Posts

গল্প

ছায়ার শহর

May 18, 2025

Raisa Chowdhurani

89
View

      ছায়ার শহর             18 May 2025

চট্টগ্রামের এক পুরনো পাহাড়ঘেরা শহর — নাম ‘আলোরডাঙা’। শহরের নাম শুনে বোঝা যায় যেন আলোয় ভরপুর, অথচ এই শহরের অনেক পুরনো বাড়ি, অলিগলি আর পাহাড়ি ধাপ যেন চিরকাল ছায়ার চাদরে ঢাকা।

এই শহরের এক প্রান্তে ছিল এক প্রাচীন, ধূসর রঙের বাড়ি — ‘ছায়াবাড়ি’। নামটা স্থানীয়রা দিয়েছে, কারণ কেউ কখনও দেখে নি যে দুপুরের রোদেও ওই বাড়ির উপর সূর্য ঠিকভাবে পড়ে। চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড় আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসে সবসময়ই একরকম গা ছমছমে ভাব।

বাড়িটিতে একা থাকত এক যুবক — নাম নীলয়। বয়স তেইশ। নীলয় ছিল শান্ত স্বভাবের, অল্প কথা বলা ছেলে। শহরের কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পড়ত, কিন্তু সে ছিল অন্য রকমের — তার চোখে ছিল সবসময় এক বিষন্নতা। কেউ জানত না, নীলয় আসলে কে? কোথা থেকে এসেছে?

শুধু এতটুকু জানত সকলে, ছয় বছর আগে এক রাতে হঠাৎ এক গাড়ি এসে ‘ছায়াবাড়ি’র সামনে থামে। গাড়ি থেকে নামে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আর এক কিশোর — সে ছিল নীলয়। লোকটি কয়েকদিন পরেই আবার চলে যায়, কিন্তু নীলয় থেকে যায় একা।

প্রথম প্রথম শহরের মানুষজন কৌতূহলী ছিল। কেউ বলত, ও কোনো ধনীর অবৈধ সন্তান, কেউ বলত, হয়ত সে কোনো বড় দুর্ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু এসব গুজবই থেকে যায় গুজব।

নীলয় দিনের বেলা কলেজে যেত, লাইব্রেরিতে সময় কাটাত, আর রাতে ছায়াবাড়িতে ফিরে আসত। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, রাত বাড়লেই ওই বাড়ি থেকে কিছু অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসত — মৃদু চিৎকার, পিয়ানোর সুর, আর কখনও কখনও কান্না।

একদিন কলেজে নতুন ভর্তি হওয়া এক মেয়ে — রিদা, এই ছেলেটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সে সাহস করে একদিন ছায়াবাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কলিং বেল বাজায়, কিন্তু কেউ দরজা খোলে না।

রিদা নাছোড়বান্দা। সে পরেরদিন আবার যায় — এবার দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে নীলয়। চোখে ক্লান্তি, গলায় নিরুত্তাপ স্বর,
— "তুমি কে?"

— "আমি রিদা। তোমার সাথে কথা বলতে চাই।"

— "কেন?"

রিদা থমকে যায়, কিন্তু চোখের মধ্যে ভয়ের চেয়ে কৌতূহল ছিল বেশি।

— "তুমি কি একা থাকো?"

নীলয় একটু হাসে। সেই হাসিতে ছিল রহস্য, হতাশা আর অভিমান।

— "না। আমি একা নই।"

— "মানে?"

— "এই বাড়িটা আমাকে ছেড়ে দেয়নি। আমিও পারিনি চলে যেতে।"

সে দিন রিদাকে ভিতরে আসতে দেয়নি, কিন্তু তার কথার ধরণে এমন কিছু ছিল, যা রিদার মনে গভীর ছায়া ফেলেছিল।

পরের কয়েকদিনে রিদা অনেকবার গেল, মাঝে মাঝে গল্প করতে পারল নীলয়ের সাথে। ধীরে ধীরে সে জানতে পারল, নীলয়ের বাবা একজন ধনী শিল্পপতি ছিলেন। কিন্তু মা ছিলেন একজন স্নিগ্ধ, কল্পনাবিলাসী কবি। তাদের সম্পর্কে ছিল টানাপড়েন। এক রাতে ঝগড়া হয় এবং মা আত্মহত্যা করেন — ছায়াবাড়ির এক নির্জন কক্ষে। সেই রাতেই নীলয় নিজের চোখে দেখে মায়ের দেহ পাখায় ঝুলছে।

তখন থেকে এই বাড়িতে সে আর কখনও স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারেনি। মাঝে মাঝে ঘরের দেয়ালে কবিতা ভেসে ওঠে, মাঝরাতে খোলা জানালা দিয়ে কবিতার পাতা উড়ে আসে। কেউ দেখে না, কে লিখছে, কে পাঠাচ্ছে!

রিদা আরও জানে, নীলয় মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, আর জেগে উঠে দেখে দেয়ালে নতুন কিছু লেখা — "আমি এখানেই আছি" অথবা "তুমি ভুলে যেতে পারবে না আমাকে"।

রিদা ভয় পায়, কিন্তু নীলয়ের প্রতি তার টান আরও বাড়ে। সে একদিন বলে বসে —
— "তুমি চলো এখান থেকে। এই শহর, এই বাড়ি তোমার মাকে আটকে রেখেছে। তুমি পালাও।"

নীলয় মাথা নাড়ে,
— "তুমি জানো না, মাকে ছেড়ে যাওয়া মানে নিজেকেই ফেলে যাওয়া।"

একদিন, শহরে প্রবল ঝড় ওঠে। চারদিকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই রাতে রিদা আবার ছায়াবাড়িতে যায়। ভিতরে গিয়ে দেখে, নীলয় জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছে। তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে শত শত ছেঁড়া কবিতার পাতা। দেয়ালে লেখা —
“তুমি যেও না... তুমি গেলে আমি হারিয়ে যাবো”

রিদা কাঁদতে কাঁদতে নীলয়কে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। জানালা দিয়ে একটা আলোর রেখা এসে পড়ে ঘরে। সেই আলোতে হঠাৎ দেখা যায়, নীলয়ের মুখে এক প্রশান্তি।

সে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। বলে,
— "মা আমাকে মুক্তি দিলেন। তিনি তোমার ভালোবাসা টের পেয়েছেন।"

পরদিন সকাল। শহরজুড়ে আলো। ছায়াবাড়ির সামনে লাল রঙের ফুল ফুটে উঠেছে — যা কেউ কখনও দেখেনি। বাড়ির রং ফিকে ধূসর থেকে হয়ে গেছে নরম সাদা।

আর ছাদের ওপরের ঘরটাতে এখন আর কোনো শব্দ আসে না।

নীলয় আর রিদা এখন শহরেই থাকে, কিন্তু অন্য বাড়িতে। ছায়াবাড়ি হয়ে গেছে শহরের এক ছোট্ট পাঠাগার — নাম “ছায়ার শহর”, যেখানে কেউ মন খারাপ নিয়ে ঢোকে আর একটুখানি আলো নিয়ে বের হয়।

(শেষ)

Comments

    Please login to post comment. Login