ইয়েমেনের প্রত্যন্ত এক গ্রামে থাকত লায়লা। বয়স মাত্র উনিশ, কিন্তু তার চোখে ছিল গভীরতা আর হৃদয়ে ছিল প্রেমের এক অতল সাগর। সে প্রেম করত আদেল নামের এক তরুণ সৈনিকের সঙ্গে। আদেল ছিল গ্রামের সবার চেনা—সাহসী, সৎ আর প্রাণবন্ত। দুজনের ভালোবাসা ছিল যেন ঝরনার মত স্বচ্ছ, শিশির ভেজা সকালের মত নির্মল। গ্রামের পেছনের পাহাড়ঘেরা মাঠে তারা অনেক স্বপ্ন এঁকেছিল একসাথে। লায়লা বলত, “তুমি কোথাও গেলে আমি একটুও বাঁচতে পারব না।” আদেল শুধু হাসত, তারপর বলত, “তুমি বাঁচবে, কারণ তুমিই আমার জীবনকে অর্থ দাও।”
তবে সেই হাসিগুলো একদিন থেমে গেল, যখন দেশে যুদ্ধের দামামা বাজল। চারপাশে গোলাগুলির শব্দ, আকাশে যুদ্ধবিমানের গর্জন, আর মানুষের চিৎকারে ভরে উঠল এলাকা। আদেল আর পিছিয়ে থাকেনি—সে যোগ দিল দেশের সেনাবাহিনীতে।
যাওয়ার দিন লায়লার চোখে ছিল শুধু জল, আর আদেলের ঠোঁটে একটা অস্ফুট প্রতিজ্ঞা—"ফিরব… তোমার জন্যই ফিরব।"
কিন্তু দিন গেল, মাস গেল, বছর পেরিয়ে গেল—আদেল আর ফিরল না। তার কোনো খোঁজ নেই, কোনো চিঠি নেই, এমনকি জীবনের কোনো চিহ্নও না। লায়লা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার পরিবার তাকে বোঝাতে থাকল—“জীবন কাউকে অপেক্ষা করে না।” একসময় সমাজের চাপে, পরিবারের জোরে সে বিয়ে করে ফেলল একজন শিক্ষকের সঙ্গে।
এইদিকে আদেল জীবিতই ছিল—ধরা পড়েছিল শত্রুপক্ষের হাতে। আট বছর বন্দি ছিল অন্ধকার কারাগারে। না ছিল আলো, না ছিল আশা। তবু তার মন শুধু একটাই নাম ডাকত—লায়লা। আট বছর পর বন্দিমুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসে আদেল। ভাঙা শরীর, ক্লান্ত চোখ, তবুও হৃদয়ে সেই পুরনো আগুন। প্রথম যেই কাজটা সে করল—গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিল লায়লার। কিন্তু তখন জানতে পারল, সে এখন আর লায়লা নেই—সে এখন কারো স্ত্রী, কারো সন্তানদের মা। সেই রাতে আদেল প্রথমবার ভেঙে পড়ল। পাহাড়ঘেরা সেই পুরনো মাঠে গিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকল। বাতাসে লায়লার নামে ডাক দিল, কিন্তু জবাব এল না। শুধু দূরের পাহাড় থেকে একটা প্রতিধ্বনি ফিরল—"ফিরব… তোমার জন্যই ফিরব।" আদেল আর স্থির থাকতে পারল না। জীবনের সব আশা বিসর্জন দিয়ে আবার চলে গেল যুদ্ধে। কিন্তু এবার তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন—সে আর কারো জন্য নয়, নিজের শেষটুকু দিতে চেয়েছিল দেশের জন্য।
মাস কয়েক পর, টেলিভিশনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক জরুরি সংবাদ। শত্রুপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছে এক সাহসী যোদ্ধা—নাম, আদেল। ক্যামেরার সামনে তার নিথর দেহ, রক্তে ভেজা ইউনিফর্ম, আর পাশে পড়ে থাকা এক ছবি—লায়লার একটা পুরনো ছবি। মাস কয়েক পর, টেলিভিশনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক জরুরি সংবাদ। শত্রুপক্ষের হামলায় নিহত হয়েছে এক সাহসী যোদ্ধা—নাম, আদেল। ক্যামেরার সামনে তার নিথর দেহ, রক্তে ভেজা ইউনিফর্ম, আর পাশে পড়ে থাকা এক পুরনো ছবি—লায়লার ছবি। সেই মুহূর্তে লায়লা বসেছিল তার স্বামী ও সন্তানের পাশে। চোখ আটকে গেল টিভি স্ক্রিনে, কিন্তু মুখে একটুও ভাব প্রকাশ করল না। শুধু ঠোঁট দুটো কিছুটা কাঁপল। বুকের ভেতরে যেন কিছু একটা চিরে গেল নিঃশব্দে। সে কিছু বলল না, চোখ থেকে একটি অশ্রুবিন্দুও গড়াল না। কিন্তু তার বুকের ভিতর, সেই পুরনো পাহাড়ঘেরা মাঠে, একটা ছায়ামানুষ চিরতরে নিখোঁজ হয়ে গেল। স্বামী পাশে বসে খবরটি দেখে বলল, “যোদ্ধা মানুষটা বীরের মতো মারা গেছে।”
লায়লা শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ... সে সত্যিকারের বীর ছিল।” আর কিছু বলল না সে। শুধু জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল দূরের আকাশের দিকে।
কেউ বুঝতে পারল না, লায়লার হৃদয়ের একটা দিক সেই দিন চিরতরে নিঃশব্দে মরে গেল।