পোস্টস

গল্প

বিহঙ্গের সুর

২৩ মে ২০২৪

মাহবুব হোসেন

ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২।

অপেক্ষা খুব খারাপ জিনিস। ক্রিস আধঘন্টা ধরে ক্লারার জন্য অপেক্ষা করছে। ও সাধারণত দেরি করে না, ক্লাস সেরে সোজা চলে আসে হিলভিউ পার্কে। ক্রিসও পত্রিকা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে পার্কের গেটে দাঁড়ায়। বিকেল থেকে সন্ধ্যে অব্দি একসঙ্গে থেকে যে যার গন্তব্যে- ইংল্যান্ডের উলভারহ্যাম্পটন শহরের দুই প্রান্তে। ক্রিস লন্ডন টাইমসে জুনিয়র রিপোর্টার, ক্লারা এখনও পড়াশোনা করছে। দুজনেরই ফুটবল পছন্দ। গত মৌসুমের টুর্নামেন্ট দেখতে গিয়ে পরিচয়, তারপর একটু একটু করে কাছে আসা। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল, অথচ ক্রিসের মনে হয় এইতো সেদিনের কথা! অপেক্ষায় কাটেনি বলেই কী এক বছর কম সময় মনে হচ্ছে? অথচ আধঘণ্টাকে যেন মনে হচ্ছে এক যুগ!

একটা ট্যাক্সি পার্কের গেটে দাঁড়ালো, সেটার দরজা খুলে ক্লারা নেমে এলো। দেখতে অবসন্ন, অথচ চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।

‘টিকেট পেয়ে গেছি!’ ক্লারা চিৎকার করে উঠল।

ক্রিস প্রথমটাতে বুঝতে পারল না। কীসের টিকেট? ক্রিসের মাথায় কিছুই ঢুকল না। কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। এদিকে রাজার অবস্থা সংকটাপন্ন, পত্রিকায় প্রতিদিন তাঁর খবরাখবর যোগাতে হচ্ছে। ওদিকে দ্বিতীয় এলিজাবেথ রাণী হিসেবে শপথ নেবেন, সেই অনুষ্ঠানে কি হবে না হবে তা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। ক্রিসকে সম্পাদকের অফিসে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ঘোষণা দিয়েছেন, ইংল্যান্ড পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আপাত শান্ত বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের দুর্বল রাখতে রাজি নয় ইংল্যান্ড। শীতল স্নায়ুযুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে। ওদিকে নরওয়েতে অলিম্পিকের আসর বসছে, সেখানকার খবরও ছাপতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ক্রিসের মাঝেমধ্যে মনে হয় সব ছেড়েছুঁড়ে স্কটল্যান্ডে কোন একটা পানশালায় গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকতে, কিন্তু এই মুহূর্তে চাকরি ছাড়া একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার।

পার্কের গেট থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওরা এগিয়ে গেল ভেতরের দিকে। শীত শেষ হবার পথে, শুষ্ক বৃক্ষরাজিতে সজীব পত্রপল্লব ডানা মেলতে শুরু করেছে। ক্লারার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় ক্রিস বলল, ‘কীসের টিকেট? আমি বুঝতে পারছি না’।

ক্লারা হাসিমুখে বলল, ‘সন্ধ্যের দিকে আলবার্ট হলে অপেরার টিকেট!’

ক্রিস বিষণ্ণ গলায় বল, ‘আরেকদিন গেলে হয় না?’

ক্লারার মুখ থেকে হাসি সরে গেল। মেঘগম্ভীর গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা তো লন্ডন না যে প্রতিদিন তো অপেরা হবে। আজ তোমার একদমই সময় হবে না?’

ক্রিস কিছু বলল না। ক্লারা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জীবনটা এমন জটিল কেন? দুজন দুজনার হাত ধরে নদীর ধারে হাঁটবে, হাসিমুখে থিয়েটারে যাবে, অপেরার সুরের ভুবনে হারিয়ে যাবে ক্ষণিকের তরে- এগুলো কি খুব বেশি?

জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলাতে ব্যস্ত দুটো মানুষ হাঁটতে থাকে। ঠিক একই সময়ে হাজার হাজার মাইল দূরের এক রাজপথে হাঁটতে থাকে একদল তরুণ। এদের চাওয়া বেশি কিছু না, এরা কেবল নিজের ভাষায় কথা বলতে চায়, হাসতে চায়, বাঁচতে চায়। কিন্তু শাসকেরা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে আসা মিছিল থেকে গ্রেফতার করা হয় অনেক তরুণকে। তাদের মধ্যে বড় বড় চুলওয়ালা হালকা গড়নের এক যুবক পুলিশের গাড়িতে বসে গুণগুণ করে কী যেন গাইতে থাকে। পুলিশ ধমক দেয় চুপ করতে, কিন্তু সে একমনে গুণগুণ করতেই থাকে, থামে না। 

পুলিশের খাতায় আটকের তালিকায় তাঁর নাম লেখা হয়- শাহ আবদুল করিম।