রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি কে -নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নাকি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের স্থায়ী কর্মচারী? প্রশ্নটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বাভাবিকতার সময়কালেও বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু যখন দেশে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো জাতীয় নির্বাচন হয় না, কিংবা একটি ‘নির্দলীয়’ অথবা ‘অনির্বাচিত’ সরকার প্রশাসন চালায়, তখন প্রশ্নটির গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। এমন প্রেক্ষাপটে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার প্রতিক্রিয়াশীল বিকাশ একটি গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের জন্ম দেয়।
জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত না হয়েও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অনেকাংশ এমন এক অদৃশ্য বলয়ের হাতে কুক্ষিগত থাকছে, যাদের জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা প্রায় নেই হতে চলেছে -নাম তার আমলাতন্ত্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র এমন এক চূড়ায় উঠেছে, যেখানে তারা কার্যত নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করছে, আবার নিজেদেরকে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ হিসেবে জবাবদিহিমুক্ত রাখতেও পারছে। এক কথায়, তারা এখন শাসক নয়, যেন শাসনের আসল রূপকার।
করদাতার অর্থে আমলার খরচ নির্বাহ করা হয় বলে 'পাবলিক সার্ভেন্ট' তথা জনসেবক কথাটি এসেছে। জনসমর্থিত শুদ্ধ রাজনীতিবিদরা না থাকলে ওই সেবকরা লাইনচ্যুত হয়ে পড়তে পারে।
'বাঙালির জাতীয়তাবাদ' বইয়ের আমলাতন্ত্র প্রবন্ধে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখ করেছেন- ‘আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ মনে করা হয়, যদিও নিরপেক্ষ সে মোটেও নয়, হতেই পারে না, সবসময় সরকারের পক্ষে থাকে, আর সরকার যেহেতু এখন পর্যন্ত কখনোই জনগণের পক্ষে ছিল না, তাই আমলাতন্ত্রের ঝোঁক জনগণের স্বার্থ দেখার দিকে- এমন দাবি করবার উপায় নেই।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আকবর আলি খান তাঁর বহু বক্তব্যে বলেছেন, 'আমলারা যখন রাজনীতির জায়গা দখল করে নেয়, তখন প্রশাসন হয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল।' তিনি এও বলেছেন, 'ব্রিটিশ আমলের ইংরেজদের রেখে যাওয়া আমলাতন্ত্র বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য উপযোগী নয়।'
বাংলাদেশের সংবিধান পরিষ্কারভাবে বলে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ” (অনুচ্ছেদ ৭)। সেই জনগণের করের টাকায় নিয়োজিত আমলারা প্রজাতন্ত্রের ‘সেবক’ হিসেবেই চিহ্নিত (অনুচ্ছেদ ২১)। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, এই সেবকই নিজেকে এখন মালিক ভাবতে শুরু করেছেন। এর সর্বশেষ ও সবিশেষ প্রমাণ হিসেবে পটুয়াখালীর বাউফলে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি শহীদুল হক এবং ইউএনও আমিনুল ইসলামের মধ্যে ঘটে যাওয়া উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনাটি উল্লেখ করা যায় - যা এখন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল।
শহীদুল হকের অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি ইউএনওকে ফোন করেছিলেন স্থানীয় একটি অনুষ্ঠান বিষয়ে আলোচনা করতে। ফোন না ধরার কারণ জানতে চাইলে ইউএনওর উত্তর ছিল, "আমি আপনার ফোন ধরতে বাধ্য না। আপনি আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ফোন দিলে আমি ধরব কেন?" জবাবে শহীদুল বলেন, "আপনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, একজন কৃষকের ফোনও ধরতেও বাধ্য।" তখন ইউএনও বলেন, "আমি এমন কর্মচারী মালিককে শাস্তিও দিতে পারি।" এখানেই প্রশ্ন ওঠে -কার হাতে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা, আর কার প্রতি দায়বদ্ধতা?
বাংলাদেশে নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার রিপোর্ট, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB)-এর বিবৃতি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মন্তব্যে সেই বিতর্ক স্পষ্ট। ২০২৪ সালের জানুয়ারির একপাক্ষিক ডামি নির্বাচনের পর জুলাই গণ-আন্দোলনে তৎকালীন সরকারের পতন হলে -দেশে কার্যত একটি অনির্বাচিত রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে, যেখানে বিরোধী দল নেই বললেই চলে।
এই শূন্যতায় জায়গা নিচ্ছে আমলাতন্ত্র। একজন মন্ত্রীর পদ শূন্য হলেও, একজন সচিব বা ইউএনও’র পদ থাকে পূর্ণ ক্ষমতায়। সকল মহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে যখন রাজনীতি দুর্বল, তখন নীতিনির্ধারণের ছায়া-ক্ষমতা ক্রমে চলে যায় প্রশাসনের হাতে। ব্যুরোক্রেসি বিশেষজ্ঞদের মতে, “সিভিল প্রশাসন তখন হয়ে ওঠে আনসিভিল!"
আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা শুধু রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অনুপস্থিতিতেই নয়, বরং প্রশাসনের অভ্যন্তরেও নতুন বৈষম্য তৈরি করছে। বিসিএস-এর অন্যান্য ক্যাডার যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, পুলিশ, ট্যাক্স, ইত্যাদি আজ কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডার, বিশেষত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সচিবালয় ও মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মকর্তারা নিজেদের ‘সুপিরিয়র সার্ভিস’ মনে করছেন, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় একটি অঘোষিত শ্রেণিবিভাজন তৈরি করছে।
এই বৈষম্যের ফল হচ্ছে সেবাখাতে অকার্যকারিতা ও হতাশা। একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বা সরকারি কলেজের অধ্যাপকও আজ একজন তরুণ ইউএনও বা সহকারী কমিশনারের কাছে নিরুপায়। অথচ সংবিধান বা প্রশাসনিক নিয়মে এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
বাউফলের ঘটনা এখানেই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক প্রতিরোধের কাজে নিয়োজিত একজন সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে প্রশাসনের এমন রূঢ় আচরণ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় বিশেষ প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়। আমরা জানি, ইউএনওরা হচ্ছেন সরকারের নির্বাহী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনকারী, তবে তারা ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসক’ নন। তারা জনপ্রতিনিধিদের সহযোগী হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু নির্বাচন ও রাজনীতি যদি অকার্যকর হয়, তবে আমলা হয়ে ওঠেন ‘একা প্রভু’ -যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ ক্ষীণ।
নির্বাচন না হলে, বা জনগণের প্রতিনিধি রাষ্ট্রে অনুপস্থিত থাকলে, আমলাতন্ত্র হয়ে ওঠে সেনাবাহিনীর মতোই প্রশ্নহীন এক প্রতিষ্ঠান। তারা দায়িত্বের বদলে কর্তৃত্বের চর্চা করে। যা সমাজে চূড়ান্ত বৈষম্য ও অধিকারহীনতার জন্ম দেয়। এক পর্যায়ে রাষ্ট্র চলে যায় পদাধিকারী মানুষের দখলে, নাগরিকের হাতে আর থাকে না। ‘রাষ্ট্র নাগরিকের নয়, চাকরির’ -এই ভাবনা তখন পরোক্ষ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়।
আমলাতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলায় রাখতে হলে নির্বাচনের বিকল্প নেই। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জবাবদিহিমূলক উপস্থিতি ছাড়া প্রশাসন হয়ে পড়ে দায়িত্বহীন, কর্তৃত্বপরায়ণ এবং জনবিচ্ছিন্ন। সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসনের অভ্যন্তরের বৈষম্য দূর করতে হবে, এবং নাগরিক সমাজকে শক্তিশালী করতে হবে। নয়তো আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বাস করব, যেখানে ফোন না ধরাও হয়ে উঠতে পারে দাম্ভিকতাপূর্ণ ক্ষমতা, এবং প্রশ্ন করলেই সেটা হবে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’।
আমলাতন্ত্রের এই ‘অবাধ্য উত্থান’ ঠেকাতে হলে চাই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক নির্বাচিত সরকার, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং সিভিল সোসাইটির সক্রিয়তা। না হলে আমরা একটি নির্বাচনহীন অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ প্রশাসনিক রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে থাকব -যেখানে পেশাদারিত্ব নয়, বরং ভয় আর আনুগত্যই হবে নাগরিকের টিকে থাকার একমাত্র মাধ্যম।
তথ্যসূত্র:
• বাংলাদেশ সংবিধান, ৭, ১১ ও ২১ অনুচ্ছেদ
• TIB রিপোর্ট ২০২৩: ‘Public Administration and Power Dynamics’
• বাঙালির জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
• প্রথম আলোর বাউফল ঘটনার প্রতিবেদন (মে ২০২৫)
লেখক: সাংবাদিক
২০ মে ২০২৫
216
View