বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' শুধু একটি গান নয়—এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম এক ঘোষণাপত্র। এই গান আমাদের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। কিন্তু খুব কম মানুষ জানেন, এই গানটির মূল সুর নেওয়া হয়েছিল একটি বাউল গানের ছায়া থেকে। সেই গানটির নাম ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’। এ গানের স্রষ্টা ছিলেন একজন সাধারণ ডাক হরকরা—গগন হরকরা। আজকের প্রবন্ধে আমরা খুঁজে দেখবো কীভাবে কুষ্টিয়ার মাঠঘাটে ভেসে বেড়ানো এক সহজ সুর পৌঁছে যায় আমাদের জাতীয় সংগীতের মর্যাদায়।
---
১. গগন হরকরা—এক অসাধারণ সাধারণ মানুষ
গগন হরকরা ছিলেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহ পোস্ট অফিসের ডাকহরকরা। তাঁর পেশা ছিল চিঠিপত্র পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু অন্তরে তিনি ছিলেন এক নিখাদ বাউল সাধক। বাউলরা যেমন অন্তর্জগৎকে উপলব্ধি করার জন্য গানকে পথ করে নেন, গগনও সেই পথেই হেঁটেছিলেন। হাতে লণ্ঠন, পিঠে ঝোলা, আর মুখে নিজের লেখা গান—এই ছিল তাঁর চলার সঙ্গী। তিনি লিখেছিলেন, "আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে"—যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে।
---
২. রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহবাস ও বাউলপ্রেম
১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে যান জমিদারি কাজের দায়িত্ব নিতে। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন বাংলার বাউল-লোকজ সংগীতের সঙ্গে। শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে থাকাকালীন তাঁর দেখা হতো স্থানীয় বাউলদের সঙ্গে, যাঁরা গান গেয়ে বেড়াতেন। গগন হরকরাও তাঁদের একজন ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে, বাউল গান তাঁর মননে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি লেখেন, “আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি... বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।”
---
৩. ‘বাউল গান’ বনাম ‘বাউলাঙ্গের গান’
বাউল গান মানে শুধু গান নয়—এটি দর্শনের প্রকাশ। বাউলরা গানকে ব্যবহার করেন নিজস্ব আধ্যাত্মিক ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে গানগুলো রচনা করেন, সেগুলো মূল বাউল দর্শন থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হলেও সুরের ধাঁচে বাউলসুলভ—এই গানগুলোই ‘বাউলাঙ্গের গান’। যেমন—‘আমার সোনার বাংলা’। এর কথা ও গঠন বাউলের ছায়া বহন করলেও, ভাবনায় রবীন্দ্র-চেতনার প্রতিফলন।
---
৪. গানটি কার কাছ থেকে?
এই গান রবীন্দ্রনাথ কোথা থেকে পেলেন—তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে দাবি করেন, তিনি নিজেই গানের সুর মামাকে শোনান। অন্যদিকে, প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’ অনুসারে, রবীন্দ্রনাথ এই গানটি শুনেছিলেন গায়ক সুনা-উল্লার কণ্ঠে। যে-ভাবেই হোক না কেন, বেশিরভাগ দলিল গগন হরকরাকেই ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের রচয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
---
৫. ছাপা অক্ষরে গগনের গান
এই গানটি প্রথম ছাপা হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩২২ সংখ্যায়, ‘হারামণি’ শিরোনামে একটি লেখায়। সেখানে বলা হয়, গানটি রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেছিলেন গগনের কাছ থেকে। এর আগে ‘ভারতী’ পত্রিকার ১৩০২ সালের ভাদ্র সংখ্যায় সরলা দেবীর ‘লালন ফকির গগন’ নামে একটি রচনায় গগনের নাম উঠে আসে।
---
৬. উপনিষদের সঙ্গে গগনের গানের সংযোগ
রবীন্দ্রনাথ গগনের গান শুনে তাৎক্ষণিকভাবেই অনুভব করেছিলেন—এই সাধারণ কথার মধ্যে রয়েছে এক আধ্যাত্মিক গভীরতা। তিনি উপনিষদের বাণী উদ্ধৃত করে লেখেন, “তং বেদ্যং পরুষং বেদ, মা বো মৃত্যু পরিব্যথাঃ”—এই চিন্তা তিনি গগনের গানেই খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর ‘An Indian Folk Religion’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, “এই গান এতই সরল যে, তা অনুবাদে রূপান্তর করতে দ্বিধা হয়।”
---
৭. বঙ্গভঙ্গ ও গানটির সৃষ্টি
১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলা ভাগের প্রতিবাদে শুরু হয় স্বদেশী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ তখনই লেখেন 'আমার সোনার বাংলা'—বাংলার প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে। গগনের সুরে গাঁথা এই গান যেন বাংলার মাটি, মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির প্রতি এক গভীর প্রেমের অভিব্যক্তি।
---
৮. গান থেকে জাতীয় সংগীত
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটি হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রেরণা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায় গানটির যন্ত্রসঙ্গীত রচনা করেন। পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর সহায়তায় গানটির সঠিক স্বরলিপি বাংলাদেশে প্রেরণ করা হয়।
---
৯. আমাদের হৃদয়ের গান
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কেবল আন্দোলনের সঙ্গীত নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের সারবত্তা। কুষ্টিয়ার মাঠে গাওয়া এক বাউল গানের সুর আজ জাতীয় আত্মঘোষণার প্রতীক। এটি আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, প্রকৃতি আর জাতিসত্তার প্রতিফলন। যে প্রেম, যে আকুলতা গগনের কণ্ঠে ছিল ‘মনের মানুষ’ খুঁজে পাওয়ার, তা-ই রবীন্দ্রনাথের কলমে রূপ নেয় দেশের প্রতি চিরন্তন ভালোবাসায়।
---
উপসংহার
গগন হরকরা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—দুই ভিন্ন জগতের মানুষ। একদিকে বাউল দর্শনের সহজ-সরল গান; অন্যদিকে, বিশ্বকবির মননের শৈলী। এই দুইয়ের মেলবন্ধনে জন্ম নেয় এমন এক গান, যা আজ কোটি মানুষের আত্মপরিচয়। ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ ছিল হৃদয়ের আহ্বান, আর ‘আমার সোনার বাংলা’ হয়ে উঠেছে জাতির কণ্ঠস্বরে সেই হৃদয়ের জবাব। এই গান তাই শুধু সংগীত নয়—এটি ইতিহাস, এটি চেতনা, এটি বাংলাদেশ।
---
পাদটীকা:
এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত তথ্যসূত্রের মধ্যে রয়েছে ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রাচীন সংখ্যা, সরলা দেবীর আত্মস্মৃতিগ্রন্থ, প্রশান্তকুমার পালের ‘রবি জীবনী’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘An Indian Folk Religion’, শান্তিদেব ঘোষের স্মৃতিকথা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস।