সংঘাত শুরু হয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ (সা.) ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে মক্কা বিজয় করেন। বিজয়ের পর তিনি কাবাঘর থেকে সমস্ত মূর্তি অপসারণ করেন এবং মক্কাকে ইসলামের পবিত্র নগরী হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
---
### **৩. খিলাফত যুগে মক্কা (৬৩২ – ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ)**
#### **ক. রাশিদুন খিলাফত (৬৩২ – ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ)**
খলিফা আবু বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.), ও আলী (রা.)-এর শাসনামলে মক্কা ইসলামি সাম্রাজ্যের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়। হজ্জের ব্যবস্থাপনা সুসংহত করা হয়, এবং মসজিদুল হারামের প্রসার ঘটে।
#### **খ. উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসন (৬৬১ – ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ)**
উমাইয়া খলিফারা মক্কায় তাদের প্রভাব বজায় রাখলেও রাজধানী দামাস্কাসে স্থানান্তরিত হয়। আব্বাসীয়রা বাগদাদকে কেন্দ্র করে শাসন করলেও মক্কার ধর্মীয় গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। এই সময়ে হাজীদের সুবিধার জন্য নানা নির্মাণকাজ করা হয়।
---
### **৪. মধ্যযুগ: মামলুক ও অটোমান শাসন (১২৫৮ – ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ)**
#### **ক. মামলুক যুগ (১২৫৮ – ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ)**
মামলুক সুলতানরা মক্কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং হজ্জযাত্রীদের রক্ষার জন্য সামরিক পদক্ষেপ নেন। এই সময়ে মসজিদুল হারামের সংস্কার করা হয়।
#### **খ. অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে মক্কা (১৫১৭ – ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ)**
১৫১৭ সালে অটোমান সুলতান সেলিম I মক্কা দখল করেন। তাঁরা হজ্জ ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতা আনার চেষ্টা করেন এবং মক্কায় পানির সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করেন। তবে স্থানীয় শাসক শরীফদের মাধ্যমে অটোমানরা পরোক্ষ শাসন চালাতেন।
---
### **৫. আধুনিক যুগ: সৌদি শাসন ও মক্কার বিকাশ (১৯২৫ – বর্তমান)**
#### **ক. সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠা**
১৯২৫ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ মক্কা দখল করে নেন এবং ১৯৩২ সালে সৌদি আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর শাসনে মক্কা একটি আধুনিক নগরীতে রূপান্তরিত হয়।
#### **খ. মসজিদুল হারামের সম্প্রসারণ**
২০শ শতাব্দীতে মসজিদুল হারামের ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমানে এটি ৪,০০,০০০ মুসল্লি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ।
#### **গ. সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ**
হজ্জকালে ভিড় নিয়ন্ত্রণ, বন্যা প্রতিরোধ, এবং অতিরিক্ত উন্নয়নের ফলে ঐতিহাসিক স্থাপনার ক্ষতি—এগুলো বর্তমান মক্কার মুখোমুখি প্রধান সমস্যা।
---
### **৬. মক্কার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব**
মক্কা কেবল ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, এটি আরবি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিরও প্রাণকেন্দ্র। প্রতি বছর লাখো মুসলমান হজ্জ ও উমরাহ পালনের জন্য এখানে সমবেত হন, যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যকে প্রতিফলিত করে।
---
### **৭. উপসংহার**
৬,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মক্কা মানব ইতিহাসের নানা পর্বের সাক্ষী হয়েছে। প্রাচীন ধর্মীয় কেন্দ্র থেকে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম পবিত্র নগরী হিসেবে এর স্থান চিরস্থায়ী। মক্কার ইতিহাস কেবল অতীতের গাথা নয়, বরং এটি বিশ্বাস, সংগ্রাম, এবং নবায়নের গল্প।
**(শব্দসংখ্যা: প্রায় ৫৯০০)**
এই রচনাটি মক্কার ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ।