মাথার উপর নির্দয় সূর্যটা যেন ফেটে পড়ছে। গরমের খা খা রোদ্দুরে নিধি পিচঢালা রাস্তায় একা হাঁটছে। টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছল সে। কোথাও না বসলেই নয়। ভার্সিটি থেকে বাসায় যাচ্ছে । রাস্তার জামে আটকে পড়েছিল। কাঠফাটা গরমে রিক্সায় না বসে রাস্তায় নেমে পড়েছিল। বাসাটা অবশ্য খুব বেশি দূরে না! হেঁটে যেতে ২০ মিনিটের রাস্তা। সামনে একটা ক্যাফেটেরিয়া দেখতে পেল সে। ক্লান্ত মুখে কিছুটা হাসি ফুটে উঠলো। এটা তার পছন্দের জায়গার মধ্যে একটা বলা চলে। কারণ সময় পেলে বা ব্যস্ত সময় পার করার পর একটু রিফ্রেস হতে এখানে আসে সে।ক্যাফেটেরিয়ার পরিবেশটা খুবই ভালো।
সে দ্রুত গতিতে ক্যাফেটেরিয়ার ভিতরে ঢুকলো । একটা ঠান্ডা জুস আর একটা আইসক্রিম অর্ডার করে জানালার পাশে একটা জাগায় বসলো। কিছু সময় পর ওয়েটার জুস আর আইসক্রিম নিয়ে আসলো। নিধির জুস খাচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সহসাই চোখ গেল ক্যাফেটেরিয়ার দরজার দিকে। দেখলো একজন বলিষ্ঠ পুরুষ এক রমণীর হাত ধরে দরজা খুলে ভেতরে আসছে। চেয়ার টেনে রমণীকে বসছে দিল। ওয়েটারকে কিছু অর্ডার দিয়ে মেয়েটার সাথে হেসে খেলে গল্প করতে লাগলো। ওয়েটার খাবার দিলে ছেলেটা মেয়েটাকে খাইয়েও দিতে লাগলো। এসব দেখে নিধির চোখে অচিরেই জল জমতে শুরু করল। কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে তার আদল ভিজিয়ে দিল। এক মুহূর্ত আর বসলো না সেখানে। ঝটপট বিল পরিশোধ করে তাড়াতাড়ি চলে গেল সেখান থেকে।
"এক্সকিউজ মি মিস!"
নিধি চমকালো! থমকাল! পিছন ফিরে দেখে এ তো সেই ছেলেটা।
"জ্বী, আমাকে বলছেন? "
ছেলেটা মিষ্টি করে একটা হাসি দিল। বলল,
"আপনার ফোনটা ফেলে রেখে এসেছিলেন। "
বলে নিধির দিকে ফোনটা দেওয়ার জন্য হাত বাড়াল।
নিধি ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
"ধন্যবাদ। আমি খেয়াল করিনি। "
"ইটস ওকে। কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? আপনি কি এই এলাকার?"
"হ্যাঁ সামনে আমাদের বাসা ।"
আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে বাসায় আসে নিধি।
একবারও পেছন ফিরে তাকায় না। চোখ জ্বালা করছে। বাসায় ঢুকে কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। রহিমা বেগম কিচেনেই ছিলেন। নিধিকে ঢুকতে দেখেন তিনি। নিজের দরজার কাছে এসে বলেন,
"কিরে! এসেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিস! খাবি না?"
নিধি কন্ঠটা স্বাভাবিক করে বলল,
"ভালো লাগছে না মা। পরে খাব।"
রহিমা বেগম মনে করলেন হয়তো ভার্সিটি থেকে এসে ক্লান্ত হয়ে গেছে। পরে খাবে। চলে গেলেন তিনি।
এদিকে নিধি খাটের এক পাশে বসে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। তার গলার কান্নায় চারদিক নিস্তব্ধ কিন্তু তার ভিতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। চোখের পানিতে ভিজে গেছে গাল। তবুও যেন সেই অশ্রু ব্যথার সামান্য প্রকাশমাত্র। বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে ভিতরে ভিতরে। নিধির নিঃশ্বাস ভারী এক সময়। কান্নার ফলে শ্বাস থেমে থেমে আসছে। বারবার বুক চেপে ধরে সে। যন্ত্রণার ভার সামলাতে চাইল। কিন্তু পারল না। শব্দহীন হাহাকারের ভেতর নিধি ছটফট করছে। অসহ্য এক ব্যথা তাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে । নিজের ভেতরেই যেন সে ধসে পড়ছে ধীরে ধীরে।
একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। রহিমা বেগম দুপুরে অসংখ্যবার ডাকার পরেও কোনো সাড়া পায় না তার। নিজের মতো বকাঝকা করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যান।
__________________
ঐ দিনের পর থেকে নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দেয় নিধি।কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে সারাক্ষণ।কারোও সাথে কথা বলে না। ঠিকমত পড়াশোনা করে না। কি যেন ভাবতে থাকে!
হাসিবুর রহমানের কানে কথাটা গেলে তিনি নিধির কাছে আসেন। নিধি তখন তার রুমে শুয়েছিল কাঁথা মুড়ি দিয়ে। এই গরমে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে নিধির কপালে হাত রাখেন তার বাবা । না শরীর একদম ঠিক আছে!
"তোমার কি মন খারাপ আম্মু? "
বাবার কন্ঠ শুনে কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে নিধি। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে,
"না বাবা আমি একদম ঠিক আছি।"
হাসিবুর রহমান বলেন,
"তাহলে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছো না কেন?
বাবার কোন কথার উত্তর দিতে পারে না সে। চুপ করে থাকে। হাসিবুর রহমান মেয়ের মৌনতা দেখে বললেন,
"তোমার জন্য আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিধি। আমি জানি তুমি অমত করবে না। তারপরও জানিয়ে রাখি,
একটু থেমে আবার বলতে লাগেন,
তোমার জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। পরিবারটা বেশ ভালো।ছেলে শিক্ষিত, মার্জিত। ব্যাংকে চাকরি করে। আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আর তোমার মায়েরও।আগামীকাল তারা তোমাকে দেখতে আসবে। তৈরি হয়ে থেকো। "
বলে মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিবুর রহমান সেখান থেকে বের হয়ে যান। নিধি পলকহীন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখে পানি শূন্য। থমকে গেছে সে। অনুভূতি শূন্য হয়ে যেভাবে বসে ছিল সে অবস্থায় শুয়ে পড়ে।
__________________
আজ নিধির বিয়ে। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে হাসিবুর রহমান কোন কমতি রাখেননি। আত্মীয় স্বজনদের খুব ভালো করে আপ্যায়ন করেছেন। সাথে নিধির শ্বশুর বাড়ির লোকজনের। হাসিবুর রহমানের একদম মন মত পাত্র পেয়েছেন। ছেলেটা অত্যন্ত ভদ্র সুশীল। গুরুজনদের খুবই মান্য করে। নরম সরম ছেলেটা নিধিকে খুব সুখে রাখবেন। এটাই বিশ্বাস তার।
চারদিকে মরিচ বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরো বাসাটা। লোকজন আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনায় পুরো বাসাটা ভরে গেছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। ইতিমধ্যে বর চলে এসছে। বরের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য ছেলেমেয়ের এক প্রকার হট্টগোল বাধিয়ে ফেলেছে। সেদিকে ছুটলেন হাসিবুর রহমান। সবকিছু সামলিয়ে বরকে নিয়ে আসলেন।
বিয়ের কার্য সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পর হাসিবুর রহমান মেয়েকে বিদায় জানানোর জন্য গেটের কাছে আসেন। নিধির বরের নাম অভ্র। তিনি অভ্রের হাতে নিধির হাত তুলে দিয়ে কাঁদতে থাকেন। পৃথিবীর সমস্ত বাবার কাছেই মেয়ে বিদায়ের মত কষ্টের মুহূর্ত মনে হয় আর একটা নেই। নিধির মা ও আঁচলে মুখ দেখে কাঁদতে থাকে। নিধির চোখ রিক্ত শূন্য। যেন তার কোন অনুভূতি নেই। নিষ্প্রাভ চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দিন দুনিয়ার জন্য কোন হদিস নেই তার।
___________________
ফুলশয্যার খাটে বসে আছে নিধি।তার শাশুড়ি মা হাফসা বেগম একটু আগে তাকে এই রুমে বসিয়ে দিয়ে গেল।নিধি মনে মনে ভাবে, ও কেমন করে সংসার করবে! যাকে মনে মনে ভালোবাসা তাকে ছেড়ে অন্য একটা অপরিচিত মানুষকে কি করে ভালোবাসবে! ভালোবাসা ছাড়া কি সংসার করা যায়! যায় হয়তো! কতো মানুষই তো ভালোবাসা ছাড়াই সংসার করে যাচ্ছে। হাহ্।ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছু আসলো না।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। এতে যেন নিধি আরো জড়োসড় হয়ে বসলো বিছানায়। মনের মাঝে ভয়,সংকচ থাকা সত্ত্বেও বুকে পাথর বেঁধে চুপ করে বসে থাকলো মাথা নিচু করে।
ভ্যাপসা গরমে অভ্রের একদম নাজেহাল অবস্থা। পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে ঘরে ঢুকেছে সে। খাটের দিকে চোখ যেতেই চক্ষু শীতল হয় তার। মনের ভেতর সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। মুখে চাওড়ার হাসি নিয়ে বিছানায় বসলো। বড় ঘোমটার নিচ দিয়ে তার বউয়ের মুখটা দেখতে চাইলো। কিন্তু এত বড় ঘোমটা থাকার কারণে দেখতে পারলো না। অভ্র নিধির হাতে এক আঙ্গুল দিয়ে ছুঁতে গেলেই নিধি হাত সরিয়ে নেয়। ব্যাপারটাতে দারুন মজা পায় অভ্র। আবার হাত ধরতে গেলে নিধি আবারও হাত সরিয়া নেয়। অভ্র ঘোমটার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে বলে,
"এই গরমে আর কতক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকবে বউ?
তোমার গরম লাগছে না? "
প্রতিউত্তরে নিধি কিছুই বলে না। চুপ করে থাকে।
তাই অভ্র নিজেই উদ্যোগ নেয় ঘোমটা খোলার। অভ্র নিধির পেছন থেকে হাত গলিয়ে মাথার ওড়না ধরে টান দেয়। সাথে সাথে ওড়নাটা নিচে ঝরে পড়ে। নিধির চাঁদ পানা মুখটা দেখে অভ্রের বুকে ব্যথা হতে শুরু করে। ও কি হার্ট অ্যাটাক করবে? এত সুন্দর কোন মানুষ হয়? নাকি ভালোবাসার মানুষগুলোকে দেখতে সুন্দর লাগে। ঠিক তো স্বপ্নে দেখা পরীর মত। সে কখন থেকে অভ্র নিধিকে টুকুর টুকুর চোখে দেখেই যাচ্ছে। নিধি যেন একটা কাঠের পুতুল। কোন হেলদোল নেই। মনে হচ্ছে দুনিয়াতেই নেই। অভ্র একটু মনঃক্ষুন্ন হলো। বলল,
"সেই কখন থেকে আমি তোমাকে দেখে যাচ্ছি! তুমি একটু আমার দিকে তাকাও!আমি কি দেখতে এতটাও সুন্দর! "
নিধির কোন সাড়া না পেয়ে অভ্র ওর কোলে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ ঘটনায় নিধি চমকে যায়। অভ্রের মাথা হাত দিয়ে সরাতে গেলে তার চোখে চোখ পড়ে নিধির। মানুষটাকে দেখে তার কায়া ছলকে উঠল। হাতও কেঁপে উঠল। অভ্র মুচকি মুচকি হেসে নিধির হাত তার হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। নিধি নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না। কাকে দেখছে ও? যাকে এতদিন ধরে মনে মনে ভালোবেসে এসেছে সে তার হাজবেন্ড! নাকি পুরোটাই চোখের ভ্রম!
সেদিন পাত্রপক্ষ দেখতে আসলেও ছেলে এসেছিল না। শুধু ছেলের বাবা-মা এসেছিল । আর নিধিকে খুব পছন্দ করেছিল তারা । তাই তো সেদিনই আংটি পড়িয়ে আসে। নিধির বাবা-মা ও ভীষণ পছন্দ হয়। তাইতো বিয়ের কথা ফাইনাল করে। নিধি হা করে অভ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে অভ্র নিধির মুখে ফুঁ দেয়। শীতল ঠান্ডা বাতাসে নিধির চোখ বুঝে আসে।
"তুমি অনেক ক্লান্ত বউ। এসব ভারী সাজ মুুছে ফ্রেশ হয়ে এসো।তোমার সাথে অনেক কথা আছে আমার। "
নিধি অভ্রের কথা মেনে বাথরুমে চলে যায়। নিধির ফ্রেশ হতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে। নীতি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে অভ্র অশান্ত হয়ে সারা ঘর পায়চারি করছে। নিধিকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অভ্র।
নিধি দেখে অভ্র একটা ট্রাউজার আর কালো রঙের গেঞ্জি পড়ে আছে। অভ্রের এই কাতিল লুক দেখে তার গলা শুকিয়ে যায়।অভ্র নিধির কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বিছানায় বসায়। বেডের পাশে সাইড টেবিল থেকে প্লেট তুলে নিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বলে,
"আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে বউ। আসো তুমিও খাও আর আমিও খাই। আমার হাতে খেতে কোন সমস্যা নেই তো?
নিধি লাজুক হেসে মাথা নাড়ে। এই প্রথম নিধির মুখে লাজুক হাসি দেখে অভ্রের স্পন্দন থেমে যায়। তার চোখের কোণায় জমে থাকা লাজুক দীপ্তি আর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠা মৃদু হাসিটা এতটা নিস্পাপ, এতটা আন্তরিক যে অভ্রের চোখ আটকে যায় সেই হাসিতে।
অভ্র খেয়াল করেছিল বিয়ের সময় ওর চোখে এতটা দীপ্তি ছিল না যতটা এখন আছে। কারণ কি!
খাওয়া শেষ হলে নিধির হাত ধরে বলে,
" ছাদে যাবে? আমাদের ছাদের ভিউটা কিন্তু রাতে অনেক সুন্দর লাগে? যাবে? '
নিধি মুচকি হেসে সম্মতি জানায়।
___________
ইতিমধ্যে বাসার সবাই রাত হওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। অভ্র নিধির হাত ধরে সাদে চলে যায়।
রাতের আকাশ রুপোর পাতায় আঁকা এক অপার্থিব ছবি। অসংখ্য তারার ভীড়ে চাঁদটা আজ ঠিক এক ফালি স্বপ্নের মতো। আর জ্যোৎস্নায় চারদিক আলোয় ভেসে যাচ্ছে।গাছের পাতাগুলো যেন রুপালি ঘোমটা গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝিরিঝিরি করে বাতাস বইছে চারিদিক।
অভ্র মুখে হাত দিয়ে নিধির দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্রকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিধির খুব অস্বস্তি হয়। চোখ এদিক ওদিক চেয়ে দৃষ্টি লুকাতে থাকে।
"তুমি খুব সুন্দর নিধি! "
বিনিময়ে নিধি লাজুক হাসি দেয়। অভ্র নিধির বাতাসে উড়ে যাওয়া চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলে,
"তোমাকে একটা কথা বলবো নিধি। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা!অবশ্য কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য না। কথাগুলো শুনে তুমি হয়তো আমাকে পাগলও ভাবতে পারো। "
নিধি লজ্জা ভেঙে দিয়ে অভ্রের দিকে চোখ তুলে তাকায়। সেও জানতে চাই অভ্র কি বলবে ?
অভ্র নিজের দুই হাত ভাজ দিয়ে বলে,
"আমি তোমাকে গত পাঁচ বছর যাবত চিনে নিধি। আমি তোমাকে এর আগেও দেখেছি। "
নিধি চমকে ওঠে। তার চোখে মুখে বিস্ময়। বলে,
"কোথায় দেখেছেন? "
প্রতিউত্তরে অভ্র একটা মুচকি হাসি দেয়।
"স্বপ্নে!"
"কি!"
আতঁকে ওঠে নিধি।
অভ্র নিধির একটু কাছে যায়। এতটাই কাছে যে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারবে। নিধির থুতনি উঁচু করে বলে,
"সেই একই চোখ, একই মুখ, একে আদল একদম এক। তুমি প্রতিদিন আমার স্বপ্নে আসো নিধি। স্বপ্নের এসে আমাকে খুব জ্বালাতন করো। এতটা পাগল কেন কর তুমি আমাকে! জানো নিধি সেদিন ক্যাফেটেরিয়াতে তুমি যখন উঠে চলে এলে তোমার মুখটা আমি তখন দেখিনি কিন্তু তোমার ফোন রেখে যাওয়া দেখেছিলাম। টেবিলের উপর তোমার ফোন পড়েছিল। তাড়াতাড়ি উঠে তোমার ফোনে হাত দিতেই তোমার হাস্য উজ্জ্বল চেহারা সামনে ভেসে উঠে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। তুমি কি সেই, যাকে গত পাঁচ বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি? আমার বন্ধুরা কি বলতো জানো? আমি নাকি ভ্রমের পিছনে ছুটছি। তুমি নাকি বাস্তবে নেই কিন্তু আবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন আমি তোমাকে ঠিক খুঁজে পাবো দেখো আজ তুমি আমার সামনে অর্ধাঙ্গীর উপর দাঁড়িয়ে। আমার থেকে ভাগ্যবান আর কে আছে বলো? আচ্ছা তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছো?"
নীতি মাথা নাড়ে। মানে সে করেছে। অভ্র আরেকটু দূরত্ব ঘুচিয়ে নিধির আরো কাছে আসে। একে অপরের নিশ্বাস দুজনার মুখে আছড়ে পড়ছে। অভ্র নিধির ঠোঁটের কোন স্লাইড করে বলে,
"হাজবেন্ড পছন্দ হয়েছে তোমার? "
এমন মুহূর্তে অভ্রের কথা শুনে তাজ্জব বনে যায় নিধি। অভ্রের দিকে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি দেয়। শ্যামবর্ণের পুরুষটা দেখতে আসলেই সুদর্শন। নিজের দিকে এমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে চট করে নিধির ঠোঁটে একটা ছোট্ট চুমু একে দেয়। সর্বাঙ্গ শরীর কেঁপে ওঠে তার। আবেশে নিধির চোখ বুজে যায়। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে অভ্রের বুকে লুটিয়ে পড়ে। অভ্র বলে,
"মানুষ আদর করে বউ অজ্ঞান করে ফেলে। আর আমার সামান্য একটা চুমুতে বউ অজ্ঞান হয়ে গেল।বাহ! আমার চুমুতে তো খুব পাওয়ার ? এত পাওয়ার জানলে তো আগে চুমু বিক্রি করতাম। বড়লোক হওয়ার সহজ পন্থা হাত ছাড়া করতাম না।"
_____________
অভ্র নিধিকে রুমে নিয়ে এসে বেডে শোয়ায়। নিধির পাশে সে ও শুয়ে পড়ে। নিধির একদম কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
"আমার কি মনে হয় জানো নিধি! রুহের জগতে যখন যার সাথে বন্ধু, ভালোবাসা গভির ছিলো দুনিয়াতে তার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক হয়। তুমি আর আমি হয়তো পাশাপাশি ছিলাম। হয়তো দুজনের দৃষ্টি মিলিত হয়েছিল আর আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তা না হলে আমি কেন তোমাকে স্বপ্নে দেখবো বলো! আমি তোমাকে একবার স্বপ্ন দেখিনি। বারংবার দেখেছি। প্রতি রাতে দেখেছি। সেটা কি ভুল? অবশ্যই না! নিশ্চয়ই সেটার কোনো কারণ ছিল। তুমি আমার সোলমেট নিধি। আত্মার সম্পর্ক তোমার সাথে আমার।"
বলে কপালে চুমু খেয়ে নিধিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এতক্ষণ নিধি অভ্রের ঘুমিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল। যখন অভ্রের নিশ্বাস গাঢ় হয়ে এলো তখন টুক করে মাথাটা উপরে দিকে তুলল। টুকুর টুকুর চোখে অভ্রকে দেখতে লাগলো। একটু পর বুকে মাথা রেখে ওর হৃদস্পন্দন অনুভব করতে থাকল। আর মনে মনে বলতে লাগলো,
"আপনার নাম কি? আমি এখনো জানিনা। কারণ বিয়েতে আমি আপনার চেহারা দেখিনি। ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারে আপনার সাইনের দিকে লক্ষ্য করিনি। কারণ কি জানেন? আমারও যে স্বপ্নে একজন আসতো। চুপি চুপি, নিঃসঙ্গপনে। আর আমাকে এত এত ভালোবাসা দিয়ে যেতো। আমিও তো তাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এতটা বছর তার ভালোবাসা এ বুকে লালন করেছি। জানেন সে ব্যক্তি টা কে? আপনি। আপনি সেই নাম না জানা পুরুষ যে প্রতিনিয়ত আমাকে ব্যাথিত করেছে। আপনার অস্তিত্ব পাওয়ার জন্য সব সময় আমি মুখিয়ে থাকতাম। চারপাশে খুঁজতাম যদি আপনার দেখা পায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পেয়েও গেলাম। সেদিন ক্যাফেতে দেখে আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। আপনার অস্তিত্ব সত্যিই আছে। আপনি আমার কাল্পনিক পুরুষ না। আপনার অস্তিত্ব বাস্তব জীবনেও আছে। কি যে খুশি হয়েছিলাম! কিন্তু আপনার পাশে বড় আপুকে দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম মনে করেছিলাম আপনারা হয়তো হাসবেন্ড ওয়াইফ। আপনার আম্মু যেদিন আমাকে দেখতে আসে ঐদিন বড় আপু ফোন করেছিল । আমরা পাশাপাশি থাকায় ফোনে আপুর ছবি দেখেছিলাম আমি। তখনো জানতাম না আপনার সাথে আমার বিয়ে। প্রতিমুহূর্তে গুমরে গুমরে কেঁদেছি আর ভেবেছি, একই বাড়িতে অন্যের বউ হয়ে আপনার সাথে দেখা যখন হবে তখন ব্যাপারটা কেমন হবে? আপনার জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা আছে অথচ আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আর আপনি জানতেও পারবেন না তো আপনাকে এতটা ভালবেসে ছিল। আমি খুব ভাগ্যবতী জানেন! তা না হলে আপনাকে আমার করে পাই কি করে!
আপনি সত্যিই আমার আত্মার সঙ্গী। আমার সোলমেট আপনি।