Posts

চিন্তা

সেনাপ্রধানের বার্তা: পেশাদারিত্ব, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি

May 22, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

101
View

অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে প্রভাবশালী গণমাধ্যম রয়টার্সকে যেমনটা বলেছিলেন, ঠিক সেখানেই স্থির আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি পুনরায় বলেছেন, 'আমার কোন রাজনৈতিক ইচ্ছা বা উচ্চাভিলাষীতা নেই'! সেই সাথে চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতাও তিনি তুলে ধরেছেন। 

বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতায় যখন আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা ঘনীভূত, তখন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’-এ যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুধু একটি প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশনাই নয়; বরং তা জাতির সার্বিক ভবিষ্যৎ চিন্তা ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে একটি স্পষ্ট অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা, জাতীয় স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি তাঁর আনুগত্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে চলমান সব ধরনের জল্পনা-কল্পনার ইতি টানতে পারে। 

সেনাপ্রধানের ভাষণে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হওয়া উচিত। তাঁর প্রত্যাশা, ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন, তেমনি একটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন। 

মানবিক বা কৌশলগত ‘করিডর’ ইস্যুতে সেনাপ্রধানের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কঠোর ও সুস্পষ্ট -"কোনো করিডর হবে না"। তিনি উল্লেখ করেছেন, করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র একটি নির্বাচিত সরকার নিতে পারে এবং সেটিও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সেনাবাহিনী কোনো বিদেশি পরামর্শ বা চাপে করিডর ইস্যুতে নমনীয় হবে না -এমন বার্তা শুধু একটি প্রতিরক্ষা বাহিনীর আত্মমর্যাদার পরিচায়কই নয়, বরং তা জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একটি শক্তিশালী অবস্থান। 

সেনাপ্রধান কঠোরভাবে জানিয়েছেন, রাস্তায় সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা আর সহ্য করা হবে না। ‘মব ভায়োলেন্স’ রুখে দিতে সেনাবাহিনী এখন আরও সক্রিয়, আরও কঠোর হবে। এ বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের বিদেশি পরিচালনার বিষয়েও সেনাপ্রধানের মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি স্পষ্ট করেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমেই নেওয়া উচিত, যেখানে স্থানীয় মানুষের মতামত ও জাতীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে। এটি আবারও তার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। 

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সেনাপ্রধানের সতর্ক বার্তা -বর্তমান প্রশাসনের অজান্তেই বাংলাদেশ এক ‘প্রক্সি যুদ্ধের মাঠে’ পরিণত হচ্ছে। বিদেশি আগ্রহ ও হস্তক্ষেপের যে ইঙ্গিত তিনি দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। ১/১১-এর অভিজ্ঞতার পটভূমিতে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও বাহ্যিক প্রভাবমুক্ত থাকার বার্তা তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

সেনাপ্রধান তাঁর বক্তব্যে সেনাসদস্যদের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। নির্বাচনকালীন সময় ও পরবর্তী কয়েক মাস বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুধাবন করেছেন। একইসঙ্গে সকল ক্রীড়া ও সামাজিক আয়োজন স্থগিত রেখে নির্বাচনের গুরুত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বার্তা দিয়েছেন। 

সেনাপ্রধানের অ্যাড্রেসে সশরীরে ও ভার্চুয়ালি উপস্থিত কর্মকর্তরা সেনাপ্রধানকে সমস্বরে সমর্থন দিয়েছেন। এবং পাশাপাশি সেনাপ্রধানও অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করে যাবার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছেন। 

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এই বক্তব্য কেবল সেনা অফিসারদের উদ্দেশে নয়, বরং পুরো জাতির উদ্দেশে একটি বার্তা: সেনাবাহিনী পেশাদার, জাতীয়তাবাদী এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদেশি চাপ, এবং অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে, তখন সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য নিশ্চয়ই একটি নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন এখন একটাই -রাজনৈতিক নেতৃত্ব, অন্তর্বর্তী প্রশাসন ও জনগণ কি এই পেশাদার ও বাস্তববাদী অবস্থানের গুরুত্ব অনুধাবন করবে? 

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো 

লেখক: সাংবাদিক 
২২ মে ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login