নুসরাত ফারিয়াকে আমি চিনি না। চেনার প্রয়োজনও অনুভব করি না। ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটি দেখেছি। শ্যাম বেনেগালের নির্মিত সেই ছবিতে শেখ হাসিনার চরিত্র খুব একটা কেন্দ্রস্থানীয় ছিল না, ফলে কে সে চরিত্রে অভিনয় করলেন, তা নিয়ে আগ্রহও জাগেনি। পরে জানলাম, সেই ভূমিকায় ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া।
এখন শুনছি, তাকে সেই অভিনয়ের কারণে জুলাই আন্দোলনের পর হত্যাচেষ্টা মামলায় জড়িয়ে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাথায় হেলমেট পরিয়ে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ! আদালত প্রাঙ্গণেও তাকে দেখা গেছে ভীষণ বিমর্ষ, বিধ্বস্ত ও ভীত।
এই দুঃখজনক দৃশ্য কি স্বাভাবিক? একজন শিল্পী, যাঁর কাজ কেবলমাত্র অভিনয় -অভিনয়ের অপরাধে তাকে জেলে যেতে হবে? এটি অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য ও অনভিপ্রেত।
নুসরাত একজন অভিনয়শিল্পী। শিল্পের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য তো মানবতা ছড়ানো, বাস্তবতার প্রতিবিম্ব তুলে ধরা। আজ যদি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একনায়ক হাসিনার চরিত্র নিয়ে কোনও রাজনৈতিক সিনেমা নির্মাণ করেন, সেখানেও নুসরাত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন, কারণ অভিনয়ের কাজই হলো অনুকরণ, প্রতিক্রিয়া নয়। শিল্পী বাস্তবতা পুনর্গঠনের মাধ্যম। তাঁকে অপরাধী বানানো, আসলে আমাদের চেতনার দেউলিয়াপনার ভয়াবহ প্রমাণ।
তবে শুধু আমরা নই, সরকারপক্ষের অভ্যন্তর থেকেও এ ঘটনার প্রতি হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন—
“নুসরাত ফারিয়ার গ্রেফতার বিব্রতকর একটা ঘটনা হয়ে থাকলো আমাদের জন্য। আমাদের সরকারের কাজ জুলাইয়ের প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করা। ঢালাও মামলার ক্ষেত্রে আমাদের পরিষ্কার অবস্থান ছিল—প্রাথমিক তদন্তে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। সেই নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছিল। ফারিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলাতো অনেকদিন ধরেই ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ নেয়ার বিষয় আমার নজরে আসেনি। কিন্তু এয়ারপোর্টে যাওয়ার পরেই এই ঘটনাটা ঘটে। আওয়ামী লীগের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ গমনকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের পর ওভার নার্ভাসনেস থেকেই হয়তো এইসব ঘটনা ঘটেছে... আমি বিশ্বাস করি, ফারিয়া আইনি প্রতিকার পাবেন।”
যদিও আমরা মনে করি, ফারুকীর এই বক্তব্য নিছক সান্ত্বনার মালিশ। অনাকাঙ্ক্ষিত গ্রেপ্তারের প্রকৃত প্রতিকারের পরিবর্তে একটি ব্যথানাশক বুলি মাত্র।
কোনো যুক্তি দিয়ে কি প্রমাণ করা সম্ভব, নুসরাত ফারিয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারো প্রাণনাশ করেছেন? কেবল ‘মুজিব’ সিনেমায় শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলেই তার মাথায় হেলমেট? অথচ তিশা আম্মা যখন একই সিনেমায় শেখ ফজিলাতুন্নেছার চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন কেন তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়নি? এই বৈষম্য ও দ্বিচারিতা কেমন করে মানবেন সাধারণ নাগরিক?
এই সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ বলছে -শিল্পী ফারিয়ার অপরাধ একটাই, তিনি শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অথচ বাস্তবে যাঁরা শেখ হাসিনার ভূমিকাকে ছাপিয়ে গিয়ে আজ নিজেকে হাসিনা মনে করছেন, তাদের বিচার কবে হবে? বীর জনতা আর কবে জাগবে? সেই প্রশ্নই আজ মানুষের মুখে মুখে।
সদাশয় ইন্টেরিম আপনাদের বদান্যতায় পরাজিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির পাতি নেতারাও আজ নিরাপদ দূরত্বে, বহিঃবিশ্বে আশ্রয় নিয়ে হাসিমুখে আছেন। আর দেশজুড়ে প্রান্তিক কর্মী ও শিল্পীদের ওপর চালানো হচ্ছে অযাচিত দমনপীড়ন।
অথচ আরেক নুসরাত, যিনি শেখ মুজিবের স্ত্রীর চরিত্রে আবেগঘন পাঠ পরিবেশন করেছিলেন, যিনি সরাসরি শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রচারে জড়িত ছিলেন। তিনি ও তার স্বামীও ছিলেন সেই ভূমিকায় অত্যন্ত তৃপ্ত। তাকে কি একবারও জিজ্ঞেস করা হয়েছে -কেন করেছিলেন, কীভাবে করেছিলেন? না, করা হয়নি। কারণ ওই প্রশ্ন করবার সাহস ইন্টেরিমের নেই। কারণ সময় বুঝে স্রোতে গা ভাসানো মোসাহেবদের খুব পছন্দ করে আমাদের ইন্টেরিম।
এই রাষ্ট্রযন্ত্র এখন ‘নার্ভাসনেস সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত। যেকোনো ছায়াকেও আজ শত্রু মনে করছে। বিচার না, প্রতিহিংসা এদের কর্মনীতি। অথচ যারা সত্যিকারের অপরাধী, তাদেরকে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রভাবের ছায়ায়। ব্যবসায়ী ও আমলারা আগের মতোই স্বাধীনতা ভোগ করছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য চাই অদম্য সাহস, অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা। আজ সেই সাহস অনুপস্থিত। তার জায়গায় এসেছে ভয়, বিভ্রান্তি ও নির্বোধ প্রতিক্রিয়া। ভীত মানুষ কখনো যুক্তির ধার ধারে না, সাহসের পথে হাঁটে না। ভীরুরা রাষ্ট্রকে বন্দী বানায়। সেই বন্দিত্বের বলি হয় ফারিয়ার মতো একজন নির্বিরোধ ও নিরীহ অভিনয় শিল্পী।
লেখক: সাংবাদিক
১৯ মে ২০২৫