শেষ চিঠি ১৮ ই মে ২০২৫
(একটি শিক্কনীয় গল্প)
লেখিকা: Raisa Chowdhurani
রাত তখন প্রায় দু’টা। পুরো পাড়া নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যায়। এমন সময় শহরের এক কোণে পুরনো এক ভাঙা ঘরে বসে এক যুবক লিখে চলেছে তার জীবনের শেষ চিঠি।
"আমার প্রিয় মা,"
"আজ আমি যে চিঠিটা লিখছি, সেটা হয়তো তুমি কখনো পড়তে পারবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো, এটা আমার মন থেকে লেখা, চোখের পানি দিয়ে ভেজানো একেকটা শব্দ…"
১
রিয়াদ, বয়স তেইশ। ছোট্ট এক গ্রামে জন্ম। বাবা নেই, মা গার্মেন্টসে কাজ করে কোনোভাবে দিন চালাতেন। রিয়াদ খুব মেধাবী ছিল। স্কুলে তার নাম থাকত সবার আগে। সবাই বলত, "এই ছেলেটা একদিন বড় কিছু হবে।"
কিন্তু বড় হওয়া তো শুধু মেধা দিয়ে হয় না, দরকার হয় সহায়তার, সমাজের, পরিবারের, অর্থনীতির।
এসএসসি-তে গোল্ডেন এ+ পাওয়ার পরও কলেজে ভর্তি হতে পারেনি সময়মতো। কারণ, মায়ের হাতে ছিল না ভর্তি ফি'র টাকা। বন্ধুরা যখন নতুন ড্রেস কিনে কলেজে যাচ্ছিল, রিয়াদ তখন দিনমজুরির কাজ খুঁজছিলো।
একসময় হাল না ছেড়ে রাতের ক্লাসে ভর্তি হলো। দিনে কাজ, রাতে পড়া। হ্যাঁ, জীবন ছিল ক্লান্তিকর, কিন্তু স্বপ্নে ছিল আলো।
২
তবে জীবনে সবচেয়ে বড় বাঁধা এলো যখন তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তারের রিপোর্টে ধরা পড়ল, মা'র কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন অপারেশন, ঔষধ, নিয়মিত ডায়ালাইসিস।
রিয়াদ তখন নিজের পড়ালেখা একদম বন্ধ করে দিয়ে পুরোপুরি মা'র চিকিৎসায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অর্থ জোগাড়ের জন্য সে ঢাকায় চলে আসে। এক বন্ধুর সাহায্যে গার্মেন্টসের কাজ পায়। কিন্তু স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায় দিন দিন। মা'র চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে নিজেই খেয়ে না খেয়ে থেকেছে কতদিন!
তবুও মা'কে বলত,
– "মা, চিন্তা কইরো না। তুই ঠিক হইয়া যাবি, আমি আছি তো!"
৩
একদিন কাজ থেকে ফেরার পথে রিয়াদ পড়ে যায় এক প্রতারণার ফাঁদে। এক লোক তাকে বলে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। শুধু এক লাখ টাকা দিলেই নাকি মালয়েশিয়ায় পাঠাবে কাজের জন্য।
রিয়াদ নিজের শেষ জমানো টাকাগুলো দেয় আর ধার করে বাকিটা জোগাড় করে।
কিন্তু কাগজপত্র দেওয়ার আগেই লোকটা উধাও। ফোন বন্ধ, অফিস গায়েব।
তখন রিয়াদ বুঝল, সব শেষ। এই ধাক্কা সে নিতে পারেনি। মনে মনে ভেঙে পড়ল। শুধু একটাই চিন্তা – “মা’র ডায়ালাইসিস তো এখন থেমে যাবে।”
৪
সেই রাতে রিয়াদ নিজেকে প্রশ্ন করল:
– “আমি কি হার মানলাম?”
– “আমি কি ব্যর্থ?”
– “আমি কি আর পারব না?”
তার মন বলছিল – "তোর কিছুই হয়নি, রিয়াদ। তুই আবার উঠবি।"
কিন্তু বাস্তবতা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল, সে আর পারছে না।
একদিন তার মা অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গেলেন। ডাক্তার বলল – "শুধু অলৌকিক কিছু ঘটলে বাঁচবে।"
রিয়াদ জানত, অলৌকিক কিছু আসবে না।
৫
চিঠি লিখতে লিখতে রিয়াদের চোখ ভিজে যাচ্ছে। সে লিখল:
"মা, তুই যদি কখনো এই চিঠি পড়িস, জানিস – তোর ছেলে হাল ছাড়েনি। তোর জন্য শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছে।
আমি যদি এই পৃথিবী থেকে চলে যাই, সেটা ব্যর্থতা নয়, সেটা ছিল আমার শেষ চেষ্টা।"
সে জানত, কাল সকালে তাকে আর কেউ দেখতে পাবে না। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
কিন্তু ঠিক তখন, দরজায় টোকা।
সে ভয় পেয়ে যায়। কে এলো রাত দু’টায়?
দরজা খুলে দেখে – মিজান ভাই, আগের গার্মেন্টসের ম্যানেজার।
– "রিয়াদ, তুই তোকে খুঁজছি রে! তোর জন্য একটা চাকরির সুযোগ আছে। মালিক তোর কাজের প্রশংসা করছিল। এবার তোকে ফোরম্যান বানাতে চায়। পাঁচ গুণ বেতন বাড়াবে!"
রিয়াদ থমকে যায়। কিছু বলতেও পারে না। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।
– "তুই ঠিক আছিস তো, রে?" – মিজান ভাই জিজ্ঞেস করে।
রিয়াদ শুধু চিঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে বলে – "আছি ভাই, এখন বাঁচতে চাই।"
শেষ কথা:
এই গল্প আমাদের শেখায় – জীবনে যতই অন্ধকার হোক, হাল ছাড়লে নয়, লড়লেই আলো ফিরে আসে।
একটা রাত, একটা সুযোগ, একটা মানুষ অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। কখনো হাল ছেড়ো না। কারণ, জীবনের শেষ চিঠির পরে হয়তো নতুন শুরু অপেক্ষা করছে।