অধ্যায় ১: চিঠির আগমন
শীতের সকালের আলোটা যেন আজ একটু বেশিই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। জানালার কাঁচে জমে থাকা শিশির ফোঁটার পেছন দিয়ে দেখা যায় হালকা কুয়াশা ঢাকা রাস্তাটা। আজ থেকে ঠিক আট বছর আগে এই দিনেই রুদ্র হারিয়ে গিয়েছিলো তিলোত্তমার জীবন থেকে। ঠিক এমনই একটি জানালার ধারে বসে সে প্রতীক্ষা করেছিলো কোনো ব্যাখ্যার—কিন্তু রুদ্র কোনো চিঠি রাখেনি, কোনো শব্দও না। শুধু এক নিঃশব্দ বিদায়।
তিলোত্তমা আজও প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপ হাতে পত্রবাহী ডাকে চোখ রাখে। যদিও এখন ই-মেইল আর ইনবক্সের যুগ, তবু সে আজও ডাকবাক্স খুলে দেখে। যেন এক অলিখিত আশা—একদিন কোনো উত্তর ফিরে আসবে।
এই ভোরবেলাতেই ডাকপিয়ন এল। কালো ট্রাঙ্ক হাতে। একটা খাম রেখে গেল দরজার সামনে।
তিলোত্তমা তখন রান্নাঘরে। কেটলিতে গরম পানি ফোটার শব্দে তার মনোযোগ যাচ্ছিলো অন্যদিকে, কিন্তু দরজার পাশ দিয়ে হালকা শব্দ হতেই সে ফিরে তাকালো।
একটি সাদা খাম।
কোনো প্রেরকের নাম নেই।
শুধু তার নামটাই লেখা—“তিলোত্তমা দাস”।
কাপ হাতে সে ধীরে ধীরে খামটা তুলে নিল। ভেতরে ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বয়ে গেল।
চিঠিটা ভারী। মনে হলো যেন এর ভেতরে শুধু কাগজ নয়, কোনো গোপন বোঝা।
ড্রয়িংরুমে এসে সে ধীরে ধীরে খাম খুলল।
চিঠির প্রথম লাইনেই লেখা ছিল—
“যখন তুমি এই চিঠিটা পড়বে, আমি হয়তো আর বেঁচে থাকব না…”
তিলোত্তমার হাত কেঁপে উঠল।
অক্ষরগুলো পুরনো স্টাইলের, কালো কালিতে লেখা। চিঠির নিচে লেখা নামটা যেন হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দেওয়ার মতো—
রুদ্র।
কিন্তু… এটা কীভাবে সম্ভব?
রুদ্র তো আট বছর আগে মারা গেছে!
তার মৃত্যুসনদ, পুলিশ রিপোর্ট, সবার চোখের সামনে কবর দেওয়া হয়েছিল তাকে।
তাহলে?
এই চিঠি এখন এলো কেন?
কে পাঠালো?
আর রুদ্র যদি মরে গিয়ে থাকে, তাহলে এই লেখা…?
চোখের সামনে সব ঘোলা হয়ে আসে। শব্দগুলো ঝাপসা।
তিলোত্তমা সেই চিঠি হাতে নিয়ে বসে পড়ে। চোখের কোনায় জমে থাকা জল আর মনের কোণে ছড়িয়ে থাকা প্রশ্ন—দুটোই কাঁপে সমান তালে।
চিঠিতে লেখা পরবর্তী কথাগুলো ছিল আরও অদ্ভুত—
“আমার হারিয়ে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, তিলো। আমি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই রাতের সত্যটা কখনও জানোনি তুমি…”
তিলোত্তমার মন যেন উল্টে গেল। কোন রাত? কিসের সত্য? কেন বলতে পারেনি রুদ্র তখন?
চিঠির ভাষা ছিল এমন, যেন তা ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া।
যেন কোনো গভীর রহস্য ঢেকে রেখেছে এই কয়েক পৃষ্ঠার পাতায়।
আর সেই রহস্য খুলবে—ধীরে ধীরে, পৃষ্ঠা উল্টানোর সাথে সাথে।
চিঠির শেষ লাইনটুকু ছিল:
“শেষ চিঠি বলেই লিখছি না… বরং এই চিঠি থেকেই সবকিছুর শুরু হবে। যদি তুমি সত্যিটা জানতেই চাও—তাহলে পুরনো স্মৃতির বাক্সটা খোল… সেই নীল খামে রাখা ডায়েরিটা পড়ো। আমি সব রেখে গেছি তোমার জন্য।”
তিলোত্তমার গা শিউরে ওঠে। সেই ডায়েরি!
যেটা সে লুকিয়ে রেখেছিল রুদ্রের হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই…
যেটা সে কখনও সাহস করে খুলে দেখেনি।
হঠাৎ করে তার চোখের সামনে রুদ্রের মুখটা ভেসে ওঠে—চোখে রহস্য, মুখে বিষাদের ছাপ।
তখন সে জানত না, সেই মুখটাই একদিন এমন এক চিঠির প্রেত হয়ে ফিরে আসবে…
[পরবর্তী অধ্যায়: “অপরিচিত প্রেরক” – যেখানে চিঠির রহস্য আরও ঘন হয়ে উঠবে এবং তিলোত্তমা বের করতে চেষ্টা করবে, কে এই চিঠিটা পাঠিয়েছে এবং রুদ্র আসলেই কি মারা গেছে?]