রূপোলি সুরের জাদুকর
শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, পুরনো বটগাছটার নিচে একটা ছোট চায়ের দোকান। সেখানেই দেখা যেত আব্দুল চাচাকে। তার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, কিন্তু চোখের তারায় লেগেই থাকত এক কিশোরের মতো স্বপ্ন। আব্দুল চাচা শুধু চা বানাতেন না, তিনি ছিলেন একজন অসামান্য বাঁশিওয়ালা। তার বাঁশির সুরে ছিল এক অদ্ভুত জাদু, যা পথচারীদের মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দিত, তাদের মনকে এক অজানা শান্তির দেশে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।
শীতের সন্ধ্যা, শহরজুড়ে অফিসের ছুটির তাড়া। আব্দুল চাচার চায়ের দোকানে ভিড় জমেছে। বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে একদল তরুণ আড্ডা দিচ্ছে, তাদের চোখে ভবিষ্যতের ঝলকানি। আব্দুল চাচা তাদের চা দিতে দিতেই আলতো করে বাঁশিটা হাতে তুলে নিলেন। প্রথমে মৃদু, তারপর ধীরে ধীরে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। তার বাঁশির সুর যেন প্রকৃতির ভাষা – কখনও নদীর কলকল ধ্বনি, কখনও পাখির কিচিরমিচির, আবার কখনও বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ।
সেই ভিড়ে একজন তরুণী ছিল, নাম রিনা। সে একজন ব্যস্ত চিত্রশিল্পী, শহরের ফ্যালক্যাল বিল্ডিং আর কর্পোরেট জীবনের চাপে যার মনটা প্রায়ই হাঁপিয়ে উঠত। রিনা প্রতিদিন এই পথেই বাড়ি ফিরত, কিন্তু আজ আব্দুল চাচার বাঁশির সুর তাকে আটকে দিল। সে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। বাঁশির সুর যেন তার তুলির রঙগুলোকে নতুন করে চিনিয়ে দিল।
একদিন রিনা চায়ের দাম দিতে গিয়ে আব্দুল চাচাকে বলল, "চাচা, আপনার বাঁশির সুরটা যে কী শান্তি দেয়, তা বোঝাতে পারব না। মনে হয় যেন সব ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়।"
আব্দুল চাচা হাসলেন। "আসলে কি জানো মা, এই বাঁশিতে শুধু সুর নেই, আছে আমার জীবনের সব গল্প। সুখের, দুঃখের, হারানোর, পাওয়ার..."
রিনা এরপর থেকে প্রতিদিন আব্দুল চাচার চায়ের দোকানে আসত, চা খেত আর মন ভরে বাঁশির সুর শুনত। একদিন সে তার sketchbook নিয়ে এলো এবং বাঁশির সুর শুনতে শুনতে স্কেচ করতে শুরু করল। তার তুলির আঁচড়ে বাঁশির সুরের সেই জাদুময়তা ফুটে উঠতে লাগল।
একদিন রিনা সিদ্ধান্ত নিল, আব্দুল চাচার বাঁশির সুরের ওপর ভিত্তি করে সে একটা আর্ট প্রদর্শনী করবে। সে আব্দুল চাচাকে সব খুলে বলল। আব্দুল চাচা প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না, বলছিলেন, "মা, আমি তো সাধারণ মানুষ। আমার সুরের কি আর তেমন কদর হবে?"
কিন্তু রিনা নাছোড়বান্দা। সে বোঝাল, "আপনার সুর সাধারণ নয় চাচা, এটা অসাধারণ। এটা মানুষের মন ছুঁয়ে যায়।"
শেষ পর্যন্ত আব্দুল চাচা রাজি হলেন। রিনা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে বাঁশির সুরকে চিত্রে রূপ দিল। প্রদর্শনী শুরু হলো। প্রথম দিকে ভিড় কম থাকলেও, ধীরে ধীরে মানুষের কৌতূহল বাড়তে লাগল। আব্দুল চাচার বাঁশির সুর এবং রিনার চিত্রকর্মের যুগলবন্দী মানুষকে মুগ্ধ করল। বিশেষ করে, যে ছবিটায় আব্দুল চাচার বাঁশি বাজানোর মুহূর্তটাকে রিনা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল, সেটা সকলের নজর কাড়ল।
প্রদর্শনীর শেষ দিনে, যখন আব্দুল চাচা তার বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, তখন রিনা দেখল অনেক মানুষ তাদের ভেতরের শান্তি খুঁজতে তার দোকানে আসছে। আব্দুল চাচার বাঁশির সুর আর রিনার চিত্রকর্ম, এই দুয়ে মিলে প্রমাণ করে দিল যে শিল্পীর কোনো বয়স নেই, কোনো ভেদাভেদ নেই। যেকোনো সাধারণ মানুষও তার নিজের মতো করে অসাধারণ কিছু করতে পারে, যদি তার মধ্যে থাকে সত্যিকারের স্বপ্ন আর সৃষ্টিশীলতা। আব্দুল চাচা আর রিনা একে অপরের জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছিল, একজন সুর দিয়ে, অন্যজন রঙ দিয়ে। আর শহরের কোলাহলে, তাদের শিল্প যেন রূপোলি সুরের মতো ছড়িয়ে পড়ল মানুষের মনে।
গল্পটা কেমন লাগল?
72
View